#মায়াবতী
#পর্ব:৪৯
#তানিশা সুলতানা
আড়াল থেকে অর্ণব তন্নির মলিন মুখখানা দেখে। এখনো গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে। চোখ দুটো ফোলা। প্রচন্ড কান্না করার ফলে হয়েছে এমনটা। লম্বা চুল গুলো এলোমেলো। বই সামনে নিয়ে বসে আছে। জামাটা ঘামে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। সবেই এসেছে রান্নাঘর থেকে।
অর্ণবের মনে পড়ে যায় এই চুল গুলো দেখেই ক্রাশ খেয়েছিলো সে। কিন্তু তখন চুলগুলো ছিলো পরিপাটি। তন্নির চেহারায় এসেছে অনেকটা পরিবর্তন। গোলগাল মুখখানা কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। যেনো অনেকদিন রাতে ঘুমায় না। কিন্তু তন্নি তো রাতে ঘুমায়। তার শাক্ষি অর্ণব নিজে। তাহলে এমনটা কেনো দেখাচ্ছে মেয়েটাকে?
তন্নি বই বন্ধ করে দরজার দিকে তাকাতেই অর্ণবকে দেখতে পায়। শুষ্ক ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। দুই হাতে চুল গুলো খোঁপা করে এগিয়ে যায় অর্ণবের দিকে।
“আপনি এসেছেন? আমি সবেই ভাবছিলাম কল করবো।
অর্ণব দু পা এগিয়ে এসে তন্নির দুই গালে হাত রাখে। তন্নি চোখ নামিয়ে নেয়।
” ওই ডাইনি বুড়ি মেরেছে তোমায়?
তন্নি মলিন হাসে। অর্ণবের হাত দুটো সরিয়ে দেয় গাল থেকে।
“ওই মুখে মুখে তর্ক করেছিলাম একটু। আমিও না দিন দিন কটা হয়ে যাচ্ছি। মায়ের মুখের ওপর কথা বলতে শিখে গেছি।
বাদ দেন এইসব। এবার বলুন অথৈয়ের কি অবস্থা? সারাদিন আমায় কল করলো না। সাগর ভাইয়াকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলো?
অর্ণব খাটে বসে৷ তন্নিও পাশে বসে পড়ে।
” অথৈ ভালো আছে। কিন্তু তুমি ভালো নেই মায়াবতী।
তন্নির চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। সে অর্ণবের হাতের উপর হাত রাখে৷
“মানুষ বলে না আমার এটা চাই, ওটা চাই
এটা নেই, ওটা নেই
আমার এসব কিছুই চায় না। আমি একটু মানসিক শান্তি চাই। আপনার সাথে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকতে চাই।
আমার নিয়ে যাবেন অর্ণব আপনার সাথে? আমি আপনার সব কথা শুনবো। আমার পেছনে আপনার টাকা খরচ করতে হবে না। আমি না হয় টিউশনি নিবো দুটো। শুধু আপনার সাথে থাকতে চাই।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে তন্নি। অর্ণব মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” আর কয়দিন অপেক্ষা করো। ঠিক নিয়ে যাবো।
তন্নি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের অনুভূতি বোঝাতে পারলো না অর্ণবকে। হয়ত তন্নি বোঝাতে ব্যর্থ আর নয়ত অর্ণব বুঝতে ব্যর্থ। তবে জীবনটা এমন নাহলেও পারতো।
আজকে তন্নির সাথে বেশিখন সময় কাটায় না অর্ণব। একটুখানি তন্নিকে বুঝিয়ে ভালোবাসার দুটো কথা বলে চলে যায়। ইতি বেগমকে চোখ রাঙিয়ে গেছে সে। নেক্সট টাইম তন্নির গায়ে হাত তুললে হাত ভেঙে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। বয়সে গুরুজন আর তন্নির মা না হলে সত্যিই এই মহিলার গায়ে হাত তুলে ফেলতো অর্ণব। মহিলাটার চোখে তন্নির জন্য ভালোবাসা দেখতে পায় অর্ণব কিন্তু তবুও কেনো এতো খারাপ ব্যবহার?
_
দিন গুলো কাটছে ব্যস্ততায়। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। অথৈ আর সাগরের সম্পর্ক অনেকটা উন্নতি হয়েছে। সাগর কয়েকদিন পরপর কল করে। কিন্তু মেসেঞ্জারে টুকটাক কথা হয় রোজই।
অর্ণব শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু একটু কথা বলে তন্নির সাথে। এই মাসেই সে তন্নিকে বাড়িতে তুলবে। তাকে আর রাখবে না ওই বাড়িতে। তাই তার ব্যস্ততা শতগুন বেড়েছে।
তন্নির শরীরটা ইদানীং আরও খারাপ লাগে। কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। কাকে বলবে? মা কে? সে তো বকা দিবে। অর্ণবকে বললে সে চিন্তা করবে। অথৈকে বললে সে পাগল হয়ে যাবে। আর রইলো পড়ে বাবা। সে কাল দেশে আসছে। তখনই বলবে।
বাবা আসার খুশিতে তন্নি কলেজে যায় নি। অথৈ তন্নিকে ভীষণ মিস করছে। তাকে ছাড়া সে ক্লাসে ঢুকে নি। মাঠের এক কোণে বসে আছে। সারাদিন তন্নির মুখটা দেখতে পারবে না?
অথৈ শপিং করার নাম করে বাবার থেকে দশ হাজার টাকা এনেছে। এই টাকা দিয়ে সে তন্নিকে ডাক্তার দেখাবে। বেশ কয়েকদিন হলো খেয়াল করছে তন্নির পরিবর্তন। কিছু একটা হয়েছে তন্নির এটা ভালো করেই বুঝতে পারছে অথৈ। টাকার জন্য বাড়িতে নিজের অসুখের কথা বলবে না এটাও জানা অথৈয়ের।
তন্নিকে আজকে ডাক্তারের কাছে নিতে পারবে না বলে অথৈয়ের চোখে পানি চলে আসে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
তখনই অথৈয়ের সামনে বাইক থামায় সাগর। বাইক থেকে নেমে হেলমেট রেখে অথৈয়ের পাশে এসে বসে।
অথৈ এতোখনে তাকায় সাগরের দিকে।
সাগর হেসে অথৈয়ের মাথায় টোকা দিয়ে বলে
“কি হয়েছে অথৈ রানীর? মুড অফ যে?
অথৈ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
” তন্নির শরীর ভালো নেই। চোখ মুখ কেমন হলুদ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম আজকে ওকে ডাক্তার দেখাবো কিন্তু ও আসলোই না।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অথৈ। সাগর অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে। বন্ধুর জন্য মানুষ এতোটা সেনসেটিভ হতে পারে?
সাগর হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে অথৈয়ের চোখের পানি মুছে দেয়।
“আরে বাবা কান্না করছো কেনো? বিকেলে তন্নির বাসায় চলে যেয়ো। আর ওকে নিয়ে বেড়িও। তখন না করবে না।
অথৈ ভেবে দেখে সত্যিই তো তাই। এবার হাসি ফুটে ওঠে অথৈয়ের ঠোঁটে। সাগরও হাসে।
” সত্যি করে একটা কথা বলবেন আমায়?
“আমি কখনোই মিথ্যে বলি না অথৈ।
অথৈ খানিকটা সময় নিয়ে বলে
” তন্নিকে এখনো মিস করেন?
সাগর অথৈয়ের চোখে চোখ রাখে।
“আমাদের মিস করার মতো কোনো সম্পর্ক ছিলো না অথৈ। ওয়ান সাইড লাভ ছিলো। ভালোবাসতাম আমি তন্নিকে। বিয়ে করবো বলে ভেবে নিয়েছিলাম। একা একাই স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম।
তুমি কষ্ট পেলেও আমি বলতে বাধ্য যে আমার মনে সারাজীবন তন্নির জন্য একটা সফট কর্ণার থেকেই যাবে।
অথৈ সাগরের হাতের ওপর হাত রাখে।
” তবে তুমিও মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছো। সারাক্ষণ জ্বালিয়ে যাচ্ছো।
তোমার জ্বালা সহ্য করা যাচ্ছে না। দ্রুত তোমাকে বাড়িতে নিতে হবে।
বলতে বলতে সাগর উঠে যায়। বাইকে গিয়ে বসে। অথৈ ভাবতে থাকে সাগরের কথা। যখনই কথার মিনিং বুঝতে পারে লাজুক হাসে। নিজেও উঠে সাগরের পেছনে বসে।
দুই হাতে পেট জড়িয়ে পিঠে মাথা ঠেকায়। তারপর রিনরিন করে বলে
“আমিও ভাইয়ার মতো আমাদের বেবির নাম ঠিক করতে চাই। তাদের পাপা বলে ডাকতে চাই আমি।
” ঠিক আছে আয়রার পাপা বলে ডেকো। অনির বোন আয়রা। কিউট না?
অথৈ বড়বড় চোখ করে তাকায় সাগরের দিকে। মনে মনে বেবির নামও ঠিক করে নিয়েছে? ভালোই সেয়ানা হয়ে গেছে। শুধু অথৈয়ের সামনেই প্রকাশ করে না। খারাপ পুরুষ।
একে আর ছাড়াই যাবে না। শক্ত হাতে জাপ্টে ধরতে হবে। দ্বিগুন বেশি জ্বালাতে হবে।
__
তন্নি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। মনে মনে ভীষণ চিন্তিত সে। এমন কেনো হয়ে যাচ্ছে? চিরুনি ভর্তি চুল উঠে যাচ্ছে। চোখ দুটো কেমন মরা মরা লাগে। নিজেকে দেখেই নিজেই অবাক হয় তন্নি।
ইতি প্লেটে করে ভাত এনে তন্নির খাটের ওপর রাখে। তারপর তন্নির সামনে এসে দাঁড়ায়।
“কয়মাস চলছে?
তন্নি অবাক হয়। কিসের কয়মাস চলছে?
ভ্রু কুচকে মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে
” কিসের কয়মাস চলছে?
“একদম নেকা সাজবি না। তর সইলো না একটু? শশুড় বাড়ি যাওয়ার আগেই পেট বাঁধিয়ে বসলি? কালকে তোর বাবা এসে আমাকেই বকবে। সব দোষ আমার ঘাড়েই চাপবে। সে আর বুঝবে না তার মেয়ের কীর্তি।
তন্নি বিরক্ত হয়।
” তুমি যেটা ভাবছো সেটা না।
“একদম বেশি কথা বলবি না তুই। ওই বেয়াদপকে কল করে বল তোকে ডাক্তার দেখাতে। আর হাসপাতাল থেকেই শশুড় বাড়ি চলে যাবি। মানসম্মান রাখলি না আমাদের।
বলেই সে চলে যায়। তন্নি আবারও আয়নার দিকে তাকায়। এটা কি করে সম্ভব? তাদের মধ্যে তো কিছুই হয় নি। তাহলে?
অর্ণবকে কি বলবে? অর্ণব কি মনে করবে? যদি ভুল বোঝে? তখন কি করবে তন্নি?
চলবে
#মায়াবতী
#পর্ব:৫০
#তানিশা সুলতানা
বিকেল বেলা সাগর চলে আসে অথৈয়ের বাড়িতে। অথৈ ঘুমচ্ছিলো। তন্নির বাড়িতে যাওয়ার কথা প্রায় ভুলে গেছিলো।
কেউ বাড়িতে নেই। আর্থি শশুড় বাড়ি গেছে।
আনোয়ার আর অর্ণব অফিসে। আশা বেগম শপিং করতে বেরিয়েছে।
বাড়িতে অথৈ একা। দারোয়ান গেইট খুলে দিয়েছে সাগরকে। সাগর অথৈয়ের রুমে আসে। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। এই গরমেও কোমর ওবদি কম্বল টেনে দিয়েছে।
সাগর হাসে। কোমরে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ দেখে অথৈকে। তারপর অথৈয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরে সুস্থ ডাকতে থাকে। অথৈয়ের ঘুম পাতলা। কয়েক ডাকেই উঠে যায়। পিটপিট করে চোখ খুলে সাগরকে সামনে দেখে লাফিয়ে ওঠে।
“আরে আরে রিলাক্স। আমি এসেছি।
অথৈ বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে। তারপর ধীর গলায় বলে
” আপনি এখানে?
“তন্নির বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো তো তোমার।
অথৈ মাথায় হাত দেয়। কি করে ভুললো সে? অথৈয়ের মনের কথা বুঝতে পেরে সাগর বলে
” এখনো সময় আছে। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
অথৈ মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে যায়।
সাগর কম্বল ভাজ করে বিছানা চাদর টানটান করে বালিশ আর কম্বল সাজিয়ে রাখে।
অগোছালো তার পছন্দ না। তারপর খাটের এক কোণে বসে অথৈয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
অথৈও তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে বের হয়।
_
সাগর আর অথৈকে দেখে তন্নি বেশ অবাক হয়। সাগর কখনো এই বাড়িতে আসবে ভাবতেই পারে নি তন্নি। তাছাড়া ঘরে কিছুই নেই। কি খেতে দেবে সাগরকে? অথৈ কতো বড় মুখ করে নিয়ে এসেছে। এখন খালি মুখে ফিরে যাবে?
তন্নিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অথৈ এগিয়ে যায়। তন্নির কাঁধে হাত রাখে।
“তুই খুশি হস নি?
তন্নি হাসার চেষ্টা করে বলে
” খুব খুশি হয়েছি। সাগর ভাইয়া ভালো আছেন?
সাগর তন্নির মুখের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয়
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷
” অথৈ ভাইয়াকে নিয়ে বস
আমি আসছি
বলে তন্নি বের হতে যায়। অথৈ হাত টেনে ধরে
“তুই রেডি হয়ে নে। আমরা এক জায়গায় যাবো।
” আমাকে মা যেতে দেবে না রে।
“দেবে। তুই রেডি হ। আমি আন্টির সাথে কথা বলছি।
অথৈকে না করার সাধ্য তন্নির কখনোই ছিলে না। তাছাড়া ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে। ইদানীং প্রায়ই করে। একটু ঘুরলে যদি ভালো হয়।
অথৈ ইতি বেগমের কাছে যায়। সে রান্না করছে। সাগর তন্নিদের উঠোনে বসে।
অথৈয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ইতি বেগম আবার রান্নায় মন দেয়। অথৈ একটু হাসে
” আন্টি ভালো আছেন?
ইতি গম্ভীর মুখে বলে
“হুমম
” তন্নিকে নিয়ে একটু বেরুচ্ছি।
“ও যাবে না।
” ও যাবে। রেডি হচ্ছে। আপনি বোধহয় যেতে দিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু আপনার কথা আমি শুনবো না। কজ আপনি তন্নির কেউ না।
ইতি চোখ পাকিয়ে তাকায় অথৈয়ের দিকে।
“আমি তন্নির মা
” মা কখনো সন্তানের গায়ে হাত তুলতে পারে না আন্টি। আপনি তো তামিমকে এতোটা টর্চার করেন না। কারণ সে আপনার সন্তান। তন্নি আপনার কেউ না।
বলেই অথৈ চলে যায়। ইতি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে তন্নিকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসাটা বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না। কোনো না কোনো কারণে সেই ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়। মনটা বিষিয়ে যায়।
তন্নি আর অথৈ রিকশায় যাচ্ছে সাগর বাইকে। তন্নি নিজের অসুবিধার কথা অথৈকে বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। মৃ/ত্যুকে ভীষণ ভয় পায় তন্নি। জীবনে এতো এতো খারাপ সময় এসেছে কিন্তু কখনোই তন্নি মৃ/ত্যুর কথা মাথায় আনে নি৷ তন্নি বাঁচতে চায়। অনি তাতান ওদের দুনিয়াতে আনতে চায়। শান্তিতে সংসার করতে চায়।
তন্নি ঘামছে। অথৈ এক হাতে তন্নিকে জড়িয়ে ধরে।
তন্নি তাকায় অথৈয়ের দিকে
“কি হয়েছে তন্নি? আমায় কেনো বলিস নি তোর শরীর ভালো যাচ্ছে না?
তন্নির চোখে পানি চলে আসে। মেয়েটা বুঝে গেলো। অথচ অর্ণব বা তার মা বুঝলো না।
তন্নি অথৈয়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলে
” তুই বুঝে গেলি?
“তোর থেকেও বেশি তোকে চিনি আমি।
আর কিছু বলতে পারে না তন্নি। আল্লাহ অথৈকে পাঠিয়েছিলো তার জীবনে। মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় সবার ভালোবাসা পূরণ করেছে এই মেয়েটা। বন্ধুরা কখনো এমন হয়?
হাসপাতালের সামনে এসে রিকশা থামে। সাগর আগেই পৌঁছে গেছিলো। সে দাঁড়িয়ে আছে। অথৈ ভাড়া মিটিয়ে নামে। তারপর তন্নির হাত ধরে তন্নিকে নামতে সাহায্য করে।
তারপর তিনজন যায় হাসপাতালের ভেতরে।
ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে অথৈ তন্নি আর অর্ণব। ডাক্তার তন্নিকে দেখছে ভালো করে। ডাক্তার নিজেও চিন্তিত।
অথৈ ধৈর্য রাখতে পারছে না। সে জিজ্ঞেস করে ফেলে
” কি হয়েছে আমার তন্নির?
ডাক্তার তন্নির চোখ আর জিহবা দেখে হতাশার সুর টেনে বলে
“কিছু টেস্ট দিচ্ছি। রিপোর্ট আসলেই বলতে পারবো।
বুকটা কেঁপে ওঠে অথৈয়ের। তন্নির বুকটা অশান্ত হয়ে ওঠে। নিশ্চয় বড় কিছু হয়েছে তার। নাহলে কেনো টেস্ট দিবে?
সাগর দু পা পিছিয়ে যায়। এতক্ষণে তাকিয়েছে সে তন্নির মুখটার দিকে। এটা যেনো তন্নি না। অন্য কেউ। মায়াবতী তন্নির চোখে মুখে অসুস্থতা।
এতোটা অসুস্থ সে?
অথৈ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ডাক্তারকে পূণরায় জিজ্ঞেস করে
” আমার তন্নি ভালো হয়ে যাবে তো?
ডাক্তার তন্নির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন।বয়স কতো হবে? ১৮ কি ১৯ এই টুকু মেয়ের এতোবড় অসুখ? যদিও সে আন্দাজ করছে। শিওর না। তবে এতো বছরের ডাক্তারিতে এইটুকু ধারণা আছে তার।
মেয়েটার চোখ মুখ দেখে মায়ায় পড়ে যায় ডাক্তার। এতোটা মায়াবী কেউ হতে পারে? এক পলকে মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই মেয়ে।
“ওনার বাবা মা আসে নি?
তন্নি মাথা নিচু করে ফেলে।
সাগর এগিয়ে এসে বলে
” আমি ওর বড় ভাই। আমাকে বলতে পারেন।
অথৈ বলে
“আমি ওর হাসবেন্ডকে কল করছি।
ডাক্তার নার্সকে ডাকে। এবং নার্সের সাথে তন্নিকে যেতে বলে। তন্নি বাধ্য মেয়ের মতে চলে যায়। এখন ডাক্তারের চেম্বারের বসে আছে অথৈ আর সাগর। অর্ণবকে কল করেছে অথৈ। সে আসছে।
ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
” আমার যতদূর মনে হচ্ছে ওনার ক্যান্সার হয়েছে। এতো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটাই মনে হচ্ছে।
অথৈ চিৎকার করে ওঠে। সাগর দুই হাতে আগলে নেয় অথৈকে। মেয়েটা কাঁপছে। নিশ্বাসটাও নিতে পারছে না ঠিকভাবে।
ডাক্তার আবার বলে
“দুই একদিনে কখনে কেনো রোগ হয় না। অনেকদিন থেকেই হয়েছে ওনার এরকম। আমার মনে হচ্ছে ছোট বেলা থেকেই। বাকিটা রিপোর্ট আসার পরে বলছি।
__
গতকাল রিপোর্ট বের হবে। এখনো একটা টেস্ট বাকি। অর্ণব কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। অথৈ অর্ণবের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। সাগর তন্নির সাথে গেছে। কারণ মেয়েটা ভয় পাচ্ছে।
অর্ণব কি করবে, কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার পুরে পৃথিবী থমকে গেছে। নিজেকে থামাতে পারছে না সে। শান্তনা দিতে পারছে না।
” আচ্ছা অথৈ ক্যান্সার হলে তো অনেক মানুষই বেঁচে যায় তাই না?
হঠাৎ করে বলে ওঠে অর্ণব।
অথৈ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়
“তাছাড়া ডাক্তার তো বলেছে শিওর না। ওনার এটা মনে হচ্ছে। অন্য কিছুও তো হতে পারে তাই না?
বলতে বলতে থেমে যায় অর্ণব। তার মনে পড়ে যায় হোক তার তন্নি অসুস্থ।
” অথৈ রে
ভালো কিছুই হবে বল? আমার আল্লাহ আমাকে হতাশ করবে না বল?
আমার আল্লাহ নিশ্চিত ভালো কিছু করবে। আমাদের ধৈর্যহারা হলে চলবে না বল।
অথৈ ভাইকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলে। নিজেকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে তার ভাই। তন্নির কিছু হয়ে গেছে দুই ভাই বোন বাঁচবে না। শেষ হয়ে যাবে তারা।
__
রাত দশটার দিকে হাসপাতালের সব কাজ শেষ হয়। অর্ণব তন্নিকে নিজের সাথে নিয়ে যাবে। তন্নিও যেতে চায়। অথৈ আর সাগর বাইকে চলে গেছে। অর্ণব আর তন্নি গাড়িতে। অর্ণব তন্নির সাথে একটাও কথা বলছে না। তন্নি তাকিয়েই আছে অর্ণবের দিকে। অন্ধকারে অর্ণবের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে হেডলাইনের আলোতে একটু একটু দেখা যাচ্ছে।
ড্রাইভার ড্রাইভ করছে।
হঠাৎ করে তন্নি বলে ওঠে
“আপনি আমার যে চুলের ওপর ক্রাশ খেয়েছিলেন সেই চুল গুলো প্রায় উঠে গেছে। মাত্র সাত দিনে আমার চুল গুলো উঠেই গেলো।
কি হলো বলুন তো আমার? এমন কেনে হয়ে যাচ্ছি? মা বললো আমি না কি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু এটা তে হওয়ার না।
কি করলে বলুন তো সুস্থ হবো?
অর্ণব তন্নির হাত টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।
” আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মায়াবতী। তোমার চুল লাগবে না আমার। তোমার সৌন্দর্যও লাগবে না। অসুন্দর কুৎসিত হয়ে তুমি শুধু আমার সাথে সারাজীবন থেকে যেয়ো তাতেই হবে আমার।
আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অনির মাম্মা। ভীষণ ভালোবাসি।
তন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অর্ণব।
অর্ণবের বুকে মাথা রেখেও তন্নি শান্তি পায় না। মাথাটা ব্যাথা করতেই থাকে।
“অর্ণব ইদানীং আপনার বুকের মধ্যেও সুখ খুঁজে পাই না আমি।
চলবে