#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_04
#Writer_NOVA
লা’শের ফ্রিজিং ড্রয়ার খুলতেই এক অনিন্দ্য সুন্দরি মেয়ের দেখা মিললো। সারা মুখ ফ্যাকাশে। শরীরে এক বিন্দু র’ক্ত বোধহয় নেই। চেহারা অতিরিক্ত সাদা দেখাচ্ছে। কি মায়াবী মুখ! চোখ সরানো দায়। ছুঁয়ে দিলে র’ক্তিম হয়ে যাবে এমন লাল আভা সারা মুখে বিদ্যমান। সারা মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ প্যাচানো। এক মুহুর্ত দেখলে মনে হবে এটা কোন লা’শ নয়। যেনো রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যা। কত সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে! হ্যাঁ, চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে। কোন দিন উঠবে না। ঘন পল্লবিত চোখের পাতাগুলো বন্ধ। হুট করে এই বুঝি আঁখি মেললো! কিন্তু তা কখনো হওয়ার নয়৷ মাস খানিক আগের মৃতদেহ কি কভু চোখ মেলে তাকায়? ছেলেটা আলতো হাতে মেয়েটার গাল স্পর্শ করলো। কি ঠান্ডা সেই গাল! হাত রাখা যায় না। তবুও সে হাত সরালো না। অজেলা ভরে তুলে করুন গলায় আর্তনাদ করে উঠলো।
‘আমার স্লিপিং বিউটি। আর কত ঘুমিয়ে থাকবে? এবার উঠো না। এখন থেকে আমি তোমার সব কথা শুনবো।’
মেয়েটি উঠলো না। তবে ছেলেটির মনে হলো মেয়েটি যেনো ঠোট প্রসস্থ করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। নড়েচড়ে শরীর দুলালো। এরপর হুট করে চোখ দুটো খুলে মুখটা কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘থাকতে মূল্য দেওনি। হারিয়ে ফেলে কাঁদছো কেনো?’
‘আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
আশপাশ থেকে একসাথে অনেকগুলো মানুষের ফিসফিসানি শোনা গেলো,
‘মিথ্যে কথা। মিথ্যে কথা। ভালোবাসলে আমায় মুক্তি দিয়ে দিতে। এভাবে আটকে রাখতে না। আমি মুক্তি চাই। আমার ভীষণ কষ্ট হয়।আমাকে মুক্তি দিয়ে দাও। এই ঠান্ডা হিমাগারে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়।’
শব্দগুলো কেমন করুন শুনালো। চারপাশ থেকে অজস্র ফিসফিস আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। বদ্ধ রুমের প্রতিটি কোণা থেকে একটা বাক্য ভেসে আসছে। “মুক্তি চাই, মুক্তি চাই”। ছেলেটা চোখ লাল করে দুই কান চেপে চিৎকার করে উঠলে,
‘আমার থেকে মুক্তি তোমার কখনো মিলবে না। আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ার শাস্তি তুমি পাবে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।’
চমকে উঠে গেলো ইয়াসফি। কি ভয়ানক স্বপ্ন! লাশ কথা বলে? আদৌও কি সম্ভব? কিন্তু স্বপ্নে তো সব সম্ভব। টেবিল বাতিটা জ্বালিয়ে গ্লাসে থাকা পানি ঢকঢক করে শেষ করলো। হাত-পা তার প্রচন্ড কাঁপছে। স্বপ্নের রেশ তার এখনো কাটেনি। মনে হচ্ছে এই বুঝি সেই মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখবে। গ্লাস রেখে হাঁপানি রোগীর মতো বড় বড় শ্বাস টানলো। গলার কাছে রুহ আটকে গেছে। একটু হলে বের হয়ে যাবে৷ মনে মনে আওড়ালো। নাহ, অনেকদিন ধরে তার সাথে দেখা হয় না৷ এবার সময় করে দেখা করা উচিত। চুল টেনে ধরে মাথা উবু করে রাখলো। বাকি রাত তার ঘুম আসবে না। ছটফট করতে করতে কেটে যাবে। এমনটা প্রায়ই হয়।
‘আপনি যেই নাম্বারে ডায়াল করছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে একটু পর আবার ডায়েল করুন।’
হাতের মোবাইলটা ছুঁড়ে মারলেন পলাশ হায়দার। কটমট চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মিশি বেগম সেদিকে তোয়াক্কা না করে সিরিয়াল দেখায় মন দিলেন। স্ত্রীর অলস ভঙ্গি দেখে উত্তপ্ত দাবানলের ন্যায় জ্বলে উঠলেন হায়দার সাহেব।
‘তোমার জন্য এমনটা হয়েছে। আমার আদরের মেয়েটা ঘরছাড়া। তুমি কি আসলেই ওর মা? তোমার কি কোন দায়িত্ব নেই? বিগত কয়েক মাস ধরে মেয়েটা লাপাত্তা। অথচ তুমি স্বাভাবিক। নিজেও কিছু করছো না আমাকেও কিছু করতে দিচ্ছো না।’
মিশি বেগম এবার চোখ গরম করে তাকালেন। টিভি বন্ধ করে হাতের রিমোট অদূরে ছুঁড়ে মারলেন।
‘তোমার মেয়েকে কি আমি বলেছিলাম বাসা থেকে বের হয়ে যেতে? সে স্বইচ্ছায় চলে গেছে। এখানে আমার কি দোষ?’
‘তুমি সেদিন খ্যাচখ্যাচ না করলে তো যেতো না।’
‘রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা তুমি বলেছিলে।’
‘উস্কানীমূলক কথাবার্তা তুমিও বলেছিলে।’
‘তোমার মেয়ে কি কারো কথা শোনার মানুষ? চিন্তা করো না ঠিক চলে আসবে।’
‘এর জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?’
‘না, ঢোক ঢোল নিয়ে রাস্তায় নেমে যাও। আদরের মেয়ে বলে কথা।’
‘মিশি, মাথা কিন্তু গরম আছে।’
‘আমারো আছে। রাগ দেখিয়ো না। ফলাফল ভালো হবে না।’
হায়দার সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে রাগটাকে পিষিয়ে নিলো। এখন বউয়ের সাথে কথা বলা মানে ঝামেলা হওয়া। এতে দেরী হয়ে যাবে। আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এবার কামান দাগা নিয়ে মেয়েকে খুজতে বের হতে হবে। হনহন করে বেরিয়ে গেলো পলাশ হায়দার। মিশি বেগম রিমোট কুড়িয়ে টিভি অন করলেন।
দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখলো পিয়াল। বাবা-মায়ের এমন টুকটাক ঝগড়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই তার গায়ে লাগে না। পরিবেশ ঠান্ডা দেখে নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলো। বইয়ের স্তুপ থেকে মোবাইলটা বের করে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে কল করলো। দুই বার রিং হওয়ার পর ধরলো না। তৃতীয়বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। লঘুস্বরে পিয়াল বলে উঠলো,
‘হ্যালো আপি!’
“তোমাকে চাই, শুধু তোমাকে চাই।
আর কিছু জীবনে পাই বা না পাই।”
গোসল শেষ করে গান গাইতে গাইতে বাইরে বের হলো মাসুম। মাথা মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত।
‘তুই এতো সুন্দর না যে আয়নার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হবে।’
হঠাৎ করে খালি রুমে কারো কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো মাসুম। বুকে হাত দিয়ে দ্রুত পেছনে ঘুরলো। রুহানি আসাম করে বিছানায় বসে মনোযোগ দিয়ে মোবাইল গুতাচ্ছে। মুখে চুইংগাম। সেটাকে কিছু সময় পরপর ফুলাচ্ছে আর ঠাস শব্দ করে ফাটাচ্ছে। মাসুম শব্দ করে বুকে ফুঁ দিলো৷ সে ভয় পেয়ে গেছে।
‘তুই, তুই কখন এলি?’
‘তোর গার্লফ্রেন্ডকে চাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে।’
মাসুমের পরনে ঢোলাঢুলা হাঁটু অব্দি প্যান্ট। উদোম শরীর। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে হাতের তোয়ালে দিয়ে কোমড়ে প্যাচ মারলো৷ তড়িঘড়ি করে ওয়ারড্রব থেকে টি-শার্ট বের করে গায়ে চাপালো৷ তা খেয়াল করে রুহানি মুখ টিপে হেসে উঠলো।
‘ইশ, কি লজ্জা!’
‘তোর মতো নাকি?’
‘আমার মতো হলে তো ওড়না নিতি।’
‘হোপ!’
মাসুমের ধমকে রুহানি কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। মাসুম বিরক্ত হলো৷ হাতের তোয়ালে ছুঁড়ে মারলো রুহানির দিকে। রুহানি ততক্ষণে হাসতে হাসতে বিছানায় কাইত।
‘তোকে বলছিলাম আমার বাসায় আসতে না। একা ছেলে আমি। তোর সাথে আমাকে দেখলে লোকে খারাপ বলবে। তোর চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। আমি তা চাই না। তোর যখন প্রয়োজন পরবে আমাকে ডাকবি আমি হাজির হয়ে যাবো।’
রুহানি মাসুমের কথা গ্রাহ্য করলো না। চোখ সরু করে মাসুমের দিকে তীর্যক দৃষ্টি দিলো৷ এরপর বিছানা থেকে উঠে মাথার ঝুটি টাইট করলো৷ প্যান্টের পকেটে মোবাইল রেখে মাসুমকে সাইড কাটিয়ে ওয়ারড্রবের সামনে গেলো৷ বড় কপাট খুলতেই ধপ করে শব্দ হলো৷ মাসুম সেদিকে তাকাতেই চোখ দুটো গোল আলু করে ফেললো।
‘এটা আমার ওয়ারড্রবে কি করছে?’
‘আমি এনেছি।’
‘এটা ঐদিনের লোকটা না? যাকে জেন্টস পার্লার থেকে ফলো করতে বলেছিলি?’
রুহানি অজ্ঞান হয়ে থাকা মধ্য বয়স্কের নাকের সামনে হাত রেখে নিঃশ্বাস চেক করতে করতে বললো,
‘হ্যাঁ!’
‘এটাকে কখন উঠালি?’
‘গতরাতে।’
‘কেউ দেখে ফেললে আমার কি অবস্থা হবে ভেবেছিস?’
‘কিছু হবে না। মুখে স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। হাতে-পায়ে নাইলনের রশি বাঁধা। ছোটা এতো সহজ নয়।’
‘লোকটাকে কিডন্যাপ করেছিস?’
রুহানি মুখ ভোঁতা করে কটমট চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
‘না জামাই আদর করতে এনেছি। তুই করবি?’
মাসুম অসহায় গলায় বললো,
‘তাই বলে আমার ওয়ারড্রবে লুকিয়ে রাখবি?’
রুহানি ঠেলে ধাক্কিয়ে লেকটাকে ওয়ারড্রবে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,
‘মা’লটাকে দেখে রাখিস।’
‘আমি পারবো না।’
‘তাহলে কিন্তু কেস খাইয়ে দিবো।’
রুহানির হুমকিতে মাসুম চুপ হয়ে গেলো। তার এখন ইচ্ছে করছে হাত-পা ছুঁড়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে। এই মেয়েটা ওকে জেলের ঘানি না টানিয়ে ক্ষান্ত হবে না। সেদিন খাওয়ালো এক কেস। আজকে আরেকটা। ইয়াসফি নিজে ফেসবুক লাইভে এসে বিষয়টা ক্লিয়ার করায় এখন আপাতত সেই টপিক বন্ধ। কিন্তু ইয়াসফি মাহবুব যেই ছেলে তাকে কি এতো সহজে ছেড়ে দিবে?
আবছা আলোতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ইয়াসফি। ওমর নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে চায়ের কাপ রাখলো। হালকা টুং শব্দ হতেই কপালের ওপর থেকে হাত সরালো।
‘আপনার মামা কল করেছিলো।’
ওমরের কথায় চোখ ছোট করে তাকালো ইয়াসফি। মুখে কোন কথা বললো না।
‘আপনার মামি অনেক কান্নাকাটি করছে আপনাকে দেখার জন্য। সময় নিয়ে এক দুপুরের জন্য দেখা করে আসতে বলেছে। আপনাকে কলে পায়নি৷ তাই আমাকে জানিয়ে দিতে বলেছে।’
ইয়াসফি মূর্তির ন্যায় আধশোয়া হয়ে রইলো। হু না কিছুই বলছে না। সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ওমর ক্ষীণ স্বরে ডাকলো।
‘ভাই! কি বলবো?’
ইয়াসফি চোখ তুলে তাকালো।
‘বলে দিও আমি ব্যস্ত আছি৷ অবসর হলে যাবো।’
‘ঠিক আছে।’
ওমর চলে যাওয়ার জন্য পথ ধরতেই আবার পিছু ফিরলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘রাতের খাবার দিবো?’
‘একটু পর।’
ওমর উচ্চবাচ্য না করে ভীরু পায়ে বেরিয়ে গেলো৷ ইয়াসফি চায়ের কাপ হাতে কাউচের দিকে পা বাড়ালো৷ মোবাইল হাতে নিয়ে কি ভেবে যেনো সপ্তাহ খানিক আগের ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ ওন করলো৷ খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো৷ এক সময় তার মুখের আদল বদলে গেলো। চোয়াল শক্ত করে ডাকলো,
‘ওমর!’
ওমর বাইরে ছিলো। ইয়াসফির ডাকে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এলো।
‘জ্বি ভাই!’
হাতের মোবাইল ওমরের মুখের সামনে ধরলো। মুখটাকে পাংশুটে বর্ণ করে কঠিন গলায় বললো,
‘এই ছেলেটাকে আমার চাই।’
#চলবে
এতো প্যাচ দিতেছি যে ভবিষ্যতে কিভাবে ছুটাবো সেই ভেবে এখুনি ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি 😬।