#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_03
#Writer_NOVA
ইন্টারনেটে যেখানে ইয়াসফির টপিক রাত থেকে রাতারাতি ভাইরাল সেখানে তার টনক নড়লো দুপুরের পর। মন্ত্রীসভা থেকে বের হওয়ার পর পার্শ্ববর্তী জেলার নেতা তুলন সাহেব ঘেরা দিয়ে কথাটা না জানালে ইয়াসফি বোধহয় তখনও জানতো না। কন্ফারেন্স থেকে বের হতেই সামনে পরলো তুলন শেইখ। কোন নির্দিষ্ট একটা কারণে লোকটাকে ইয়াসফি সহ্য করতে পারে না। তাই তাকে এড়িয়ে সরে যাচ্ছিলো।
‘কি মাহবুব সাহেব, বিয়েসাদী করবেন দাওয়াত দিবেন না?’
ইয়াসফির পা থেমে গেলো। ভ্রু কুঁচকে সামনের দিকে ঘুরলো। বিয়েসাদী! কি বলে লোকটা? দিনদুপুরে মাথা-টাথা খারাপ হয়েছে নাকি?
‘মানে? কি বলতে চাইছেন তুলন সাহেব?’
‘ওমা, এমন ভান করছেন যেনো কিছুই জানেন না। সকালে আপনার ভিডিওটা তো দেখলাম। ভাবীকে নিয়ে তার এক্সের সাথে রাতে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আপনি তো মিয়া পুরো ভাইরাল। কতশত সমালোচনা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে।’
লোকটা কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো। ইয়াসফি ভ্রু কুঁচকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলো। গতকাল রাতে, ভাবী, এক্স! না, কোন কিছু মিলাতে পারছে না। পারবে কি করে সে কি এসব জানে নাকি? তবে খেয়াল করেছে আশেপাশের নেতারা আজ তাকে দেখে কেমন কানাঘুষা করেছে। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। ইয়াসফি এসব পাত্তা দেয়নি। তুলন শেইখ ইয়াসফির কাঁধে চাপর মেরে বললো,
‘ইয়াং ম্যান, এভাবে বিয়ে মানবো না। বর্তমান তরুণদের আদর্শ ইয়াসফি মাহবুবের বিয়ে আমরা কব্জি ডুবিয়ে খেতে চাই।’
‘আমি আপনার কথা এখনো বুঝতে পারছি না।’
‘অনলাইনে একবার ঢু্ মারেন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
ইয়াসফির কাঁধে ফের চাপর মেরে তুলন শেইখ মাথা হেলিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো। ইয়াসফি দ্রুত পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে সুইচড অন করলো। অনলাইনে যেতেই চক্ষু চড়কগাছ। তার নিজস্ব একটা ব্লু টিক পাওয়া ফেসবুক পেইজ আছে। সেখানে সে নানা উন্নয়ন মূলক কাজের ভিডিও প্রকাশ করে। ফ্যান, ফলোয়ার অনেক। এই পর্যন্ত তার পেজেকে ট্যাগ করে একই ভিডিও হাজারটা পোস্ট হয়েছে। তাই ভিডিওটা খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। গলা হাঁকিয়ে ডাকলো,
‘ওমর!’
পড়ন্ত বিকেলে সোনালী আলো জ্বলজ্বল করছে। নীল রঙ করা দোতলা বাড়িটা এই সময় অদ্ভুত সুন্দর লাগে। অদ্ভুত বলার কারণ হলো কেমন সুন্দর তার সঠিক সঙ্গাটা দিতে না পারা। ঘন গাছগাছালি ঘেরা বাড়িটা দূর থেকে তত নজরে পরে না। আশেপাশে কয়েক মাইল জুড়ে ঘনবসতি নেই। একটা,দুটো টিনশেডের বাড়ি। জায়গাটা ভীষণ পছন্দের আজিম সারোয়ার। লোকালয় থেকে দূরে। ভোর সকালে পাখির গান। প্রকৃতির সন্নিধি পাওয়ার মতো পরিবেশ। সারাজীবন শহরে কাটিয়ে তিক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই অবসরেরে আগে ছায়া নিবিড় পরিবেশে বাড়ি তৈরি করেছেন। যেখানে নেই কোন যানবাহনে উচ্চ শব্দ, ইট পাথরের দালান, ঘুণে ধরা মানুষের সঙ্গ।
বারান্দায় বসে সংবাদপত্র খুলে বসেছেন। গরম গরম এক কাপ চায়ের সাথে সংবাদপত্রে ডুবে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। এমপি পদ থেকে অবসর নিয়েছেন দেড় বছর আগে। নিজের বদলে দাঁড় করিয়েছেন ভাগ্নেকে। বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। নিজের কোন ছেলে না থাকায় ভাগ্নে যেনো সব। রাজনৈতিক পাতা উল্টে রেখে দিলো। এখন আর এসব ভালো লাগে না। তবুও মাঝে মধ্যে কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে উঁকি ঝুঁকি মারেন। ভাগ্নে মন্ত্রী, খবর না চাইলেও রাখতে হয়।
‘তুমি কি একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে না?’
স্ত্রীর কান্নাভেজা কন্ঠ শুনে আজিম সারোয়ারের হঠাৎ করে চায়ের স্বাদটা বিস্বাদময় হয়ে উঠলো। চায়ের কাপ রেখে সংবাদপত্র ভাজ করে পাশের বেতের চেয়ারে রাখলো। বিরক্তির আভা সারা মুখে ছড়িয়ে পরেছে।
‘তুমি বুঝেও অবুঝের মতো কেনো করো?’
‘তুমি তো পাষাণ, তোমার মন কাদে না। আমার ভেতরটা পুড়ে যায়।’
আঁচলে মুখ ঢাকলেন নাসিমা বেগম। আজিম সারোয়ার তখন সামনের দেয়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চুপটি মেরে আছেন।
‘একটা কল করে আসতে বলো না।’
স্ত্রীর কন্ঠে স্পষ্ট অনুনয়। আজিম সারোয়ার চোখ তুলে তাকালেন ঠান্ডা দৃষ্টি। যার মানে সে কিছু বলতে পারবে না। তেতে উঠলেন নাসিমা বেগম।
‘দরকার নেই। এখন তো আমি কেউ না। আমার কথা কেন মনে পরবে?’
‘পাগলামি করছো কেনো? ও অনেক ব্যস্ত।’
‘ব্যস্ততা বলতে কিছু নেই। এটা একটা অযুহাত। ইচ্ছে থাকলে হাজার কাজও কাউকে আটকে রাখতে পারে না। লাগবে না কারো আসতে। আমি মরে গেলেও যেনো না আসে।’
নাসিমা বেগম নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আজিম সারোয়ার তপ্ত শ্বাস ফেলে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তার কিছু বলার নেই। নিজের মনকে প্রশ্ন করলেন আসলেই কি ব্যস্ততা একটা অযুহাত?
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ওমর। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সামনেই ইয়াসফি চুপ করে মেঝেতে দৃষ্টি দিয়ে চেয়ারে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি ঠাওর করা যাচ্ছে না। হাতে থাকা মোবাইলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একসময় শান্ত হয়ে গেলো।
‘ভাই আসলে…..
ইয়াসফি আঙুল উঁচু করে থামতে বললো। ওমর ভীতু চোখে আশেপাশে চোখ বুলালো।
‘কখন ঘটেছে?’
ওমর আমতা আমতা করে বললো,
‘গতকাল রাতে।’
‘আমাকে জানাওনি কেনো?’
‘সুযোগ পাইনি। আমি বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি আমার কথাই শুনেননি।’
ইয়াসফির দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। জানালা দিয়ে সন্ধ্যার আকাশে নজর দিলো। ওর এমন শান্ত ভঙ্গিতে ওমরের বুক দুরুদুরু করছে। বাবরি চুলগুলো পেছনে ঠেলে ইয়াসফি বললো,
‘ফেসবুক লাইভের ব্যবস্থা করো। যা বলার আমি পেইজের লাইভে বলবো।’
ওমর মাথা হেলিয়ে দ্রুত তার ব্যবস্থা করতে লেগে পরলো। ইয়াসফি আবারো হলুদাভ আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
‘আফা নেন চা।’
মোবাইলে হিসাব কষছিলো রুহানি। সেখান থেকে চোখ উঠিয়ে সামনের দশ বছরের বালকের দিকে নজর দিলো। বাম হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বললো,
‘আজ স্কুলে গিয়েছিলি টুকু?’
‘হো আফা।’
‘কেমন লাগে?’
‘ভালাই, কত নতুন নতুন জিনিস শিখন যায়।’
‘মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে কিন্তু।’
‘জে আফা করমু।’
রুহানি মিষ্টি হেসে টুকুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। পাশে থাকা টুকুর মা মিনালির মুখে প্রশান্তির হাসি। ঝুলন্ত বিস্কিটের প্যাকেট থেকে দুটো বড় বিস্কিট এনে রুহানির দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘একি দিদি, আমি তো বিস্কুট চাইনি।’
‘নতুন উডাইছি, বিস্কিটগুলান অনেক মজা। তুমি একটু ট্যাশ করো।’
‘না না লাগবে না।’
মিনালি এক পলক তার ছেলের দিকে তাকালো। টুকু বই খাতা নিয়ে পাশের নিয়ন বাতির আলোয় চটের বস্তার ওপর পড়তে বসেছে। সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে বললো,
‘কথা কইয়ো না তো। তুমি আমগো লিগা যা করছো এইডা হেই তুলনায় অনেক কম।’
মাসুম খোপ করে একটা বিস্কুট নিয়ে পাশের বেঞ্চে বসে পরলো। রুহানির চোখ গরম করে তাকানো কে পাত্তাই দিলো না। চায়ের কাপে বিস্কুট চুবিয়ে চিবোতে চিবতে বললো,
‘আসলেই তো দিদি, খেতে অনেক মজা।’
মিনালি খুশি হলো। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রুহানি বিস্কুট নিলো। আশা নিয়ে দিয়েছে, ভঙ্গ করা উচিত নয়। কিন্তু এই বিস্কিটের টাকা মিনালি রাখবে না। যার দরুন রুহানি বিস্কুট নিতে চাইনি। মাসুম মোবাইল বের করে অনলাইনে উঁকি মারলো। টুংটাং ম্যাসেজের শব্দ পেতেই রুহানি ওর পাশ ঘেঁষে বসলো।
‘কি হয়েছে? এমন ঘেঁষাঘেঁষি করছিস কেন?’
রুহানি দাঁত কেলালো। যা দেখে তার উদ্দেশ্য বুঝে গেছে মাসুম।
‘হটস্পট দিতে পারবো না।’
‘একটু দে না। এমন করিস কেন?’
‘এ্যাহ, কত ধারদেনা করে এমবি কিনলাম কি তোকে দেওয়ার জন্য?’
‘তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড?’
‘তুই মানিস?’
‘না মেনে যাবো কই?’
‘তোর মিষ্টি কথায় ভুলছি না, সর।’
রুহানি চোখ সরু করে মাসুমের বাহুতে দুম করে এক ঘুষি দিয়ে সরে গেলো। মাসুম বাহু ধরে আহ্ করে চেচিয়ে উঠলো। লাথি মারতে গেলে রুহানি সরে দাঁড়ালো। ওদের কান্ড দেখে টুকু বই পড়া রেখে কিছু সময় হেসে নিলো৷ রুহানি সরে গেলো। আবার তার পুরনো হিসাব কষতে আরম্ভ করলো। মিনিটের মধ্যে গতকাল রাতের ভাইরাল ভিডিও মাসুমের নিউজফিডে হানা দিলো। চোখ মুখ শুকিয়ে উঠলো। আৎকে উঠলো।
‘রুহানি সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
রুহানি জায়গা থেকে নরলো না। চোখ তীক্ষ্ণ করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি?’
‘আমাদের গতকালের ঘটনা তো সেই ভাইরাল।’
‘কই দেখি।’
হুরমুর করে এসে মাসুমের ঘাড়ের ওপর পরলো রুহানি। অস্থির চিত্তে প্রশ্ন করলো,
‘আমাকে কি দেখা যায়?’
‘না, তুই সাইডে বলে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাকে দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, রে রুহানি! এই কাজ করলো কে?’
মাসুমের গলা শুকিয়ে আসছে। আচানক মনে হচ্ছে তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে মরে যাবে। ভয়ে শরীর জমে যাচ্ছে। অথচ রুহানির ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। এমন গা ছাড়া ভাব দেখে মাসুমের রাগ হলো।
‘তুই এমন স্বাভাবিক আছিস কি করে? এটা ইয়াসফি দেখলে কি হবে ভাবতে পারছিস?’
‘ধরলে তোকে ধরবে আমার কি?’
‘এই তোর বন্ধুত্ব?’
‘হটস্পট দেস নাই মনে আছে আমার।’
মাসুম অসহায় চোখে রুহানির দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা সিরিয়াস কেসে সামান্য বিষয় ধরে বসে আছে। রুহানি মাসুমের অবস্থা বুঝে মনে মনে হেসে উঠলো। গালে মৃদু থাপ্পড় দিতে দিতে বললো,
‘বাচ্চি তু তো গেয়া।’
#চলবে