বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১৪

0
210

#বিবর্ণ_বসন্ত
১৪তম_পর্ব
~মিহি

‘আপনাদের পেশেন্ট পাগলামি শুরু করেছে! দয়া করে ওনাকে আপনারা একটু সামলান।’ নার্সের কথায় সোহরাব ভেতরে যায়। সুমি পাগলের মতো চেঁচামেচি করছে। সোহরাব গিয়ে বোনের মাথায় হাত রাখতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সুমি। মনে জমানো যত ক্ষোভ, যন্ত্রণা, বিষাদ যেন একত্রে চোখ বেয়ে বেরিয়ে আসে। সুমির দুর্বল শরীরটা নেতিয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সুমি বেঁচে থাকার কারণটা খুঁজে পাচ্ছে না। জীবন যেন এক ঝটকায় সব কেড়ে নিল তার থেকে। একটা অহেতুক মরীচিকার পেছনে তাড়া করতে করতে নিজের স্বপ্ন-লক্ষ্য সবকিছু থেকে ছিটকে গেছে সে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। যে সুমি উকিল হওয়ার জন্য বারো বছর ধরে মনে স্বপ্নটাকে লালন করছে, সে কী করে লক্ষ্য বিচ্যুত হতে পারলো? তাও এক মরীচিকার কারণে?

-‘সুমি শান্ত হ। সব ঠিক আছে। শান্ত হ বোন আমার।’

-‘ভাইয়া, আমি খারাপ। সরে যাও তুমি। আমি তোমার সেই লক্ষ্মী বোনটি নেই আর। আমি খারাপ হয়ে গেছি।’

-‘কিচ্ছু খারাপ হোসনি তুই। তুই আবার আগের মতো হয়ে যাবি।’

সুমি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। চাইলেই কি সে আগের মতো হতে পারবে? নার্স তৎক্ষণাৎ সুমিকে ঘুমের ওষুধ ইনজেক্ট করলো। সুমির দুর্বল শরীরটা পুরোপুরি নেতিয়ে পড়লো বালিশে। সোহরাব কেবল বোনের এ যন্ত্রণা অবলোকন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইমাদের সাথে একবার কথা বলতেই হবে তাকে। সোহরাব বের হতেই ডাক্তার নাহার তাকে কেবিনে ডাকলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য। সোহরাব সম্মতি জানিয়ে কেবিনে বসলো।

-‘দেখুন সোহরাব, সুমির অবস্থা নিয়ে আমি আবার এক বান্ধবী আফ্রিনের সাথে কথা বলেছি। আপনি একটু তার সাথে আগে দেখা করে নিন। সুমির সমস্যা সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত জানান। পরবর্তীতে সুমিকে নিয়ে তার সাথে দেখা করুন।’

-‘আচ্ছা ডাক্তার ম্যাম। ধন্যবাদ আপনাকে। ড.আফ্রিনের এপয়েন্টমেন্টটা কি পেতে পারি?’

-‘আমি ওকে কল করে দিয়েছি। আপনি সরাসরি দেখা করতে পারবেন। এই নিন ওর কার্ড। এখানে এড্রেস দেওয়া আছে।’

সোহরাব ড.নাহারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রস্থান করলো। সুমির সমস্যা নিয়ে সে মারাত্মকভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। অন্যকিছুর খেয়াল নেই তার। অনামিকা বাসায় ফিরে ফোন করতে বলেছিল সে খেয়ালও নেই। সোহরাব ফোন হাতে নিতেই দেখল অনামিকা বেশ কয়েকবার কল করেছে। কল ব্যাক করলে সোহরাবের গলা শুনেই হয়তো অনামিকা আন্দাজ করে ফেলবে কিছু একটা হয়েছে। তাই সোহরাব আর অনামিকাকে কল করলো না। সে ডাক্তারের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়লো।

_____________________

-‘কী রে অনামিকা, অমন উদাস হইয়া কী ভাবোস? বই নিয়ে বইসা হা কইরা কোনদিক চাইয়া থাকোস?’

-‘না গো চাচী, কোথাও না। তুমি মায়ের সাথে দেখা করেছো?’

-‘লে! মাইয়া চোখডা খাইছে। অহনি তো তোর মা আইসা গল্প কইরা গেল আর তোরে কইলো গল্প করতে। এতক্ষণ ধইরা যে আমি বকবক করতাছি কিছু শুনোস নাই? জামাই ছাড়া মন টিকেনা গো মাইয়া বুঝছি।’

রেহনুমা চাচীর কথায় লজ্জা পেল অনামিকা। আসলেই সোহরাবকে ছাড়া মন টিকছে না তার। লোকটাও কেমন বাসায় ফিরে একবার কলও করলো না! অনামিকা যে এতবার কল দিল সেটাও ধরলো না। এত্ত ভাব! বাইরে বাইরে নিশ্চিন্তে থাকলেও অনামিকার ভেতরটা দুশ্চিন্তায় ভরে উঠেছে। সোহরাব ফোন ধরলো না কেন? নিরাপদে বাসায় ফিরতে পেরেছে তো লোকটা?

-‘রূপার কথা শুনছোস?’

-‘কী হইছে চাচী রূপার? বিয়ের তো মাসখানেক হলো। ভালো আছে?’

-‘আর কিসের ভালো? ওর বাপ-মা তো জোর করে বিয়া দিয়া দিল। প্রথম প্রথম বহুত মিল মোহাব্বত আছিল। যেই রূপা বাচ্চা হবার লাইগা আসলো, অমনি সেই পোলা আরেক মাইয়ার পিছে দৌড়ান শুরু করছে। তার লগে নাকি বিয়াও বসবো। এদিকে রূপা তো কাইন্দা অস্থির।’

-‘সে কী! নয়ন দুলাভাই এমন করতে পারলো? নতুন বউ রেখে আরেকজনের সাথে! ছিঃ!’

-‘কপাল রে মা! রূপার কপালডায় খারাপ।’

-‘আর কোন বেয়াদব মেয়েই বা বিবাহিত পুরুষের গলায় ঝুলে পড়ে গো চাচী?’

-‘ট্যাকার লোভে রে মা। থাক তুই পড়। আমি আচার নাতে আইছিলাম। যাই অহন।’

রেহনুমা চলে যেতেই মন খারাপ হয়ে যায় অনামিকার। রূপা তার ছোটবেলার বান্ধবী। তিন বাড়ি পরেই রূপার বাড়ি। কয়েক মাস আগেই বিয়ে হয়েছিল তার। অথচ এখন কিনা এই অবস্থা! নয়নকে বিয়ের সময় দেখেছিল অনামিকা। দেখে মনে হয়েছিল সাধু সন্ন্যাসীর মতো ভদ্র অথচ এ তো লেফাফাদুরস্তি। অনামিকা ঠিক করলো বিকেলেই একবার রূপার সাথে দেখা করতে যাবে।

বিকেলের একটু আগেই রূপার সাথে দেখা করতে এলো অনামিকা। রূপার মা মলিন মুখে দরজা খুললেন। অনামিকাকে দেখে সামান্য খুশি হয়ে ভেতরে আসতে বললেন। ভেতরে ঢুকতেই অনামিকা সোফায় বসে থাকা রূপাকে দেখে চমকালো। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, শরীরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। মাতৃত্বকালীন সময়ে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য উপচে পড়ে অথচ রূপার যন্ত্রণাটা যেন তার শরীরটাই বলে দিচ্ছে। অনামিকাকে দেখে জড়িয়ে ধরল রূপা। কান্না গলায় আটকাচ্ছে তার। কিছুক্ষণ পর অনামিকাকে ছেড়ে স্থির হয়ে বসলো সে।

-‘কেমন আছিস অনু?’

-‘আমি তো ঠিক আছি কিন্তু তুই শরীরটার কী অবস্থা করেছিস? নিজের সাথে সাথে বাচ্চাটারও ক্ষতি করতে চাস?’

-‘কী করবে ও বেঁচে থাকে? যে বাচ্চার বাবাই তাকে নাজায়েজ বলে সে বেঁচে থেকে কী করবে? মরে যাক! মরে যাক ও, আমিও মরে যাই। তারপর সবার শান্তি।’

-‘চুপ! কিসব বলছিস রূপ! বাচ্চাটার জন্য তোকে বাঁচতে হবে।’

-‘তোর সাথে হলে বুঝতি। একটা মানুষকে ভালোবাসতে শুরু করার ঠিক পরমুহূর্তে তার থেকে পাওয়া বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা কতটুকু জানিস? বুক চিরে ভেতরের হৃদপিণ্ডটাকে যেন কেউ তীব্র আঁচে সেদ্ধ করছে ততটা। আমার প্রতিরাতে মনে হয় আল্লাহ আমাকে তুলে নেয়না কেন। এত মানুষ মরে, আমি মরিনা কেন?’

-‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। ধৈর্য ধর বোন।’

-‘কোনদিন যে মা আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে দেবে রে! ওরা আমায় সহ্য করতে পারেনা আর। দিনরাত মরতে বলে। আল্লাহ দেখেনা আমারে?’

অনামিকা থমকে যায়। মা হয়ে কেউ এমন করতে পারে?

-‘তুই যা অনামিকা। আমি এখন কথা বলবো না।’

-‘কিন্তু…’

-‘যা!’

রূপার ব্যবহারে অনামিকা বিমূর্ত হয়ে গেল। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার! রূপা একরকম জোর করেই অনামিকাকে ঘর থেকে বের করে দিল। অনামিকার মনটা আগের চেয়েও খারাপ হয়ে গেল। রূপা ছিল পাড়ার সবচেয়ে চঞ্চল মেয়ে। এলাকার সবার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো মেয়েটা আজ নিশ্চুপ। পরিস্থিতি মানুষকে এতটা বদলে দেয়? নয়ন নামক মানুষটার উপর অনামিকার খুব রাগ হয়। লোকটাকে পেলে বোধহয় বয়সের তোয়াক্কা না করেই গুটিকতক চড় থাপ্পড় দিতে পারলে কলিজাটা জুড়াতো। রূপার মতো একটা চঞ্চল মেয়েটার জীবন নিস্তব্ধ করে তুলেছে লোকটা। ঐ লোকের মনে কি একটুও মায়া হয়নি? আচ্ছা রূপার মায়ের মনেও কি মায়া নেই? এতটাই বোঝা হয়ে আছে রূপা? পৃথিবীটা এতটা নিষ্ঠুর কবে থেকে হলো?

তখন সবে ভোরবেলা। নামায পড়তে উঠেছেন অনামিকার মা অন্তরা বেগম। আশেপাশের বাড়ি থেকে হৈচৈ শুনে জানালায় এসে দাঁড়ালেন। পাশেই রেহনুমার বাড়ি। তাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে। রেহনুমা ডুকরে কেঁদে উঠলো।

তখনো আলো ফোটেনি। চারিদিকে থমথমে অন্ধকারে রূপার বাড়ির সামনে মানুষের ভীড়। অন্ধকারের বুক চিড়ে আলো ফোটার আগেই রূপার আত্মা খাঁচা ছেড়েছে। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু! অনামিকার বুঝতে কষ্ট হলো এ মৃত্যু কি আত্মহত্যা নাকি এক মা কর্তৃক সন্তানকে পৃথিবী থেকে বিদায় করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here