#বিবর্ণ_বসন্ত
১৩তম_পর্ব
~মিহি
-‘কার সাথে পিরিতি করে তোমার ভোলাভালা মেয়েটা হাত কাটলো গো ভাবী?’
-‘মা! তোমার ন্যূনতম লজ্জা নাই মামীকে এখন এসব বলছো! জানোনা সুমির অবস্থা?’
রাহেলা বানু চুপ করলেও মনে মনে কথা সাজাতে লাগলেন। আজই মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। সুমির ঘরের জানালা দিয়ে মূল রাস্তা দেখা যায়। জানালাটা খোলা ছিল বিধায় তন্বী সুমির রক্তমাখা হাত দেখে চেঁচামেচি করে সকলকে ডাকে। সাজিয়া সুমিকে হাসপাতালে এনেছেন। রাহেলা বানু ও তন্বীও সাথে এসেছে।
-‘মামী, সোহরাব ভাইকে কল দেই?’
-‘না তন্বী। সোহরাবকে এখনি কিছু বলো না। ও অনামিকাকে রাখতে গেছে। ওখানের কেউ এসব জানুক তা আমি চাইনা।’
-‘এতকিছু হয়ে গেল আর তুমি বউয়ের আঁচলের তলে ছেলেকে রাখতেছো ভাবী? একমাত্র বোনের এ অবস্থায় ছেলেটা শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকবে?’
-‘বেশি কথা বলো না রাহেলা। আমার মেয়ের ব্যাপারে তোমার চেয়ে ভালো আমি বুঝবো।’
রাহেলা বানু চুপ করে গেলেন। আগুন তিনি ঠিকই লাগাবেন। আগুন লাগাতেই তো এসেছেন তিনি এখানে। ডাক্তার সুমির হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। রক্তক্ষরণ হয়েছে তবে সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে আসায় খুব বেশি ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই। সাজিয়ার ইচ্ছে করছে মেয়ের গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করতে,’কী অপরাধ ছিল আমার? তোকে এতদিন এত আদরে বড় করছি এটা আমার অপরাধ? কিসের দুঃখে এত বছরের মায়ের আদর আর ভাইয়ের ভালোবাসা ভুলতে পারলি তুই?’ চাইলেও অনেক কিছু অনেক সময় বলা যায় না। ডাক্তার বলেছেন সুমির মানসিক অবস্থাও ঠিক নেই। মেয়েটা বড়সড় ডিপ্রেশন থেকেই এসব করেছে। এখন তাকে দোষারোপ করা হলে সে আরো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ডাক্তার সুমির কেবিন থেকে বের হতেই সাজিয়া চিন্তিত মুখে তার সাথে কথা বলতে গেলেন। ডাক্তার নাহার বুঝতে পারছেন সাজিয়ার অবস্থা। তিনি আশ্বস্ত করলেন তাকে।
-‘পেশেন্ট ঠিক আছে তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ওকে যতদ্রুত সম্ভব ভালো একটা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করানো আবশ্যক।’
-‘মনোরোগ বিশেষজ্ঞ?’
-‘জ্বী। সুমি মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ, ডিপ্রেশনের চরম মাত্রায় সে। বাঁচার কোনো ইচ্ছেই তার মধ্যে বিদ্যমান নেই। আমি একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের এপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিতে পারবো, ও শারীরিকভাবে সুস্থ হলে আপনারা দেখা করিয়ে আনুন।’
সাইকিয়াট্রিস্টের নাম শুনে রাহেলা বানু আরেকটা সুযোগ পেল কথা শোনানোর আর এ সুযোগ তো তিনি ছাড়বেন না।
-‘আমাদের মেয়ে পাগল নাকি যে পাগলের ডাক্তার দেখাবো?’
-‘এক্সকিউজ মি! পাগল হলেই মানুষ সাইকেল শরণাপন্ন হয়? মেন্টাল হেলথ কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে ধারণা কি আপনার নেই? মানসিক সুস্থতাকে গুরুত্ব না দেওয়া বোধহয় এ সমাজের চিরাচরিত নিয়ম। প্রমথ চৌধুরী তো আর সাধে বলেন নাই, দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার মৃত্যুর হয় না। দেখুন, ওর মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত না হলে ওর বেঁচে থাকা মুশকিল।’
-‘আপনি বেশি জানেন আমাদের মেয়ে সম্পর্কে? ওর স্বাস্থ্য কেমন আমরা জানিনা?’
-‘এতই যখন জানেন তখন ও যে সুইসাইডাল সেটা বোঝেননি কেন?’
ডাক্তারের কথায় চুপ হয়ে গেল রাহেলা। ডাক্তার নাহারও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রত্যেকটা কেসেই এ ধরনের কিছু মানুষ থাকে। তাদের যাই বলা হোক, তারা উল্টো বুঝবে। ডাক্তার চলে যেতেই রাহেলার বকবকানি আবার শুরু হলো।
-‘ভাবী দেখো এইসব মনোরোগ টনোরোগ কিছু না। এদের সব টাকা মেরে খাওয়ার ধান্দা। চলো তো তুমি সুমিরে পীরবাবার কাছে নিয়ে যাবো। উনি পানিপড়া দিয়ে ঝাঁটার বাড়িতে জ্বীন নামাবেন।’
-‘ছোটো, এসব জ্বীন ভুতের কারবার নয়। মেয়েটা অসুস্থ।’
-‘আরে তুমিও ডাক্তারের কথায় চলে আসছো! ওরা কি সবজান্তা?’
-‘তো তুই সবজান্তা? সব জায়গায় নাক ঢুকাতে হয় তোর? একবারো বোঝার চেষ্টা করতেছিস না আমি কোন অবস্থায় আছি! দূর হ তুই আমার চোখের সামনে থেকে।’
সাজিয়ার উচ্চস্বরে বলা কথায় সকলে রাহেলার দিকে তাকালো। রাহেলা অপমানিত বোধ করলেন। মনে মনে আরো জেদ কাজ করতে লাগল তার। সাজিয়ার উপর এর দ্বিগুণ প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর তিনি। তন্বী এককোণে চুপচাপ বসে। সে এতদিন কিছু বুঝতে পারেনি কিন্তু আজ সব বুঝেছে। ইমাদের কথায় সুমির মন খারাপ হওয়া, ইমাদের প্রতি সুমির দুর্বলতা সবটাই আজ তার চোখের সামনে স্পষ্টত বিদ্যমান। কিন্তু এই কথা কাকে বলবে সে? নিজের মাকে বললে তো কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। মামীকে বলার সাহস হচ্ছে না তন্বীর। একমাত্র অনামিকা ভাবীর সাথেই এসব শেয়ার করতে পারতো কিন্তু তিনিও নেই। এখন কী উপায়? তন্বী আনমনে ভাবতে লাগল কী করা যায়।
__________________
সুমির খবর পাওয়ামাত্রই সোহরাব নানান বাহানায় অতিদ্রুত হাসপাতালে গেছে। অনামিকাকে মিথ্যে না বলে উপায় ছিল না। সুমির ব্যাপারটা জানলে সে নিশ্চিত শ্বশুরবাড়িতে ফিরতে চাইতো। এখানে এমন পরিস্থিতিতে তার পড়াশোনা হয়ে উঠতো না। নিতান্তই বাধ্য হয়ে সোহরাব কথাটা লুকিয়ে গেছে। হাসপাতালে এসে সোহরাব সবটা শুনে থ হয়ে গেল। তার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে এটা তার ধারণাতীত। সোহরাব মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবার চেষ্টা করলো কী এমন কারণ থাকতে পারে এটার পেছনে। সোহরাব লক্ষ করলো তন্বী বেশ কিছুক্ষণ ধরে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বোধহয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে বলে উঠতে পারছে না। সে নিজেই গেল তন্বীর কাছে।
-‘তন্বী? কিছু জানিস তুই? সুমি কেন করেছে এসব?’
-‘ইমাদ ভাইয়ার জন্য।’
-‘মানে?’
-‘ভাইয়া সুমি ইমাদ ভাইয়ার উপর দুর্বল ছিল যার কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিল না। এ নিয়ে ইমাদ ভাইয়া কাল সুমিকে অপমান করে বলেছে আর পড়াতে আসবে না। এর জন্যই বোধহয়…আমি এতদিন এসবের কিছু বুঝতে পারিনি কিন্তু আজ এ ঘটনার পর সব পরিষ্কার বুঝতে পারছি।’
-‘ইমাদকে ভালোবাসে সুমি?’
-‘তা তো জানিনা ভাইয়া। তবে ইমাদ ভাইয়া আসার পর থেকেই সুমির মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়।’
-‘এখন সরাসরি ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না। দেখি কী করা যায়। ইমাদের সাথেও কথা বলে দেখতে হবে।’
-‘যা ভালো বোঝো ভাইয়া তবে সুমি বোধহয় ইমাদ ভাইয়ার সাথে কথা বললে খানিকটা স্বস্তি পাবে। ইমাদ ভাইয়াই ওকে ভালোমতো কাউন্সিলিং করতে পারবে।’
তন্বীর কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ইমাদ কাউন্সিলিং করলে সুমির ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে না তো? দেখা গেল ইমাদের কাউন্সিলিংয়ে সুমি আরো গভীরভাবে তার মায়ায় জড়িয়ে পড়লো। তখন কীভাবে কী করবে সোহরাব? সোহরাবের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
হাসপাতালের বালিশটাতে হেলান দিয়ে চিন্তাজগতে পাড়ি জমিয়েছে সুমি। অদ্ভুতভাবে আজ যেন তার বোধশক্তি কাজ করছে না। মরিচা ধরেছে মস্তিষ্কে নাকি মস্তিষ্কটাই মরীচিকার পেছনে ছুটছে? শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটি রক্তফোঁটাও কি জানতো এ মরীচিকার পেছনে ছোটা বৃথা? অলীক সব কথা আজ সুমির মানসপটে ভাসছে। আগ্রাসী একটা চেতনা আবারো ক্রমশ তার অন্তরাত্মাকে প্রলুব্ধ করছে। কোথাও একটু মানসিক শান্তি নেই কেন? একতরফা ভালোবাসা পোড়ায় তবুও কেন সে চিতায় ভালোবাসার দহন হয় না? মানুষ মারা যায় তবুও কেন ভালোবাসা রয়ে যায়? নিজেকে এত যন্ত্রণা দেওয়ার পরও কেন একটুও ক্ষত হলো না এ একতরফা ভালোবাসাটুকু? পাশে থাকা ছোটখাটো ট্রে টেবিলটা ডান হাত দিয়ে হালকাভাবে ধাক্কা দিল সুমি। মাথার যন্ত্রণায় সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সব ভেঙে ফেলতে। টেবিলটা মেঝেতে পড়তেই টেবিলে থাকা স্টিলের ট্রের ওষুধপত্র চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। স্টিলের ট্রে মেঝে স্পর্শ করতেই ঝনঝন শব্দে সুমির কর্ণকুহরে মৃত্যুধ্বনি পুনরুজ্জীবিত করে তুললো। সুমির কানে ক্ষীণ কণ্ঠে বেজে উঠলো, ‘ভালোবাসার মৃত্যু নেই। দেহ ক্ষয়ে যায়, ভালোবাসা চিরকাল রয়ে যায়।’
চলবে…
[