#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৮)
যতটা আনন্দ,মজা আর হুল্লোড় করার স্বপ্নে ছিল ইকবাল তার সব মাটি। কিচ্ছুটি হলোনা। বরং সম্পূর্ন রাস্তায় ধূসরের নিস্তব্ধতা চুপসে রাখল তাদের। পুষ্পর সঙ্গে সেই লুকোচুরি, প্রেম -প্রেম চোখাচোখি পর্যন্ত হয়নি। মেয়েটারও যে মন খা*রাপ! সেই যে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েছে,আর ফেরেনি কোনও দিক। ধূসর ভাইয়ের অন্ধকার চেহারা প্রভাব ফেলেছে ওর মনেও। এই একই কারণ, ইকবালের দুষ্টুমি গুলোকেও মাথা তুলতে দিলোনা। যেই মেয়ে ধূসরের পায়ে পায়ে ঘোরে,লেগে থাকে, পারলে ঝুলে থাকে শার্টের কোনায় সেই ছোট্ট পিউয়ের একটা অস্বাভাবিক প্রত্যা*খান তিনটি মানুষকে থমকে রাখল আজ।
ইকবালের গাড়ি থামল মেইন গেটে। সে আর ঢুকবেনা ভেতরে। ধূসর নামল খুব দ্রুত। ছেলেটা সৌজন্যে বোধ দেখিয়েও ইকবালকে বিদায় জানাল না। নামা মাত্র গটগট করে ঢুকে গেল বাড়িতে। পুষ্প ঢোক গি*লে ভী*ত কণ্ঠে বলল,
‘ পিউয়ের যে আজ কী হবে!’
ইকবাল বলল,
‘ ও হঠাৎ এরকম করল কেন?’
‘ জানিনা, আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছেনা। শোনো ইকবাল, তুমি যাও এখন,আমি ভেতরে গিয়ে দেখি কী অবস্থা!’
‘ আচ্ছা জানিও আমায়।’
পুষ্প ব্যস্ত পায়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল ‘ আচ্ছা।’
ধূসরদের গাড়িটা সবার পরে ছাড়ায়,পৌঁছালও সব শেষে। যে যার ঘরে গেলেন বিশ্রামের জন্যে। শুধু মিনা বেগম ঢুকলেন রান্নাঘরে। তাকে দেখে রুবায়দাও হাত মুখ ধুয়ে নেমে এলেন। বাসায় এতদিন না থাকায় প্রচুর কাজ জমেছে। মিনা বেগম এতদিনের নোংরা হওয়া আমজাদ আর তার কাপড় গুলো ঝুড়িতে ফেললেন। কাল বুয়া এসে কেচে দেবে। এর মধ্যে ধূসর বাড়িতে ঢোকে। হাঁটা পথে শুধায়,
‘ পিউ কোথায়?’
তিনি বললেন, ‘ ঘরে। বলল পড়তে বসবে, কেউ যেন বিরক্ত না করে।’
ধূসর ওমনি দাঁড়িয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকাতেই মিনা বেগম বললেন,
‘ আমিও অবাক হয়েছি,পড়া চোর মেয়ের এত আগ্রহ দেখে। যেখানে এত পথ জার্নি করে এসে সবাই বিছানায় চিৎপটাং হয়ে গেল সেখানে সে না কি পড়বে এখন। ভাবা যায় বলতো?’
রুবায়দা বেগম বললেন
‘ ওর তো পরীক্ষা আপা,তাই পড়ছে। তুমি যতটা বলো পিউ ততটাও ফাঁকি দেয়না। আর এরকম পড়েও ভালো রেজাল্ট করছে যখন, তখন সমস্যা কোথায়?’
‘ তুই আর ওর হয়ে কথা বলিস না ভাই। সব সময় আগের রাতে পড়ে পরীক্ষা দিতে যায়। তাও কীভাবে অত নম্বর পায় আল্লাহ মালুম। নির্ঘাত স্যার গুলো একটা খাতাও ভালো করে দেখেনা। ‘
রুবায়দা বেগম কথাটায় হেসে ফেললেন। নিজের মত আরো কিছু সাফাই গাইলেন পিউয়ের নামে। কিন্তু শ*ক্ত হয়ে রইলো ধূসর। সিড়ির হাতলে রাখা হাতটা আর দৃঢ় হলো। বুঝতে বাকী নেই, পিউয়ের নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য। ‘কেউ যেন বিরক্ত না করে , এই লাইনটা শুধুই তার জন্যে। তাইতো?
ধূসর যতটা ক্ষি*প্ত ছিল,তার থেকেও অত্যধিক রা*গ মুহুর্তে জাপটে ধরল শরীর। ললাটের শিরা সমূহ ফুঁ*সে ওঠে। র*ক্ত, উত্ত*প্ত জলের ন্যায় টগবগ করল। তারপর শব্দ করে করে সিড়ির একেক ধাপ বেঁয়ে চলল সে।
***
পিউয়ের দরজার সামনে এসে থামল ধূসর। দোর ভেতর থেকে বন্ধ দেখে ক্রো*ধ আরো চড়ে বসে। তামাটে নাকের ডগা ফুলে ওঠে।
পিউ চেয়ারে বসে। মাথাটা টেবিলে। আচমকা দরজার দ্রিমদ্রিম শব্দে কলিজা ছ*লাৎ করে লাফিয়ে ওঠে। চমকে দরজার দিক তাকাল সে। হুলস্থূল কড়া*ঘাতের শব্দ কানে স্পষ্ট। পিউয়ের বড় বড় চোখ নিবদ্ধ সেখানে। পরমুহূর্তে নিভে এলো দৃষ্টি। চোখ ফিরিয়ে আনল সে। আবার আগের মত দুহাত জড়ো করে টেবিলে রেখে, মাথাটা এলিয়ে দিল।
ধূসরের হাতের তালু লালিত। যেন চামড়া ফে*টে র*ক্ত আসবে বাইরে। দাঁত কপাটি একই জায়গায় এসে মিশেছে। পুষ্প গুটিসুটি মেরে পেছনে দাঁড়িয়ে। চেহারায় শঙ্কা,আত*ঙ্ক। দরজা ধা*ক্কানোর শব্দ জোড়াল হলো আরো। একে একে পৌঁছে গেল বাড়ির প্রতিটি কোনায়। উচ্চশব্দে নীচ থেকে ছুটে এসেছেন মিনা, রুবায়দা। বাকীরাও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। পেছনে ভিড় জমল,অথচ নিরুদ্বেগ ধূসরের এলো- গেলোনা। সে অধৈর্য, বিক্ষি*প্ত,ত্বরান্বিত। কেন দরজা খুলছেনা পিউ,কেন?
আফতাব সিকদার চশমা চোখে দিয়ে বের হলেন। ছেলেকে বললেন,
‘ কী ব্যাপার? এভাবে দরজা ধা*ক্কাচ্ছো কেন? কি হয়েছে?’
ধূসর জবাব দিলোনা। একবার ঘুরেও দেখল না বাবাকে। মিনা বেগম বুঝতে না পেরে বললেন,
‘ ও ধূসর! কী হয়েছে রে বাবা? পিউ কিছু করেছে?’
পুষ্প চো*রের মত চুপটি করে দাঁড়িয়ে। ঘটনার আদ্যপ্রান্ত তার অবগত। তবুও টু শব্দ করছেনা। বাড়ির প্রত্যেকে ধূসরের কান্ডে একে অন্যের মুখ চাওয়া- চাওয়ি করল। ভাবল, হয়ত পিউ কিছু করেছে! নাহলে এত শব্দেও কেউ দরজা কেন খুলবেনা?
অবশেষে ক্ষান্ত হলো ধূসর। থামল সে। পিউ খুলল না তো খুললই না। ধূসর বন্ধ দোরের দিক কিয়ৎক্ষন র*ক্ত চোখে চেয়ে রইল । প্রসস্থ বুকটা লা*ফাচ্ছে ঝ*ড়ের ন্যায় নিঃশ্বাসের গতিতে। সে ক্ষু*ব্ধ নজরে শেষ বার তাকিয়ে হনহন পায়ে নিজের ঘরে গেল। ধ*ড়াম করে দরজা লাগাল। উৎকট শব্দে কেঁ*পে উঠল রিক্ত থেকে রাদিফ। আমজাদ সিকদার ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চটজলদি বাইরে এলেন। মেয়ের ঘরের সামনে বাড়ির সবাইকে দেখে তব্দা খেয়ে বললেন,
‘ কী হয়েছে এখানে?’
তাজ্জব, কৌতুহলি প্রতিটি সদস্য তার দিকে তাকাল। তবে যুতসই উত্তর কারো কাছে নেই। সকলেই প্রশ্নবিদ্ধ। কেউ ভাবল পিউ হয়ত বেয়া-দবি করেছে,তাই রে*গে গেছে ধূসর। আফতাব সিকদার তিঁতি বিরক্ত। শান্ত মানুষ বলেই ছেলেকে কিছু বলেন না।
মিনা বেগম স্বামীকে দেখেই ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ কিছু হয়নি। আপনি যান, বিশ্রাম করুন। ‘
‘ তাহলে তোমরা এখানে কেন? পিউ ঠিক আছে?’
‘ আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। ওতো মাত্র ঘরে গেল। আমি ডাকছিলাম,জোরে জোরে দরজা ধা*ক্কিয়েছি বলে ওরা সবাই চলে এসছে।’
সাজানো, গোছানো কথাগুলোই মেনে নিলেন আমজাদ। মিনা বেগমের ওপর দিয়ে সত্যিটা আর কেউ বলতে গেল না। এমনিতেও বলতোনা। আমজাদ সিকদার আগে থেকেই ধূসরের ওপর চটে আছেন। গ্রামে গিয়ে ধূসরের মা*রা-মা*রির ঘটনা,আর এক ঘর মানুষের সামনে তার বেপরোয়া ভাবভঙ্গির পর সে মনে মনে ক্ষু*ন্ন ভীষণ। প্রকাশ করছেন না,তবে দরকার ছাড়া ধূসরের সাথে একটা কথাও বলেননি।
আফতাব সিকদার হতাশ চোখে ভাবির দিক চাইলেন। এই নারীটি রুবায়দার থেকেও বেশি অন্ধ ধূসরের প্রতি। একটা কোনও কারণ রাখবেনা, যাতে কেউ একটা কথা শোনাবে ওকে। যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, এই যে এখনও করলেন। ভদ্রমহিলা মনপ্রাণ দিয়ে মানেন,একটা সুখী পরিবারের মূলমন্ত্রই হলো একে অন্যের দো*ষ ঢেকে রাখা।
আনিস ঘরে ফিরে এলেন। শরীর ক্লান্ত, আপাতত কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর শক্তি নেই। কাল থেকে আবার অফিসে ছোটাছুটি। একে একে সবাই ফিরে গেল কামড়ায়। সাদিফ বাড়িতে ছিল না। মাঝপথেই গাড়ি থেকে নেমে অফিসে গিয়েছে। সেদিনের হারানো ডকুমেন্টসের সমাধানের জন্যে তাকেই দরকার। ছেলেটা সামান্য বিশ্রাম অবধি পায়নি।
মিনা বেগম,রুবায়দা দুজনেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। রুবায়দা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
‘ কী হলো ব্যাপারটা? ছেলেটা এমন করল কেন? ‘
‘ কী আর হবে? হয়ত দেখছিল পিউ সত্যিই পড়তে বসেছে কীনা। আর ওটাও ভ*য়ে দরজা খোলেনি দেখেছিস?ফাঁকিবাজ তো!’
দুজন সরল- সহজ রমনীর আলাপের মাঝে পুষ্প ঘরের দিকে পা বাড়াল। মনে মনে বলল,
‘ আল্লাহ বাঁচিয়েছেন তোমাদের সরল বানিয়ে,নাহলে কী হতো! ধূসর ভাই যা ক্ষে*পেছেন কখন শান্ত হবে আল্লাহ জানে। কেন যে এরকম করছিস পিউ!’
****
পিউয়ের দরজা খোলা হলো তখন,যখন ধূসর বাড়িতে নেই। দুপুরে খেলোনা,কয়েকজন হাজার ডেকেও তাকে পায়নি। ভেতর থেকে উত্তর পাঠাচ্ছিল ‘ পরে খাব, পড়ছি।’
ধূসর আসার আগে আগে খেতে গেল। একেবারেই সামান্য ভাত মুখে দিয়ে আবার রুমে ঢুকে যায়। ফের দরজা লাগাতে গেলেই পুষ্প এসে সামনে দাঁড়াল। থেমে গেল পিউ। সে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করল
‘ কী হয়েছে তোর?’
পিউ অনতিবিলম্বে জবাব দেয়,
‘ কিছুনা।’
‘ কিছু হলে আমাকে বল,আমি সব ঠিক করে দেব।’
পিউ দূর্বোধ্য হেসে বলল ‘ হলেই না ঠিক হতো। যেখানে কিছু হলোইনা,সেখানে আর কী করবি?’
‘ তুই বড়দের মত করে কথা বলছিস কেন?’
‘ বড় হয়ে গেছি বলছিস?’
পুষ্প দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকল। বোনের গাল ধরে মোলায়েম স্বরে বলল,
‘ তোর কি মন খা*রাপ পিউ?’
পিউয়ের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। অথচ চোখ শুকনো। মিহি হেসে মাথা নাড়ল।
পুষ্প বলল, ‘ ধূসর ভাই দুপুরে ডাকলেন বের হলিনা কেন?’
‘ এমনি। পরীক্ষার চারদিন বাকী,একটু পড়ি?’
পুষ্প অবাক হলো। পরক্ষনে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
‘ পড় । আমি আজ তোর সাথে ঘুমাব।’
‘ না। আমি শব্দ করে পড়ব,তোর ঘুম হবেনা।’
পুষ্প বিস্ময়টা আর চাপা দিতে পারেনা। চোখ ফে*টে বেরিয়ে আসে তার স্পষ্ট ছাপ।
এই মেয়েটা তার সঙ্গে ঘুমাবে বলে প্রত্যেকটা দিন বায়না করে। সেইত নিতে চায়না। রাত জেগে ইকবালের সাথে ফোনালাপের জন্যেই নেয়না। তবে অজুহাত দেখায়, পিউয়ের ঘুম ভালোনা বলে।’
অথচ আজ সে নিজে যেঁচে এলো,পিউ মানা করছে?
পিউ ঠান্ডা স্বরে বলল ‘ তুই এখন যা আপু। আমার পড়তে বসতে দেরি হয়ে যাবে।’
পুষ্পর মুখটা ছোট হয়ে আসে। এইবার সে শতভাগ নিশ্চিত, পিউয়ের কিছু একটা হয়েছে। নির্ঘাত ক*ষ্ট পেয়েছে কিছু নিয়ে। কিন্তু ওতো দুঃ*খ পেলে চে*পে রাখার মেয়ে নয়। হাত পা ছড়িয়ে কাঁ*দে। বলেও দেয় সরাসরি। অভিযোগ জানায়। তাহলে হঠাৎ কী হলো?’
***
সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে এসে ধূসর থমকাল। সবাই আছে, পিউ নেই। সবসময় বসা চেয়ারটাও ফাঁকা। পরপর স্বাভাবিক হলো সে। ভাবল আসবে হয়ত,ওঠেনি এখনও। আজ অবধি তাকে ছাড়া মেয়েটা সকালে খেয়েছে না কি! ধূসর এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসে। রুবায়দা বেগম প্লেটে নাস্তা বেড়ে দিলেন। গ্লাসে ঢাললেন তাজা ফলের রস। ধূসর চুমুক দিতে দিতে আড়চোখে সিড়ির দিকে তাকাল। পিউয়ের ছাঁয়ারও দেখা নেই। ধূসর শরবত মুখের সামনে ধরলেও খেতে পারল না। রেখে দেয়। পাশে পরে থাকা খালি চেয়ারটা দেখে বি*শ্রী অনুভূতি হয়। স্যান্ডউইচ হাতে তুলেও নামিয়ে রাখে। ওই টুকু সময় কয়েকবার তাকাল সিড়ির দিকে। এই বুঝি পিউ নামছে! কিন্তু না,মেয়েটার খোঁজ নেই। এমন তো কখনও হয়নি। এই বাড়িতে এত ভোরে মিনা,রুবায়দা,আর সুমনার পর পিউই ওঠে। শুধুমাত্র ধূসরের সাথে দিন শুরু করার আশায়। নামাজ শেষে ঘুমোয় না। বসে থাকে,অপেক্ষা করে,চেয়ার টেনে মুছে রাখে,ধূসর ভাই পাশে বসবেন বলে। সারাদিন দেখবেনা , এই একটু সময় কাছে পাবে বিধায় যে মেয়ে এতটা মুখিয়ে থাকে সে আজ এলোনা? এতক্ষণেও না? ধূসর ঢোক গি*লল। খাবার আজ নামবে না গলা দিয়ে। আফতাব লক্ষ্য করলেন ছেলেকে। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ খাচ্ছোনা কেন?’
ধূসর বাবার দিকে তাকায়। আরেকবার চোখ বোলায় সিড়ির দিকে। শেষমেষ উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। মিনা বেগম বললেন ‘ কী হলো?’
‘ খাব না।’
‘ ওমা কেন? বসেছিস যখন….’
কথা সম্পূর্ণ করতে দিলোনা ধূসর। লম্বা পায়ে বাড়ি ছাড়ল। বাড়ির লোকের জিজ্ঞাসু চোখমুখ তোয়াক্কা পেলোনা সেখানে।
পিউ চাপানো দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিলো। পুষ্প গভীর ঘুমে মগ্ন। সে পা টিপে টিপে ঢুকল ভেতরে। সোজা চলে গেল বারান্দায়। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল নীচে। ধূসর বাইক ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল কেবল। ওইত পেরিয়ে যাচ্ছে গেইট। পিউ দাঁড়িয়ে রয়,একধ্যানে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে তার প্রানপ্রিয় ধূসর ভাইকে।
***
ধূসর আক্রো*শে পরপর চারটে ঘু*ষি বসাল দেয়ালে। আঙুলের চামড়া ছিলে গেল। তবু এক চুল রা*গ কমলোনা। আবার ঘু*ষি দিতে গেলে, ইকবাল হকচকিয়ে হাতখানা টেনে ধরল। আর্ত*নাদ করে বলল,
‘ কী করছিস? পাগল হলি!’
ধূসর হিঁসহিস করল। অথচ শান্ত কণ্ঠে বলল
‘ হাত ছাড়।’
‘ ধূসর,মাথা ঠান্ডা কর। রা*গ কমা,নিজেকে আ*ঘাত করলে লাভ হবে?’
ধূসর তাকাল।
‘ তুই ভাবতে পারছিস ইকবাল, আমি ডাকলাম পিউ এলোনা। আমি দরজা ধা*ক্কালাম,বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেল কিন্তু ও খুলল না। রাতে পর্যন্ত বের হয়নি। সকালে খেতে আসেনি। কাল থেকে একবার আমার দিকে তাকায়নি, কথা বলা তো দূর!’
কথাগুলোর শুরু অক্রো*ধে হলেও, শেষদিকে গলা বুজে এলো ধূসরের। প্রতিটি বাক্যে মনঃক*ষ্ট, ক্লেশ,দুঃ*খ পরিষ্কার। ইকবাল নিরাশ শ্বাস টেনে বলল,
‘ এইটুকুতে তোর ক*ষ্ট হচ্ছে? তাহলে ভাব,গত তিন বছর ধরে মেয়েটা কতটা ক*ষ্ট পেয়েছে! কতটা ধৈর্য ধরেছে তোর আশায়, তোর অপেক্ষায়!’
ধূসরের রুষ্ট অভিব্যক্তি শিথিল হয়। অক্ষিপটে কোমলতা ছড়ায় নিমিষে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বিচলিত, নিস্তব্ধ কণ্ঠে শুধাল,
‘পিউ বদলে যাচ্ছে নাতো ইকবাল? ‘
‘ গেলে যাচ্ছে,সমস্যা কী?’
ধূসর ব্যাকুল চোখে তাকায়। ইকবাল উদ্বেগহীন গলায় বলল ‘ আরো চুপ করে থাক,অপেক্ষা কর সময়ের। আর এদিকে পিউ পালটে যাক,তারপর অন্য কাউকে বিয়ে ক….’
এটুকু শুনতেই ধূসর ধম*কে উঠল ‘ চুপ। চুপ কর। ‘
ইকবাল থামল তবে হাসল। ধূসরের অবস্থায় তার দুঃখ পাওয়ার কথা, অথচ দাঁত মেলে হাসছে সে। ধূসর হাঁস*ফাঁস করে বসে পরল চেয়ারে। হাঁটুতে ঝুঁকে মাথা চে*পে ধরে বলল,
‘ পানি আনা তো।’
ইকবাল ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতেই বাইরে গেল। কাউকে একটা হুকুম দিল পানি দিতে। ধূসর মাথা নুইয়ে বসে রইল ওভাবে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সোজা হলো। তৎক্ষনাৎ পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিল কারো নম্বরে। সে রিসিভ করতেই শুধাল,
‘ তোর ভাবি কি কলেজে?’
****
পিউ কলেজে গেল না। শরীর খারাপের ছুঁতো দেখিয়ে বাড়িতেই থেকে গেল । অন্য সময় এমন করলে মিনা বেগম ব*কেন, রাগা*রাগি করেন, জোর করে পাঠাতে চান। আজ মেয়ের শুকনো মুখ দেখে রা করলেন না। ভাবলেন সত্যিই অসু*স্থ!
তখন মাত্র দুপুর। রবির কড়া আলো, শীতের প্রকোপে মিইয়ে আছে। এতটা বেলায়ও কুয়াশা কাটেনি। হলদেটে বিভায় জুড়েছে শহরের বুক।
পিউ বিছানায় শুয়ে। মেঘ ছুটছে তার আদোল ঘিরে।
নিশ্চল আখিজোড়া নিবদ্ধ সিলিং ফ্যানের ওপর। তক্ষুনি ঘরে ঢুকলেন মিনা বেগম। মেয়েকে গভীর চোখে দেখলেন। গত দুই দিন ধরে তার দুরন্ত মেয়ে এমন চুপচাপ কেন? কথা বলছেনা,হাসছেনা,হু হা ছাড়া উত্তর নেই। সারাদিন বসার ঘরে টেলিভিশনের দিক চোখ গেঁথে রাখা মেয়েটা, আসা থেকে একটাবারও নীচে নামেনি। তিনি আস্তে করে ডাকলেন,
‘ পিউ!’
পিউ নড়েচড়ে উঠল। ধ্যানে ছিল যেন। সামনে তাকিয়ে মাকে দেখে উঠে বসল।
‘ তুমি এখন?’
‘ নাস্তা করতে এলিনা যে।’
পিউ চোখ নামিয়ে বলল ‘ পরে খাব।’
‘ কাল থেকে এই এক কথা শুনছি। না খেয়ে থেকে একটা রোগ বাধিয়ে ক্ষান্ত হবি তাইনা?’
‘ কিছু হবে না। খিদে লাগলে নিজেই খেয়ে নেব।”
মিনা বেগম ছোট্ট শ্বাস ফেললেন। এগিয়ে এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন
‘ পরীক্ষার জন্যে এত চিন্তা করছিস তাইত? চিন্তা নেই মা। যা হবে ভালো হবে। এসব নিয়ে ভাববিনা, ঠিক আছে? ‘
পিউ উদাস হাসল। নীচের দিক চেয়ে বাধ্যমেয়ের মতো মাথা দোলাল।
মিনা বেগম বললেন ‘ চল খাবি। রুটি খেতে না চাইলে তোকে নুডুলস রেধে দেব আয়।’
পিউ জোরপূর্বক হেসে বলল
‘ মা! এখন খাব না,যখন খাব তোমাকে বলব করে দিতে।’
হার মানলেন তিনি। পরমুহূর্তে পিউয়ের এলোমেলো চুল দেখে বললেন,
‘ চুলের কী অবস্থা করেছিস! ফ্যাকাশে কেন এত? তেল টেল দিসনা?’
পিউ বলল না কিছু। মিনা বেগম অপেক্ষাও করলেন না উত্তরের। এগিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল আর চিরুনি তুলে আবার এসে জায়গায় বসলেন। মেঝে ইশারা করে বললেন,
‘ আয় দেখি, এখানে বোস,তেল দিয়ে দেই।’
পিউ মানা করল ‘ না, দেব না এখন।’
‘ চুপচাপ আয়। অত বড় চুল, যত্ন না নিলে থাকবে? আয় বলছি!’
মায়ের চোখ পাকানো দেখে পিউ ব্যর্থ শ্বাস নেয়। বিছানা থেকে নেমে এসে পায়ের কাছে বসে। মিনা বেগম পাঞ্চ ক্লিপ খুলে পাশে রাখলেন। চুলের ভাঁজে হাত দিয়েই, মুখ কুঁচকে বললেন,
‘ ইশ! কত্ত জট বেঁধেছে। আসা থেকে চিরুনি করিসনি?’
পিউ দীর্ঘ শ্বাস নিল। সত্যিই করেনি। সে যে নিজের মধ্যেই নেই। যার অন্তকরনের পুরোটা অম্বুবাহি ছেঁয়ে তার কী সাজসজ্জায় মন বসে?
মিনা বেগম হাতের তালুতে তেল ঢেলে,চুলে ঘষলেন প্রথমে। ভাঁজে ভাঁজে তেল লাগাতে লাগাতে বললেন,
‘ তোর মত বয়সে আমার হাঁটু অবধি চুল ছিল। চিরুনি ঢুকতোনা,সিথি দেখাতোনা। ঠিকঠাক মুছতে পারতাম না বলে প্রায়সই ঠান্ডাও লেগে যেত। তবুও বড় চুল রাখার জন্যে কী না করেছি! আর তোরা? চুলের যত্ন নিসনা,তেল দিসনা। মাসে মাসে কাট*ছাট করে ছোট করে রাখিস। কী লাভ এতে? বড় চুলের মত সৌন্দর্য আর কিছুতে হয়?’
পিউ নিশ্চুপ, নিরুত্তর। মিনা বেগম আরো অনেক কথা বললেন! সব তার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। একটাও না শুনেছে, না ঢুকেছে মাথায়। তার অবিচল চাউনী আটকেছে জানলার পর্দায়। মিনা বেগম যত্ন নিয়ে চুল আচড়ে , হাত খোপা করে দিলেন। হাতে লেগে থাকা অবশিষ্ট তেল পিউয়ের দুগালে মাখলেন। এরপর ওর থুত্নী ধরে নিজের দিক ফিরিয়ে বললেন,
‘ এখন কত সুন্দর লাগছে দ্যাখতো। আর এতক্ষন মনে হচ্ছিল রাস্তার পাড়ের পাগল টা বসে আছে আমার বাড়িতে।’
পিউ ক্ষীন হাসল। তারপর মাথাটা এলিয়ে দিল মায়ের কোলের মধ্যে। মিনা বেগম হাত বোলাতে বোলাতে বললেন
‘ দুপুরে কী খাবি? বিরিয়ানি রাধব একটু?’
‘ উহু। ‘
‘ তাহলে? ‘
পিউ নিস্পৃহ কণ্ঠে জানাল ‘ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘ ওমা কেন? ‘
সেই সময় রুবায়দা বেগম চঞ্চল পায়ে ঘরে ঢুকলেন। উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
‘ আপা তুমি এখানে? আর আমি সব জায়গায় খুঁজছি।
আওয়াজ শুনে পিউ মাথা তুলল। তবে মেঝেতেই বসে থাকল। মিনা বেগম বললেন,
‘ কেন রে? কী হলো আবার? তরকারি বসিয়ে এসেছিলাম, পু*ড়ে গেল না কি?’
‘ আরে না না। আমি জাল কমিয়ে রেখেছি। আসলে কথা ছিল একটা। সকাল থেকে বলব বলব করে হচ্ছেনা,তুমিতো জানো, আমার পেট ততক্ষণ অবধি গুড়গুড় করতে থাকবে, যতক্ষন তোমার কাছে না বলছি।’
মিনা বেগম হেসে বললেন,
‘ আয় বোস। শুনি তোর কথা।’
রুবায়দা বেগম দরজা চাপাতেই বললেন
‘ খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা না কি রে রুবা?’
‘ হ্যাঁ অনেক! আমি তোমার দেবরের সাথে রাতেই আলাপ -আলোচনা করে রেখেছি বুঝলে?এখন তোমাকে বলব।’
মিনা বেগম একটু নড়েচড়ে বসলেন । পিউও কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে। রুবায়দা বেগম চাপা কণ্ঠে বললেন
‘ আমি না একটা কথা ভাবছি। এখন তুমি আর ভাইজান মতামত দিলেই আগাব ভাবছি। তোমরা হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে এখানেই শেষ। ‘
‘ আচ্ছা বাবা সে বুঝলাম। কিন্তু কথাটা কী?’
রুবায়দা বেগম বললেন,
‘ কথাটা তোমার ছেলে কে নিয়ে!’
পিউ আগ্রহভরে তাকাল। মিনা বেগম শুধালেন
‘ধূসর কী করল?’
রুবায়দা বলার পূর্বে পিউয়ের দিক নেত্রপাত করলেন। সচেতন কণ্ঠে বললেন,
‘ পিউ মা, তুই কাউকে বলবিনা তো ?’
পিউ জানাল ‘ না মেজো মা।’
মিনা বেগম অধৈর্য কণ্ঠে বললেন ‘ ধূসর কী করেছে বল! ‘
‘ আরে, না, কিছু করেনি। তবে দেখছো তো কেমন ভবঘুরে! বাড়িতে থাকেনা,রাত করে ফেরে,নিজের দিকে খেয়াল নেই,কারো কথা শোনেনা। চিন্তা হয়না বলো? ‘
‘ হ্যাঁ সেত হবেই। আবার রাজনীতি করছে, কতদিক সামলাতে হয়!’
‘ হ্যাঁ। এইজন্যে চাইছি, ওর বিয়ে দেব। একটা লাল টুকটুকে বউ আনব বাড়িতে। বউয়ের টানে হলেও তো বাড়িমুখো হবে তাইনা?’
মিনা বেগম প্রজ্জ্বলিত হাসলেন। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,
‘ হ্যাঁ, হবেইত। আমিও কদিন ধরে ভাবছিলাম, তোকে বলব,যে ধূসরের জন্যে মেয়ে দেখি চল। কিন্তু মনেই থাকেনা। আচ্ছা এখন যখন তুইও চাইছিস, দুবোন মিলে মেয়ে দেখা শুরু করি?’
পিউয়ের শ্বাসরু*দ্ধ হয়ে আসছে। বারবার ঢোক গিলছে।
রুবায়দা বেগম মিনমিন করে বললেন’
‘ আসলে, আপা হয়েছে কী,আমার না ধূসরের জন্যে একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে। তবে তোমার পছন্দ নাহলে ক্যান্সেল।’
মিনা কপাল কোঁচকালেন,
‘ পছন্দ করেছিস? কাকে?’
রুবায়দা বেগম ওমনি হাসি হাসি মুখ করে বললেন
‘ মারিয়াকে। ‘
পিউয়ের হৃদপিণ্ড থমকে গেল ওখানেই। গোটা আকাশটা টুক*রো টুক*রো হয়ে ভে*ঙে পরল মাথায়। পায়ের নীচের জমিন কম্প*মান। ঘোলা নেত্রযূগল বিস্ময়াকূল হয়ে চেয়ে রইল তাদের দিকে।
মিনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
‘ মারিয়া? হঠাৎ ওকে পছন্দ করলি যে?’
‘ আগেই পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু বলিনি। তারপর আবার ধূসরের মুখে ওসব শুনে এত মায়া হলো! মেয়েটার কত ক*ষ্ট! আমাদের বাড়ি এলে সুখেই থাকবে। ‘
‘ সে থাকবে। কিন্তু ধূসর…?
‘ ওতো রাজি হবেই। দ্যাখো আপা, ছেলে যতই বলুক,আমার মনে হচ্ছে মারিয়ার প্রতি ওর কিছু একটা আছে। নাহলে রাজনীতিতে কত মানুষ আহ*ত হয়, মা*রা যায়, সবার পরিবার রেখে মারিয়াদের পরিবারেরই খেয়াল কেন রাখবে? কেন ওকেই আনবে পিউয়ের টিচার হিসেবে? বলো? আর বিয়ে বাড়িও দেখলাম, অনেকবার লক্ষ্য করেছি আমি, ওদের মধ্যে মিল খুব। হতেই পারে ভেতর ভেতর একজন আরেকজন কে পছন্দ করে। কিন্তু বলছেনা।’
মিনা বেগম বিজ্ঞের মত মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘ হ্যা। কথাখানা ঠিক। হতেই পারে। ‘
‘ তাহলে তুমি ভাইজানের সাথে কথা বলবে?”
‘ আচ্ছা বললাম না হয়। মেয়েতো সুন্দর, ভদ্র, সুশীল, ভালোই হবে। পরিবারও ভালো। বাবার সরকারি চাকরী ছিল, খা*রাপ তো নয়।’
রুবায়দা খুশি হয়ে আওড়ালেন,
‘ ঠিক আছে। ‘
আচমকা খেয়াল পরল পিউ কেমন অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে। পলক পরছেনা,অক্ষিকূট নড়ছেনা। যেন মূর্তি বসে একটা। তিনি ভ্রুঁ গুটিয়ে বললেন ‘ এভাবে কী দেখছিস?’
পিউয়ের হুশ এলো। চোখ নামিয়ে দুদিকে মাথা নাড়ল। বোঝাল’ কিছু না’।
রুবায়দা বেগম সুদীর্ঘ হেসে বললেন,
‘ মারিয়াকে ভাবি হিসেবে পছন্দ হয় পিউ? তোর ধূসর ভাইয়ের সাথে মানাবেনা?’
পিউ চোখ খিঁচে বুজে ফেলল। বুকের মধ্যে তলোয়ার দিয়ে হৃদয়টা কে*টে আনলেও এতটা ব্য*থা লাগতোনা, এতটা য*ন্ত্রনা হতোনা, যতটা অনুভূত হলো এই এক প্রশ্নে!
মারবেল মেঝেতে চোখ রেখেই সে আবার মাথা দোলাল। বক্ষে বয়ে যাওয়া ঝড়-তু*ফান এড়িয়ে আওড়াল,
‘ খুব ভালো মানাবে!’
চলবে,