#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৮)
ছোঁয়াকে ভুলে যাওয়া ঈশানের পক্ষে সম্ভব নয়। ছেলেটা যতই চেষ্টা করুক না কেন এই চেষ্টার কোনো মানে নেই। অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে কিছু একটার সাথে সংঘর্ষ হলো ওর। ছিটকে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামনে নিল। সাদা রঙের প্রাণীটা মিউ মিউ করছে। অদ্ভুত লাগছে ঈশানের নিকট। কিন্তু চোখের সামনে যখন উষশীকে দেখতে পেল তখন সব যেন থমকে গেল। উষশী জগিং এ বের হয়েছিল। সেখান থেকেই এদিকে ছুটে আসে কোকো। তার পিছু নিতে নিতে এখানে চলে এসেছে। মেয়েটি সরি শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেল। ঈশানের চোখে মুখে অদ্ভুত দ্যুতি’র দেখা মিলল।
“উষশী!”
“ঈশান!”
“তুমি এখানে! হোয়াট আ সারপ্রাইজ।”
“আমি তো ডেনমার্কেই থাকি।”
“তুমি তো অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছ। কিন্তু স্লোভেনিয়ায় কেন যাও নি?”
“এই প্রশ্নটা কোরো না ঈশান।”
“ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে?”
কালো মেঘের ছায়া নেমে এল উষশী’র মুখে। মেয়েটি চট জলদি ঈশানের হাতটা ধরে ফেলল। চোখে মুখে অনুনয়ের ছাপ।
“ফ্রেন্ড। প্রমিস কর, আমার সাথে তোমার স্বাভাবিক সম্পর্কটা অন্য কাউকে বলবে না।”
“কিন্তু উষশী।”
“প্লিজ ফ্রেন্ড।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“থ্যাংক ইউ। আমি আজ আসি। কোনো এক সময় কথা হবে।”
মেয়েটি ঝড়ের গতিতে মিলিয়ে গেল। এতটা আশ্চর্য এর আগে হয়েছে কি না ঈশানের জানা নেই। উষশী’র ভেতরকার সত্য জানার জন্য মন আকুপাকু করছে। এদিকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ও উপায় নেই।
পরের দুটো দিন এত বাজে গেল অভিরাজের। ছেলেটার ভেতরে যেন উষশী’র চিন্তাটা রয়েই গেল। উষশী সেদিন বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। মিথ্যে বলেছিল। কিন্তু কেন এমনটা করেছিল? এই রহস্যটার কোনো সমাধান ই পাওয়া যাচ্ছে না। অভি সেই বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে উষশীকে দেখেছিল। বাগানের চারপাশে ঘুরেও যুবতী’র দেখা মিলল না। একরাশ মন খারাপ নিয়ে ফিরে এল অভিরাজ। হোটেলে ফিরেই শুনল ছোঁয়ার অসুস্থতার কথা। মেয়েটা হুট করেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার শারীরিক অবস্থা’র খবরটা শুনেই ঈশান এর মস্তিষ্ক বন্ধ হয়ে গেছে। অভিরাজ ওর শান্ত, গুমোট মুখটা দেখেই যেন সবটা বুঝতে পারল। পিঠে হাত রেখে বলল,”কোনো বাঁধা নেই। যেতে পারিস তুই। তবে একজন প্রেমিক হয়ে নয় একজন ভাইয়ের দায়িত্ব পালনে।”
ঈশানের দু চোখে নোনাজল নেমে এসেছে। লাবণ্য এই বিষয়ে কিছুই জানত না। সে যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মৃদু হাওয়া এসে ধ্যান ফিরাল লাবণ্য’র। ততক্ষণে ঈশান বেরিয়ে গিয়েছে।
“ঈশান, কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“ওকে ডাকিস না লাবণ্য।”
“এটা কি হলো? ঈশান, ছোঁয়াকে…।”
“অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে।”
“অলকের সাথে রিলেশন হওয়ার আগে থেকে?”
“হুম। ছোঁয়া ও পছন্দ করে।”
“মানে টা কি?”
“এর পেছনের কারণটা আমি বলতে পারব না লাবণ্য। তবে একটা কথা,যা হয়েছে তা ভীষণ অনুচিত।”
অভিরাজ চলে গেলেও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লাবণ্য। ওর শরীর মৃদু আন্দোলিত হলো। এর পেছনের কারণটা বুঝি খুবই ভয়ঙ্কর?
ছিমছাম গড়েনের উষশী ধীর গতিতে পথ চলছে। তার পাশে আজ কোকো নেই। প্রায় সময় কোকো কে ছাড়াই অবস্থান করে সে। অথচ একটা সময় প্রাণীটাকে চোখে হারিয়েছে। হারিয়েছে কি, এখনো হারায়। প্রাণীটা ওর ভীষণ আপন। মেয়েটির মৃদু পায়ের গতিতে অনুসরণ করছে অভিরাজ। সে খুব ধীর স্থির ভাবে আগাচ্ছে। মনের ভেতর এত প্রশ্ন থাকলেও সেগুলোকে বাড়তে দিচ্ছে না। উষশী’র দু চোখের ভাষা পড়তে চাইছে। নিজের থেকে কিছু দূরে অভি’কে দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে মেয়েটির। বিশ বছর বয়সী সে যেন সেই কিশোরীতে ফিরে যেতে চাইছে। ছুটে গিয়ে ছেলেটার বুকে মাথা নুইয়ে দেওয়া’র ইচ্ছে হয়। অথচ এমনটা সম্ভব নয়।
“কিছু সময় হবে?”
হু না কিছুই বলল না মেয়েটি। অভি সম্মতি বুঝে নিয়ে বলল,”ঐদিকটা চলো। এখানে অনেক ক্রাউড।”
ভদ্র মেয়েটির মতো এগিয়ে গেল উষশী। অভিরাজ এর ঠিক পাশে বসতে নিয়েও বসল না। মেয়েটি দূরে অবস্থান করায় অভিই এগিয়ে গেল। দূরত্ব মিটিয়ে নিল। একটা সুবাসে ভরে উঠল তার মন।
“পেছনের কিছু জানতে চাইব না। শুধু একটাই প্রশ্ন।”
পথিমধ্যে থেমে রইল অভিরাজ। উষশী তার দিকে পূর্ণ নজর দিল এবার। দুজনের চোখাচোখি হলো। পাঁচ বছর পূর্বের মতো লাজুকহীন ভাবে চেয়ে আছে তারা।
“এখনো ভালোবাসো আমায়?”
এ প্রশ্নের বিপরীতে রকমারি উত্তর দেওয়ার অপশন থাকলেও অভি জানে এর উত্তর একটাই। তবু সে উষশী’র মুখ থেকে শুনতে চায়।
“আনসার মি উষশী।”
“এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।”
“হ্যাঁ ধরে নিব তবে?”
“পাঁচ বছর পূর্বে সব ছেড়ে এসেছি আমি।”
“তবে কি মিথ্যে ছিল আমাদের ভালোবাসা?”
দুজনেই মৌন হয়ে গেল। খানিক বাদে উষশী বলল,”আমার কাছে সময় নেই। আমি আসছি।”
“এভাবে চলে যাওয়ার মানে নেই উষশী।”
“আমাকে সান বলে ডাকলে খুশি হব।”
“কিন্তু তুমি তো আমার উষশী। আমার রেইন।”
“পুরনো দিন স্মরণ করবেন না অভিরাজ। এতে কষ্ট ছাড়া কিছুই মিলবে না।”
হাওয়াই মিঠাই এর মতো মিলিয়ে গেল উষশী। তার বাদামি রঙের চুলের শুভ্রতা আজও অভিরাজের শরীর জুড়ে মেখে আছে। অথচ পা ষা ণ মেয়েটি কি না অতীত স্মরণে নিষেধ করে গেল!
ছোঁয়া’র শারীরিক স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো নয়। মালতি মেয়ের পাশে বসে আছেন। একটা মাত্র সন্তান ওনার। বড়ো আদরে মানুষ করেছেন। স্বামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় বিদেশেই গত করেছেন। ওনার জীবনের সবটুকু আলোর নাম ছোঁয়া। মেয়ের পাশে বসে সারারাত কেঁদেছেন তিনি। ইমার্জেন্সি টিকেটে দেশে এসেছে ঈশান। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে। অলক এসে ওকে দেখে অসন্তোষ হলো। কঠিন স্বর নেমে এল।
“এখানে কি করছ ঈশান?”
নিজের মলিন মুখটা স্বাভাবিক করল ঈশান। অলকের চোখে মুখে অপ্রত্যাশিত বিরক্তির ছাপ। তবু গায়ে মাখল না ছেলেটা।
“ছোঁয়া কে দেখতে এসেছি।”
“ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে?”
“হ্যাঁ।”
“আর কেউ কেন এল না? শুধু তুমিই কেন এলে?”
“কেমন প্রশ্ন করলে অলক?”
“প্রশ্নটা যুক্তিসম্মত। ছোঁয়া’র হাসবেন্ড আমি। ওর বিষয়ে কেউ এক পা আগালে তা জানার অধিকার আছে আমার।”
একটা রাগ এসে স্পর্শ করে গেল ঈশানের চোখে মুখে। তার চোয়ালের পেশি উঠানামা করছে। অলক এগিয়ে এসে ঠিক বরাবর দাঁড়াল।
“আমার স্ত্রী’র প্রতি কারো নজর আমি সহ্য করব না ঈশান সিনহা।”
“ছোঁয়া তোমার স্ত্রী হওয়ার পূর্বে আমার কাজিন। সেটা ভুলে যেও না অলক।”
“শুধু কাজিন হলে আসলেই সমস্যা ছিল না আমার।”
ওর বিদ্রুপ মাখা কথাটা সহ্য হলো না ঈশানের। রাগের বসে কলার চেপে ধরল।
“তুই কি ভেবেছিস,এত সহজে আমার হাত থেকে মুক্তি পাবি? মোটেও না। জোর করে সম্পর্ক করেছিস ওর সাথে। কখনো তোকে ভালোবেসেছে? কখনো ভালোবাসে নি। একটা আগা গোড়ায় ব্যন্ডেজ করা সম্পর্কের কোনো মানে হয় না। এর শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকিস।”
হুট করেই অলক হেসে উঠল। কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”এই রাগ গুলো নিজের বাবা মায়ের উপর দেখালে কাজে দিবে ঈশান। অন্তত কিছু পাপ তো নামবে।”
“আমার মা বাবা নিয়ে একটা কথা বললে তোর জ্বিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব অলক।”
ওদের চেচানোর শব্দে চারপাশের মানুষজন কেমন করে তাকিয়ে আছে। একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি’র সৃজন হয়েছে। ঈশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”পরে দেখে নিচ্ছি।”
সবটা শোনার পর অভিরাজ বলল,”তোমাকে নিষেধ করেছিলাম অলক। কেন এমনটা করলে?”
“আমি বাধ্য হয়েছি ভাইয়া। আমার স্ত্রী’র দিকে অন্য পুরুষ ভালোবাসার চোখে তাকাবে আমি সেটা মেনে নিব না।”
“শোনো অলক,ঈশানকে এই বিষয়ে আর একটা কথাও বলবে না। আর এত গুলো কথা বলার কোনো অধিকার নেই তোমার। মেয়েটি এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল তোমার বেখেয়ালের জন্য।”
তারপরই রাগ মিশ্রিত কণ্ঠটা নিভে গেল। অভি কল কেটে দিয়েছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে অলক। ভেতরে ছোঁয়া। নিস্তেজ হয়ে আছে। ওর শরীরের তপ্ততা যেন এত দূর থেকেও অনুভব হচ্ছে। সেই সাথে বুকের মধ্য ভাগে বাড়ছে ক্ষ ত। ভালোবাসা কি তবে,শুধু দহন ই দেয়?
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি