#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৫৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
“হোয়াট রাবিশ রূপল। যে কি-না তোমাকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসল না তুমি এখনও তাকে প্রেমিকা ভাবছ? তার জন্য কী-না একসময় হাতের শিরা কেটে সু’ই’সা’ইড করতে বাধ্য চেয়েছিলে? এখন আবার তার বিয়ে ভাঙতেও যাচ্ছ? হাউ ফানি ইয়ার!”
আরিয়ানের কথায় থমকালো রূপল। ল্যাকেজ গোছানো বন্ধ করে দিলো। সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেল সে। নিথর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকা আরিয়ানের দিকে। মুহূর্ত কয়েক বাদে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রূপল। মৌনতা ভুলে গলায় রুক্ষতা এনে প্রত্যত্তুরে বলল,
“সে আমাকে ভালোবাসেনি কে বলল? আমি বিশ্বাস করি আজও সে আমাকে ভালোবাসে! আমার ফিরে যাব সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে। বরং তাকে ভুল বুঝে দূরে সরে এসে আমি জীবনের সবচেয়ে বড়ো বোকামিটা করেছি! জীবন থেকে দেড় দেড়টা বছর হেলায় নষ্ট করেছি। আজ এই সময়ে দাড়িয়ে আমি বুঝতে পারছি যে, একটা মেয়ে তার পরিবারের কাছে কতটা অসহায় আর কতটা অনুগত। চাইলেও তারা পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারেনা। সেদিন যখন নীহু তার ভাইয়া ও আমার মধ্যে তার ভাইয়াকেই বেছে নিয়েছিল সেদিন আমি জীবনের সবচেয়ে বড়ো আঘাতটা পেয়েছিলাম! সইতে পারিনি আমি সেই আঘাত। বাধ্য হয়ে সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম। হসপিটালের বেডে শুয়ে যখন জীবন মরণের সাথে লড়াই করছিলাম তখনও আমি নীহুকে আমার আশেপাশে এলাউড করিনি! ভাগ্যবশত যখন মরণ পথ থেকে বেঁচে ফিরি তখনও ক্ষোভ থেকে আমি নীহুর থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য কানাডায় চলে আসি! পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিই! তবে আর নয়। অনেক হয়েছে অহেতুক রাগ, অভিমান, ভুল বুঝাবুঝি, দুঃখ, যন্ত্রণা, দূরত্ব। এখন তো নীহুকে বিয়ে করতে ও আমার কোনো বাঁধা নেই। একবছরে মোটামুটি স্যাটেল্ড হয়ে গেছি আমি। তার দায়িত্ব নেওয়ার যথেষ্ট সামর্থ্য হয়েছে আমার। এবার কেউ আর আমাকে আটকাতে পারবেনা। নীহুর থেকে আমাকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা। তাকে আপন করে নেওয়াটাই হলো এখন আমার মূল লক্ষ্য।”
কথা শেষে রূপল কয়েকদফা রুদ্ধশ্বাস ফেলল। ক্লান্ত হয়ে এলো সে। ল্যাকেজ গোছানো শেষে হ্যাঙারে ঝুলন্ত এ্যাশ কালারের শার্টটি গাঁয়ে জড়ালো। ঠোঁটের কোণে লেগে রইল তার আলতো হাসির রেখা। নীহারিকার ভাবনায় মত্ত সে। তার রুহ্ যেন পড়ে আছে এখন নীহারিকার কাছে। কখন সে বাংলাদেশে ল্যান্ড করে তার অতৃপ্ত চোখদুটো নীহারিকাকে দেখে তৃপ্ত করবে সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে আছে। বিয়ে ভাঙার ব্যাপারটাও তাকে দ্রুত কনফার্ম করতে হবে। প্রয়োজনে এবার সে নিহালের হাতেপায়ে ধরবে! তবুও বিয়ে আটকে ছাড়বে।
এতক্ষণ যাবত রূপলের কথাগুলো বসে বসে ধ্যান করছিল আরিয়ান। ধ্যান ভেঙে সে হঠাৎ সন্দিহান গলায় ব্যস্ত রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“এতকিছুর পরেও কী নীহারিকা তোমাকে গ্রহণ করবে রূপল?”
শার্টের বোতম লাগানো থামিয়ে দিলো রূপল। পিছু ঘুরে আহত দৃষ্টি ফেলল আরিয়ানের দিকে। তার সংশয়ও ঠিক এখানেই ছিল! নীহারিকা আদোতে তাকে মেনে নিবে তো? নাকি চাপা অভিমানকে প্রশ্রয় দিয়ে তাকে আবার দূরে সরিয়ে দিবে? তার ভেতরটাকে আবারও ভেঙেচূড়ে গুড়িয়ে দিবে না তো? তবে এবার আর ভাঙা মন নিয়ে ফিরবেনা রূপল। ভালোবাসার জোর খাঁটাবে! যত যাই হয়ে যাক না কেন নীহারিকাকে এবার তার হতেই হবে। তার ভালোবাসার কাছে নীহারিকাকে এবার হার মানতেই হবে। পরিস্থিতি যেমন সে বিগড়ে দিয়েছে তেমন ঠিকও করবে!
মুহূর্তেই ব্যগ্র হাসল রূপল! ভ্রু নাচিয়ে সন্দিহান আরিয়ানের দিকে তাকালো। চুলটা ঠিক করে ফিচেল স্বরে বলল,
“রূপল চাইলে সব সম্ভব ডুড। এবার হোক তা ভালোবাসার ক্ষেত্রে কিংবা শত্রুদের ঘায়েল করার ক্ষেত্রে! এতদিনে নিশ্চয়ই রূপলকে ভালোভাবে চেনা হয়ে গেছে তোমার?”
আরিয়ানের ঠোঁটের কোণেও ফুটে উঠল ক্রুর হাসির রেখা! লাফ দিয়ে সে বিছানা থেকে ওঠে দাড়ালো। দুষ্টু ভাব নিয়ে হুট করে রূপলের কোমরে থাকা টাওয়ালটি টেনে খুলে ফেলল! হাত থেকে টাওয়ালটি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দৌড়ে পালালো রুম থেকে। বাঘা রূপল যেন তাকে অ্যাটাক করতে না পারে তাই সে বাইরে থেকে দরোজার খিল আটকে দিলো! উচ্চ শব্দে হেসে রূপলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সেদিনের কথা আমার আজও মনে পড়ে রূপল। মিস এলিনাকে তুমি কী গোলটাই না খাওয়ালে! ইউ আর অ্যা জিনিয়াস বস! দোয়া করি রূপল, তুমি যেন তোমার উদ্দেশ্যে সফল হও। নীহারিকা ভাবির মন জয় করে নাও।”
রাগে ফুঁসে ওঠে রূপল মেঝে থেকে টাওয়ালটি তুলল। কোমরে টাওয়ালটি প্যাচিয়ে ছুটে গিয়ে দরোজাটি সশব্দে ধাক্কাতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“শুভ কাজে যাচ্ছি বলে তোমার সাথে ফাইট করলামনা আরিয়ান। তবে যদি আবারও এই দেশে ফিরে আসি তো এর রিভেঞ্জ কিন্তু আমি নিয়েই ছাড়ব!”
___________________________________
মেহেন্দি আর্টিস্টরা নীহারিকার দু-হাতে মেহেন্দি লাগিয়ে দিচ্ছে। তা বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে নীহারিকা। বিয়েতে দুই হাত ভরে মেহেন্দি পড়ার মজাই আলাদা! মেহেন্দির অনুষ্ঠানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নীহারিকা আজ সবুজ রঙের একটি শাড়ি পরেছে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কানের দুল, গলার সেট পরেছে। চুলের মাঝ বরাবর সিঁথি করে সেই সিঁথিতে গলার সেটের সাথে মিল রেখে একটি টিকলি পরেছে। চুলগুলো দু-পাশে ছেড়ে দিয়েছে। মাথায় ছোটো ঘুমটা টেনে আর্টিস্টদের মেহেন্দি দেওয়া দেখছে। নীহারিকাকে দেখে বুঝা যাচ্ছেনা যে বিয়েতে অসুখী সে! নতুন আশায় বুক বাঁধছে সে। তবে কী রূপলকে ভুলে নীহারিকা এত সহজেই অন্য কাউকে গ্রহণ করে নিলো?
ড্রইংরুম জুড়ে আজ আত্নীয়-স্বজনদের ঢল নেমেছে। বিশাল মাদুর বিছিয়ে বসার জায়গা করা হয়েছে মেঝেতে। যেহেতু আজ মেহেন্দির প্রোগ্রাম তাই সবাইকে মেঝেতেই বসতে হবে। পাশেই স্পিকারে ফুল ভলিউমে গান বাজছে। ছেলেফেলেরা কিছুক্ষণ পর পর গান পাল্টাচ্ছে। মনের মত গান খুঁজে পাচ্ছেনা তারা। মহল মোটামুটি জমেই উঠেছে। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়ার মহিলারাও বেশ আগ্রহ নিয়ে নীহারিকার হাতে মেহেন্দি দেওয়া দেখছে। আর্টিস্টদের অনেক প্রশংসাও করছে তারা। সেই সাথে মারজিনা বেগমের সার্ভ করা কোল্ড ড্রিংকসও খাচ্ছে। ছোটো ছোটো মেয়েরা তো বায়না ধরেছে তারাও হাতে মেহেন্দি পরবে। নীহারিকার আশেপাশে হাত পেতে বসে আছে তারা। এরমধ্যে হৃদিও রয়েছে! নীহারিকাকে বড্ড জ্বালাতন করছে সে। সেই কখন থেকে হৃদি নীহারিকার কানের পর্দা ফাটিয়ে বলছে মেহেন্দি আর্টিস্টদের বলতে তাকে আগে একটু মেহেন্দি পরিয়ে দিতে! ফ্রেন্ডসদের সাথে একটু পরেই নাচতে হবে তাকে! নীহারিকার বিয়েতে নাচবে বলে টানা দুইদিন নাচ প্র্যাক্টিস করেছে সে। হৃদির জ্বালাতনে অধৈর্য্য হয়ে নীহারিকা এবার মুখ খুলল। তার ডান হাতে মেহেন্দি পরাতে থাকা আর্টিস্টকে ডেকে সে নমনীয় সুরে বলল,
“আপু? আমার এই হাতে তো মেহেন্দি দেওয়া প্রায় শেষের দিকে। এখানেই ডিজাইনটা একটু স্টপ রাখুন প্লিজ! আমার দুষ্টু মেয়েটার হাতে একটু মেহেন্দি লাগিয়ে দিন তো। অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাতন করছে সে।”
নীহারিকার আবদারে বিরক্তবোধ করলেন মেহেন্দি আর্টিস্ট! নাকমুখ কুঁচকে তিনি বিব্রতকর গলায় বললেন,
“সরি ম্যাম। এক হাতে একটানা মেহেন্দি পরাতে না পারলে আমার কন্সেন্ট্রেশন ব্রেক হবে। ডিজাইনটা খাপছাড়া হয়ে যাবে। দেখতে বিশ্রী দেখাবে। কাইন্ডলি তাকে আর একটু ওয়েট করতে বলুন ম্যাম। আপনার মেহেন্দি দেওয়া তো প্রায় শেষের দিকেই।”
অসহায় দৃষ্টিতে নীহারিকা ঠোঁট উল্টে হতাশ হৃদির দিকে তাকালো। রাগ নিয়ে হৃদি ফুলে ফেঁপে ওঠে বুকের উপর দু-হাত গুজে মাথা নুইয়ে বসে রইল। নিশ্চল দৃষ্টিতে নীহারিকা একধ্যানে তাকিয়ে রইল হৃদির অভিমান মিশ্রিত রক্তিম মুখশ্রীর দিকে। এই দেড় বছরে অনেকটাই বড়ো গেছে হৃদি। চেহারার আকৃতি ও গাঁয়ের রঙ পাল্টে হুবহু রূপলের কার্বন কপি হয়ে গেছে! এর মাঝে হঠাৎ রূপলের কথা মনে পড়ে যেতেই নীহারিকার মন কেঁদে উঠল! শান্ত মুখের গড়ন তার অশান্ত হয়ে উঠল। চেহারার উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে এলো। চোখজোড়া জল নিয়ে সে মাথা নুইয়ে নিলো। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সে হয়ত এতক্ষণে চিৎকার করে কাঁদত! মন থেকে যাকে একবার মুছে ফেলেছে সে তাকে নিয়ে তো দু’বার ভাবাটাও পাপ! সেখানে চিৎকার করে কাঁদার প্রসঙ্গ উঠতেই পরক্ষণে নীহারিকার বড্ড হাসি পেল!
গত দুইদিন ধরে কাজকর্মের অনেক চাপ যাচ্ছিল নিহালের উপর। বিয়ে বাড়ির কাজ বলে কথা। খুটিনাটি সব দিকেই তার নজর রাখতে হচ্ছে। শরীরের দুর্বলতা থেকে নিহাল বাধ্য হলো কাজ ফেলে তার বেডরুমে আসতে। ধপ করে বিছানার উপর পরল সে। চোখ জোড়া বুজে কপালে হাত রেখে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। তখনই রুমে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ঘটল। শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে পিয়াসা এলো! মাথা নুইয়ে সে অপরাধী গলায় নিহালকে ডেকে বলল,
“নিহাল শুনছেন? আপনার শরবত।”
পিয়াসার গলার আওয়াজ পেয়ে মুহূর্তেই যেন নিহালের গরম মাথাটা আরও গরম হয়ে গেল! কপাল থেকে হাত সরিয়ে সে ঝট করে চোখ মেলল। রক্তিম চক্ষুতে পিয়াসার দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ শোয়া থেকে ওঠে গেল। বদরাগী গলায় শুধালো,
“আমি বলেছি আমার শরবত লাগবে?”
ভয়ে থুত্থুর করে কেঁপে উঠল পিয়াসা! শরবরতের গ্লাসটি হাতে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। যদিও নিহালের এই রূপ তার এখন আর অচেনা নয় তবুও নিজেকে মানিয়ে নিতে তার সময় লাগছে! শঙ্কিত গলায় সে জবাবে বলল,
“বলেননি। তবুও…
“এত দরদ দেখানোর প্রয়োজন নেই ওকে? আমার যখন যা প্রয়োজন হবে নিজের হাতেই করতে পারব। এই একই কথা আমি গত পাঁচমাস ধরে আপনাকে বুঝাতে বুঝাতে হাঁপিয়ে উঠছি।”
প্রতিবারের মত এবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পিয়াসা। ভরাট দু’চোখে রোষাগ্নি নিহালের দিকে তাকালো। আহত গলায় শুধালো,
“আপনি এমন কেন বলুন তো? রঙ এত পাল্টান কেন? বাড়ির সবার সামনে প্রকাশ্যে আপনি আমার সাথে এক ব্যবহার করেন তো সবার অগোচরে চার দেয়ালের মাঝে আবার অন্য রকম ব্যবহার করেন। একবছর তো ছিলাম আপনার থেকে দূরে তাইনা? এরপরেও কীসের এত দম্ভ আপনার? কেন আপনি আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন বলুন তো? অন্যায় করার বিনিময়ে শাস্তি তো কম দেননি আমায়। আর কত শাস্তি দিবেন?”
চট করে পিয়াসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো নিহাল! পিয়াসা শুনতে চাইল তাই কঠিন গলায় সে জবাবে পিয়াসাকে বলল,
“মন থেকে ওঠে গেলে কী করার?”
“তাহলে সোজা ডিভোর্স দিয়ে দিন!”
তড়াক করে নিহাল ক্রন্দনরত পিয়াসার দিকে তাকালো। ডিভোর্সের কথা শুনে তার বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল! তবে খারাপ লাগা বুঝাতে চাইল না সে। মুখের উদ্বেগী ভাব পাল্টে কঠিন ভাব ফুটিয়ে তুলল। পিয়াসার থেকে মুখ ফিরিয়ে সে রুম থেকে প্রস্থান নিতে নিতে বলল,
“যদি সম্ভব হতো তাও দিতাম! শুধুমাত্র আপনার অসুস্থ মায়ের দিকে তাকিয়ে আপনাকে একটা মিথ্যা সম্পর্কে বেঁধে রেখেছি! নয়ত সেই কবেই মুক্তি দিতাম।”
হনহনিয়ে হেঁটে রুম থেকে প্রস্থান নিলো নিহাল। হতবাক দৃষ্টিতে পিয়াসা তাকিয়ে রইল নিহালের যাওয়ার পথে। হাত থেকে শরবতের গ্লাসটি পড়ে গেল তার! হঠাৎ শোকে মাথা ঘুরে মেঝেতে পরে গেল সে!
নীহারিকার দু-হাতে মেহেন্দি দেওয়া মাত্র শেষ হলো। মেহেন্দি রাঙা দু’হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল নীহারিকা। কালো হাতে মেহেন্দির রঙ তেমন ফুটবেনা জেনেও সে খুশি! হৃদিকে তার জায়গায় বসিয়ে দিয়ে সে বসা থেকে ওঠে দাড়ালো। পা দুটো ঝিমঝিম করছে তার। এক্ষুণি পা দুটি না ঝারলে নয়। তখনি সজল ও শাকিল ব্যস্ত ভঙ্গিতে ক্যামেরা নিয়ে এলো নীহারিকার মেহেন্দি রাঙা হাতের ফটোশুট করতে। হাসিমুখে নীহারিকা ফটোশুট করতে ব্যস্ত হয়ে গেল! নীহারিকার হাতের ছবি তুলতে তুলতে শাকিল ও সজল নীহারিকাকে কৌশলে বাড়ির পেছনের দিকটায় নিয়ে এলো!
হুট করে তখন ঐদিকের সমস্ত আলো নিভে গেল! ভয়ে ঘাবড়ে উঠল নীহারিকা। নিভু দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালো। বিরক্তিকর গলায় বলল,
“ওত্তেরি। কারেন্ট যাওয়ার আর সময় পেলোনা?”
ভীতসন্ত্রস্ত গলায় নীহারিকা শাকিলকে বলল,
“ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করো শাকিল। আমার অনেক ভয় করছে।”
মুহূর্তেই নীহারিকার চোখের সামনে আলো জ্বলে উঠল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে নীহারিকা তার সামনে স্বচ্ছ দৃষ্টি ফেলতেই হাসিখুশি মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে এলো! চোখের স্বস্তি উড়ে গেল। মনের শান্তি নষ্ট হলো। পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের লোকটি যে তার সামনে দাড়িয়ে! কীভাবে সম্ভব তা? কানাডা থেকে তো তার আগামী পাঁচ বছরেও ফেরার কথা না। মাথা ঝাকালো নীহারিকা। সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার সামনে তাকালো। এবারও তার কাছে এটা স্বপ্ন বা অকল্পনীয় কিছু মনে হলোনা! তবে কী লোকটি উদ্দেশ্যপ্রবণভাবে আবারও তার জীবনের সমস্ত সুখ কেড়ে নিতে এসেছে?
হতভম্ব নীহারিকার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রূপল! চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেল সে। প্রেয়সীর ব্যাকুল দু’চোখে তাকিয়ে ভালোবাসা খুঁজতে লাগল। তবে হায়। ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পেলনা চোখে। রীতিমত নিরাশ হলো রূপল৷ চোখে জল জমে এলো তার। শুকনো গলায় শুধালো,
“তার মানে তুমি সত্যি সত্যিই রাজি এই বিয়েতে?”
নির্ভীক রইল নীহারিকা। ক্ষুদ্রতম আবেগও প্রকাশ করলনা। রূপলের থেকে দৃষ্টিও নত করলনা। সমানে সমানে দাড়িয়ে কঠিন গলায় বলল,
“হ্যাঁ তো? আমাকে দেখে মনে হচ্ছেনা?”
“মনে হলেও বিশ্বাস করতে পারছিনা!”
এই বলে রূপল ক্ষুব্ধ হয়ে তার হাতে থাকা ফোনটি শুকনো ঘাসের উপর ছুড়ে ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে নীহারিকার দু-বাহুতে হাত রেখে তাকে ঝাকাতে লাগল। তেজী গলায় বলল,
“সামান্য অভিমান থেকে তুমি জীবনের এত বড়ো কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে পারোনা নীহু। কাইন্ডলি একবার বলো কার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? তোমাকে আর কিছু করতে হবেনা। জাস্ট এতটুকুই বলো।”
নিথর হয়ে দাড়িয়ে রইল নীহারিকা। রূপলের দিকে ভাবশূণ্য দৃষ্টিতে তাকালো সে। আঙুল দ্বারা ইশারা করে তাদের থেকে একটুখানি দূরে দাড়িয়ে থাকা সজলকে দেখালো! উদ্দেশ্যপ্রবলভাবে বলে উঠল,
“সজল!”
রূপলের পাশাপাশি সজলও চমকে ওঠে চিৎকার করে উঠল! রূপল এবং সজল দুজনই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“হোয়াট?”
শাকিলও তাদের সাথে সাথে বোকা বনে গেল! গোল গোল চোখে হা করে দাড়িয়ে থাকা সজলের দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় শুধালো,
“সিরিয়াসলি? তুই নীহারিকা আপুর উডবি?”
রূপলকে পুরো দমে উল্লু বানিয়ে নীহারিকা হনহনিয়ে হেঁটে সজলের গাঁয়ের সাথে ঘেঁষে দাড়ালো। হতবাক রূপলের দিকে তাকিয়ে সে জোরপূর্বক হাসল। বিড়বিড় করে সজলকে শাসিয়ে বলল,
“যেভাবেই হোক তোমার ভাইয়াকে বিশ্বাস করাও যে তুমিই আমার উডবি! নয়ত সানিয়ার সাথে তোমার ব্রেকাপ কনফার্ম!”
বিচলিত দৃষ্টিতে সজল পাশ ফিরে নীহারিকার দিকে তাকালো! অন্তরআত্তা কেঁপে উঠল তার। কপাল চাপরাতে লাগল সে। মাথা নুইয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমি আপনার কোন জন্মের শত্রু ছিলাম বইন? কেন আপনি আমাকে এই মাইনকার চিপায় ফাসালেন? কার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হইছে তা ভাইয়াকে ডিরেক্টলি বলে দিলেই তো হয়। আমিও বেঁচে যাই আপনিও বেঁচে যান।”
“বলা যাবেনা! এটা টপ সিক্রেট। তোমাকে যা বলতে বলছি তাই বলো। নয়ত সানিয়ার সাথে…
রূপলের হটকারি রূপ এবার হিংস্র হয়ে উঠল। রক্তশূল দৃষ্টিতে তাকালো সজলের দিকে। ক্রমশ আক্রমন প্রবণতা বাড়ছে রূপলের। এই বুঝি তেড়ে এসে ধরে ফেলবে তাকে। ভয়ে ‘কিডনি’ শুকিয়ে এলো সজলের! বুকে হাত চেপে ধরে সে দুরুদুরু গলায় বলল,
“সানিয়ার থেকেও বড়ো ঠাকুরের কাছেই তো আমাকে ফাঁসিয়ে দিলেন আপনি! তার চোখই তো বলে দিচ্ছে আজ আমার শেষদিন। জীবনের বড়ো কোনো শখ আহ্লাদ পূরণ করারও আর সময় পেলামনা! আহারে আমার সানিয়া! কত আশায় বুক বেঁধে আছে আমার বাচ্চার মা হবে। এখন তো বিয়ে শাদি করার আগেই তাকে বিধবা হতে হবে! সাদা থান পড়ে ঘুরে বেড়াবে আমার মা বাবাও বুঝি তাদের নায় নাতকুরের মুখ দেখতে পারবেনা।”
তখনি পাশ থেকে শাকিল হুড়োহুড়ি করে সজলের হাত থেকে তার ওয়াচটি খুলে নেওয়ার চেষ্টা করল! দ্রুত স্বরে বলল,
“দাড়া ভাই দাড়া। মরার আগে তো আমার ওয়াচটা আমাকে দিয়ে যা! যাক বাবা ফাইনালি তোর মত ছ্যাঁচড়া কাজিনের হাত থেকে মুক্তি মিলবে আমার! থ্যাংকস রূপল ভাইয়া। তোমাকে ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস।”
#চলবে…?
[না মানে আজকের পর্ব লিখতে গিয়ে আমারও মাথা ঘুরিয়েছে! নীহারিকা আসলে চাইছেটা কী?😑]