শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব ১৭

0
435

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৭||

★টেস্ট কিট হাতে দাঁড়িয়ে আরশ। থরথর করে কাঁপছে সে। এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে তার। হৃদস্পন্দন যেন বাতাসের গতিতে বেড়ে গেল। কাঁপছে তার ভোকাল কর্ড। স্বরনালী অসাড় হয়ে আসছে। চোখ ভর্তি জ্বল টলমল করছে। আরশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহিনের দিকে তাকালো। ফারহিন হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াতেই আরশ নিজের মুখ এক হাতে চেপে ধরল। আরশ দ্রুত ফারহিন কে বেডে বসালো। অস্থির কন্ঠে বলল-
“-বসো এখানে। এসব…
“- আপনার বাচ্চা খুব শীগ্রই আসবে।
আরশ হেসে দিলো। পেটে হাত বুলিয়ে দিতেই আরশের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আরশের চোখে পানি দেখে ফারহিন ভড়কে গেল। দুহাতে আরশের মুখ ধরে বলল-
“-আপনি কাঁদছেন কেন? খুশি হোন নি?
“-অনেক হয়েছি। আমি আমার খুশি বলে প্রকাশ করতে পারবো না। তুমি এমন একটা উপহার দেবে কল্পনাও করিনি৷
“-তাহলে কাঁদছেন কেন?
আরশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মৃদুস্বরে ডাকলো।
“-ফারহিন?
“-হুম?
“-আমি আমার বাবুকে কখনো একা রেখে কোথাও যাবোনা। আমার বাবুকে আমি সর্বোচ্চ সময় দেব। আমি কখনো ওকে আমার মত একা করে দেব না। আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড হবো, ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ হবো। ও হাত বাড়ালেই আমাকে ওর কাছে পাবে। আমি কখনো ওকে বা দিয়ে নিজের কথা ভাববো না। আমি বেস্ট বাবা হবো। তুমি দেখো, ও আমাকে ছাড়া কিছু বুঝবেই না। ও তোমার কাছে কম আমার কাছে বেশি থাকবে।

আরশের চোখে পানি টলমল করছে। ঠোঁটের কোণে হাসি। ফারহিন আরশের মাথায় হাত রাখলো। মৃদুস্বরে বলল-
“-বাবার কথা মনে পড়ছে?
আরশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
“-আমার বাবুর খেয়াল রেখো, ওর কোনো কমতি হতে দিও না বউ।
“-আপনি তো আছেনই! আপনি থাকতে আমার এত চিন্তা নেই।
কথাটা বলেই ফারহিন মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চুমু দিলো আরশের কপালে। আরশ ফারহিনের বুকে মাথায় রেখে বলল-
“-আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না তো?
“-আমি কেন আপনাকে ভুল বুঝবো?
“-তুমি বলেছিলে আমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি আসবেনা, কোনো থার্ড পার্সন এসে যদি তোমাকে কিছু বলে তাহলে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে না তো?
“-আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা আরশ। আপনার আর আমার মাঝে ভালোবাসা ছাড়া কেউই আসবেনা, কেউ না।
“-ফারহিন?
“-হুম?
“-আমি যা করেছি শুধু তোমার জন্য করেছি। তোমাকে ভালো রাখতে তোমাকে কাছে পেতে করেছি।আমি সব সময় তোমার মাঝে নিজেকে দেখতে চেয়েছি, আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে কখনো এত তীব্রভাবে চাইনি। তুমি আমার কাছে গোটা একটা পৃথিবী। তুমি যদি কখনো দূরে চলে যাও আমি বাঁচবো না ফারহিন। আমি সত্যিই তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। তোমার আগে আমার কাছে কিছু না, আমি নিজেও না।
“-আপনি চিন্তা করবেন না, কেউ কখনো আমাকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। পৃথিবীর বুকে এমন কেউ নেই যে ফারহিনকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। আপনি আমার আবেগ না আরশ, আপনি আমার ভালোবাসা।

★হাতে থাকা কাঁচের গ্লাস মাটিতে পড়ে ঝংকার তুলল। ভেঙে টুকরোতে পরিণত হলো। সালমা ধপ করেই বসে পড়লো বেডে। কানে ধরে রাখা ফোন কাঁপছে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো অস্থির এক কণ্ঠস্বর-
“-খালামনি তুমি ঠিক আছো?
তীব্রের ডাকে ধ্যান ভাঙলো সালমার।
“-হ..হ্যাঁ ঠিক আছি।
“-খালামনি আমি যা বলেছি তুমি শুনেছো তো? ওই আরশের কাছ থেকে দূরে থাকো। তুমি বেরিয়ে আসো প্লিজ।
“-কিন্তু ফারহিন..
“-ফারহিন কে পরে বুঝানো যাবে। আপাতত তুমি চলে এসো। আরশ খুবই ভয়ংকর খালামনি। আমি চাইনা তোমারও কিছু হোক।
“-আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তীব্র। আরশ কীভাবে…
“-আরশ এর আগেও খুনের মত জঘন্য কাজ করেছে খালামনি। ওর কাছে এসব কিছুই না। ও আজ যেই ফারহিনের জন্য এত কিছু করেছে, নিজের বাবাকে মেরে ফেলেছে, সেই ও নিজেই ফারহিনকে আঘাত করতে দুবার ভাববে না যদি ফারহিন ওর কাছ থেকে সরে আসতে চায়। ফারহিনের জন্য ও অনেক বিপদজনক। ফারহিনের মাথার উপরে আজ ছায়া নেই তা শুধু ওর জন্য। আঙ্কেল কেও আরশই মেরেছে।ওইদিন ওই এক্সিডেন্ট আরশই করিয়েছে। কারণ আঙ্কেলদের শত্রু ফারহিনকে আঘাত করেছিলো তাই।

সালমা চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা জল। সালমা ফোন কেটে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে হাটতে হাটতে আরশের রুমের সামনে গেল। দরজা খোলা ছিলো। পর্দা সরাতেই সালমা দেখলো আরশের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ফারহিন। আরশ হেলান দিয়ে বসে আছে, সেই অবস্থাতেই ঘুম। আরশের এক হাত ফারহিনের মাথায় যা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না এতক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো সে। সালমার ঠোঁটের কোণে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। সালমা এতদিনে একবারও আরশকে দেখেনি ফারহিনকে অবহেলা করতে। আরশের কাছে ফারহিন সুখে আছে। বাবা মারা যাওয়ার পর আরশ সবসময় ফারহিনকে সময় দিয়েছে। ফারহিন বাবার শোক কাটিয়ে উঠেছে খুব অল্প সময়ে। ফারহিনের যত্নের বিন্দুমাত্র ক্রুটি রাখে নি। অফিস যাওয়ার আগে নিজে সব কাজ করে যেত। ফারহিনের জন্য আরশ নিজের হাতে রান্না করে। মাঝে মাঝে ফারহিনকে অফিসেও নিয়ে যেত। কখনো কখনো হাফ টাইমে ফেরত চলে আসতো অফিস থেকে। ফারহিন কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ফারহিনের মন ভালো করার জন্য আরশ সব করেছে। সালমা সরে এলো। হাটতে হাটতে ছাদে গেল। ফিরে গেল নিজের অতীত এ। যেখানে দুঃখ, আঘাতের সাথে সাথে ছিলো কোনো এক বিপদজনক লোকের ভয়াবহ ভালোবাসা।

**ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর এক মাত্র মেয়ে ছিল সালমা বিনতে সোলায়মান। বাবার খুব আদরের ছিল। মেয়ের সমস্ত আবদার সবার আগেই ছিলো যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত কাজ ফেলে মেয়েকে সময় দেওয়া ছিলো তার কাছে প্রধান ও মুখ্য কাজ। মেয়েকে প্রতিদিন স্কুল থেকে নিয়ে আসতো নিজেই। সোলায়মান সাহেব ছিলেন অত্যন্ত সৎ,ও নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। গরীবের বন্ধু ছিলেন তিনি। তার সৎ কর্মের ফলাফল হিসেবে তিনি নিজেই সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করলেন খুব শীগ্রই। যার দরুন তার নাম ছড়িয়ে পড়ল শহরের কোণায় কোণায়। কোনো এক সম্মেলনে যাওয়ার কারণে একদিন তিনি তার মেয়ের স্কুলে আসতে পারেন নি। সেদিনই ঘটলো অঘটন। সালমার উপর নজর পড়লো এলাকারই একজন নাম করা দুর্নীতিবাজের। সালমা ভয় পেত স্কুলে আসা যাওয়া করতে। বাবাকে সবটা বলার পর বাবা একদিন তার লোকদের বলে তাকে হাজির করালো। সালমার এখনো মনে আছে প্রথম সাক্ষাতে দিদার হাসান আর তার বাবার মাঝে বেশ তর্কাতর্কি হয়েছিলো। যার কারনে লোকসম্মুখে চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলো যে, বেঁচে থাকতে তিনি তার মেয়ে এই ছেলের হাতে দেবে না। আর সেদিন দিদার হাসান প্রতুত্তরে বলেছিলো, ‘আপনার মেয়ে আমার ঘরেই আসবে। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আপনার মেয়ের অবস্থান বদলে দেব। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।’
ব্যস! এক সপ্তাহের মধ্যেই সালমা কে তুলে নিয়ে দুজনেই গায়েব হয়ে গেল। পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে ও নিজের মেয়েকে পায়নি সোলায়মান সাহেব। বছর দুইয়েক পর সালমা ফিরে এসেছিলো। নিজের মেয়েকে পেয়ে সোলায়মান যতটা খুশি হয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি আঘাত পেয়েছিলেন নিজের মেয়ের মুখে দিদার হাসানের সুনাম শুনে। সালমা বলেছিলো, ‘ আমি ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি বাবা। তুমি বিশ্বাস করো সে তোমার মত না হলেও সে আমাকে কখনো কোনো অনাদর, অবহেলা করে নি।’ মেয়ের কথা শুনে সোলায়মান স্ট্রোক করেছিলেন। মৃত্যুর কোলে তিনি ঢলে পড়েছিলেন। নিজের বাবাকে হারিয়ে সালমা পাথরের মত হয়ে গিয়েছিলো। তখন ফারহিন গর্ভে ছিলো। স্বামীর সাথে আর কখনো তার বনিবনা হয়নি। কারণ সে কখনো তার কাজ থেকে সরে আসেনি। দিন দিন আরো তলিয়ে গেল অবৈধ কালো ব্যবসার অতল গহীনে।
অতীত বিচরণ করতে গিয়ে সালমা প্রচন্ড তিক্ততার মুখোমুখি হলো। সালমা চোখের পানি মুছে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো। রুমে যাওয়ার আগে ফারহিন আর আরশের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পর্দা সরাতেই দেখলো ফারহিন আরশের বক্ষস্থলে। সালমার চোখ, মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সালমা মৃদু হেসে বলল-
“-আমি কখনো স্বামীর ভালোবাসা পাইনি ফারহিন। তোমার বাবা আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে বার বার। যার জন্য আমি সব হারিয়েছিলাম দিনশেষে আমি তাকেও পাইনি। আমার জীবনটা একটুও পরিবর্তন হয়নি ২০ বছরে। স্বামী স্ত্রী নামক সম্পর্কে দুজনে বাধা ছিলাম অথচ আমার প্রতি তার কোনো দায় ছিলো না। অথচ আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম শুধু মাত্র তার জন্য। তুমি অনেক ভাগ্যবতী ফারহিন। আরশ যা করেছে তোমার জন্য করেছে। যে চলে গেছে তার চলে যাওয়া নিয়ে আমি তোমাদের জীবনে কোনো অশান্তির সৃষ্টি করবো না। কারো না কারো হাতে তার পতন হতোই। তবে আমি ভাবিনি সেটা আরশ হবে। আরশ তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আরশের মত কেউ কখনো তোমাকে আগলে রাখতে পারবেনা। তোমার উপর আঘাত যে করেছে তাদের আরশ ছেড়ে দেয়নি। আর যাদের জন্য এই ঘটনা ঘটেছে তাদেরও সে ছেড়ে দেয়নি। হোক অপরাধ। এবার আমি এই অপরাধের সঙ্গই দেব। আরশকে কখনো কেউ তোমার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবেনা। আরশের ভালোবাসার শক্তি অনেক, অনেক মজবুত। আমি যা আমার জীবনে পাইনি তা তোমার জীবনে আসুক ফারহিন। আমি কাউকে তার বাধা হতে দেব না।

বলেই মৃদু হাসলেন সালমা। অতঃপর নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলেন।

চলমান…

রি – চেক করিনি, ভুল ক্রুটি মার্জনা করবেন। আগামীকাল আমি প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম তাই গল্প দিতে পারিনি। আমি জানিনা আমি কি এমন এই গল্পে উল্লেখ করেছি যার কারণে মানুষ আমার রুচি নিয়ে কথা বলছে। মানুষের তিক্ততায় ভরা মেসেজ আমার মন প্রাণ বিষিয়ে দিচ্ছে তবুও এটা তাড়াহুড়োতে শেষ করবো না। যেমন এন্ডিং ভেবেছি তেমনই থাকবে। আসসালামু আলাইকুম ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here