রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব ১

0
306

১,
“রিয়ানার সাথে তোর বিয়ে হলে কেমন হবে?”

“ঐ তাড়ছিড়া আধ-পাগল মেয়েকে বিয়ে কে করবে মা? মেয়েটার সংস্পর্শে তুমিও কি পাগল হতে চললে?”

“আমি তাড়ছিড়া আধ-পাগল কে বলেছে আপনাকে? আমি পুরো-টাই পাগল। এটা বুঝতে এখনও বাকি আছে আপনার?”

নিজের কথার মাঝে আচমকা নারীকণ্ঠ শুনতে পেয়ে দরজার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রায়াদ। দরজায় দাড়ানো মেয়ে-টিকে দেখে তার মুখের কথা ফুরিয়ে আসলো যেনো। সামনে অবস্থানরত মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোঁস করে দম ফেললো। এরপর বসা থেকে উঠে হনহনিয়ে হেঁটে তৎক্ষনাৎ মায়ের রুম ত্যাগ করলো সে। দরজার সামনে গিয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে অগ্নিচক্ষু বর্ষণ করে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে। ফাতেহা খানম ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখের চশমা খুলে শাড়ির আঁচলে মুছলেন। মেয়েটিকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন। মেয়েটি নিজের স্কার্ট দু’হাতে উঁচু করে আলগোছে হেঁটে ফাতেহা খানমের সামনে এসে দাড়ালো। ফাতেহা খানম বললেন,

“দাড়িয়ে আছিস কেনো তাড়ছিড়া? বোস এখানে।”

“আন্টি এট লিস্ট তুমি ঐ নাম টায় ডেকো না। আমার বিরক্ত লাগে, প্রচুর বিরক্ত লাগে।”

“নিজেই তো নিজেকে তাড়ছিড়া বলে উপস্থিত করলি! আমার ডাকা না ডাকায় কি যায় আসে?”

“আমার একটা কিউট নেইম আছে আন্টি, রিয়ানা । তুমি তুমি প্লিজ ওতো লম্বা নামে ডাকতে না পারো! রিয়ু বলো! আমি মেনে নিবো। বাট ঐ ওয়ার্ডে ডেকো না৷”

“চুপ কর, তোকে এতো পাকনামি করতে কে বলেছে?”

“আচ্ছা বাদ দাও, তোমার ছেলেকে আমায় বিয়ে করার কথা বললে কেনো তুমি?”

ফাতেহা খানম এবার ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলেন৷ চোখে চশমা-টা পরে ইতিউতি করে আশপাশে দেখতে লাগলেন। রিয়ানা নিজেও ফাতেহা খানমের দৃষ্টি লক্ষ্য করে চারপাশে নজর বুলিয়ে জিগাসা করলো,

“কিছু খুজছো আন্টি?”

“হ্যাঁ, পানির জগটা দেখছি না যে!”

“পানি খাবে তুমি?”

ফাতেহা খানম ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক ইশারা দিলেন। রিয়ানা নিজেই উঠে ফাতেহা খানমের রুম ছাড়লো। সে যেতেই ফাতেহা খানম হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যেনো। তিনি তো এমনিই ছেলের মনের ভাব বোঝার জন্য কথার ছলে জিগাসা করেন রিয়ানার কথা। কিন্তু কে জানতো মেয়েটার কাছেই সোজা ধরা পরে যাবেন! রিয়ানা গ্লাস ভর্তি পানি এনে ততোক্ষণে এসে পরে ফাতেহা খানমের রুমে। ফাতেহা খানম এক নজর রিয়ানাকে দেখে পানির গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে একদমে পানি টুকু পান করেন। পানি খাওয়া হতেই রিয়ানা বেড সাইড টেবিলে পানির গ্লাসটা রেখে কোমড়ে হাত দিয়ে জিগাসা করে,

“এবার বলো আন্টি উনার সাথে আমার বিয়ের কথা কেনো বলেছো?”

“এমনি, রায়াদের তো বিয়ের বয়সও হয়েছে। তাই ওর মনোভাব জানতে। এরবেশি কিছু না। তোরা দুটোই যে প্রাণী! তোদের বিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। একদম না।”

“এই তো আমার গুড গার্ল। রেস্ট করো। আমি আমার রুমে গেলাম, ঘুমাবো। তোমার মেয়ে কলেজ থেকে ফিরলে দয়া করে আমায় উঠিয়ে দিতে বলো। কেমন?”

রিয়ানা দু’হাতে ফাতেহা খানমের গাল টেনে দিয়ে কথাগুলো বললো। মনে হচ্ছে ফাতেহা খানম মেয়ে আর তাকে তার মা গাল টেনে দিলো। রিয়ানা দ্রুত পদে রুম ছাড়লো ফাতেহা খানমের। সে যেতেই ফাতেহা খানম হাফ ছাড়লেন। ভাবলেন, ‘তোকে আমার ছেলের বউ করে পেলে ভালোই হতো রে রিয়ু।’

২,
মায়ের রুম থেকে নিজের রুমে এসে বিছানায় বোসে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে রায়াদ। দুনিয়ায় আর মেয়ে খুজে পেলো না তার মা! একদম রিয়ানার কথা-ই বলতে হলো? মেয়েটি তাদের বাড়ির অতিথি। তার বাবার বেস্টফ্রেন্ডের মেয়ে। ৩মাস থেকেই চলে যাবে। সেই ছোটোবেলায় মেয়েটিকে দেখেছিলো একদম বাচ্চা অবস্থায়। এরপর তার বাবার বন্ধু দেশের বাইরে চলে গেলে মাঝখানে আর মেয়েটিকে দেখা যায়নি। ফোনে যদিও বা মেয়েটির বাবার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হতো! কিন্তু মেয়েটিকে দেখতোনা। সেই মেয়েটিকে দেখলো এতো বছর পর৷ কিন্তু দেশে এসে তার বাবার বন্ধু মেয়েকে নিজের সাথে না রেখে তাদের বাসায় কেনো রেখে গেলেন! বিষয়টা আজও বুঝে উঠতে পারেনি রায়াদ। একসপ্তাহ হলো এসেছে তাদের বাড়িতে আর তাতেই একদম তার মা তার গলায় মেয়েটিকে ঝোলানোর কথা ভেবে ফেললো! মেয়ে-টার মাঝে না আছে বাঙালি শিক্ষা! না আছে বাঙালি মেয়েদের মতো চালচলন। থাকবেই বা কি কারণে! বাবার অতি আদরের উচ্ছন্নে যাওয়া কন্যা। তারমাঝে থেকেছে জার্মানির মতো উন্নত দেশে। একটা মেয়ে যে কি করে এরকম হয়! মাথায় ঢোকেনা রায়াদের। যতোই বিদেশে থাকুক! বাঙালি মেয়ে তো!, বিদেশ গিয়েছে বলেই বাঙালিয়ানা ভু্লতে হবে? সে মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছেই বা কেনো? পুরো একটা বাসা! মানুষ তিনজন। রায়াদ, তার মা এবং মেয়েটি। শরীর-টা একটু খারাপ লাগায় আলসেমি করে ভার্সিটিতে যায়নি রায়াদ। মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে সে। পাশাপাশি বাবার ছোট্ট কাপড়ের বিজনেসে সাহায্য করে। আজ বাসায় থাকায় মায়ের কাছে গেলো একটু মায়ের সাথে সময় কাটাবে বলে! তার মা-ও মেজাজ টা বিগড়ে দিলো। নিজের বাড়ি ছেড়ে তিন মাস ধরে অন্যের বাড়িতে এসে থাকার কোনো মানে হয়! ঘুরতে মানুষ আসে, তাই বলে এতোদিন! বাড়ির মাঝে অপরিচিত কন্যার আনাগোনা রায়াদের অসস্তি অনুভব হয়। বাবা মা-কে বলেও তো লাভ নেই! আসেই না কোনোদিন সেভাবে! এসেছে যেতে কি করে দেয় তারা! নিজের বাড়িতেই নিজের অশান্তি লাগছে রায়াদের। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো রায়াদ। টিশার্ট বদলে চট জলদী শার্ট পরে নিলো। বেড সাউড টেবিল থেকে নিজের বাইকের চাবি বের করে নিয়ে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে হাঁটা ধরলো বাইরে যাওয়ার জন্য। ড্রইং রুমে আসতেই রিয়ানার মুখোমুখি হয় রায়াদ। রিয়ানার আচমকা ক্ষুধা লাগায় সে ঘুমানো বাদ দিয়ে খেয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিলো। তখনই রায়াদের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। রায়াদ রিয়ানাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই রিয়ানা মুখ ভেঙচি কাটে। রায়াদের কোন পাকা ধানে সে মই দিয়েছে! কে জানে? আসার পর থেকে তার ড্রেসআপ, চলাফেরা সবকিছু নিয়েই রায়াদের সমস্যা। জিন্স, টিশার্ট পরা দেখতেই পারেনা। যার ফলে স্কার্ট-টপস আর গলায় ওরনা ঝুলিয়ে চলছে সে। যা এ অব্দি সে কখনও পরেনি। স্কার্টে পা বেজে উস্টা খাওয়ার ভয়েতে স্কার্ট উঁচু করে ধরে হাঁটতে হচ্ছে তার। এ ছেলে নাকি কড়া শাসনের বয়াম! বুঝতে পারেনা রিয়ানা। রায়াদ চোখের অগোচর হতেই রিয়ানা রুমে ঢুকে। ফোন টা হাতে নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে পরে৷ ঘুম আর ধরবেনা তার। যখন ধরেছিলো! ক্ষুধার চোটে ঘুমায়নি। দুপুরে খাবার টেবিলে রায়াদ আর সে একসাথেই বসেছিলো। অবশ্য ফাতেহা খানমও ছিলেন। তবুও অসস্তি বোধ হওয়ায় পেটপুরে খায়নি রিয়ানা। কিন্তু ক্ষুধা লাগলেও সহ্য করার উপায় নেই। এজন্য কিচেনে গিয়ে হাড়িপাতিল হাতরে চুপিসারেই খেয়ে আসতে হলো তাকে। রিয়ানা ফোনের গ্যালারি ঘেটে নিজের বাবার ছবিটা বের করে এক নাগারে তাকিয়ে রইলো। চোখের কোণে অশ্রু-রা ভীড় জমাতে শুরু করলো। কখন জানি টুপ করে ঝড়ে পরে। রিয়ানা বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে জল মুছে ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে বললো,

“দেখলে বাবা, তোমার জন্য নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যের বাড়িতে পরে আছি। যদিও বা সব মানুষই ভালো। শুধু তোমার বন্ধুর ছেলে টা আমায় ভালো চোখে দেখেনা। আমি কি করবো বলো! ছোটো থেকেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে গোছালো জীবন টা মানতে আমার প্রচুর কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। তবুও তোমার কথা ভেবে মেনে নিচ্ছি। তুমি তো যা চেয়েছো, তার মান রাখতে গিয়ে আমার নিজেকে অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে বাবা। তবুও তুমি, বড়ো আপু যদি এতেই খুশি হও, রায়াদ সাহেবের করা সব অপমান মেনে নিলাম মাথা পেতে। অথচ আমায় অপমান করে কেউ কিছু বললে তা মাটিতে পরার আগেই জবাব পেতো। হাহ জীবন, দেখো কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! ২০বছরের বসন্ত পেরুনো জীবন টায় রঙিন ধরা দেখার বদলে শুধু একপাক্ষিকতা দেখে আসলাম। আচ্ছা বাবা! আমি এতোটাই খারাপ মেয়ে তোমার? যে আমায় একটু আদর করে নিজের কাছে রাখা গেলো না? আমার বড়ো বোনের বিয়ে! অথচ আমিই বাড়ি থাকবোনা। কি অদ্ভুত বিষয়, বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বাবা। আমি তোমায় আর আপুকে বড্ড মিস করে যাচ্ছি। মাত্র একসপ্তাহ পেরুলো! আরও কতোগুলো দিন, তোমাদের ছেড়ে কি করে থাকবো! যদিও বা আন্টির মাঝে মা মা গন্ধটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু তোমাদের ছেড়ে থাকা! নিদারুণ কষ্টের শামিল।”

রিয়ানা কথাগুলো নিজ মনে বলেই ফোনটা বুকে চেপে বালিশে মুখ গুজে কেঁদে উঠলো। বাড়িতে যাওয়ার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। অথচ তার বাড়ি ফেরার উপায় নেই। কি এক বাঁধা! বাঁধা-টা যে কবে কাটবে! জানেনা রিয়ানা।

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#সূচনাপর্ব
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here