#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১৭|
লাবিবা ওয়াহিদ
আনোশী শক্ত পাথরের মতো বসে আছে কাদের সাহেবের সম্মুখে। কাদের সাহেব এতক্ষণ খুব সুন্দর করে বিয়ের ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। কাদের সাহেব আশেপাশের সমাজকে নিয়ে নয়, আনোশীর নিজের কথা ভেবে সমস্ত কথা বলেছে। এখন তার অগাধ আত্মবিশ্বাস, আনোশী এই প্রস্তাবে বারণ করবে না। বলা বাহুল্য, আনোশীকে বারণ করার কোনো রকম সুযোগ সে দেয়নি।
আনোশী বিয়ে করবে বলে মত দিল। এক জীবনে অপেক্ষা করার মতো তার কেউ নেই। সে কেন তার রঙিন জীবন ধ্বংস করবে? কাদের সাহেব আনোশীর বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়। কাদের সাহেব যে এক মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেছিল তাদের আনোশী এখন অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে।
কাদের সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তার দেখা ছেলের বায়োডাটা দিল। তার ফ্যামিলি সম্পর্কে জানাল। আনোশী কিছুটা নীরব থেকে জবাব দিল,
–“আমার আত্মনির্ভরশীল ছেলে পছন্দ বাবা। যেদিন সে আত্মনির্ভরশীল হবে সেদিন যেন আমার কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয়!”
কাদের সাহেব হাসি-মুখে আনোশীর চাওয়ায় সম্মতি জানাল। সবশেষে কাদের সাহেব আনোশীর মাথায় স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে বলল,
–“তোকে নিয়ে আমার গর্ব হয় রে মা!”
আনোশী জোরপূর্বক হাসল। অনুভব করল সে একা নয়, তার ভালোবাসার মানুষ দিয়ে চারিপাশ পরিপূর্ণ। খাওয়া-দাওয়া সেরে আনোশী বিকাল অবধি কাদের সাহেবদের বাসায় থেকে নিচে এলো। নিচে এসে শিশিরকে কোথাও দেখল না। আনোশী মনে করেছে শিশির বাড়ি নেই। এজন্যই মূলত সে তার বাবার ঘরে গেছে পুরাতন আসবাব পত্রকে, টিনের বড়ো বাক্সটাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে শিশিরের কোনো জিনিসপত্র-ই আনোশী পেল না। এমনকি আলনার শেষ মাথায় শিশিরের সেই চাদরটাও পেল না। আনোশীর ভুরু কুচকে গেল। বিছানার কাছাকাছি আসতেই একটা চিরকুট পেল সে। চিরকুটের নিচে ছিল কয়েক হাজার টাকা। টাকার দিকে চোখ বুলিয়েই টাকার অংকটা ধরতে পারল সে। আনোশী চটজলদি চিরকুটের ভাঁজ খুলে পড়তে লাগল,
–“আমি আবার আব্বার কাছে ফিরে যাচ্ছি। সেখানে থেকেই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য পূরণ করব। ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে গেলাম। ইন-শা-আল্লাহ্ আবার আমাদের দেখা হবে। হতেই হবে!”
আনোশী চিরকুটের শেষ দুটো বাক্য নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল। দেখা হবে ভালো কথা, হতেই হবে কেন বলল? আনোশীর হঠাৎ চারিপাশ কেমন শূন্য শূন্য লাগতে শুরু করল। আনোশী পুরো ঘরটায় চোখ বুলালো। দখিনের জানালাটা খোলা। শিশির-ই খুলে গিয়েছে বোধহয়। আনোশী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তার রুমে ফিরে গেল।
এভাবেই আরও তিন মাস কেটে গেল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আনোশীর জীবন নিজস্ব গতিতে চলছে। তিয়াসা এখন ছুটিতে আছে। যতদিন অবধি না তার বেবি হচ্ছে ততদিন অবধি সে ছুটিতে থাকবে। এখন সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী। আনোশীর একা লাগতে শুরু হলো। স্কুলে দিনের অর্ধেক পার করে বাকি অর্ধেক সময় কাদের সাহেবদের পরিবারের সাথেই সময় কাটায়। এর মাঝে রিয়াদ তাশুতি এবং নোরাকে নিয়ে এখানে এসে চমকে দিয়েছিল। তাশুতি আনোশীর সাথে বিশেষ কথা বলেনি। তবুও ভদ্রতার খাতিরে টুকটাক বলেছে।
কাদের সাহেব রিয়াদকে দেখে খুব আদর, যত্ন করল। তবে তাশুতির প্রতি তার চাপা রাগ আছে। সেই রাগ তার এখন অবধিও যায়নি। তবে সেটা সে প্রকাশ করেননি। মুখে না বললেও কাদের সাহেবের এড়িয়ে চলাটা তাশুতি ভালোই উপলব্ধি করেছে।
কাদের সাহেব ওদের সামনে বলেছে আনোশীর বিয়ে ঠিক হয়েছে, একজন সুনামধন্য ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে। এটা শুনে তাশুতির গা পিত্তি জ্বলে গেল। সে বলেছিল,
–“বিয়ে ঠিক করেছেন আমাদের জানাননি কেন জেঠু?”
কাদের সাহেব বিশেষ কিছু বললেন না। হেসে বললেন,
–“এখন তো বললাম!”
তাশুতি জ্বলন্ত নজরে আনোশীর দিকে চাইল। কারো ভাগ্য এত ভালো হয় কী করে? তাশুতি তো এমনটা চায়নি। আনোশীর এসবের মধ্যে যোগ্যতা কী? আনোশী পুরো ঘটনায় নীরব স্রোতা ছিল। সে মোটেও এসব কথায় আগ্রহী না।
তাশুতিরা দুইদিন বেড়িয়ে চলে যায়। আনোশী আবার নিত্যকার দিনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্কুলে পরীক্ষা চলছে, এজন্যে অন্যান্য দিনে তুলনায় এই সময়গুলিতে সে ভীষণ ব্যস্ত। পরীক্ষার হলে দু’বেলা গার্ড দেওয়া, আরও জরুরি কাজ। সবমিলিয়ে আনোশী ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেরদিন-ই কাদের সাহেব জানাল ছেলে আনোশীর সাথে দেখা করবে। সে কতটা আত্মনির্ভরশীল হয়েছে তা সে নিজ মুখেই বলবে। আনোশী রাজি হয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যাতেই রীপাকে নিয়ে চলে যায় এক সুন্দর পরিবেশের রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের রুফটপে বসে আনোশী অপেক্ষা করছে সেই ছেলের। রীপা এবং তার মেয়ে দো’তলায় বসেছে। কিডস জোনে। ওখানে রীপার মেয়ে খেলছে আর রীপা তাকে পাহাড়া দিচ্ছে।
আনোশী রাতের আকাশ দেখছে কিংবা দূরের শহরটাকে। হঠাৎ তার পাশে কেউ বসতেই আনোশী পাশ ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে আনোশীর দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল। অসাবধানবশত চেয়ার নিয়ে পিছে পড়তে নিচ্ছিল আনোশী। কিন্তু তার চেয়ার টেনে ধরে সোজা করে শিশির বলল,
–“আরে আস্তে। পড়ে যাবে তো!”
আনোশী তখনো চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে আছে শিশিরের দিকে। কয়েক মাসের ব্যবধানে সে শিশিরকে চিনতেই পারছে না যেন! সে কী ভুল দেখছে? এছাড়া পাত্রের জায়গায় শিশির কেন? এর মানে কী সেই পাত্র-ই শিশির? কিন্তু কীভাবে সম্ভব? আনোশী কম্পিত গলায় বলল,
–“তু..তুমি?”
শিশির আনোশীর নাক টেনে বলল,
–“হ্যাঁ, আমি! তোমার হবু বর!”
আনোশী আরেকটা ঝটকা খেল, এ কথা শুনে। অবাক হয়ে বলল,
–“কীভাবে সম্ভব?”
শিশির হেসে বলে,
–“এত দ্রুত ভুলে গেলে? তোমার বিষের শিশিকে? ছোটোবেলায় কথা দিয়েছিলাম না? বিয়ে করলে তোমাকেই করব? আমার হৃদয়ের গলিতে এভাবে মেঘ না ছড়ালেই পারতে আনোশী!”
আনোশী হঠাৎ অনুভব করল তার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সেই ছোটোবেলার স্মৃতি তার স্মৃতিতে কিছুটা অস্পষ্ট। শিশিরের চেহারাও। এটা সেই শিশির যে আনোশীর খেলার সঙ্গী ছিল, তারা একই সাথে স্কুলে যেত। শিশির ছোটো বেলায় আনোশীকে প্রচন্ড বিরক্ত এবং রাগাত দেখে আনোশী তাকে বিষের শিশি সম্বোধন করত। সোনালী দিন গুলি হঠা চোখে ভেসে ওঠে তার। শিশিরের ছোটোবেলার স্বভাব আজও বদলায়নি। প্রতিনিয়ত রাগিয়ে গিয়েছে এই ছেলেটা। আনোশী তাকে এতদিন যাবৎ চিনতে পারল না? তার চাইতেও বড়ো কথা আজ শিশিরের কোনো কথায় আজ তার রাগ লাগছে না। কিন্তু কেন?
আনোশী এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শিশির আবার বলল,
–“নিয়তি সঙ্গে থাকলে আমাদের এক হওয়াটা অসম্ভব নয়। তুমি জানো, কত যুদ্ধের পর তোমাকে আমি নিজের করে পেতে যাচ্ছি?”
আনোশী তখনো পিটপিট করে চেয়ে রইল শিশিরের দিকে। অর্থাৎ সে জানতে চাচ্ছে সবকিছু। শিশির সেটা বুঝতে পেরে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ সময় নিল কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে।
——————————-
অসুস্থতার সময়গুলো খুব কষ্টের সাথে কেটেছে শেহরিমের। অদ্রী সেদিন চলে গেলেও দু’দিন পর ঠিকই ফিরে এসেছে। মেয়েটার এই বয়সেই ছেলে মানুষী কাজ-কর্ম ভাবলে শেহরিম আপনমনেই হেসে ওঠে। অদ্রী বন্ধু হিসেবে পারফেক্ট। কিন্তু জীবন সঙ্গীনি হিসেবে কেমন হবে সেটা সে ভাবতে পারে না। আনোশী ধীরে ধীরে তার অতীত হয়ে গিয়েছে। অতীতের টানাপোড়েন কোথাও না কোথাও তার থেকে গেছে। আনোশীর জন্যে আগের মতো জোরালো অনুভূতি না থাকলেও আনোশীর প্রতি তার অনুভূতি এখনো অল্পস্বল্প কাজ করে। শেহরিম বড্ড দ্বিধা-দ্বন্দে সময় পার করে। তার অনুভূতি গুলো কেন দিনকে দিন ফিকে হয়ে আসছে? এর মানে কী সে মোটেও সেরকম প্রেমিক পুরুষ হতে পারেনি?
অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে শেহরিম আবারও হাসপাতালে জয়েন দেয়। অদ্রী তার সাথে বিশেষ কথা না বললেও শেহরিমকে রোজ তাকে দেখতে হয়। সবসময় অদ্রী তার চোখের সামনেই মনে হয় ঘুরঘুর করে। একসাথে একই হাসপাতালে চাকরী করছে, দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু শেহরিমের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। আজকাল অদ্রীর দিকে তার চোখ চলে যায়। একদিন অদ্রী শেহরিমের সাথে ক্যান্টিনে বসে। অদ্রী সেদিন শেহরিমকে বলেছিল,
–“আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখলে তোমার চোখ আমি বের করে ফেলব। বিয়ে করবে না তো পর মেয়ের দিকে তাকাও কেন?”
শেহরিম অদ্রীর এ-কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“সব ব্যাপারকে তুমি বিয়ের দিকে টেনে নাও কেন?”
–” আমার ইচ্ছে। তোমার সমস্যা? বিয়ে ছাড়া তুমি আমার জন্যে অসহ্য পুরুষ মানুষ!”
অদ্রীর এই বিয়ে দিয়ে শুরু এবং বিয়ে দিয়ে শেষ কথাবার্তা আজকাল শেহরিমের শুনতে ভালোই লাগে। কিছুদিন পর ওরা জানতে পারে পাহাড়ি অঞ্চলে ওদের সপ্তাহখানেকের মতো ক্যাম্পিং হবে। সেই ক্যাম্পিং-এ শেহরিম এবং অদ্রীও যাবে। অদ্রী তখন নাক ফুলিয়ে বলেছিল,
–“আমি কিছুতেই এই অসহ্য পুরুষ মানুষের সঙ্গে ক্যাম্পিং এ যাব না।”
শেহরিম তখন হেসে দিয়ে বলে,
–“বিয়ে করলে যাবে তো?”
সেদিন অদ্রীর চোখ কপালে তোলা মুখখানা দেখার ভালোই সৌভাগ্য হয়েছিল শেহরিমের। সেই মুখখানা সে চিরদিনের জন্যে নজরবন্দী করে রাখল। মেয়েটা সত্যি-ই দারুণ। তার সাথে বাকি জীবন কাটালে মন্দ হবে না!
~[ক্রমশ]