#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১৫|
লাবিবা ওয়াহিদ
–“আচ্ছা! আপনি তাহলে কাদের স্যারের ভাইয়ের মেয়ে?”
মনোমুগ্ধকর কন্ঠে প্রশ্ন করল একজন শিক্ষিকা। আনোশী মুচকি হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। আনোশীর সহকারী তিয়াসা উৎফুল্লের সাথে বলল,
–“আমি একসময় কাদের স্যারের ছাত্রী ছিলাম। আমি ভাগ্যবতী কাদের স্যারের ছাত্রী হতে পেরে। কখনো ভাবতে পারিনি আবার এই স্কুলেই শিক্ষকের চাকরিতে ঢুকব। এই গল্প শুধু আমার একার নয়, আরও শিক্ষকরাও আমার মতো কাদের স্যারের ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন!”
–“আপনি এখানে কতদিন যাবৎ আছেন?”
–“দুই বছর হলো।”
এরকম নানান কথা-বার্তায় মুখোরিত হলো দুজনে। আনোশী অল্প করে কথা বললেও তিয়াসা ম্যাম বেশি-ই বলছে। তার উৎফুল্লতা আনোশী ধারণা করতে পারছে। তিয়াসা আনোশীর থেকে দুই বছরের সিনিয়র। চাকরির দিক দিয়েও, বয়সের দিক দিয়েও। আনোশী বেশ উপভোগ করেছে তিয়াসার সঙ্গ।
প্রথমদিন আনোশীর দিন ভালোই কাটল। নতুন পরিবেশে নতুন নতুন বাচ্চাদের সাথে মিশতে পেরে তার অনেকদিনের বোঝা যেন নিমিষেই নেমে গেল। আনোশী বাড়ি ফিরল লাঞ্চের সময়। ফিরে এসেই দেখতে পেল শিশির গালে হাত দিয়ে খাবার টেবিলে বসে আছে। নজর তার সদর দরজার মুখেই। তাকে দেখে শিশির চওড়া হাসি দিল। আনোশীর তাকে বিরক্ত লাগলেও বিশেষ কিছু বলল না। হয়তো আনোশী ধরতে পেরেছে শিশিরের অপেক্ষার কারণ।
আনোশী উঁকিঝুঁকি দিয়ে রান্নাঘরে দেখার চেষ্টা করল। তা বুঝে শিশির মুচকি হেসে বলল,
–“প্রয়োজনীয় সব বাজার-ই এনেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে জলদি কাজে লেগে পড়ুন, আমার পেট খুদায় শব্দ করছে!”
আনোশী মুখ বাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেল। সকালে দুজনের টাকার ভাগাভাগি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এখন থেকে বাজার-সদাই শিশির করে দিবে আর আনোশী রান্না করবে। অর্থাৎ শিশির বাইরের খাবারের চাইতে বাসার খাবারে ফুরে আসতে চাইছে। এজন্যে নানান কথায় ভুলিয়ে, ভালিয়ে বেশ কয়েকবার মিনুতি করার পর আনোশীকে রাজি করতে পেরেছে। আনোশীকে রাজি করানোটা শিশিরের নিকট যুদ্ধের মতো ছিল।
আনোশীর তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে টেবিলের ওপর থাকা ফটোকপির সার্টিফিকেট গুলো দেখতে পেল। যা যা প্রয়োজন হয় তাই ফটোকপি করতে গিয়েছিল আনোশী স্টুডিওতে। সেখানে শিশিরকে বসে থাকতে দেখে আনোশী অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছিল। যদিও তার সিভি রেডি ছিল, কিন্তু কখন কোনটা কোন কাজে লেগে যায় তা তো আর বলা যায় না। শিশির আনোশীকে দেখেই প্রতিবারের মতো হাসি মুখে লেপ্টে বলল,
–“মিস বাড়িওয়ালী যে! কী সাহায্য করতে পারি আপনার?”
শিশিরের বলা সামান্য দুটো বাক্যও যেন আনোশীর সহ্য হলো না। আপাদমস্তক শিশির ছেলেটাই আনোশীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা আর বেফাঁস কথা বলা যেন এই ছেলের রোজকার স্বভাব। আনোশী নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সার্টিফিকেটের ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“সব গুলোর তিন-চার কপি করে দিন!”
শিশির ডান দিকে মাথা এলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফাইল থেকে এক এক করে সার্টিফিকেট ফটোকপি মেশিনে দিতে গেলে দেখা যায় কালি শেষ। শিশির পুরো দোকান তন্নতন্ন করে খুঁজল। এক্সট্রা কালি পেল না। তৎক্ষণাৎ শিশির রাগের বসে মুখ ফসকে বলেছিল,
–“শালার, গর্ধব! কালি ছাড়া দোকান খুলতে কে বলেছিল? প্রয়োজনের সময় কপালটাই আমার নষ্ট!”
আনোশী হতভম্ভ হয়ে চেয়েছিল শিশিরের দিকে। শিশিরের আনোশীর মুখ দেখে হুঁশ এল। আড়ালে জিভ কেটে বলল,
–“আপনি আপাতত বাড়ি যান। এগুলা আমার কাছে থাকুক!”
–“তা কেন? আমার ফাইল দাও। আমি অন্য দোকান থেকে করে নিব!”
বলেই আনোশী তার ফাইল নিতে যাবে তার আগেই শিশির ছোঁ মেরে সেটা নিজের দখলে নিয়ে চোখ পাকাল। বলল,
–“বললাম তো থাকুক আমার কাছে! আমার আপনার সার্টিফিকেট চুরি করে কাজ নেই। ওটা আমার এমনিতেও কাজে লাগবে না!”
সব কথায় আনোশীকে খোঁচা দেওয়াটাও শিশিরের স্বভাবের মধ্যে অন্যতম। এজন্যে আনোশী একপ্রকার রেগে-মেগে বেরিয়ে এসেছিল স্টুডিও থেকে। আনোশী বের হওয়ার আগেই শিশির তাকে পিছু ডাক দিয়ে বলেছিল,
–“স্টুডিও-তে কিন্তু ছবিও তোলা হয়। চাকরিতে ছবি লাগলে আমার কাছে চলে আসবেন। আমার ছবি কিন্তু অসাধারণ হয়!”
আনোশী তখন রেগে বলেছিল,
–“আমি জীবনেও ছবি তুলব না, তোমার কাছে!”
শিশির কিছু বলেনি। শুধু হেসেছে। বিড়বিড় করে কিছু বললেও আনোশী সেটা শুনতে পায়নি। সেদিন রাতে শিশির অবশ্য তার কাগজপত্রের ফটোকপি করে এনে দিয়েছিল।
আনোশী যখন পেঁয়াজ কাটছিল তখন হঠাৎ শিশির এসে বলল,
–“পেঁয়াজ কী পানিতে ভালো ভাবে ধুঁয়ে কাটা যায় না? নিজেও কাঁদছেন অন্যকেও কাঁদাচ্ছেন! এটা বড়ো জুলুম মিস!”
আনোশী ঘাড় বাঁকিয়ে শিশিরের দিকে তাকাল। শিশিরের চোখ, নাক লাল হয়ে গিয়েছে। শিশির বারবার চোখ জ্বলছে পেঁয়াজের ঝাঁজে। আনোশী ভুরু কুচকে বলল,
–“এতই যেহেতু জানো তো নিজের কাজ নিজে করতে পারো না?”
–“তাহলে আপনি বাজার করে এনে দিন, আমি আপনাকে রান্ন করে খাওয়াচ্ছি। আমার রান্না খাবার আবার মুখে তুলতে না পারলে আমার কোনো দোষ নেই!”
বলেই শিশির চোখ ডলতে ডলতে বেসিনের দিকে চলে গেল। বেসিনে চোখ-মুখে ভালো করে পানি দিয়ে আনোশীর মুখে ইচ্ছাকৃত একটু খানি ছিটিয়ে দিল। তাতে আনোশী রেগে ধমকাল শিশিরকে। শিশির ভুরু কুচকে বলল,
–“আমি তো রুমাল বের করলাম। আপনার মুখে ছিটা পড়লে আমার কী দোষ!”
আনোশী অত্যন্ত রাগে থরথর করে কাঁপল শুধু। শিশির ছোটো ছোটো চোখে আনোশীর দিকে চেয়ে বলল,
–“রাগ করেছেন বুঝি? আচ্ছা স্যরি!”
আনোশী মুখ ফিরিয়ে নিল। সব রাগ সবজির ওপর ঝাড়তে লাগল। তা দেখে শিশির আনোশীর দিকে ঝুঁকে বলল,
–“এভাবে রাগ তো মানুষ তার প্রেমিকের উপর দেখায়। আমি কী আপনার প্রেমিক নাকি?”
এক মুহূর্তের জন্যে আনোশীর কাজ থমকে গেল। কিড়মিড় চোখে তাকিয়ে বলল,
–“সেসব চিন্তা মাথাতেও আনবে না। নয়তো তোমার উপরের ছাদ কেড়ে নিতে আমার এক মুহূর্তও লাগবে না!”
এ-কথা শুনে শিশির হো হো করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে বলল,
–“বাড়িওয়ালী মেয়েদের প্রেমে পড়তে নেই। ওই জ্ঞান আমার আছে মিস। এছাড়া প্রেমও আজকাল সাবধানতা অবলম্বন করে। প্রেম করার মতো যদি প্রেমিক-ই বেঁচে না থাকে তাহলে সেই প্রেম ফোটাবে কার মনে? উপরওয়ালার তরফ থেকে সবার মনেই একটু করে প্রেম নির্ধারিত থাকে। আর সেই প্রেম বিশালতায় রূপান্তর করাটা সেই প্রেমিক/প্রেমিকার কাজ। আমি অন্তত আমার এই প্রেমঘটিত কাজ কোনো বাড়িওয়ালীর সাথে মেটাব না।”
আনোশীর কাজে আবারও ব্যঘাত ঘটল শিশিরের কথা-বার্তায়। তবে শিশিরের আনোশীর পালটা কোনো কথার অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল কে জানে। আনোশী আবার কাজে মনোযোগ দিল। রান্না চুলায় বসাতেই জানালা দিয়ে দেখল শিশির সিয়ামের একমাত্র মেয়ের সাথে খেলছে। সিয়ামের মেয়েটা এবার নার্সারিতে পড়ছে। দুইদিন যাবৎ সিয়ামের বোনের বাড়িতে বেড়িয়েছে সে। এইটুকু বাচ্চা নির্দ্বিধায় মাকে ছাড়া দু’দিন ফুপির বাসায় থেকেছে। ভাবা যায়? তবে আনোশীর মনে হলো এই দৃশ্যটা সুন্দর। বাচ্চাদের ঘিরে থাকা সব দৃশ্য-ই আনোশীর মন খুব কাড়ে। শিশিরকেও খেলতে দেখে তার ভালো লাগল।
————–
শেহরিম দরজা খুলতেই দেখল অদ্রী দাঁড়িয়ে। তার হাতে কিছু খাবার প্যাকেট! শেহরিমকে দেখে খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
–“গুড মর্নিং!”
শেহরিমও জোরপূর্বক হেসে বলল,
–“গুড মর্নিং!”
অদ্রী শেহরিমের কোনো রকম অনুমতি না নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করল। শেহরিম দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,
–“রোজ সকালে আর রাতে আসো সমস্যা হয় না?”
–“তাহলে বিয়ে করে একটা বউ রাখতে পারো না? তাহলে তো আর এক্সট্রা চিন্তা, যত্ন আমার করতে হয় না!”
শেহরিম কিছুটা দমে গেল অদ্রীর কথা শুনে। মেয়েটার কথার বচন ঠিক নেই। ঊনিশ থেকে কুড়ি করতে তার বচনভঙ্গি ওস্তাদ। খাবারের প্যাকেট খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
–“আমার মনে হচ্ছে সত্যি তোমার বিয়ে করাটা দরকার। নয়তো তোমার যা কন্ডিশন, একা একা সব সামলানোটা টাফ হয়ে যাচ্ছে।”
–“আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না!”
অদ্রী ছোটো ছোটো চোখে শেহরিমের দিকে চেয়ে বলল,
–“আমার মুখ দেখে কোন দিক দিয়ে আমাকে তোমার মূর্খ মনে হয় বলো তো?”
শেহরিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
–“আমি তোমাকে মূর্খ কখন বললাম?”
–“তোমার কথা-বার্তায় তো তাই প্রকাশ পাচ্ছে। সুস্থ হয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ফিরতে চাইলে বিয়ের কথাটা ভেবে দেখ। পৃথিবীতে সবারই নিজেকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্যে একজন পার্টনার জরুরি। যার একমাত্র মাধ্যম বিয়ে। এছাড়া বাইরের মানুষের কাছে বেশি কিছু এক্সপেক্ট করাটা মূর্খতার পরিচয়!”
–“তুমি মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে যাচ্ছো?”
শেহরিমের হঠাৎ এই কথায় অদ্রী কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও পরমুহূর্তে হেসে ফেলল। বলল,
–“বলতে পারো তাই। অসহায়দের এভাবে অসহায় দেখতে ভালো লাগছে না। এছাড়া এই কয়েকদিনে বুঝে গেছি তুমি আমার টাইপের। তুমি লাইফ পার্টনার হলে মন্দ হবে না!”
শেহরিমের ভুরু কুচকে গেল। অদ্রী শেহরিমের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
–“এই মুহূর্তে আমি তোমার জন্যে সঠিক মানুষ। কাজি অফিস খোলা আছে। পরিবারেরও সম্মতি আছে। তুমি চাইলে এক চুটকিতে নিজের জীবনটাকে রাঙাতে পারো। বেশি দেরী করলে প্রতিবারের মতো কিন্তু পস্তাবে!”
শেহরিম আলতো করে ঢোঁক গিলল। বলল,
–“আমি হৃদয়ে অন্য কাউকে রেখে আরেকজনের সঙ্গে জড়াতে পারব না। প্রতারণা হয়ে যাবে না ব্যাপারটা?”
অদ্রী হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিমিষেই রাগে টইটম্বুর হয়ে যায়। শেহরিমকে ধমক দিয়ে বলল,
–“ঠাটিয়ে কয়েক ঘা মে!রে তোমার গাল লাল করে দিতে ইচ্ছা করছে। বিয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে কতটুকু জানো তুমি? ওই সম্পর্কটা উপরওয়ালা প্রদত্ত। সে-ই ধীরে ধীরে তোমার ধূসর অনুভূতি মুছে দিবে। গর্ধব! না খেয়ে মরো তুমি! খবরদার আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছ তো। দেখি আমি ছাড়া কে তোমার খোঁজ নিতে আসে!”
বলেই অদ্রী হনহনিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। শেহরিম হতভম্ভ হয়ে শুধু সব দেখল। অদ্রী যা খাবার দিয়ে গেছে তাতে দু’বেলা শেহরিমের হয়ে গেল। কিন্তু রাতে শেহরিমের আশায় জল ঢেলে অদ্রী সত্যি-ই এলো না। যার ফলে শেহরিমের ওষুধটাও রাতে না খাওয়াই রয়ে গেল। শক্ত একাকিত্ব অনুভব করল সে সারা-রাত।
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ কেমন লেগেছে জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।