#হৃদয়ে_মেঘগলি
|১৪|
লাবিবা ওয়াহিদ
পরেরদিন আনোশী রুম থেকে বের হতেই দেখল রীপা মুখ ভার করে টেবিলে নাস্তা দিচ্ছে। আনোশী আসার শব্দ পেতেই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে রীপা বলল,
–“ঘুম ভেঙেছে? এসো, নাস্তা করতে বসো!”
আনোশী হাই তুলে সামনের কিছু চুল কানে গুঁজে চাপা কন্ঠে বলল,
–“এখানে না থাকলেও পারতে ভাবী। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ!”
রীপার মুখ আবারও ভার হয়ে গেল। কার কাছে কী লুকাবে সে? মুখ ভার অবস্থাতেই রীপা বলল,
–“খেতে বসো!”
আনোশী খেতে বসল। ঠিক তখনই আনোশীর বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো শিশির। ড্রেসাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে এখনই বেরোবে! রীপা শিশিরকে দেখে বলল,
–“কোথায় যাচ্ছ?”
রীপার কথা শুনে শিশির থেমে যায়। রীপার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে বলল,
–“আর কোথায়, স্টুডিওতে যাচ্ছি!”
–“সকালে কিছু না খেলে আমাদের সাথে খেতে পারো!”
আনোশী মুখে থাকা খাবারটা চিবানো বন্ধ হয়ে গেল ভাবীর কথা শুনে। কোণা চোখে একপলক শিশিরের দিকে চাইতেই বুঝতে পারল শিশিরও তার দিকেই চেয়ে আছে। শিশির হেসে বলে,
–“এ তাহলে আমার চরম সৌভাগ্য। তবে বসা থাকা বাড়িওয়ালী ম্যাডামের সমস্যা হতে পারে আমি খেতে বসলে!”
চট করে শিশিরের দিকে তাকাল আনোশী। শিশির চোখে-মুখে দুষ্টুমি ফুটিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে। ছেলেটা এসব অযৌক্তিক কথা-বার্তা এত বেশি বলে কেন? আনোশী মহা বিরক্ত হয়ে বলল,
–“আমার কোনো সমস্যা নেই!”
শিশির আর কথা না বাড়িয়ে টেবিলে গিয়ে বসল। একদম আনোশীর মুখোমুখি। আনোশী তাতেও বিরক্ত হলো। এত চেয়ার খালি থাকতে তার মুখোমুখি চেয়ারেই কেন শিশিরকে বসতে হবে? শিশিরের ওপর থাকা রাগ, বিরক্তি চেপে আনোশী রীপাকে বসতে বলল। রীপা বসেছে শিশিরের পাশেই। শিশির খেলো দুটো পরোটা এবং খুব অল্প আলুভাজি। আজকের সকালের নাস্তা হিসেবে পরোটা, আলুভাজি এবং ডিম হয়েছে। রীপা শিশিরকে ডিম নিতে বললে সে নেয় না। শুধু বলেছে,
–“ওটা বাড়িওয়ালীর খাবার। তাকেই দিন আপু। আমার আবার এত খাবার হজম হবে না!”
বলেই এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে আনোশীকে বলে যায়,
–“যাচ্ছি বাড়িওয়ালী, আপনি চাইলে আপনার বাবার রুমটা চেক করতে পারেন। আপনার ভাষ্যমতে, যদি আবার কিছু চুরিটুরি করি?”
আনোশী গরম চোখে তাকাল শিশিরের দিকে। শিশির হেসে গুণগুণিয়ে গাইতে গাইতে চলে গেল। যাওয়ার আগে রীপার রান্নার প্রশংসা করতেও ভুলল না। রীপা শিশিরের মুখে নিজের জন্যে প্রশংসা শুনে খুশি হলেও আনোশীর সাথে শিশিরের লাগালাগি-টা ঠিক হজম করতে পারছে না। বড়ো বড়ো চোখে শুধু চেয়ে ছিল ওদের দিকে। আনোশী নাক ফুলিয়ে খেয়ে উঠে যায়। অলেট গোছাতে গোছাতে বলল,
–“তুমি উপরে চলে যাও ভাবী, বাকি কাজ আমি সামলে নিব!”
——————–
শেহরিমের ঘুম ভাঙার পর নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করল। ক্যানেল লাগানো হাতে কপালের ব্যান্ডেজে একটু চাপ দিতেই চোখ-মুখ কুচকে গেল তার। আরেক হাত নাড়াতে পারছে না। খুব সম্ভবত ভেঙেছে হাতটা। আশেপাশে কিছুক্ষণ নজর বুলালো সে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু উচ্চারণ করল না। মিনিট পাঁচেক বাদেই একজন পরিচিত মুখ দেখে সে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। আরে, এ যে অদ্রী! শেহরিমের যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। অদ্রী তার চোখের চিকন ফ্রেমের চশমা ঠিক করতে করতে অধরে চওড়া হাসি টানল। শেহরিমের কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলল,
–“সারপ্রাইজ!”
শেহরিম তখনো হা করে চেয়ে আছে অদ্রীর দিকে। অদ্রী শেহরিমকে চেক করে বলল,
–“এখন কেমন লাগছে?”
অদ্রী পেশায় ডাক্তার এবং শেহরিমেরই সেম ব্যাচ ছিল। কলেজ জীবন থেকেই তাদের সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শেহরিম দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর তাদের সুন্দর সম্পর্ক ভাটা পড়েছিল। শেহরিম চাইলেও অদ্রীর সাথে সহজ সুলভ হতে পারছে না। কোনো এক জড়তা তাকে ঘিরে রেখেছে। শেহরিম নিজেকে সামলে বলল,
–“মনে তো হচ্ছে ঠিক আছি!”
অদ্রী শেহরিমকে উঠে বসতে সাহায্য করল। অদ্রী যখন শেহরিমের মেডিসিন চেক করছিল তখন শেহরিম বলল,
–“তুমি এখানে কেন?”
অদ্রী মেডিসিনের দিকেই চোখ রেখে বলল,
–“তোমার মতো করেই বদলি হয়ে এসেছি। শুধু পার্থক্য একটাই, আমি সুস্থ-সবল এসেছি আর তুমি রোগী হয়ে!”
বলেই অদ্রী স্মিত হাসল। শেহরিম নজর ফিরিয়ে নেয়। এভাবে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে শেহরিম বুঝতে পারেনি। শেহরিম আবার বলল,
–“আজ না আমাদের এঙ্গেজমেন্ট ছিল? তুমি এই সময়ে সিলেটে?”
অদ্রী আবার হাসল। হেসে বলল,
–“একই প্রশ্ন তো আমারও করার কথা। তুমি কেন সিলেটে? এই হালে? আজ তো সত্যি-ই আমাদের এঙ্গেজমেন্ট ছিল!”
শেহরিম বলল,
–“আমি এই বিয়ে করতে চাইনি। নিজের জন্যে ভাবার, নিজের মানসিক শান্তির জন্যে এখানে এসেছি! জোর-জবরদস্তির জীবন আর ভালো লাগে না!”
–“তো করো না বিয়ে। আমি তো চাপ দিচ্ছি না। তুমি নিজ ইচ্ছের মালিক!”
–“তাহলে তুমি…?”
অদ্রী এবার শেহরিমের দিকে চেয়ে বলল,
–“আমি চাইনি বাবার বিজনেসের জন্যে নিজেকে কুরবানি দিতে!”
শেহরিম হতভম্ভ হয়ে গেল অদ্রীর কথা শুনে। অদ্রী হেসে নার্স ডাকল। মেয়েটার অধর ছেড়ে যেন হাসি-ই সরে না। আর ওদিকে আনোশী, গম্ভীর রাজ্যের শক্ত পাহাড়! শেহরিম অদ্রীর দিকে তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। অদ্রী নজর সরিয়ে নিলে শেহরিমও নজর সরিয়ে ফেলে। নার্সকে কিছু নির্দেশ দিল অদ্রী। অতঃপর নার্স চলে যেতেই অদ্রী বলল,
–“আমার এখন মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার সঙ্গ খারাপ যাবে না!”
শেহরিম তড়িৎ চাইল অদ্রীর দিকে। ভুরু কুচকে বলল, “কী বলতে চাইছ?”
–“আমাদের বিয়ে কিন্তু ভাঙেনি। যেহেতু আমরা এখন একসাথে আছি, আমরা নিজেদের চিনতে পারব, বুঝতে পারব।”
শেহরিম চমকে বলল,
–“আমি কিন্তু ডিভোর্সি। এটা ভুলে যাচ্ছ কেন? শুধু শুধু আমার সাথে জীবন কাটিয়ে সময় নষ্ট করবে!”
–“শুধুই ডিভোর্সি? একজনের প্রেমে পড়ে কী পাগলামি করেছ তাও কানে এসেছে আমার!”
–“তবুও তুমি বলছ আমাদের এগোনো উচিত?”
–“অবশ্যই! আমিও জীবনে দুটো প্রেম করেছি। ভুল মানুষের সাথে। জীবনে সঠিক, ভুল মানুষ অনেক আসে যায়। কিন্তু যার সাথে ভাগ্য জুড়ে থাকে সে-ই তোমাকে দিনশেষে মানসিক শান্তি দেবে। থাকো। আমি অন্য পেশেন্ট দেখতে যাচ্ছি। বিকালে তোমাকে রিলিজ দেওয়া হবে।”
অদ্রী শেহরিমকে গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়ে চলে গেল। আর শেহরিম মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল।
আনোশী সারাদিন কাজের পাশাপাশি বাবার ডায়েরীটা নিয়ে বসে ছিল। অতীতের সোনালী স্মৃতিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু বাসায় বসে থাকলে কী আর পেট চলবে? আনোশী পরেরদিন-ই স্কুলে জয়েন করার চিন্তা-ভাবনা করল। কাদের সাহেব যেই হাই স্কুলে একসময় এমপিওভুক্ত শিক্ষক ছিলেন সেখানেই জয়েন করার মনোনিবেশ করল। বাচ্চাদের সাথে আনোশী ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে গেছে। বাচ্চাদের হাসি-মুখ না দেখলে তার দিনকাল বেশিদিন ভালো কাটে না।
দুপুরে শিশির এলো হাতে দুই প্যাকেট খিঁচুরি নিয়ে। আনোশী তখন রান্নাঘরে সবে ঢুকেছে কিছু রান্না করার জন্যে। নাস্তার পরপরই রীপাকে আনোশী উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে। রাত ছাড়া ওরা ফিরবে না। সিয়াম তো আনোশী ওঠার আগেই অফিস চলে গেছিল।
শিশির রান্নাঘরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,
–“রান্না করতে হবে না। খিঁচুড়ি এনেছি।”
আনোশী কোণা চোখে শিশিরের দিকে চেয়ে বলল,
–“তুমি বললেই বা আমি খাব কেন?”
–“আমি সকালে আপনার নুন খেয়েছি, এখন আপনি আমার নুন খাবেন। শোধবোধ! ”
আনোশী হুট করে চুলা বন্ধ করে দিল। শিশিরের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
–“তাহলে খেতে আসেন কেন?”
–“সেটা আপনাকে কেন বলব? আমার ইচ্ছা তাই খাই, শোধবোধও আমি করি। তবে আপনার এই “তুমি” থেকে “আপনি” তে আসাটা ভালো লাগল!”
আনোশী হতভম্ভ চোখে চেয়ে রইল শিশিরের পানে। শিশির যাওয়ার আগে আবার বলল,
–“সুন্দরী বাড়িওয়ালীদের নরম কন্ঠে গাম্ভীর্য মানায় না আনোশী!”
~[ক্রমশ]