প্রেম প্রেম পায় পর্ব ৩৭

0
829

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব সাইত্রিশ

৩৭.
সকালের আলো ফুটতে শুরু করলো। আর কিছু ঘন্টার মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে।চারপাশে আবছা আবছা আলো ফুটছে।ফায়াদের ঘুমটা ভেঙে গেল৷ ঘুম ভাংতেই দেখলো অপরাজিতা গুটিসুটি মেরে তার বুকের মাঝে ঘুমাচ্ছে। দেখে মুচকি হাসলো সে। বাহিরে তাকিয়ে দেখলো ভোর। বাসের সবাই ঘুমাচ্ছে। ঘুমানোর আগে সবাই জানালা অফ করে দিয়েছিল বাসের। ফায়াদ জাগনা পেতেই হাত বাড়িয়ে পাশের জানালা টা একটু খুলতে চাইলো। ভোরের বাতাস উপভোগ করতে চাইছে সে। হাত বাড়িয়ে জানালা হালকা খুলতেই অপরাজিতা নড়েচড়ে উঠলো। বাতাস গায়ে লাগতেই ফায়াদের আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো৷ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ফায়াদ তাকে৷ গায়ের চাদর টা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে দিল।
অপরাজিতা বেশ কিছুক্ষন নড়েচড়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলল।প্রথমে বুঝতে একটু সময় লেগেছে সে কোথায়। পরে মনে পড়লো।এটাও বুঝলো সে কারো বুকের উষ্ণতায় মেখে আছে। মানুষটা কে সে জানে৷ আর তা জানে বলেই তার অধর কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
এরকম একটা সকালই তো সে কল্পনা করতো। যেখানে চোখ খুলেই ভালোবাসার মানুষের মুখ দেখা যাবে।

অপরাজিতা আস্তে করে মাথাটা উচিয়ে দেখলো ফায়াদ তাকে আঁকড়ে ধরে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সে ফায়াদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ ফায়াদ বলল,
‘সুপ্রভাত’

অথচ ফায়াদের চোখ তখনো বাহিরের দিকে। অপরাজিতা ভ্রু কুচকে ঘুমঘুম কন্ঠে ধীর স্বরে বলল,
‘কিভাবে বুঝলেন জেগে গিয়েছি?’

ফায়াদ এবার বাহির থেকে চোখ সরিয়ে অপরাজিতার দিকে তাকালো। কপালে ঠোঁট ছুয়ে বলল,
‘আমার বুকে ঘুমিয়ে আছো। আমি বুঝবো না বলছো?’

কুচকানো ভ্রু সোজা হলো অপরাজিতার।মুখে ফুটলো মিষ্টি হাসি। ফায়াদের বুকে হাত রেখে বলল,
‘জায়গা টায় এতো শান্তি কেন?’

ফায়াদ অপরাজিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘নিজের জিনিসে শান্তি ই থাকে।’

অপরাজিতা ফায়াদের বুকের কাছের টিশার্ট খামছে ধরে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
‘হুহ আমার জিনিস!’

হাসলো ফায়াদ। অপরাজিতা আবার চোখ বন্ধ করলো। আবারো ঘুমের রাজ্যে পারি দিচ্ছে সে। ফায়াদ অপরাজিতাকে আগলে রেখে আকাশের রঙ বদল দেখছে। আজকের সকালটা একটু বেশিই সুন্দর ঠেকছে।নাকি প্রিয় মানুষ বুকে আছে বলে সুন্দর লাগছে!

ধীরে ধীরে ভোর কেটে সকাল হলো। সকলে জাগছে একে একে। বাকিদের মধ্যে রাফিয়া আগে জাগলো। সে উঠে বাকিদের দেখতে লাগলো নিরবে। পাশে তাকাতেই চোখ গেল ফায়াদ আর অপরাজিতার দিকে। ফায়াদ অপরাজিতাকে ধরে রেখেছে আর অপরাজিতা ফায়াদের বুকে ঘুমাচ্ছে। দৃশ্যটা রাফিয়ার খুব কিউট লাগলো। সে ফোনে নিশব্দে একটা ছবি তুলল তাদের দুজনের। তারা টেরই পেল না। কারন ফায়াদের ধ্যান তো প্রকৃতি দেখা তে। বাসে চোখ বুলাতেই আরেকটা দৃশ্য তার মনে ধরলো।
তা হলো ফায়াদের এক সিট সামনে ফারাজের দিকে। ফারাজ ঘুমাচ্ছে নীতির কাধে মাথা রেখে। নীতির মাথা ফারাজ এর মাথার সাথে হেলানো। দুজনকে এভাবে দেখা হয় নি কখনো। খুবই সুন্দর লাগছে একসাথে।রাফিয়া এখন বুঝতে পেরেছে ফায়াদ কেন নীতিকে তার সাথে বসতে নিষেধ করেছে।ব্যাপারটা মন্দ নয়,বরং দারুন!
রাফিয়া ফারাজ নীতির এই দৃশ্যটিও ক্যামেরা বন্ধী করলো।

বাস এসে থামলো একটা হোটেল এর সামনে। সবাই একে একে নামলো।যে যার যার রুমে যাচ্ছে। সবাই রুমে গিয়ে আরামে একটু ঘুমাতে চায় আগে। তারপর নাস্তা। ফারাজ, রিজু এবং সামির একই রুমে।নীতি ও রাফিয়া একই রুমে। ফায়াদ আর অপরাজিতা যেহেতু এখন বিবাহিত তাই তাদের এক রুমে দেওয়া হলো। তা নিয়ে অপরাজিতার লজ্জার শেষ নেই। আর মা বাবা দের জন্য তো আলাদা রুম আছেই।

নীতি বাস থেকে নামার পর থেকে লজ্জায় ফারাজের দিকে তাকাচ্ছে না। সে আর ফারাজ ঘুমের মধ্যে খুব কাছাকাছি ছিল। এটা তার জন্য কল্পনার মতো। ফারাজ তাকে কি ভাবছে কে জানে? আচ্ছা ফারাজ কি তাকে গায়ে পড়া ভাববে? এই টেনশন আর লজ্জায় নীতির দেওয়ালে মাথা ঠুকাতে ইচ্ছে করছে।
রাফিয়া বাস থেকে নেমেই রুম জেনে রুমে দৌড় দিয়েছে। সারা রাত বসে থেকে তার নাকি আর চলতে ইচ্ছে করছে না। হোটেল টা ফারাজের এক ফ্রেন্ড এর। তাই আয়োজন বা কিছুতে তেমন সমস্যা হয় নি। তাদের সবার রুম একই দিকে। নীতি রুমে ঢুকতে নিতে ফারাজ পিছু ডাকলো। ডাক শুনে নীতির মন চাইলো দৌড়ে রুমে ঢুকে যেতে। কিন্তু সে তা পারবে না। তাই পিছু ঘুরলো। ফারাজ তার কাছে এসে বলল,
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন। একদম লজ্জা পাবেন না।’

লজ্জার কথা শুনে নীতির লজ্জা লাগছে। সে মিন মিন করে বলল,
‘আমি লজ্জা পাই না।’

ফারাজ বাকা হাসলো।টিটকারি মেরে বলল,
‘রাতে ঘুম কেমন হলো?’

নীতি ফারাজের দিকে চোখ বড় করে তাকালো। তারপর রুমে ঢুকে গেল। দরজা আটকানোর আগে ফারাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘খুবই বাজে।’

তারপর ঠাস করে দরজা টা বন্ধ করে দিল। ফারাজ কানে হাত দিয়ে হেসে ফেলল।নিজেকে নিজে বলল,
‘কিন্তু আমার খুব ভালো হয়েছে।অনেক দিন পরর’

নীতির ফোনে ম্যাসেজ পাঠালো,
‘নীতি আপনি বড্ড অবাধ্য হচ্ছেন!এভাবে দরজা লাগায়?’

যার যার নাস্তা তার তার রুমে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারন জার্নি করে সকলে খুব ক্লান্ত। তাই সিদ্ধান্ত নিল দুপুর পর্যন্ত সবাই নিজেদের রুমে থাকবে রেস্ট করবে।

খাবার আসার পর সেই কখন থেকে ডাকছে ফায়াদ অপরাজিতাকে। কিন্তু তার কোনো খবরই নেই৷ ঘুমে মশগুল। ফায়াদ বলছে খেয়ে আবার ঘুমাতে কিন্তু অপরাজিতার কানে তা ঢুকছেই না। ফায়াদ এবার সিরিয়াস ভাবে বলল,
‘তুমি উঠবে নাকি তোমাকে নিজের পদ্ধতিতে তে উঠাবো?’

অপরাজিতা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। ফায়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। গিয়ে অপরাজিতাকে চট করে কোলে তুলে নিল। তাতেও অপরাজিতার তেমন হেলদোল হলো না। সে ফায়াদের গলা জড়িয়ে ধরলো। তারপর হালকা আওয়াজে বলল,
‘আমার না পেট ব্যথা করছে’

ফায়াদ ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বাহানা বানাচ্ছো? খাওয়া দাওয়া করলে ব্যথা চলে যাবে।’

ওয়াশরুমে গিয়ে ফায়াদ অপরাজিতাকে নামিয়ে দিল। দাড়া করিয়ে দিয়েই অপরাজিতাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিল।হঠাৎ ভিজে যাওয়ায় অপরাজিতা হকচকিয়ে উঠলো। ফায়াদের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গি করে বলল,
‘সিরিয়াসলি?’

ফায়াদ পাত্তা দিল না। বের হয়ে যেতে যেতে বলল,
‘একেবারে গোসল সেড়ে বের হও। ফ্রেশ লাগবে৷’

ফায়াদ যেতেই অপরাজিতা ফায়াদকে মনে মনে বকা শুরু করলো। এখন আর কি করবে। ভিজে তো গেলোই।
শাওয়ার নিতে নিতেই অপরাজিতা বুঝলো তার কিছু হয়ে গিয়েছে। সে এবার সত্যিই অসহায় বোধ করলো।এখনি হতে হলো?কেন?

অপরাজিতা ফায়াদকে ডাকছে।ফায়াদ অপরাজিতার লাগেজ বের করে কাপড় এগিয়ে দিল দরজার ফাকা দিয়ে। অপরাজিতা কাপড় হাতে নিয়ে দরজা দিয়ে মাথা বের করে আস্তে করে বলল,
‘আরেকটা জিনিস লাগবে’

ফায়াদ বলল,
‘কি?’

অপরাজিতা ইতস্তত করছে।কিভাবে বলবে সে? অপরাজিতাকে ভাবতে দেখে ফায়াদ বলল,
‘বলবে তো?’

অপরাজিতা আমতা আমতা করে বলল,
‘আসলে আমার হয়েছে।মানে আর কি! ওই যে প্রতি মাসে মেয়েদের–‘

পুরোটা শেষ করতে হলো না।ফায়াদ কোনো রিয়েকশন না দিয়ে বলল,
‘বুঝেছি। কোথায় আছে বলো।’

অপরাজিতা বলল।ফায়াদ দিল বের করে তার প্রয়োজনীয় জিনিস।অপরাজিতার খুব লজ্জা লাগছে। এখনই কেন হলো। ঘুরতে এসেও নিজস্ব বাধা!!

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফায়াদ অপরাজিতাকে খেতে ডাকলো। চুপচাপ খেয়ে নিল সে। খাওয়া শেষে ফায়াদ জিজ্ঞেস করলো,
‘পেট ব্যাথা আছে?’

‘অল্প’

‘আচ্ছা রেস্ট করো। ঘুমাতে চাইলে ঘুমাতে পারো এখন।’

অপরাজিতা বিছানায় বসে বিছানা খুটাতে খুটাতে বলল,
‘আপনি বুঝলেন কিভাবে?’

‘কি?’

‘এই যে আমার যে–‘

ফায়াদ তার পরনের টিশার্ট খুলে পাতলা একটা টিশার্ট পড়তে পড়তে অপরাজিতার পানে তাকিয়ে বলল,
‘আমি ডক্টর ভুলে যাচ্ছো?’

অপরাজিতা জিবে কামড় দিল।আসলেই তো। তার জামাই তো ডক্টর।
ফায়াদ অপরাজিতাকে বলল,
‘শুয়ে পড়ো।’

‘আপনি কি করবেন?’

ফায়াদ বিছানায় এগিয়ে এসে অপরাজিতার পাশে শুয়ে পড়লো।অপরাজিতাকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবো।’

নীতির এখন আর ঘুম আসছে না। তাই সে বের হলো হোটেল টা ঘুরে দেখতে। হোটেল এর একসাইডে থেকে সমুদ্র দেখা যায়। নীতি বাগানের দিকে গেল। সেখানে যেতেই চোখে পড়লো ফারাজকে।
ফারাজ দাড়িয়ে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে।নীতি জানে ফারাজ সিগারেট খায় মাঝেমধ্যেই। তাই সে অবাক হলো না। নীতি গিয়ে ফারাজের পাশে দাড়ালো।
ফারাজ নীতিকে দেখে সিগারেট লুকালো না। সে নীতিকে একটি হাসি উপহার দিল। নীতিও তা সাদরে গ্রহণ করলো।

‘ঘুমোন নি?’

‘ঘুম আসছে না ‘

‘কেন? আপনার না বাজে ঘুম হয়েছে?’

নীতি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।ফারাজ তা দেখে হেসে বলল,
‘আচ্ছা থাক ঘুমাতে হবে না।আমাকে সঙ্গ দিন’

‘না’

‘কেন?’

‘আপনি অপরাধী’

ফারাজ অবাক হয়ে বলল,
‘কি করেছি?’

নীতি হাত ভাজ করে বলল,
‘এতো সুন্দর একটা জায়গার বায়ু দূষণ করছেন’

ফারাজ হাতের সিগারেট এর দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। তারপর সেটা ফেলে দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা ফেলে দিয়েছি।এখন কি ম্যাডাম আমাকে কোম্পানি দিবেন?’

ফারাজের বলার ভঙ্গিতে হেসে দিল নীতি। মাথা দুলিয়ে বলল,
‘হুম’

ফারাজ আর নীতি হাটছে। হাটতে হাটতে নীতি বলল,
‘জায়গা টা খুব সুন্দর’

‘সমুদ্র আরো সুন্দর।’

‘তাই?’

‘তবে!’

‘তবে?’

ফারাজ রহস্যময় হেসে বলল,
‘থাক জানতে হবে না।’

নীতির কৌতুহল লাগছে। সে বলল,
‘বলেন’

ফারাজ ত্যাড়ামি করে বলল,
‘না’

‘বলবেন না?’

‘না’

নীতির বিরক্ত লাগলো। উল্টো পথে হাটা শুরু করে বলল,
‘দিব না কোম্পানি।থাকেন একা!’

ফারাজ পিছু ডেকে চিল্লিয়ে বলল,
‘আরে এটা রেখে যাচ্ছেন কেন?’

নীতি হাটা থামিয়ে পিছু ফিরে বলল,
‘কি?’

ফারাজ দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘আপনার মন’

নীতি এবার সত্যি ভীষণ বিরক্ত হলো। লোকটা তাকে এভাবে বিরক্ত করছে কেন? আগে তো এমন করতো না। তাকে বিব্রত করে কি মজা পায়!সে রাগে বলল,
‘মুড়ি খান সেটা দিয়ে।’

বলে হনহনিয়ে হেটে হোটেলের ভিতর চলে গেল। ফারাজ উচ্চ স্বরে হাসছে। এই মেয়ে রাগও দেখায় আজকাল! ইন্টারেস্টিং! তার থেকেও ইইন্টারেস্টিং হচ্ছে মন দিয়ে মুড়ি।হুম!! ট্রাই করতে হবে ফারাজের।সে হেসে শিস বাজাতে বাজাতে আরো সামনে এগিয়ে গেল।

(চলবে)

(তাড়াতাড়ি দিবেন বলিয়া লজ্জা দিবেন নহে৷ আমি আমার সাধ্যমতো প্রতিদিন দেওয়ার চেষ্টা করছি।আশা করি কেউ রাগ করবেন না।আপনাদের জন্যই এতো রাতে লিখেছি। হ্যাপি রিডিং কিউট পিপলস 💖)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here