প্রেম প্রেম পায় পর্ব ১৯

0
911

#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ঊনিশ

১৯.
আজ সারাদিন পার হয়ে রাত নামলো। খুবই ব্যস্ত দিন থাকায় ফায়াদ খুব ক্লান্ত। তাই ড্রাইভারকে কল করে আসতে বলল।এই ক্লান্তিতে গাড়ি ড্রাইভ করা তার আজ ইচ্ছা করছে না। দেহ ক্লান্তের সাথে মনটাও যেন ক্লান্ত। আজ সারদিনে চির পরিচিত সেই কন্ঠটা একবারো শোনা হয় নি।কাজের ফাকে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কল দিল।এই বুঝি চলে এসেছে দেখা করতে। কিন্তু তা শুধুই তার মনে হচ্ছিল। মেয়েটা অভ্যাস বানিয়ে দিয়েছে তার কণ্ঠ প্রতিদিন শুনার। তার সেই মুখ প্রতিদিন দেখার। আজ একদিন না শুনে বা না দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কি যেন একটার অভাব ছিল।তাকে দেখার জন্য মনটা আনচান করছে ফায়াদের। নতুন আরেক প্রেমের অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো ফায়াদ।
কাল রাতে হুমকি দেওয়ার পর মেয়েটা আর কল দেয় নি তাকে৷ অভিমান করে আছে বোধহয়। মনে মনে হয়তো অভিমান ভাঙানোর অপেক্ষায় আছে। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিল।পকেট হাতরে মোবাইল বের করে কল করলো প্রিয় নারীর কাছে। চোখ বন্ধ করে কানে ফোন ধরে আছে ফায়াদ।

অপরাজিতা পড়ার টেবিলে বসে আছে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে পাবলিকে চান্স পেয়ে দেখিয়ে দিবে যে সে ভালোবাসায় গা ভাসিয়ে দুনিয়া ভুলে যায় নি। তখনি ফোন আসলো৷ নাম্বারটা দেখে সাথে সাথে রিসিভ করতে নিয়েও নিজেকে দমিয়ে ফেলল।তারপর আস্তে ধীরে রিসিভ করে চুপচাপ ফোন কানে দিয়ে বসে আছে৷ কথা বলছে না।

ফোন রিসিভ হওয়ার পর নিরবতা দেখে ফায়াদ ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
‘কথা বলবে না?’

ফায়াদের কণ্ঠ শুনে বুঝা যাচ্ছে সে আজ খুবই চাপের মধ্যে ছিল। অপরাজিতার খুব মায়া লাগলো৷ সে আর রাগ দেখাতে চাইলো না। চাইলো না বলতে সে আসলে রাগ দেখাতে পারলো না। এই গম্ভীর পুরুষের সামান্য কষ্ট তাকে কষ্ট দেয়।
নিরবতা ভেঙে অপরাজিতা আস্তে করে সুধালো,
‘বাসায় গিয়েছেন? আপনাকে খুব ক্লান্ত শুনাচ্ছে। বাসায় পৌছে ঘুমান।’

ফায়াদ তার গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে নিচু স্বরে বলল,
‘হুম খুব ক্লান্ত। তার থেকেও ক্লান্ত লাগছে তোমাকে না দেখতে পেরে। তুমি কি একটু আসবে?’

অপরাজিতা বুঝার চেষ্টা করে বলল,
‘আসবো বলতে?’

‘আমি তোমার বাসার সামনে আছি। আসো।’

বলে ফোন রেখে দিল। অপরাজিতা অবাক হলো।বাসার নিচে মানে? এখন রাতে সে কি বলে বের হবে? বাবা বাসায়। যদি জানে তাহলে তো অন্যকিছু ভাববে। অপরাজিতা চায় না বাবা ফায়াদকে খারাপ ভাবুক।
অপরাজিতা মাথায় উড়না চাপিয়ে ড্রয়িং রুমে গেল। বাবা নেই সেখানে। তারমানে বাবা রুমে। মেয়েকে এমন উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে রামিসা জিজ্ঞেস করলেন,
‘কোথায় যাচ্ছিস?’

অপরাজিতা তাড়াতাড়ি করে তার মা কে ইশারায় আস্তে করে কথা বলতে বলল।সে তার মা কে মিথ্যা বলে যেতে চাচ্ছে না। বলতেও লজ্জা পাচ্ছে তবুও বলল,
‘আম্মু উনি নিচে আসছে। একটু দেখা করে আসি?’

রামিসা ভ্রু কুচকে বললেন,
‘উনি কে?’

‘ফা-ফায়াদ’

ফায়াদের নাম ধরে কখনো সে ডাকে নি তাই একটু ইতস্ততবোধ করছিল।রামিসা তীক্ষ্ণ ভাবে বলল,
‘রাতের বেলা কিসের দেখা? এখন যাওয়া যাবে না।’

‘আম্মু প্লিজ! আমাকে বিশ্বাস করো না?’

রামিসা এবার স্বাভাবিক ভাবে বললেন,
‘বিশ্বাস করি বলেই এতো টা ছাড় পাচ্ছো নাহলে কোনো মেয়ে এসে সাহস পেতো না মায়ের কাছে এভাবে বয়ফ্রেন্ড এর কথা বলতে।’

অপরাজিতা মাথা নিচু করে ফেলল।রামিসা বললেন,
‘যাও। তাড়াতাড়ি আসবা। দেড়ি যেন না হয় বলে দিলাম।’

অপরাজিতা খুশি হয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউউউউ।উম্মাহ!’

মায়ের গালে টুকুস করে একটা চুমু খেয়ে দৌড় মারলো সে। রামিসা মেয়ের কান্ডে হেসে দিয়ে বললেন,
‘পাগল মেয়ে!’

অপরাজিতা গেটের বাহিরে গিয়ে দেখলো বাসার একটু সামনে কালো গাড়িটা পার্ক করা। উড়না মাথা ভালো ভাবে চাপিয়ে গাড়ির সামনে যেতেই দেখল গাড়ির সামনে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে।সে যেতেই ড্রাইভার তাকে পিছনের সিটের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
‘আপামনি ভিতরে বসেন।আমি একটু পর আসছি।’

বলে সে চলে গেল অন্যদিকে। অপরাজিতা গাড়ির পিছনে বসতেই দেখলো ফায়াদ সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তাকে দেখতে আসলেই ক্লান্ত লাগছে।ফায়াদের কাধে হাত রাখলো সে। ফায়াদ মাথা বাকিয়ে তাকে দেখে নিচু কন্ঠে বলল,
‘গাড়ির লাইটটা অফ করবে? চোখে লাগছে৷’

অপরাজিতা গাড়ির লাইটটা অফ করে দিল৷ সিটে বসতেই ফায়াদ তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। পিঠে হাত রেখে জড়িয়ে নিল অপরাজিতাকে নিজের সাথে।কাধে মাথা গুজে দিল। অপরাজিতা কেপে উঠলো। এসব তার কাছে নতুন। এই স্পর্শ গুলো সে আগে কখনো অনুভব করে নি৷ শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন শিহরণ বইয়ে দেয়। অপরাজিতার উন্মুক্ত ঘাড়ে ফায়াদের গরম নিশ্বাস পড়ছে।যার দরুন অপরাজিতা কেপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।
সে ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো,
‘আআপনি ঠিক আছেন?’

ফায়াদ কাধে মাথা রেখেই বলল,
‘ঠিক আছি। একটু জ্বর এসেছে তাই দুর্বল লাগছে।’

জ্বরের কথা শুনে অপরাজিতা অস্থির হয়ে উঠলো। পটর পটর আর নড়া চড়া শুরু করায় ফায়াদ তাকে হালকা করে ধমক দিয়ে বলল,
‘আহহা এমন করছো কেন?থাকো এভাবে। ভালো লাগছে আমার।’

স্থির হলো অপরাজিতা। তার কান্না পাচ্ছে। ফায়াদের পিঠে হাত রেখে ব্যাকুল হয়ে বলল,
‘বেশি খারাপ লাগছে?আমাদের বাসায় চলুন।’

ফায়াদ অপরাজিতাকে আরেকটু কাছে শক্ত করে ধরে বলল,
‘তুমি একটু থাকো তাহলেই হবে।’

অপরাজিতা ফায়াদের পিঠে হাত বুলিয়ে শুধু বলল,
‘হুম।’

কারন ফায়াদ এর বেশি কথা শুনবে না।ফায়াদ আবার বলল,
‘রাগ করেছো?’

‘না’

ফায়াদ অপরাজিতার ঘাড়ে চুমু খেল। একটা নয় পর পর দুটো চুমু খেল সে।তারপর আবারো কাধে মাথা দিয়ে বলল,
‘তোমাকে আমি শাসন করবো, ভালোওবাসবো৷ তুমি রাগ করবা না।’

অপরাজিতা তো ফায়াদের কান্ডে জমে গেছে। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। ফায়াদের পিঠের শার্ট খামছে ধর কাপা কন্ঠে বলল,
‘আপনি–‘

এতোটুকু বলতেই ফায়াদ অপরাজিতার কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে অপরাজিতা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। বলল,
‘জ্বর আমাকে কাবু করে নি।কাবু তুমি করছো। হুশ হারাই নি এখনো। তবে হুশ হারাতে চাচ্ছি।তাই তোমার এখানে থাকা যাবে না।নাহয় হুশ হারিয়ে বেহুশের কিছু করে ফেলবো লাগছে। নাহ এখন আর তোমার এখানে থাকা যাবে না। বাসায় যাও এখন। ‘
এতোটুকু বলে সে অপরাজিতার কপালে অধর ছুয়ে গাড়ির গেটটা খুলে দিল।

অপরাজিতা বাধ্য মেয়ের মতো গাড়ি থেকে বের হলো।এখন বের না হলে ধমকিয়ে বের করতো তাকে৷ বেরিয়ে গাড়ির ভিতরে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি তো একা। ‘

‘তুমি বাসায় যাও। ড্রাইভার এসে পড়বে। ‘

অপরাজিতা ফায়াদের দিকে তাকিয়ে আদেশের মতো করে বলল,
‘বাসায় গিয়ে খেয়ে মিডিসিন নিয়ে ঘুমাবেন।কালকে ছুটি নিবেন।ঠিক আছে?’

ফায়াদ বাচ্চাদের মতো করে বলল,
‘ইয়েস ম্যাম’

ফায়াদের বলার ভঙ্গিতে অপরাজিতা না হেসে পারলো। তারপর সে পা বাড়ালো বাসার দিকে। কিন্তু মনটা যেন গাড়িতেই পড়ে আছে। বাসার মধ্যে ঢুকে উকি দিয়ে দেখলো ড্রাইভার এসেছে কিনা! যখন দেখলো এসেছে, তারপর সে স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে ঘরে গেল।
ঘরে প্রবেশ করতেই মায়ের সম্মুখীন হলো।

‘হলো দেখা?’

‘হুম’

মেয়ের মনটা খারাপ বুঝতে পারলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কি হয়েছে? ঝগড়া করেছিস!’

অপরাজিতার চোখ টলমল করে উঠলো।
‘উনি অসুস্থ’

রামিসা চিন্তিত হয়ে বললেন,
‘সে কি? কি হলো?’

‘জ্বর আর সারাদিন হাসপাতালে অনেক কাজ ছিল আজ তাই খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছে।’

‘ওহ ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না।’

তারপর অপরাজিতাকে রুমে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। অপরাজিতার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তার ছোট্ট মেয়েটা এখন ভালোওবাসতে জানে।মেয়েটা বড় বুঝি হয়েই গেল! বাবার ছোট্ট পুতুলটার এখন মন পুড়ে অন্য কারো জন্য। মেয়েটা পরের বাড়ি চলে যাবে ভাবলেই চোখের কোণ ভিজে আসে তার।

—————-

এয়ারপোর্টে ওয়েটিং এ বসে আছে ফারাজ আর নীতি। অ্যানাউন্সমেন্ট হলে ফ্লাইটে উঠবে। ফারাজ মোবাইল চালাচ্ছে। নীতি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। হঠাৎ তার মাথায় আসলো একটা কথা। ফারাজের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য গলা খাকারি দিল সে। ফারাজ ভ্রু কুচকে তাকালো।
নীতি বলল,
‘আমি যে জিন্স টপস পড়ি এগুলো কি বাংলাদেশে পড়তে পারবো?’

ফারাজ আবারো মোবাইলে মমনোযোগ দিয়ে বলল,
‘হ্যা পারবেন।’

নীতি খুশি হয়ে গেল। কারন সে এগুলোতেই অভ্যস্ত। তারপর কিছু মুহুর্ত পর ফারাজ মোবাইল পকেটে রেখে বলল,
‘পড়তে পারবেন কিন্তু পড়বেন না।তাই আমরা বাংলাদেশ গিয়ে রেস্ট আস্তে ধীরে শপিং মলে যাবো।’

‘কেন?’

ফারাজ নীতির দিকে ঘুরে বলল,
‘এখানে মেয়েদের এগুলো নরমাল কারন সবার ড্রেসাপ এরকম। কিন্তু বাংলাদেশে এগুল পরে কিছুদূর হাটলেই শুনতে পাবেন কেউ বলছে চুমকি চলেছে একা পথে…’

নীতি কপাল চাপড়ে বলল,
‘স্যাড লাইফ!’

ফারাজ নীতির মাথায় হালকা করে বারি দিয়ে বলল,
‘আপনার কম্ফোর্ট এর মধ্যে কিছু একটা কিনে নিবেন।আর আপনি আজ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমাকে কিসব গলা খাকারি দিয়ে তারপর কেশে ডাকছেন। এসব কি?’

‘আপনি তো বলছেন অফিসের বাহিরে স্যার ডাকতে না। ‘

ফারাজ পরাজয় স্বীকার করে বলল,
‘ওকে ম্যাডাম! স্যারই ডাকেন।’

এরই মধ্যে অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেল। ফারাজ উঠে দাড়ালো। নীতি উঠে দাড়াতে গিয়েই পিছে কিছুর সাথে আটকে তার পরণের লং শার্ট টা পিঠ বরাবর ছিড়ে গেল। নীতি চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে গেল। ছেড়ার আওয়াজ শুনে ফারাজ পিছে তাকালো।নীতি আবারো বসে পড়লো।ফারাজ নীতির দিকে তাকাতেই নীতি কাদোকাদো মুখ করে তাকালো।তাদের কাছে ব্যাগও নেই এই মুহুর্তে। ব্যাগ এর কাছে যেতে হলে নীতিকে হাটতে হবে কিছুদূর। এভাবে তো সম্ভব না।
ফারাজ নীতিকে তার পরণের উপরের ব্লেজার খুলে দিতে দিতে বলল,
‘আপনি কি যে করেন!’

নীতি জড়োসড়ো হয়ে আছে। ব্লেজার পড়ে ফ্লাইটে উঠার জন্য হাটা শুরু করলো দুজন। ফারাজ আগে আগে হাটছে। নীতি তার পিছে পিছে। হাটতে হাটতে নীতি খুব সুন্দর একটা সুগন্ধ পেল খুব কাছ থেকে। উৎস খুজতে গিয়ে বুঝলো ব্লেজার থেকে আসছে। দারুন মন মাতানো সুগন্ধ। নীতি একবার ফারাজের দিকে তাকালো।ফারাজ সামনের দিকে মনোযোগী। নীতি ব্লেজার টা ভালোভাবে আকড়ে ধরে অনুভব করছে সেই সুগন্ধ।মিষ্টি এক অনুভুতি কাজ করছে তার মধ্যে। কিসের জন্য এই অনুভূতি?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here