#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ৩৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৮৮,
রায়াদের নিস্তেজ মুখপানে দৃষ্টি আবদ্ধ রিয়ানার। নিজের রুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে হেলান দিয়ে বসে সোফার সামনে ছোট্ট টি-টেবিলে পা তুলে দিয়ে বসে আছে। হাতে সিগারেট জ্বলছে। সিগারেটে ধোয়ায় খানিক পরপর মুখের উপর ধোয়ার কুন্ডলী পাকছে। চিন্তায় মাথা ফেটে যাবার যোগার তার। দু’টো দিন হলো রায়াদ এমন তার বিছানায় পরে আছে। ঘাড়ত্যাড়া ছেলে-টাকে বাসা থেকে বিদায় করতে পারলো না। হাতে-পায়ে এমন চোট পেয়েছে! দাড়ালে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। তখন কারো একজনের সাহায্য নিতে হয়। হাসপাতালে রাখা লাগতো। অসভ্য ছেলে-টা জিদ করে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করাতে বাধ্য করেছে। তাহিয়ার বাসাতে সেন্স ফেরার সাথে সাথে আরেক জিদ তার বাসায় আসবে। রাতের বেলাতেই তাহিয়ার সাহায্য নিয়ে বাসায় এনেছে। আনার পর এই যে বাসায় তার রুমে শুয়েছে! আর উঠছেনা দরকার ছাড়া। রাতের চোটে মাথার রগ দপদপ করছে রিয়ানার। রায়াদের জিদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে আয়াত এবং জুবায়ের৷ দুজনই রায়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিতে জোড় করেছে তাকে। রায়াদের শারীরিক অবস্থা দেখে রিয়ানা দমে গেছে। সবকিছু মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছে। এখন বসে অপেক্ষা করছে কখন ঘুম-টা ভাঙবে! আর তার রুম থেকে বের করবে। আয়াত আর রিয়ানা একরুমে, রিয়ানার রুমে জুবায়ের আর রায়াদ থাকে। অসুস্থতার ফায়দা নিচ্ছে রায়াদ। এটা রিয়ানা ভালো মতোই জানে। তাকে জব্দ করতে চাচ্ছে! জব্দ করা আজ বের করবে। রিয়ানা হাতের সিগারেট পুরিয়ে আরও একটা সিগারেট ধরালো। বাংলাদেশ থেকে ফেরার পর এই এতদিন পর সিগারেট ধরিয়েছে সে। রায়াদ চাচ্ছে-টা কি? এই চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আয়াত নিচে রান্না করছে। জুবায়ের রায়াদের ভার্সিটিতে সব ব্যবস্থা করতে হবে বলে রায়াদর সবকিছু উর্জবার্গ থেকে আনার জন্য চলে গেছে ভোর পাঁচ টার ট্রেইনে। রিয়ানার ঘুম ভাঙতেই নিজের কাপড় নিতে রুমে এসে রায়াদকে তার বিছানায় আরাম করে ঘুমাতে দেখে তার মেজাজ চটে যায়। নিজের বিছানা অন্য বিছানায় আচমকা ঘুমালে তার ঘুম হয়না। ৩-৪দিন সময় লেগে যায় মানিয়ে নিতে। তার ঘুম নষ্ট করে এখানে অন্যজন আরামে ঘুমাচ্ছে? রাগের চোটে সে সিগারেট ধরিয়েছে। খাক বা না খাক! বাসায় সবই এনে রেখে দেয় রিয়ানা। মন খারাপ থাকলে বিয়ার হোক বা ওয়াইন অথবা হোক সিগারেট! সে কিছু একটা মুখে তুলে। নতুবা তার শান্তি হয়না। বড় হলো তো এসব করেই। এতদিনের অভ্যাস কি আর বদলায়? রিয়ানার ভাবনা চিন্তার মাঝেই রায়াদ চোখ পিটপিট করে তাকালো। তা দেখে রিয়ানা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“বেলা বাজে ন’টা। ঘুম ভাঙলো তবে?”
রায়াদ রিয়ানার গলার স্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তাকাতেই চমকালো সে। রিয়ানার হাতে সিগারেট দেখে ব্যথা ভুলে হন্তদন্ত হয়ে তার সামনে আসার চেষ্টা করতেই পায়ের রগে টান পরলো তার। ব্যথায় ককিঁয়ে উঠতেই রিয়ানা সিগারেট ফেলে রায়াদের দু বাহু আকড়ে ধরলো। ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে খিটখিটে মেজাজে বললো,
“ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই বাঁদরামি? চিড়িয়াখানা পেয়েছেন এটা?”
রায়াদ মৃদু হাসলো রিয়ানার কথায়। তার জন্য রিয়ানার ব্যস্ততা দেখে মজার ছলে বললো,
“আমি না হয় মরে যাই! বাঁদরামি করি। তোমার তাতে কি?”
৮৯,
রায়াদের মুখে প্রথমবার তুমি সম্মোধন শুনে রিয়ানা চকিতে রায়াদের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো। থমথমে গলায় বললো,
“আপনি ছেড়ে হঠাৎ তুমি?”
“৬-৭বছরের ছোট আমার থেকে। আপনি করে অনেক বললাম। আর সম্ভব না।”
“বেশ উন্নতি। এবার নিজের অসুস্থতা ছুটিয়ে বাসা থেকে বিদেয় হোন। সব শান্তি উধাও করে দিয়েছেন।”
রায়াদ স্মিত হেসে নিজের একহাত কোনোমতে উঠিয়ে রিয়ানার গাল টিপে দিয়ে মজা করে বললো,
“ইশ রে বাচ্চা মেয়ে-টা। রাগলে এত সুন্দর লাগে। হাসলে না জানি কত সুন্দর লাগবে! ও মেয়ে একটু হাসো প্লিজ! অনেক তো রাগ দেখলাম। এবার একটু হাসো প্লিজ!”
রায়াদ কথাগুলো বলার পর রিয়ানা হতভম্ব। ২২বছর চলছে তার। সে বাচ্চা? লাইক সিরিয়াসলি? সে কড়া গলায় বললো,
“আর একবার আমায় বাচ্চা বলবেন? সোজা কোলে চড়ে বসে থাকবো। তখন বাচ্চাদের মতো সামলিয়েন।”
“এটা তো সোনায় সোহাগা মেয়ে। চাইতেও তোমায় কাছে পাই না। তখন তোমার ইচ্ছায় পেয়ে যাবো। কত্ত মজা না? বাচ্চা মেয়ে একটা। গাল ফুলালে কি কিউট লাগে। ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি।”
“আহারে এত খাওয়ার শখ? তো চলেন, শুরু করেন খাওয়া। দেখি আমায় খাওয়ার মতো দম আপনার কতটুকু?”
রায়াদ ফাঁকা ঢোক গিললো এবার। এ মেয়ে-কে একটু লজ্জায় ফেলতে চায়। কিন্তু মেয়ে-টা ঘুরে উল্টে তাকেই লজ্জায় ফেলে দেয়। কি বজ্জাতের বজ্জাত। রায়াদ রিয়ানার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানায় বসলো। থমথমে গম্ভীর মুখে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি মেলে বললো,
“সিগারেট কেন খাচ্ছিলে?”
“জবাব দিতে বাধ্য নই। আর প্লিজ আমায় তুমি বলবেন না। আমার শুনতে উইয়ার্ড লাগছে।!
” লাগুক, তাতে আমার কি? আমার কথার জবাব দাও।”
“বললাম না বাধ্য নই।”
“তুমি ১০০% বাধ্য রিয়ানা। ভালোবাসি তোমায়। আর একটা বাজে বকলে ঠাটিয়ে চড় বসাবো। অনেক হয়েছে তোমার ঘাড়ত্যাড়ামি। সহ্য ক্ষমতা পেরিয়ে যাচ্ছে আমার।”
“কথায় কথায় থাপ্পড় মারতে চান কেন? আমার উপর কিসের এত অধিকার আপনার?”
“ভালোবাসার অধিকার। ভালোবাসি তোমায়। তুমি এটা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনা। আর তুমি মেয়ে-টা এমন-ই। সোজা কথার মানুষ না। তোমায় ঠাটিয়ে চড় মেরে আমার ভালোবাসা বুঝাবো। সাইকো প্রেমিক হবো। আর তুমি হবে আমার সাইকোলজিস্ট। বিষয়-টা সুন্দর তাইনা?”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
“সে তো তুমি মনে ভালোবাসা লুকিয়ে এর আগেও একজনকে বলেছো ভালোবাসো না। নিজের মনকে প্রশ্ন করো তো? আমায় ভালোবাসো না এটা সত্যি তো? এই একবছরে আমায় একটুও মনে পরেনি তোমার? মিস করোনি আমায়? মনে হয়নি রায়াদ শাহনেওয়াজ একটা সুযোগ ডিজার্ভ করে?”
রিয়ানার কর্ণকুহরে কথাগুলো প্রবেশ করতেই তার মনে প্রশ্ন গুলো জেগে গেলো। মনের মাঝ-টায় ধরফর করতে লাগলো। তার সত্যি টা বুঝি ধরা পরবে এবার? রায়াদকে যে মিস করেছে! এটা তার চোখমুখে প্রকাশ পাচ্ছে নাকি! নিজের অনুভূতি লুকাতে রিয়ানা ব্যস্ত পায়ে রুম ছাড়লো। রায়াদ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আনমনে বিরবির করলো,
“মিস রিয়ানা হোসাইন। তুমি আমার ভালোবাসায় ফেসেছো বহু আগে-ই। তুমি অস্বীকার করলেই আমি তো সই দিবো না। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ। অনেক হলো তোমার মন মতলবি। আর নয়। এবার যা করার আমি-ই করবো।”
বিকেলবেলায়।
আয়াত-জুবায়ের সুপার-শপে গেছে একটু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে। রিয়ানা ভার্সিটি থেকে ফিরতেই আয়াত তাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে রায়দের দিকে খেয়াল রাখার। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আয়াত তার গালে হাত বুলিয়ে একটু সহ্য করার জন্য অনুরোধ করেছে। রিয়ানা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও তার কথা মেনেছে। রায়াদ দুপুরের খাবার পর রেস্ট করছে তার রুমে। রিয়ানা অন্য রুমের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে। আকাশে মেঘ জমেছে আবারও। কিন্তু এই মেঘে বৃষ্টি নামবেনা। কি সুন্দর আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনও ঘন কালো মেঘ তো কখনও নীল আকাশ। ওয়েদার-টা কফির মগ হাতে উপভোগ করছে রিয়ানা। খানিক পরে নিজের পাশে রায়াদের অস্তিত্ব টের পেলো। সেই কড়া পারফিউম। যার ঘ্রাণে রিয়ানার বুঝতে অসুবিধা হয়না এটা কে? রায়াদের দিকে তাকালো রিয়ানা। প্রশ্ন করেই বসলো,
“সেই একই পারফিউম। এখানে পেলেন কোথায় যে ইউজ করেছেন?”
“জুবায়েরকে আনতে বলেছিলাম। এনেছে।”
রিয়ানা কিছু বললো না। সামনে দৃষ্টি ঘুরালো। জুবায়ের রায়াদের জন্য অল্প বিস্তর শপিং করেছিলো রায়াদকে নিয়ে ফেরার পর। দুদিন ওসব পরেই ছিলো। আজ সেই পুরোনো গেট-আপ এ দেখে রিয়ানার স্মৃতিতে সেই এক বছর আগের রায়াদকে চোখে ভাসছে। রায়াদ বুকে হাত বেঁধে সামনে দৃষ্টি ফেলে শুধালো,
“আমি কি সত্যি একটা সুযোগ ডিজার্ভ করিনা রিয়ানা? তোমার ভালোবাসতে হবেনা। আমার ভালোবাসা এনাফ আমাদের সম্পর্কের জন্য।”
“আমার ভালো লাগছেনা এই টপিকে কথা বলতে।”
“মন খারাপ তোমার? কি কারণে শেয়ার করো শুনি!”
“আমার মন খারাপ হয়, কান্না পায়। বিষাদ জমে। সব উড়িয়ে দেই চিঠি লিখে রঙিন খামে। আমার মন খারাপের কোনো কারণ লাগেনা যে আপনাকে বলবো।”
“তোমার রঙিন খাম-টা না হয় আমি-ই হলাম! আমার মাঝে-ই না হয় জমবে তোমার বিষাদের চিঠি। সেখানে তুমি বিষাদ জমাবে । তাকে জড়িয়ে চাপা রেখে হাসিখুশিতে তোমায় একটু ভালোবেসে মাতিয়ে রাখলাম আমি! আমরা দুজন মিলে হইনা একটু তোমার আমার রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি।”
চলবে?