#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ২৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৫৭,
পরদিন বিকেলবেলায়, একটা ক্যাফেতে বসেছে জুবায়ের এবং আয়াত। অবশ্য দেখা-টা জুবায়ের-ই করতে চেয়েছে। সে নিজে-ই বাইক নিয়ে আয়াতকে আয়াতদের বাড়ি থেকে নিয়ে ক্যাফেতে নিয়ে এসেছে। কফির অর্ডার দিয়ে বসে আছে দুজন। আয়াতের ভেতরে ভেতরে উশখুশ অনুভূতি হলেও সে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বসে আছে। ওয়েটার কফি দিয়ে গেলে জুবায়ের কফির কাপ-টা হাতে নেয়। চুমুক বসিয়ে আয়াতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আয়াত কফির কাপ হাতে নেয়নি দেখে বলে উঠে,
“আন কমফোর্ট ফিল হচ্ছে আমার সাথে?”
আয়াত হকচকিয়ে যায় জুবায়েরের প্রশ্নে। হাসার চেষ্টা করে বলে,
“যার সাথে দুদিন পর এক ছাঁদের তলায় থাকতে হবে! তার সামনে আন কমফোর্ট ফিল করা নেহাৎ-ই বোকামি।”
“ওয়েল, আপনাকে কিছু কথা জানাতে আমি আজ এখানে ডেকেছি। ইট’স অল এবাউট মাইসেলফ এন্ড মাই পাস্ট। প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার যেহেতু আপনার সাথে পার করতে হবে। সো আই থিংক আপনার আমায় পুরো-টা জেনেই আমার জীবনে আগমন করা উচিত। কারণ আমাদের বিয়ে-টা হয়ে যায়নি এখনও। জাস্ট দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। আমি এসবের আগে-ই বলতে চেয়েছিলাম। বাট আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আগের বার যখন বাবা বিয়ের কথা তুলেছিলো, আমি জানতাম না পাত্রী আপনি। তাই মানা করেছিলাম। এরপর ঢাকায় গিয়ে যখন বুঝলাম পাত্রী-টা আপনি! আমি আফসোস করেছিলাম। যে বিয়ে-টা কেন ভাঙলাম? এরপর আবার যখন দাদুর জন্য ব্যাক করলাম গ্রামে। দাদু আর বাবা দুজন-ই জানালো, পাত্রীর বাবা আর চাচা সম্পর্ক-টা আগাতে চাচ্ছে। আগের বার ইচ্ছে করে কেউ বিয়ে ভাঙতে উনাদের ভুলভাল বুঝিয়েছিলো বিধায় তারা সম্পর্ক তৈরি করতে আগায়নি। এবার পাত্র মানে আমার সম্পর্কে সব খবরাখবর নিয়ে-ই তারা মানে আপনার বাবা আর সাজ্জাদ ভাইয়ের বাবা আগাতে চায়! তো আমি আর মানা করিনি।”
আয়াত জুবায়েরের কথার আগামাথা কিছু বুঝলো না। নিজেই বলছে বিয়ে ভাঙার কথা! আবার কেউ চেষ্টা করেছে ভাঙতে! মানে কি এসবের? সে বিস্ময় দমাতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
“কি বললেন একটু ক্লিয়ার করুন। বিয়ে-টা আপনি-ই বললেন, আফসোস করছেন ভেঙেছেন বলে! আবার বলছেন কেউ ভাঙার চেষ্টা করেছে! আগের বার জানতেন না পাত্রী আমি! পরের বার জানলেন পাত্রী-টা আমি। কিছু বুঝতে পারছিনা আমি।”
“লেইট মি এক্সপ্লেইন। প্রথমবার যখন বিয়ের কথা বাবা আমায় জানায়! আমি বিয়ে-টা করতে রাজী ছিলাম না। ভাঙার জন্য আমি-ই নিজেকে আড়াল করে আপনার বাবা আর চাচার কাছে নিজের সম্পর্কে বাজে কথা বলেছিলাম। এমনভাবে কনভিন্স করেছিলাম যে, উনারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হোন আমি খারাপ। কিন্তু কোথাও একটা আরিফ চাচ্চুর মনে খুঁতখুঁতানি রয়ে-ই যায়। এজন্য আপনি আর আপনার বাবা ঢাকা ব্যাক করার পর আমার সম্পর্কে সব খবরাখবর নিয়ে আপনার বাবাকে জানায়। এবং বোঝায়, কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন-টা করেছিলো। সেই কেউ-টা যে আমি! এটা উনারা এখনও জানেন না। আর আপনার বাবা আর চাচার মাঝে একটা বাকবিতন্ডার-ও সৃষ্টি হয়েছিলো আমার জানামতে। সেটা আপনিও জানেন কেন! ভাই হয়ে ভাইয়ের মেয়ের জীবন নষ্ট করতে এমন বাজে ছেলে চয়েজ কি করে করেছিলো আপনার চাচা? এটা নিয়েই ঝগড়া হয়েছিলো তাইনা?”
আয়াত মাথা নাড়ায়। বিস্মিত চাহনীতে তাকিয়ে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, তা হয়েছিলো। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?”
৫৮,
“আরিফ চাচ্চু বাবাকে বলেন৷ তার থেকে আমি অব্দি কথাগুলো আসে। ২য় কথা, আপনাকে আমি ঢাকায় গিয়ে দেখে প্রথমে বুঝিনি দাদু আর বাবার ঠিক করা পাত্রী আপনি। পরে বুঝতে পারি আপনার বাবাকে দেখে। কারণ আমার সামনেই আপনার বাবা আরিফ চাচ্চুকে ভাই ডাকছিলেন। যেদিন আমায় দেখার জন্য জন্য দুজন গিয়েছিলো সেদিন। এরপরে ঘটনা কমন। আংকেলকে দেখে বুঝতে পারি মেয়ে-টা আপনি। কারণ উনি আপনার বাবা। গেইজ করি পাত্রী-টা আপনি ছিলেন। সেজন্য বাড়িতে এসে আর আপত্তি করিনি। কারণ আপনার ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লেগেছে। আর আমার পরিবারেরও আপনাকে পছন্দ। তাই ২য় বার আপনাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ-টা মিস করলাম না।”
জুবায়ের জবাব দেয় আয়াতের কথার। আয়াত সব শুনে মাথা দুলিয়ে কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে শুধায়,
“সব বুঝলাম। আর একটা বিষয় ক্লিয়ার করুন। বিয়ে-টা কেন প্রথম বার ভাঙতে চেয়েছিলেন? আর ২য় বার পাত্রী আমি জেনে-ই বা বিয়ে-টা করতে রাজী কেন হলেন? আর বড়-বাবা, বাবা আপনাকে চিনলো না কেন? আপনার ভাষ্যমতে তো আপনি-ই বিয়ে-টা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন!”
“প্রথম প্রশ্নের থেকে আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিই। তা হলো আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ। আমরা দুজন-ই ভেতরে ভেতরে সব যন্ত্রণা চেপে হাসতে পারি। একটা রঙিন খামে নিজেদের মুড়িয়ে রাখি। যেটা সবাই করে না। আপনার বোনের প্রতি ভালোবাসা, বাবার প্রতি শ্রদ্ধা! আমার সাথে কিছু-টা ম্যাচ করে। আমিও আমার বোনকে+বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি। আর প্রথম বার ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম, কারণ আমার লাইফের ছোট্টো কিছু বাজে ঘটনা আর আমার সৎ মা মিসেস ডালিয়া চৌধুরী। আর আপনার বাবা, চাচা আমায় চিনতে পারেনি। কারণ আমি নিজেকে সেভাবে প্রকাশ করে তাদের সামনে যাইনি। যদি চেনার চেষ্টা করে! তবে হাইট ছাড়া কিছু সন্দেহ করতে পারবেনা তারা।”
“ওকে, দ্যান আপনার কি এমন পাস্ট আছে? যেটার জন্য বিয়ে অব্দি করতে চাননি! আর সৎ মায়ের কাহিনী-টা কি?”
“পাস্ট তেমন আহামরি কিছু নয়। আমার মা মারা যান আমার ৯বছর বয়সে। আমার বোন তখন ৪বছরের। আজ আমার বয়স ২৭পেরিয়ে ২৮ছুঁইছুঁই। এই যে ১৯টা বছর! তার মাঝে ৯বছর আমার ছোটোমা আমায় কম যন্ত্রণা দেননি। আমার মায়ের মৃত্যু-টা নরমাল মৃত্যু এটা বলা চলে না। আমার মা সু’ইসাইড করেছিলেন। এটা আমার মায়ের পাপের সাজা-ই বলা চলে। আমার মা পরপুরুষে আসক্ত হয়ে পরেছিলেন। যেটা জানাজানি হওয়ার পর উনি সু’ইসাইড করেন। এই যে আমার মা একটা ভুল করেছিলেন! স্যরি ভুল নয় অন্যায়। এই অন্যায়ের সাজা উনি মারা গিয়েও কমেনি। আমার ছোটোমা আমার বাবার চাচাতো বোন। উনারও আগে এক জায়গায় বিয়ে হয়েছিলো। সেখানে তার স্বামী কর্মক্ষেত্রে এক্সিডেন্টলি মারা যান। আমার দুই সৎ ভাই উনার আগের পক্ষের সন্তান। দাদু আর ছোটো দাদু বাবা আর ছোটোমা-র বিয়ে দিয়ে দেন আমাদের ভাইবোনদের কথা ভেবে। যে আমরা মা পাবো, তারা বাবা পাবে। বিয়ে তো হয় তাদের। শুধু জীবন-টা দুনিয়াবী আযাবে ভরপুর হয় আমার। মেয়ে ছিলো না বলে ছোটোমা আমার বোনকে যথেষ্ট আদর করে অস্বীকার করবোনা। কিন্তু বাবার অলক্ষ্যে এত-টা অশান্তিময় করে দিয়েছিলেন যে, আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। ১৭বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছি। আজ ১০বছর পেরিয়েছে বাড়িতে একমাস! তাও থাকিনি।বড়জোড় একসপ্তাহ। আমার ছোটোমা সবটা সময় বাড়ির আনাচে কানাচে মিশে থাকা আমার মায়ের স্মৃতি নিয়ে খোঁচা দিতেন আমায়। আমার সামনে মা-য়ের সম্মান নিয়ে টানাহেঁচড়া করতেন। আমি থাকলে উনার ছেলেদের হক পাবেন না ভেবে বা ভাগীদার একটা বেশি! এই ভেবে উনার কত যে কথা শুনেছি! তার ইয়ত্তা নেই। যত যা হোক আমার মা তো! উনার সম্মান নিয়ে রোজ খোঁচা মূলক কথা আমার সহ্য হয়নি। বাবার তখন ভীষণ ব্যস্ততা। ব্যবসায় উন্নতি করা নিয়ে। আমি বাবাকে খুজে আমার পাশে পাইনি। দিন, মাস, বছর গড়ানোর সাথে উনার কথা শোনানো কমবে থাকতো বৃদ্ধি পায়। এই তো জীবন! বাবাকে বলে শহরের ফ্লাট-টায় শিফট হই। ওখানেই থেকে পড়াশোনা করতে থাকি। আমার ছোটো মামা আমার সাথে থাকতেন। আমি বড় হওয়ার পরপর উনি দেশর বাইরে চলে যান। এই তো এরপর একা-ই আছি। ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পর রায়াদের সাথে বন্ধুত্ব হয়। এরপর সুন্দর আর একটা পরিবার পেলাম। গ্রামে আসতাম, বোনকে দাদুকে দেখে চলে যেতাম। বাবার দেখা কখনও পেতাম। কখনও না। মাস গেলে একাউন্টে টাকা ঠিকই দিয়ে দিতেন। বাড়ি ছেড়েছি বাবার কথা না শুনে। জিদ করে চলে আসায় উনিও অভিমান করেছেন। কখনও নিজের ভুলগুলো জানার চেষ্টা করেননি। চেষ্টা করবেন এই আশাও করিনা। কারণ মানুষ নিজের থেকে বেশি অন্যের ভুল ধরতে এক্সপার্ট। এই তো ঘটনা আমার জীবনের। এত কথার শেষ কথা আমার ছোটোমা উপর থেকে যতটা ভালোবাসা দেখায়! ততটা ভালো কখনও বাসে না। বিয়ের পর হয়তো হাসির ছলেও কথা শুনিয়ে দিবে। আর মানুষের কথার আঘাত বড় আঘাত। ছুড়ির আঘাত শুকায়, কথার নয়। এজন্য বলি আমায় বিয়ে করার সিদ্ধান্তে আর একটা বার ভাবুন।”
৫৯
আয়াত সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কার জীবনে কি গল্প লুকিয়ে আছে! এটা উপর থেকে দেখে কখনও বোঝা যায় না। ইশশ! এই ছেলে-টা ভেতরে ভেতরে এত কষ্ট চেপে রেখেছে কে বুঝবে তাকে দেখে? বোঝার উপায় নেই। আয়াত টেবিলে দুহাত রেখে জুবায়েরের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“আমার ভাবাভাবির কিছু নেই। বিয়ে-টা হচ্ছে।”
জুবায়ের মৃদু হাসলো। আয়াতের মতোই টেবিলে হাত রেখে আয়াতের চোখে চোখ রেখে বললো,
“আরও একটা ছোট্ট স্টোরি আছে আমার।”
“কি শুনি?”
“আমি একজনকে ভালোবাসি। ভালোবাসি বললাম কারণ এর পাস্ট টেনস কি আমার জানা নেই। হবে হয়তো ভালোবাসতাম শব্দ-টা। কিন্তু আমার এই ভালোবাসি শব্দ-টা ভালোবাসতামে রুপান্তর করার জন্য কেউ সুযোগ পায়নি। এবার আমি নিজেই নিজেকে সুযোগ-টা আপনাকে বিয়ে করার মাধ্যমে দিতে চাচ্ছি। আপনি কি এপ্রিশিয়েট করবেন আমায়?”
আয়াত মুচকি হাসলো। বললো,
“কেউ আমায় ঘিরে আগাতে চাইলে আমি বাঁধা দেবার কে? হয়তো বলবেন, আমি আমার মর্জির মালিক। আমি-ই বাঁধা দেওয়ার মানুষ। কিন্তু আমার মর্জির উপরও একজনের হুকুম চলে। সে আমাদের রব। উনি না চাইলে কিছু এতদূর গড়াতো না। সো আই হ্যাভ নো প্রবলেম। কিন্তু একটা ছোট্ট আগ্রহ হচ্ছে।”
“কি আগ্রহ?”
“ভালোবাসি বলার মানুষ-টাকে রেখে আমায় কেন বিয়ে করছেন? কারণ অবশ্যই একটা আছে। কি সেই কারণ-টা?”
“সে আমায় চায় না। আর যে আমায় চায় না তাকে জোড় করে বাঁধার মানে হয় না। আমি আমার মতো চেষ্টা করেছি। সে আমার জীবন-কে জেনে সুযোগ দেয়নি। তো আমিও পিছুটান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। হয়তো পুরো-টা পারিনি। এবার সেটাও পারতে চাই। সে অন্য কারো বা আমি অন্য কারো হলে অবশ্যই পারবো। আমি জীবনে তার পর আপনার সামনেই নিজের জীবনে ভেঙেচুড়ে বললাম। রায়াদও এসব জানেনা। বলা হয়নি, ও জানতে চায়। আমি বলিনি। আমি চাইবো এাব কথা আমাদের মাঝে-ই থাকুক। রায়াদকে কিছু বলার হলে সময় মতো আমি বলবো।”
আয়াত হাসিমুখে সম্মতি দিলো। বললো,
“টবার বাড়ি ফেরা যাক? অনেকক্ষণ হলো বসেছি এখানে।”
জুবায়ের মৃদু হাসলো। উঠে দাড়িয়ে আয়াতকে ইশারা করলো আগাতে। সে কফির বিল মিটিয়ে দুজনে বের হলো ক্যাফে থেকে। দুজনে বাইকে করে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তার মাঝে হঠাৎ করে ভ্যানে ফুলের দোকান দেখে জুবায়ের রাস্তার একপাশে বাইক থামালো। আয়াত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“বাইক থামালেন যে?”
জুবায়ের নেমে কোনো উত্তর দিলো না। হেসে হাঁটা ধরে শুধু বললো,
“ওয়েট, এখানেই থাকুন।”
আয়াত তার কথা মতো বাইকে বসে রইলো। জুবায়ের ফুলের দোকান থেকে বেলি আর গোলাপের মিশ্রণে তৈরি গাজরা কিনে আনলো। আয়াত অবাক হলো গাজরা দেখে। জুবায়ের আয়াতের হাতের দিকে ইশারা করে বললো,
“ক্যান আই?”
আয়াত বিস্ময় সহিত হাত এগিয়ে দিলো। জুবায়ের তার হাতে গাজরা পেঁচিয়ে দিয়ে বললো,
“কেউ একজন আমার সব-টা জেনে আমায় একসেপ্ট করলো। আমার মায়ের চরিত্র কি ছিলো! জেনেও নিরবে মেনে নিলো। আমি তাকে সম্মান জানিয়ে আমার জীবনেও একসেপ্ট করে নিলাম। ফুলের শুভ্রতার মতোও আমাদের সম্পর্ক টায় শুভ্রতা বজায় থাকুক। এক নতুন শুভ সূচনা ঘটুক।”
আয়াত মনখুলে হাসলো। হাসিমুখে বললো,
“ঘটুক তবে।”
“আপনি তো বিদেশে থেকেছেন। তেমন ভাবে এই শহর ঘুরেননি! আজ একটু আমার বাইকে ঘোরা যাক? এরপর না হয় পৌঁছে দিলাম বাড়ি?”
আয়াত মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। জুবায়ের বাইকে বসে স্টার্ট দিলো। আজ একটু শান্তিতে তবে ঘোরা যাক!
৬০,
ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নামার প্রতিক্ষা। সময়-টাকে হয়তো গোধূলি বেলা বলে। রিয়ানা ছাঁদে দাড়িয়ে রেলিঙে ঝুঁকে হাত রেখে যতদূর দৃষ্টি মেলা যায়! তাকিয়ে আছে ততদূর অব্দি। পাখি-রা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের নীড়ে ফিরছে। কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতি মেতেছে। সকালবেলা থেকে দুপুর অব্দি বৃষ্টি হওয়ায় প্রকৃতি বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। রিয়ানার যেহেতু ঠান্ডার বাতিক। সে গায়ে শাল চাদর জড়িয়ে বসেছে। রিফাকে বললো তার ঠান্ডা লাগছে। সে ছাঁদে একটু একা থাকবে। তা শুনে রিফা শাল চাদর বের করে দিয়েছে। কফিও বানিয়ে দিয়েছিলো। তা ফুরিয়েছে রিয়ানা। কফির মগটা পাশেই সুন্দর করে রেখে দেওয়া। হাতের ফোন-টায় মৃদু শব্দে তার প্রিয় কিছু গান একের পর এক বেজে চলেছে। মোদ্দাকথা সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেকেও সময় দিচ্ছে। যা তার গত কয়েকদিন হলো নিজেকে একদমই দেয়নি। এখন দিচ্ছে, তার ভালো লাগে নিজেকে একটু সময় দিতে। এই সময় টুকুতে সে কারোর কথা ভাবে না। নিজের মতো থাকে। তার ভীষণ ভালো লাগে এই বিষয়-টা। নিজের নিরবতা আর প্রকৃতির চঞ্চলতার মাঝে কারোর পা ফেলার শব্দ হলো ছাঁদে। ঝড় বৃষ্টিতে অনেক পাতা উড়ে এসে পরেছে ছাঁদে। সেই পাতাতে পা পরার খসখসে শব্দ। রিয়ানা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইলো কে! কিন্তু ঘুরালো না। যার দরকার, সে নিজে এসেই দাড়াবে। তার ভাবনা সত্যি করে রায়াদ এসে দাড়ালো সেখানে। রিয়ানা না তাকিয়েও টের পেলো। পারফিউমের স্মেল বলে দিলো এটা রায়াদ। একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণের পারফিউম ইউজ করে ছেলে-টা। যার সুঘ্রাণ জানান দেয় তার উপস্থিতি। গতকাল পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হালকা ধাক্কা লেগেছিলো। রায়াদও সরে তাকে সাইড দিচ্ছিলো! আর সেও সেই সাইড দিয়েই পা বাড়িয়েছিলো। যার ফলে ধাক্কা-টা লাগে। তখন-ই পারফিউমের স্মেল ভালো ভাবে নাকে লেগেছিলো রিয়ানার। যার দরুণ এখন বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা রায়াদ। রায়াদ এসেছে বুঝেও রিয়ানা তাকালো না, কিছু বললোনা! বিষয়-টা অবাক করলো রায়াদকে। হ্যাঁ, আছে এই মেয়ের কিছু খারাপ ঘটনা মিশ্রিত অতীত। এজন্য এতটা চুপচাপ হবে? তাকে এত চুপচাপ হতে বলেছে কে? সেও তো চুপচাপ! কিন্তু রিয়ানার সাথে একটা গুড ফ্রেন্ডশিপ তো করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে সে! এই যে সে রিয়ানাকে হঠাৎ করে এত প্রায়োরিটি দিচ্ছে! রিয়ানার কি একটু অবাক হওয়া উচিৎ নয়? একবারও কি জিগাসা করা উচিৎ না যে, রায়াদ ভাই! আপনি তো আমাকে সহ্য-ই করতে পারেন না। হঠাৎ এত কথা বলার চেষ্টা করছেন? কারণ কি? কিন্তু না। সে তো ফিরে অব্দি তাকায় না। তার থেকে ৬-৭বছরের ছোট্ট মেয়ে-টার এত এটিটিউড কেন থাকবে? রায়াদ বিক্ষিপ্ত মনে এতগুলো প্রশ্ন সাজিয়ে ফেললো। কিন্তু উত্তর তো একটাও নেই। মিললোও না উত্তর গুলো। সে প্রশ্ন ভাবা বাদ দিয়ে সাথে আনা রিয়ানার ডায়েরী-টা রিয়ানার হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নিন, আপনার ডায়েরী। গতকাল জুবায়েরকে আনতে বলেছিলাম। এনেছে, দিয়ে দিলাম আপনাকে।”
রিয়ানা না তাকিয়েই ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,
“পড়া শেষ?”
“না, ভাষাগুলো কি দেখেছেন? পড়বো কি করে?”
“হঠাৎ আমায় জানার এত আগ্রহ কেন রায়াদ ভাই?”
“জানতে ইচ্ছে হলো এতটুকু ধানীলঙ্কার এত ঝাঁজ কেন?”
“ঐ যে বললেন ধানীলঙ্কা? এজন্য এত ঝাঁজ।”
“ধানিলঙ্কাও এক বয়সে এসে ঝাঁজ হয়। সেই বয়সে আপনি পৌঁছাননি মিস রিয়ানা। দ্যাট’স হুয়াই আমার আগ্রহ।”
“ওকে ফাইন। আমি বাংলা ট্রান্সলেটও লিখে দিবো লাইনগুলোর নিচে। জেনে নিবেন। এরপর দয়া করে আগ্রহ দমন করে ফেলবেন ওকে? আমার প্রতি কারোর আগ্রহ আছে? এটা বুঝতে পারলে আমার প্রচুর অদ্ভুত লাগে বিষয়-টা।”
“আপনি মানুষ-টাই আপাদমস্তক অদ্ভুদ টাইপ।”
রিয়ানা এবার হাসলো রায়াদের কথায়। তার দিকে তাকিয়ে দু কদম আগালো। রায়াদ অসস্তি নিয়ে পেছালো। রিয়ানা হাসির রেখা বড় করলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
“আমায় জেনে কি করবেন? প্রেমে পরবেন আমার? ভালোবাসার চেষ্টায় নামবেন? আসুন এখনই না হয় প্রেম করি।”
কথাটুকু বলেই রিয়ানা রায়াদের দিকে দুহাত বাড়ালো জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিমায়। রায়াদ লাফ দিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে শক্ত গলায় বললো,
“মেয়ে মানুষ আপনি। কিছু তো লজ্জা রাখুন। এভাবে পরপুরুষের গায়ে ঢলে পড়ছেন? অসহ্য লাগে আমার।”
“আমারও অসহ্য লাগে মিঃ রায়াদ শাহনেওয়াজ। আমার বিষয়ে এত আগ্রহ আমারও অসহ্য লাগে। এজন্য আমি এই কাজ-টা করেছি। আপনিও জানুন আমি কেমন। আমার ডায়েরীর একপাতা পরে আমি সিওর আপনি এত নরম আমার প্রতি। নয়তো আমার চালচলন আপনার পক্ষে মেনে নিয়ে এত নরম ব্যবহার অপ্রত্যাশিত৷ আপনি কিছু সময়ের জন্য বোধ হয় ভুলে গেছেন আমি ঘাড়ত্যাড়া, জেদি, নির্লজ্জ এক মেয়ে। সেটা আবারও মনে করিয়ে দিলাম। এই বিষয়-টা মাথায় রাখবেন। অসহ্য লোক একটা।”
রিয়ানা কথাগুলো বলেই ডায়েরী আর কফির মগ-টা নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো নিচে যাবে বলে। রায়াদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে। এই মেয়ে-টা এমন কেন? আজব তো! আয়াতের বিয়ে সামনে বলে হানিফ হোসাইন তাকে যেতে দেননি। রায়াদের পরিবার-ই এবার গ্রামে আসবে। ভাবলো থাকছে যখন! একটু রিয়ানার সাথে সম্পর্ক-টা রাগারাগি থেকে নরমাল করবে। হ্যাঁ এটা সত্যি রিয়ানার খানিক যন্ত্রণা জেনে সে নরম হয়েছে। তাই বলে মুখের উপর সরাসরি বলবে? এত সাহস কেন এই মেয়ের! সে ঠিক-ই ভাবে। আস্তো বেয়াদব একটা মেয়ে। এই মেয়ে জীবনেও ভালো হবে না। রায়াদও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচ দিকে পা বাড়ায়।
চলবে?