রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব ১৮

0
248

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩৯,
পরদিন সকালবেলায়, নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে মাথা ব্যথায় কপাল চেপে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে রিয়ানা। সারারাত কেটেছে বাবার চিন্তায়। গ্রামে যাবে কি যাবেনা! এই দ্বিধায় ভুগছে সে। আয়াত ব্রেকফাস্ট বানিয়ে রিয়ানাকে উচ্চস্বরে ডাকছে রিয়ানাকে। সে বোনের কণ্ঠস্বর শুনতেই বসা থেকে উঠে দাড়ালো। শব্দ করেই জবাব দিলো,

“ফ্রেশ হয়ে আসছি আপু। তুই খেতে বস।”

এরপর চুলগুলো পেচিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে খোপার কাঠি মাথায় ঢুকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো রিয়ানা। এদিকে আয়াত আনমনা হয়ে বসেছিলো ডাইনিং টেবিলে। গ্রামে সে একা-ই যাবে। বাবা অসুস্থ! রিয়ানা না গেলেও তো কম শোরগোল হবে না। আবার নিয়ে গেলেও বোনের মনের ক্ষত তাজা বৈ শুকোবেনা। বাবা আর বোন! কার কথা ভাববে! মাথা ঘুরিয়ে উঠছে আয়াতের। এত দায়িত্ব আর ভালো লাগেনা তার। এরথেকে ভালো রিয়ানার ছোটো হত! জীবনে শান্তি থাকতো। আয়াত ফুঁপিয়ে উঠে। উপর দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,

“ও মা! রেখে গেলে এ কোন দোটানায়! ছোটো বোনের জীবনে তোমার ছায়া! বাবার জীবনে তার মায়ের ছায়া দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি। তুমি থাকলে আজ সব ঠিক থাকতো মা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবাই উপরে উপরে আমার আমি-টার হাসিখুশি চেহারা দেখে মনে করে আমার কষ্ট নেই! অথচ আমার ভেতর-টা রোজ জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে মা। তুমি ফিরে আসো, আমি একটু তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো। আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা হচ্ছে না মা। কার কথা ভাববো! বাবার কথা ভাবলে খারাপ লাগে। বোনের কথা ভাবলেও খারাপ লাগে। মাঝখানে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়-টাই পাচ্ছি না। আমিও তো মানুষ মা। আমার খারাপ লাগাগুলোকে তো কেউ একটা বার নজর দিয়ে দেখে না। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে বাবার মন রাখতে গিয়ে বোনকে কষ্ট দিই! বোনের মন রাখতে গিয়ে বাবাকে কষ্ট দিই। দুজনের মন রাখতে গেলে তাদের থেকে-ই কষ্ট পাই। অথচ সেই কষ্ট লুকিয়ে ঠোঁটে ঝোলাতে হয় চওড়া হাসি। তুমি থাকলে আজ আমাদের পরিবার-টা সুন্দর থাকতো মা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! এই কথা-টা আমি কাউকে বলতে পারিনা মা। এ কোন দোটানায় আমায় রেখে গেলে! আমার তোমাকে প্রয়োজন মা। একজন মেয়ের জীবনে মায়ের যা অবদান! সেই অবদানের জন্য তোমায় আমার প্রয়োজন। আমি কার কাছে মায়ের পরশ পাবো বলো? বড় হয়ে এ কোন দোষ করলাম৷ আমি! যেদিকেই ভুল হয়! আমার শিক্ষার উপর আঙুল উঠে। মানুষ বলে, ছোটো বোনকে মানুষ করতে পারিনি! কেমন বড় বোন হলাম! বাবার আদর না পেয়েও শুনি বোনের কাছে, সব আদর ছিনিয়ে নিয়ে তাকে রগচটা বানিয়েছি। অথচ ওর চিন্তায় প্রতিটা নির্ঘুম রাত সাক্ষী আমার কি অবস্থা হয়! এই যে এখনও চিন্তা করছি! সাথে নিবো কিনা! নিতে চাইলে বলবে, কষ্ট দিতে নিয়ে যাচ্ছি। না নিয়ে যেতে চাইলে বলবে, বাবা শুধু আমার একার-ই। এভাবে আর জীবন-টা চলছেনা মা। আমার জীবনও এবার বুঝি থমকে যায়। তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে মা।”

আয়াত আপন মনে একদমে কথাগুলো বলে ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রিয়ানা দরজার কাছে দাড়িয়ে সব-ই শুনলো। দু-কদম পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে-ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। ছোট থেকে বড় হয়েছে। দেখেছে এই একজন মানুষ তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসে গেছে। তবুও চাইতে-না চাইতে, ইচ্ছে-য়-অনিচ্ছায় কষ্ট দিয়ে-ই গেছে। ভালোবাসার মূল্য কষ্ট দিয়ে-ই পরিশোধ করেছে। এভাবে আর কতদিন! এবার না হয় বোনকে একটু শান্তি দিলো। বোনের দিকে এগিয়ে আসলো রিয়ানা। কাঁধে হাত রেখে কাঁপা স্বরে বললো,

“আমিও গ্রামে যাবো আপু। অনেক লুকোচুরি হলো। এবার কষ্টের মুখোমুখি হয়ে কষ্ট টুকু পিছনে ফেলে আগাতে চাই। মানুষকে অনেক সুযোগ দিলাম কথা শোনানোর! এবার জবাব দেবার পালা। তোকে আর কষ্ট পেতে দেখতে পারবোনা। তুই সে মানুষ, যে আমায় মায়ের অভাব বুঝতে দিসনি। তবুও তোকে কষ্ট-ই দিয়ে গেছি। মেয়ে-রা তো হুটহাট মা-কে কষ্ট দেয়! ছোট বোন হিসেবে আমিও দিয়ে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করিস।”

৪০,
লাগাতার কলিং বেল বাজার শব্দে বিরক্ত হলো জুবায়ের। ফোন হাতরে সময় দেখে ন’টা বাজে। ফোনের স্কিনে রায়াদের নাম্বার থেকে ১০টা মিসড কল লেখা ভাসছে। আজ কাজ থেকেও ছুটি বিধায় সে পরে পরে ঘুমাচ্ছিলো। রাতে রায়াদ কল করার পর আর ঘুমানো হয়নি তার। ভোর রাতে চোখ লেগে আসে জুবায়েরের। তখন-ই ফজরের নামাজটা পরে সে ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু ন’টা বাজতেই রায়াদ আবার কল দিয়েছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় যার একটা কলও রিসিভ করতে পারেনি জুবায়ের। আবার কলিং বেলা বাজার শব্দ! জুবায়ের সন্দেহ করলো রায়াদ এসেছে। আলসেমি ভেঙে বিছানা ছাড়লো জুবায়ের। পায়ে স্লিপার গছিয়ে হাঁটা ধরলো দরজার দিকে। ড্রইং রুম পেরিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলো রায়াদকে। পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল, পরনে জিন্স, নরমাল-ই একটা স্কাই ব্লু কালারের শার্ট। যার হাতা কনুই অব্দি গোটানো। চুলগুলো উসকোখুসকো লাগলো জুবায়েরের কাছে। উজ্জল শ্যামবর্ণের পুরুষ-টির মুখায়বে মলিনতার ছাপ যেন জ্বলজ্বল করছে। বা হাতের আঙুলে বাইরের কি রিং ঝুলছে। রায়াদকে এত শ্রান্ত রুপে দেখে জুবায়ের থমকালো। রায়াদ সাধারণত সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ করে তাকে এত অগোছালো অবস্থায় দেখে খানিক-টা বিস্মিত হয়েছে জুবায়ের। এজন্য রায়াদকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো জুবায়ের। জুবায়েরকে দরজা আঁকড়ে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করতে দেখে রায়াদ বললো,

“সমস্যা কি তোর? আমায় কি পাবনা ফেরত পাগলের মতো লাগছে? নাকি মেয়েদের মতো ক্রাশ খেয়ে আমায় দেখছিস?”

“চুপ কর, নিজে-ই একটু ভেতরে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখ। প্রতিদিনের তুলনায় তোকে কেমন লাগছে! তাহলে বুঝবি ভুত দেখার মতো চমকে কেন গেছি?”

জুবায়ের বুকে হাত বেঁধে সরে দাড়িয়ে কথাগুলো বললো। রায়াদ কি রিং ঘুরাতে ঘুরাতে স্যান্ডেল খুলে বাসায় প্রবেশ করলো। সোজাসুজি ড্রইং রুমের সোফায় বসতে বসতে বললো,

“ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট বানা। দেখে তো মনে হচ্ছে আম-ই তোকে ডেকে তুললাম। যেখানে ডাকার কথা ভাবী-র। ডাকছি আমি। শালা নিজেও বিয়ে করবিনা, বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সুযোগও দিবিনা। বুড়ো হলে বিয়ে করবি নাকি?”

জুবায়ের দরজা আঁটকে রায়াদের দিকে ফিরলো। দরজায় হেলান দিয়ে একপায়ের সাথে আরেক পা আড়াআড়ি ভাবে দিয়ে বললো,

“বউ তো পেয়ে-ই গিয়েছিলাম হারা’মি। খালি নিজের দোষে হারালাম। যদি জানতাম বউ-টা আয়াত! আমি জুবায়ের চৌধুরী রায়াদ কখনও মানা করতাম না।”

“পাইছো এক টাইটেল চৌধুরী। অথচ চৌধুরী বাড়ির সীমানাও আজ ৫বছরের কাছাকাছি বন্ধুত্বে দেখলাম না।”

জুবায়ের এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো রায়াদের পানে। থমথমে গলায় বললো,

“তুই কি আমার ১৪গুস্টির খপ্পড়ে গিয়ে পড়তে চাচ্ছিস? আমার কাজিন’রা আছে। তোরে পছন্দ হবে সিওর। যে পছন্দ করবে! ধরেবেধে দিবে তার গলায় ঝুলিয়ে।”

“সমস্যা নেই। তোর বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সৌভাগ্য হবে না। নিজের বিয়ের-ই না হয় দাওয়াত খাওয়া হলো।”

“বিয়ে করতে এতদূর যাওয়ার কি দরকার? তোর আংকেলের দুই মেয়ের এক মেয়েরে বিয়ে করলেই তো পারিস!”

“আবে শালা! এক মেয়েরে তো তুই নিজের জন্য পছন্দ করে ফেলছিস! আরেক-টা তো আমার মতো বদরাগী। দুজনে এক হলে তো বাড়ি আর বাড়ি থাকবেনা! আগুণ লেগে ছাড়খাড় হবে।”

“কেন? কথাতেই তো আছে, যে যেমন! তার কপালে জুটে তেমন। আমি যেমন চঞ্চল, হাসিখুশি। একভাবে সন্ধান পেয়েও গেছি আয়াতের। আর তুই-ও বদরাগী, রিয়ানা-ও। ইমাজিন কর! তোরা দুইজন বিয়ে করলি! বিষয়-টা কেমন হবে? তোরা দুই-টাই তো এক।”

জুবায়ের মুখে হাত দিয়ে হাসি আঁটকে কথাগুলো বললো। রায়াদের মুখাভঙ্গি পাল্টালো। নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“যে যেমন, সে তেমন মানুষ পেলে দুনিয়ায় বিচ্ছেদ বলে শব্দ থাকতো না। এই কথা-টা শুধু যাদের সম্পর্ক টিকে যায় তাদের জন্য।”

জুবায়ের ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। রায়াদের দিকে এগিয়ে এসে পাশে আসলো। রায়াদ সবার সাথে গম্ভীর হলেও এক তার কাছে এসেই মনখুলে কথা বলে। তখন-ই গম্ভীর হয়! যখন রায়াদ কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকে। জুবায়ের বিষয়টা জানার জন্য রায়াদকে জিগাসা করে,

“কি নিয়ে টেনশন করছিস? বলে ফেল।”

রায়াদ হাঁটুর উপর দুহাতে ভর দিয়ে থুতুনিতে আঙুল ঠেকিয়ে বসে আছে। জুবায়েরের কথা শুনে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

” একটা জিনিস পেয়েছি রিয়ানা হোসাইনের। বুঝতে পারছিনা খুলে দেখব কিনা! এজন্য সকাল সকাল হন্তদন্ত হয়ে আসতে হলো। কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে-ই তোর কাছে ছুটে এসেছি।”

“কি পেয়েছিস?”

রায়াদ পকেট থেকে নিজের ফোন বের করলো। গ্যালারি ঘেঁটে একটা পিক বের করে জুবায়েরের দিকে এগিয়ে দিলো। জুবায়ের ফোন হাতে নিয়ে দেখলো একট ডায়েরীর ছবি। সে প্রশ্নাত্মক চাহনীতে তাকালো রায়াদের দিকে। রায়াদ সোফায় গা এলিয়ে দিলো, বললো,

“রিয়ানা হোসাইনের ডায়েরী। সাথে আনা সম্ভব হয়নি। অন্যের পার্সোনাল জিনিস। খুলে দেখা ঠিক হবেনা। আবার নিষিদ্ধ জিনিসে আগ্রহও বেশি। কি করবো বুঝতে না পেরে ছুটে আসা।”

“এটা ফোনেও বলা যেতো রায়াদ।”

“তুই রিসিভ করছিলিস না। ভাবলাম আবার বুঝি অসুস্থ হলি। এজন্ঢ় ছুটে আসা।”

রায়াদের তাকে নিয়ে চিন্তা দেখে অবাক হলো জুবায়ের। নিজের বিস্ময় চেপে রেখে জিগাসা করলো,

“কিন্তু তুই তার ডায়েরী পেলি কোথায়?”
চলবে

আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here