#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ১৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৩০,
রায়াদের কথার জবাবে জুবায়ের বললো,
“বাদ দে আপাতত। পরে ফ্রি হয়ে বলবো। এখন এদের দুবোনকে থামানো উচিত বলে মনে হচ্ছে।”
রায়াদ মাথা হেঁলিয়ে সম্মতি জানালো জুবায়েরের কথায়। আয়াত বোনকে বোঝাতে বোঝাতে একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠলো। তবু রিয়ানার জেদ সে ড্রেস পাল্টাবে না। জুবায়ের আর রায়াদ দুজনই তাকিয়ে তাকিয়ে ওদের দেখছে। রোজা এবার দু’বোনের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে বললো,
“প্লিজ থামো তোমরা। আয়াত আপু রিয়ানা আপু যেটায় কমফোর্ট। তাকে সেটাই পরে থাকতে দাও। এটা নিয়ে আর তোমরা তর্কাতর্কি করো না। বার্থডে গার্ল সে। তার মর্জিকে আজ অন্তত আমরা সম্মান জানাই?”
“হ্যাঁ আয়াত মা, রিয়ুকে ওর মতো ছেড়ে দাও। চলো কেক কাটো সব।”
ফাতেহা খানম রোজার কথার সাথে সায় মেলালেন। আয়াতের ভেতরে ভেতরে টেনশনের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে যে কেন এত তৎপর! এটা যদি বলতে পারতো! আয়াত ছটফটিয়ে দ্রুতপদে ছাঁদের এক কিনারায় গিয়ে দাড়ালো। রায়াদ এক পলক আয়াতের এত তৎপরতা দেখে হনহনিয়ে রিয়ানার সামনে এসে দাড়ালো। রিয়ানার হাত ধরে টানতে টানতে ছাঁদ থেকে প্রস্থান করলো। আচমকা রায়াদের এহেন কান্ডে সবাই হতবাক। বিমূর্ত রূপে দাড়িয়ে দুজনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আয়াত দ্রুত পদে নিজের গাউন উঁচিয়ে হাঁটা ধরলে জুবায়ের চট করে এসে আয়াতের সামনে দাড়ায়। আয়াত বিস্মিত হয়ে তাকাতেই জুবায়ের বললো,
“আপনি এখন ওদের মাঝে না গেলেই ভালো হয় আয়াত ম্যাম৷ রায়াদ ঠিক-ই রিয়ানা ম্যামকে শুধরে নিয়ে ফিরবে। আপনি বরং যা সব অগোছালো আছে! গুছিয়ে নিন। এটাই ভালো হবে।”
আয়াত দমে গেলো। মনে পরে গেলো রিয়ানা রায়াদের কথা একটু হলেও শোনে। সে ফাতেহা খানমের সামনে হাটুমুড়ে বসে কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। চিন্তা, ভয় সব বাবাকে নিয়ে। রায়াদ যদি একবার রিয়ানার এসব বাড়াবাড়ির কথা মুখ ফুটে বলে দেয়! তারপর হয়তো তার বাবা রিয়ানার সব স্বাধীনতা বন্ধ করে দিবে। যেটা রিয়ানা কখনও মানতেও পারবেনা। কষ্ট পাবে। আয়াত একটুও চায় না মেয়ে-টা কষ্ট পাক। বড় বোন হয়ে কি করে ছোট বোনকে কষ্ট পেতে দেখবে সে! যেখানে কষ্ট থেকে আগলানোর চেষ্টা করে যায় আয়াত। ফুঁপিয়ে কান্না করে দিলো আয়াত। ফাতেহা খানম টের পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রিয়ানা দিনদিন সাহসিকতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটা উনারও মনঃপুত হচ্ছে না। রোজাকে চোখের ইশারায় নিচে যাওয়ার কথা বোঝালেন ফাতেহা খানম। রায়াদের রাগ সম্পর্কে উনার ধারণা আছে। রিয়ানা কথা না শুনলে গায়ে তুলতেও বাঁধবে না রায়াদের। এই ভয়ে-ই রোজা-কে নিচে যেতে ইশারা করলেন। রোজা মায়ের ইশারা বুঝে নিচতলায় যেতে পা বাড়ায়। জুবায়ের ছাঁদের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো। দৃষ্টি ফুঁপিয়ে কান্নারত আয়াতের দিকে। মনে মনে ভাবলো, ‘এক বোন যেমন ধানিলঙ্কা, আরেকজন লবণ। লবণ যেমন পানি পেলে গলে যায়। এ মেয়ে একটু কষ্ট পেতেই গলে যায় লবণের মতো। রিয়ানার মতো একটু কঠোর হলে হয়তো রিয়ানা বিপথে যেতো না।’
৩১,
এদিকে রিয়ানার রুমে এনে রিয়ানার হাত ছাড়লো রায়াদ। এতক্ষণ রিয়ানা একটুও চেষ্টা করেনি নিজেকে রায়াদের হাত থেকে ছাড়ানোর। রায়াদ ঠিক কি করে! এটায় জানার ইচ্ছে ছিলো তার৷ রায়াদ হাত ছাড়তেই সে খাটের উপর ধপ করে বসে পরলো। রায়াদ তীক্ষ্ণ চাহনীতে তাকালো রিয়ানার দিকে। এরপর বিছানায় ছড়িয়ে রাখা আয়াতের রেখে যাওয়া ওফ হোয়াইট গাউন-টার দিকে তাকিয়ে বললো,
“টাইম ১০মিনিট। পাল্টে ড্রইং রুমে আসবেন। অপেক্ষা করছি আমি।”
রিয়ানা গায়ে মাখালোনা রায়াদের কথা। হাতের ফোন-টায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সাজ্জাদের আইডিতে ঢুকে স্ক্রল করতে লাগলো। যেখানে এই মানুষ সুযোগ পেয়ে তাকে বদলাতে পারেনি। সেখানে সুযোগ না দেওয়া লোক-টা তাকে পাল্টাতে চাচ্ছে! বেশ ইন্টারেস্টিং। রায়াদ রিয়ানার গা ছাড়া ভাব দেখে রাগ সামলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে ফের রিয়ানার হাত ধরে দাড় করিয়ে দিলো। ফোন কেড়ে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মেরে রিয়ানার চোখে চোখ মিলিয়ে বললো,
“আমি কিছু বলেছি আপনাকে!”
রিয়ানা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো রায়াদের চোখ হতে। তাচ্ছিল্যের সহিত হেসে বললো,
“আমি আপনার কথা কেন শুনবো?”
“আপনি বড্ড বেশি ঘাড়ত্যাড়া এটা জানা ছিলো না। শুধু জানতাম আপনার ঘাড়ের রগ ত্যাড়া।”
“আর কিছু?”
রিয়ানা রায়াদের দিকে আবার তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে। রায়াদ হতবিহ্বল হয়ে তাকায় রিয়ানার দিকে। তার রাগের সামনে যেখানে কেউ টিকতে পারেনা! সেখানে এই মেয়ের কিছু যায় আসে-ই না! এত ছন্নছাড়া মেয়ে হয় আদৌও? রায়াদ রিয়ানার মতোই ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
” আর কিছু নয়। চুপচাপ ড্রেস পাল্টান। আমি এসব পেট বের করা, হাত পুরো বের করে রাখা ড্রেস মোটেও পছন্দ করিনা।”
“হু আর ইউ? আমি আপনার পছন্দ অপছন্দের দাম কেন দিবো? এমনি অনেক শুনে নিয়েছি আপনার কথা। আমার অন্য কারোর কথা শুনে চলার অভ্যাস নেই।”
রায়াদ রিয়ানা হালকা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলো। হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে বললো,
“আপনি ড্রেস পাল্টাবেন না?”
“না। ”
রিয়ানার সোজাসাপটা জবাব৷ রায়াদ আলতো হাসলো। রিয়ানা খেয়াল করলো তার হাসি। কিন্তু হাসার মতো কোনো কারণ দেখল না যে রায়াদ হাসছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রায়াদ তাকে বিস্মিত করে বলে উঠলো,
“আপনি ৫মিনিটে ড্রেস পাল্টাবেন। নয়তো আমি আপনার ড্রেস পাল্টাতে বাধ্য হবো। আর অবিবাহিত হয়ে আপনি নিশ্চয় চাইবেন না কোনো পর পুরুষ আপনাকে ছুঁয়ে দেখুক!”
“ওহহ! সিরিয়াসলি? আপনি ড্রেস পাল্টে দিবেন? ওকে ট্রাই করা যাক। নিন আসুন, পাল্টে দিন ড্রেস।”
রিয়ানা কাঁধ থেকে বিজের দোপাট্টা ফেলে রায়াদকে কথাটা বললো। রায়াদের কথায় যেন তার কিছু-ই যায় আসেনা। রায়াদ থমকালো।। একটা মেয়ে এতটা বেহায়া কি করে হতে পারে! নিজের ইজ্জতের দাম টুকুও দেয়না? সে বিরক্ত হয়ে রিয়ানার দিকে তাকাতেই রিয়ানা বললো,
“ঘাবড়ে গেলেন? আমি জানি আপনি পারবেন না। আমার মাঝে লজ্জার একবিন্দু পরিমাণ কিছু নেই। থাকলে নিশ্চয় আমার স্লিম পেট, নাভীর আশপাশ বের করে ড্রেস-টা পরতাম না। সী! এদিকে তাকান। হালকা পাতলা ক্লিভেজও দেখা যায়। তাহলে বুঝে নিন আমার লজ্জা ঠিক কোন সীমানায় ঝুলছে। সে আসতে চায় আমার মাঝে, বাট আমি-ই বাঁধা দিই। যেখানে সুযোগ পেয়েও কেউ আমায় বদলাতে পারেনি। সেখানে আপনি আমার কিছু নন, নাথিং। আপনার কথায় আমি নিজের ড্রেস একটুও পাল্টাবো না। কত শত নারী আছে, যারা আমার থেকেও বাজে ড্রেস পরে বেড়ায়। সেখানে যথেষ্ট শালীন আমার ড্রেস।”
“জাস্ট শাট আপ মিস রিয়ানা হোসাইন। আর একটা কথা বললে ঠাটিয়ে চড় মারবো আপনাকে। কি ভাবেন নিজেকে? ঐ বাজে ড্রেস পরা নারীদের একজন? আপনি কারোর ঘরের সম্মান, একজন বাবার রাজকন্যা। আপনার ড্রেস, আপনার আচরণ একটা পরিবারের শিক্ষা বহন করে। দয়া করে হানিফ আংকেলের মতো সম্মানীয় ব্যক্তির সম্মান আপনার এই বাজে ব্যবহার দিয়ে প্রকাশ করবেন না।”
৩২,
রায়াদ চেঁচিয়ে-ই কথাটা বললো। রিয়ানা হাসলো, একটু শব্দ করে-ই হাসলো। রায়াদ বিস্ময়ে বিমূঢ়। এই মেয়ের কি কোনো কথা-ই সিরিয়াসলি নেওয়ার স্বভাব নেই! সে খিটখিটে মেজাজে প্রশ্ন করলো,
“হাসবার মতো কি বলেছি?”
“আমি কোনো বাবার রাজকন্যা নই। কারোর জীবন সম্পর্কে না জেনে কোনো মন্তব্য করবেন না৷ বের হোন রুম থেকে। আমি ড্রেস পাল্টে আসছি। তর্ক করার এনার্জি পাচ্ছি না। কেক কেটে ঘুমাবো আমি। আমার বোনকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছেনা আর। ”
“যা কষ্ট দেওয়ার দিয়েই ফেলেছেন। আর কি কষ্ট দিবেন?”
“আমি আমার বোনের মতো এতটা ভালো নই। সে আমার কষ্ট তাজা করেছে। আমিয়ো একটু ফেরত দিলাম। পুরোটা নয়। আমার মতো কষ্ট সহন শক্তি আমার বোনের নেই। এজন্য অল্প-ই দিয়েছি। নাউ লীভ। আমি ড্রেস পাল্টে নিবো।”
রায়াদ রিয়ানার কথা শুনে অবাক চোখে রিয়ানাকে একটু দেখলো। এরপর রুম ছাড়লো। ড্রইং রুমে এসে রোজাকে দেখে জিগাসা করলো,
“তুই এখানে? দাড়িয়ে আছিস কেনো?”
“আম্মু পাঠালো তোদের ডাকতে। তোদের চিল্লাপাল্লা শুনে সাহস হয়নি ডাকার।”
রোজা কাঁপা গলায় জবাব দিলো। রায়াদ ফোঁস করে দম ছাড়লো। বাজখাই গলায় বললো,
“মেয়ে-টাই এমন। না চিল্লালে কথা শোনেনা। চল ছাঁদে চল। উনি আসবে একটু পরই।”
“তুমি যাও। আমি আসছি আপুর সাথে।”
রায়াদ মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে বাসা ছাড়তে পা বাড়ালো। রোজা হাফ ছেড়ে বাঁচল।। ভাইয়ের রাগকে বড্ড ভয় পায় সে। রায়াদ যেতেই রিয়ানা বের হলো রুম থেকে। রিয়ানাকে দেখে রোজার চোখ কপালে উঠলো। ওফ হোয়াইট গাউনে রিয়ানার সৌন্দর্য যেন নজর কাড়ার মতো। মেয়ে-টা এমনি সুন্দর। কেন যে নিজের স্বভাবের জন্য সৌন্দর্যকে চাপা দেয় জানা নেই রোজার। সে রিয়ানার সামনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে খুশিতে গদগদ হয়ে বেশ জোড়েই বললো,
“রিয়ু আপু, তোমায় দারুণ লাগছে। ইশশশ, এত্ত কিউট তুমি।”
রোজার কণ্ঠ কানে পরতেই রায়াদ দরজার কাছে দাড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালো। রিয়ানাকে আপাদমস্তক এক নজর দেখে নিলো। রিয়ানার চোখে চোখ করতেই বেরিয়ে গেলো রায়াদ। রিয়ানা নিজেকে রোজার থেকে ছাড়িয়ে বললো,
“চলো যাওয়া যাক?”
“হুম চলো।”
রোজা খুশিমনে রিয়ানার হাত ধরে ছাঁদের দিকে পা বাড়ায়। ছাঁদে আসতেই আয়াত বোনকে দেখে খুশি হয়। কান্নার মাঝেও হেঁসে দিয়ে বোনের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। আলতো স্বরে বলে,
“একটা নতুন জীবনের শুভ সূচনা হোক আমার বোনের। তার জীবনের সকল শোক তাপ কষ্টের গ্লানি মুছে সুন্দর একটা জীবন শুরু হোক। তোকে হাসিখুশি দেখতেই আমার ভালো লাগে বোন। প্লিজ একটু ভালো থাকতে শিখ এবার। আমি আর তোকে এভাবে দেখতে পারিনা। কষ্ট হয় আমার।”
রিয়ানা মুচকি হাসলো। বোনের পিঠে হাত দিয়ে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,
“শীত এসে শরৎ এর সৌন্দর্য ছিনিয়ে নিয়ে যায় আপু। সে এসে চলে গিয়ে আমার সৌন্দর্যও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সে বিহীন আমি মলিন-ই সুন্দর।”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম।