#চোরাবালি_শেষ
রেশমা আক্তার
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জোহার বুঝে গেল সত্যিটা। দৌঁড়ে এসে হাঁটুমুড়ে বসে তুলে নিল সোহার মাথাটা। ব্যাকুল হয়ে বলল
– লানা… আই’ ম সো সরি….. জান, এ কি সর্বনাশ করে ফেললাম? তোমাকে চিনতে ভুল করলাম? ক্ষমা কর লানা, আমাকে। আমি একটা অকাট নির্বোধ। নিজের মানুষটাকে চিনতে এতবড় ভুল করে ফেললাম? উহ, একি হয়ে গেল? কি করব আমি এখন?
জোহারকে খামচে ধরে কিছু বলতে চাইছে লানা, পারছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে সোহা ঘুরে তাকাল তাদের দিকে। ঘর কাঁপানো প্রচণ্ড অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল সে।
– থ্যাঙ্ক ইউ জোহার, আমার কাজটা সহজ করে দেয়ার জন্য। তোমার হাত দিয়ে ওকে মারতে পেরে অনেক বেশি আনন্দ পেলাম। তুমি বরাবরই একটা স্টুপিড। এজন্য তোমাকে আমি এত বেশী ভালোবাসি। এতগুলো দিন আমি একটার পর একটা অপকর্ম করে গেছি, আর তুমি বোকার মত আড়াল করে গেছ। অন্ধের মত ভালোবেসে গেছ আমায়। নির্বোধ প্রেমিক…. হা.. হা… হা…। এবার বিদায় জোহার। এবার তুমিও মরো তোমার প্রেমিকার সাথে। মুনকে আমি ঠিক খুঁজে নেব। আমার সব সাধনা সফল হয়েছে আজ। বারোটা বেজে গেছে । এবার তোমরা দুজনেই এই ঘরের আগুনে পুড়ে মরবে। আমি চললাম… বিদায়….
আবারও অট্টহাসি সোহার। সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যাবার জন্য। জোহারের কোলে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাসের পথে লানা। চোখ দুটো মেলে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তবু কি যেন জোহারকে বলার বা বোঝাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে পরিতাপ, আহা… মৃত্যুর আগে, সোহার মৃত্যুকবচ হাতে পেয়েও কিছু করতে পারল না সে
জোহারের দু’চোখ বেয়ে পরিতাপের অশ্রু ঝরে পড়ছে লানার গালে। নিজের হাতে খুন করল সে লানাকে। হু হু করে কাঁদছে জোহার লানাকে জড়িয়ে। শেষ মুহূর্তে লানার যন্ত্রণা আর কষ্ট দেখে মনযোগী হল তার মুখের দিকে। লানা কি কিছু বলতে চাচ্ছে তাকে? ইস, খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। লানা তো জানতেই পারল না, কতটা ভালোবেসে ফেলেছে সে লানাকে। বরং মুনের শর্তে ওকে সোহার হাতে তুলে দিয়ে নিকৃষ্ট, বেইমান প্রমানিত হয়ে গেল জোহার। তা হোক, যদি এমন কোন উপায় জানা থাকত এখন যে, জোহার ওই আগুনে ঝাপ দিয়ে পড়লে লানা বেঁচে যাবে, তাহলে জোহার নির্দিধায় অবিলম্বে তাই করত। তবু এমন একজন সুহৃদ বন্ধুকে মরতে দিত না সে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ কিসের ইঙ্গিত করছে লানা? কি বোঝাতে চাইছে চোখের ইঙ্গিতে? তার হাত…? কী আছে তার হাতে?
জোহার লানার দৃষ্টি অনুসরন করে নিজের বন্ধ মুঠিটা খুলে ধরল চোখের সামনে। তাইতো, কি এটা…? তখন ছুঁড়ে মেরেছিল লানা তার দিকে?
– কি…? কি এটা? কি করতে বলছ লানা?
লানা চেখ টিপে লকেটের দিকে তাকিয়ে পাশে জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকাল।
মুহূর্তে কি বুঝল জোহার বোঝা গেল না। ঠিক বারোটা বাজার কয়েক সেকেন্ড আগে জোহার ছুঁড়ে মারল লকেটটা আগুনের মাঝখানে। ঝলসে উঠল যেন কিছু আগুনের মধ্যে। যেন একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল সেখানে।
শব্দ শুনে দরজার কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে সোহা। বিস্ময়ে কাঁপছে সে। ফিরে দাঁড়িয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে হতভম্ভ হয়ে গেল সে। কিসে যেন টানছে তাকে আগুনের দিকে। প্রতিরোধের চেষ্টায় হাতের কাছে ধরার জন্য কিছু খুঁজল সে, পেল না। পা গুলো অপ্রতিরোধ্যভাবে টেনে টেনে আগুনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। শরীরে তীব্র জ্বালার অনুভূতি। এসব কি হচ্ছে? এমনটা তো হবার কথা ছিল না। চিৎকার করে এগিয়ে যাচ্ছে সে। বিস্ময় মিশ্রিত ভয়ে তাকিয়ে দেখল লানাকে। আরও বিস্ময় ছিল তার জন্য। আগুনের দিকে যেতে যেতে সে তাকিয়ে দেখল, জোহারের কোলে মাথা রেখে শোয়া সোহার শরীরটা একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে লানায়। সোহা নিজের হাতে নিজের মুখাবয়বের পরিবর্তন বোঝার চেষ্টা করল। অবিশ্বাস্য, এমনটা হবার কথা নয়। এই মুহূর্তে ট্রান্সফর্ম হবে কেন? আর ওই আগুনে কী এমন আছে, যা চুম্বকের মত টানছে তাকে? সোহা কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না নিজেকে। আগুনে ঝাপ দেবার জন্য শরীরের প্রতিটি রক্তকনা যেন আর্তচিৎকার করছে। শুকিয়ে আসছে কন্ঠনালী। ওই আগুনেই যেন মিটবে তৃষ্ণা। পতঙ্গ যেমন বিভ্রান্ত আগুনে স্বেচ্ছায় ঝাপিয়ে পড়ে। সোহাও এবার তেমনি, নিজের শরীরে পরিবর্তিত হয়ে এক প্রকার দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল মন্ত্রপূত আগুনে। অসংখ্য অশরীরী চিৎকারের মধ্যে যেন একাকার হয়ে গেল সোহার চিৎকার।
আগুনের লেলিহান শিখা যেন সহস্র হাতে সাদরে গ্রাস করে নিল সোহার শরীরটা। তীব্র থেকে তীব্রতর হল আগুন।
পুরো বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। সদর দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে আগুন। টনক নড়ল জোহারের। লানার চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেছে।
না… লানা, না…। এতবড় শাস্তি দিয়ে যেও না। আমাকে এমন জীবন দান করে যেও না , যে জীবনে তুমি থাকবে না। মৃত্যুর আগে আমায় জেনে গেলে আমি একজন খুনী, বেইমান। এ জীবনের ভার কীভাবে বইব আমি? আমি নিজের হাতে খুন করলাম তোমাকে। অথচ আমি আর আমার মেয়ের জীবন বাঁচাতে কিইনা করেছ তুমি। আজও নিজের সবটুকু দিয়ে বাঁচিয়ে গেলে আমাদের।
কিন্তু ভাববার আর সময় ছিল না জেহারের। আগুনের উত্তাপ ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের। জোহার নিজেও আহত। দোতলার কাচ ভেঙে নিচে পড়ে মাথা, কাঁধ, হাঁটু, হাত সব জখম তার। সমস্ত শক্তি প্রয়োগে দুহাতে তুলে নিল সে লানাকে।
বাইরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির হুইসেল। জোহার যখন লানাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলছে তখন সমস্ত রাস্তায় জ্যাম। মুনের ঘোর তখনও কাটেনি
প্রায় একমাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিল লানা। নীল তার বিদেশীনী বউ কে নিয়ে দেশে ফিরেছে। দেশে এসেই সে তার মমকে জোর করে একেবারে নিয়ে এসেছে বাড়িতে।
সবাই জানে লানা একটা দুর্ঘটনার শিকার। তবে কীভাবে, কখন কি হয়েছে কেউ জানে না। ইমাদ হাসপাতালে প্রায়ই আসত লানাকে দেখতে। জোহারের সাথে পরিচয় হয়েছিল তার।
নিকুঞ্জভিলার দুর্ঘটনার পরদিনই স্বস্ত্রীক দেশে ফিরেছিল রিজভি। জোহার হাসপাতালে লানাকে নিয়ে বিজি ছিল আর এদিকে রিজভি সামাল দিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। সুস্থ হয়ে লানা আপাতত নিজের বাড়িতেই এসেছে। হাশেম আঙ্কেল আর লানার মধ্যে অদ্ভূত বিষয়বস্তু নিয়ে কতাবার্তা হয়, লানার মম্, নীল কেউ তা বুঝতে পারে না। তবে ব্লু সি বিচ কে কিনতে গিয়ে লানার সাথে জোহারের এই যোগাযোগটা ধরতে পেরেছে লানার পরিবার। জোহারকে তাদের ভালোও লেগেছে। জোহারের প্রতি যে লানার একটা দুর্বলতা, সেটা টের পেয়েছে লানার পরিবার।
রিজভিও সহজ স্বাভাবিক ভাবে ব্লু সি বিচ উদ্ধার করে হ্যান্ডওভার করেছে লানার হাতে। বলেছে, এ কম্পানী এখন থেকে তোমার। নিকুঞ্জভিলা ভেঙেচুরে নতুন ডিজাইনে তৈরি হচ্ছে। কারণ, রিজভি ও নীল দেশে থাকতে থাকতেই লানার সাথে জোহারের বিয়েটা হয়ে যাবে আশা সবার।
আজ লানাদের বাড়িতে আসবে ওরা। লানা এখন মোটামুটি সুস্থ। রিজভি কথা বলবে নীল আর তার মমের সাথে। জোহার আর লানার বিয়ের একটা ঠিকঠাক সময় স্থির করা হবে আজ।
মুন লানার সাথে এ বাড়িতেই থাকে। লানা বাগানের ছায়ায় একটা শ্বেত পাথরের বেঞ্চিতে বসেছিল। মুন খেলছে বাগানে। গেস্ট বলতে রিজভি, সাথে তার স্ত্রী রেখা। রিজভি ও তার স্ত্রী রেখাকে আপ্যায়ণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাড়ির ভেতরে। সবার পেছনে জোহার। মুন ছোটাছুটি করছে লনে। জোহারকে দেখে সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার ড্যাডকে। তবে বেশীক্ষণ নয়, আবার ছুটে চলে গেল খেলার আকর্ষণে।
জোহার এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল লানার দিকে। স্মিত হাসি লানার ঠোঁটে। এতগুলো দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়েছে লানা। প্রতিনিয়ত তার পাশে, পারলে লানার হাতটা ধরে বসে থাকতে দেখা গেছে জোহারকে। নীল , মম্, সবাই দেখেছে সে দৃশ্য। কাউকে কিছুই বুঝিয়ে বলতে হয়নি। সবাই জোহারের একটাই পরিচিতি জানে, ব্লু সি বিচের কর্ণধার, জোহার। লানার এত কাছাকাছি কীভাবে এলো সেটা জানার প্রয়োজন পড়েনি আর।
কাছাকাছি এসে দাঁড়াল জোহার। জোহার আজকে একটা ব্লু স্যুট পড়েছে। ভেতরে সাদা শার্ট। ব্যাক ব্রাশ চুলে পরিপাট্য। তাকে ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে। আর লানা পড়েছে সাধারণ একটা ঢোলা প্লাজো’র ওপর টপস। ভীষণ ক্যাজুয়াল। হাসপাতালের দিনগুলোয়, লানার খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছিল জোহার। লানাকে খাওয়ানো, তার চুল বেঁধে দেয়া, ঔষধ খাওয়ানো, সব করত জোহার, নিজ হাতে। তবু অপরাধবোধ কাটেনি, নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি জোহার।
– পাশের আসনটিতে বসতে পারি?
লানা জায়গা ছেড়ে দিল। পাশাপাশি বসে লানাকে পর্যবেক্ষণ করল জোহার। বলল
– এই পোশাকে কিন্তু আশা করিনি?
– মানে?
– একটা শাড়ি টারি পড়লে মনে হয় বেশি মানাতো
লাজুক হাসল লানা। আড়চোখে তাকিয়ে বলল
– কেউ পড়িয়ে না দিলে যে শাড়ি পড়তে পারি না…তাকি কেউ জানে না?
জোহারের মনে পরে গেলো বাংলোর সেই শাড়ি পরানোর দিনটা। হেসে ফেলল সে। বলল
– তাহলে চলো, একবার ট্রাই করা যাক…?
লাজুক দুষ্টুমিতে মার খেল জোহার। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল সে। লানাও ছুটল জোহারের প্রাপ্য শাস্তিটা পূর্ণ করতে। তাদের ছুটোছুটি দেখে মজা পেয়ে হাততালি দিচ্ছে মুন।
দূর থেকে দেখছে রিজভি দৃশ্যটা। জেহার আর লানাকে দেখে খুব ভালো লাগে তার। তবু বুকের ভেতর মাঝেমাঝে হু হু করে বয়ে যায় একটা ব্যথাবোধ। জগতের স্বাভাবিকতায়, জীবন তার ব্যথাগুলোকে স্মৃতি বানিয়ে দূরে ঠেলে দেয়। রিজভির ধারণা, জোহারের মনেও তাই হয়। তবু
প্রকৃতিই মানুষকে অতীত ভুলতে সাহায্য করে। এখন জোহার আর লানাই রিজভির সন্তান। আর মুন তার সর্বস্ব।
লানা ধরে ফেলেছে জোহারকে। ধরা পড়ে দোষী যেন খুশি খুব। সে নিজেই আলিঙ্গন করে নিয়েছে লানাকে বিচার প্রার্থণায়। মুচকি হেসে বাড়ির ভেতরে সরে গেলেন রিজভি।
( শেষ)