#চোরাবালি_২২
রেশমা আক্তার
লানারা এসে প্রথমেই উঠেছিল নিকুঞ্জভিলায়। এই প্রথম সোহা হয়ে লানা নিকুঞ্জভিলায় এলো। প্রথমদিন এ বাড়িতে ঢুকেই অন্যরকম অনুভূতি এসেছিল মনে। সে সোহার মত দেখতে হলেও সে আসলে সোহা নয়। জোহার এখন বিশ্বাস করে এবং জানে, সে লানা। এতদিনের ব্যাপারটা একরকম ছিল, আর এখন সবার জানা বোঝার পর ব্যাপারটা একদম ভিন্ন লাগছে। লানার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরেছিল কিছুটা জোহার।
বলেছিল
– লানা, পৃথিবীতে অহেতুক কিছুই ঘটে না। আমরা সবাই এখন একটা অদ্ভূত সময় পার করছি। এ অভিজ্ঞতা কাউকে বোঝানো যায় না। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তুমি আমার আর মুনের জন্য যা করছ তার কৃতজ্ঞতা পরিমাপের ভাষা আমার জানা নেই।
– এভাবে বলছ কেন? আমার সোহা হয়ে যাওয়ার জন্য তোমরা তো দায়ী নও। আমি শুধু ভাবছি, এর শেষটা কোথায়? মুন আর তুমি শুধু নও, আমিওতো সোহার অন্যতম টার্গেট। সোহা আমার শরীরটা চায়। শুধু এটুকু জানি আমাদের মধ্যে যেকোন একজনকে মরতে হবে।
জোহার নিঃশ্বব্দে তাকিয়ে ছিল অপলক।
জোহারের মাঝেমাঝে ভেতরে মিশ্র একটা অনুভূতি হয়। এতগুলো বছর নানান প্রতিকূলতার মাঝেও সে সংসার করেছে সোহার সাথে। একতরফা ভালোবেসেছে। সে ভালোবাসা, সম্পর্ক কখন নিমিষেই নিঃশ্বেষ হয়ে যায় না। অথচ যখন মনে পড়ছে সোহা একজন সাধারণ মেয়ের মত নয়, বরং বিভৎস একটা ডাইনী, একটা জঘন্য মানুষরূপী অপশক্তি। যে কেবল নৃশংস খুনীই নয়, নিজের ক্ষমতা ও বিকৃতি চরিতার্থ করতে যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান বলিতে চড়াতে দ্বিধা করে না। তার সাথে দিনের পর দিন সংসার যাপনের অতীত মনে করলেই শিউরে ওঠা গা। ঘৃণায় দলা পাকিয়ে আসে বুকের কাছে। তাকে আর এক মুহূর্তও নিজের ভাবতে চায় না জোহার। সোহা তার পিহুর খুনী। যে কিনা এখন জোহারকেও মারতে চায়, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু মুনের কোন ক্ষতি হোক সেটা কখনই হতে দেবে না জোহার।
লানার মুখে বাংলোয় মুনকে মারার সোহার নিষ্ঠুর প্রচেষ্টাগুলো শুনেছে জোহার। কীভাবে রুমকি, ডক্টর পার্থ আর লানা বারংবার চেষ্টা করেছে মুনকে রক্ষা করতে। কীভাবে রুমকি মারা গেল, কীভাবে ডক্টর পার্থর মৃত্যু হল। এমনকি কোন কোন সময়গুলো লানা এসেছিল বাংলোয়। স্বপ্ন ভেবে কীভাবে নির্দ্বিধায় নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল ভবিতব্যের কাছে। কীভাবে একটু একটু করে কাছে এসেছিল জোহারের।
পুরো ব্যাপারটা জানার পর, লানার উপস্থিতির সেইসব দিনগুলো, জোহার নিজেই পেরেছিল আলাদা করতে। লানা যে তাকে কত করে বোঝাতে চাইত, সে সোহা নয়, সে লানা।
– জোহার…
চমকে তাকাল জোহার।
– নিউজে নিশ্চই দেখেছ, আমার ড্যাড আর নেই।
জোহার ব্যাথিত মনে জবাব দিল
– হুম, দেখলাম।
– জোহার, আমার মনে হয় আমার ড্যাডের মৃত্যুটা আত্মহত্যা নয়। আমার ড্যাড আত্মহত্যা করার মত মানুষই নন। পারিবারিকভাবে আমাদের মধ্যে বন্ডিংটা হয়ত অত গভীর ছিল না। কিন্তু তবুও, আমি চিনি তাকে
– সেটাইতো স্বাভাবিক লানা
লানার দু’ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি।
নিজেকে স্বংবরণ করে বলল
– আমি আমার বাবার মৃত্যুর কারণ হলাম জোহার…
জোহার প্রতিবাদ করল
– কি বলছ লানা, তুমি কেন হবে? এ সবকিছুর পেছনে কে আছে তাতো জানো তুমি
– তবুও, আমার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আগে নিশ্চই আমারই ভয়ঙ্কর রূপটা দেখে চলে গেল। সে হয়ত অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে। নিশ্চই অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেলেন ।
হু হু করে কেঁদে ফেলল লানা। জোহার লানার মাথায় হাত রাখল। লানা যন্ত্রণায় ডুকরে উঠে আশ্রয় নিল জোহারের বুকে। জোহারও ভালোবাসা আর স্বান্তনার বন্ধনে জড়িয়ে নিল লানাকে। এ অধিকার তারা কেউ কাউকে স্বেচ্ছায় জেনেবুঝে দেয়নি। এ অধিকার বা প্রাপ্তি প্রকৃতির নিয়ম বা অনিয়মে ঘটে গেছে। কান্না থেমে এলে লানা সরে দাঁড়াল। বলল
– জোহার আমি একবার বাড়ি যেতে চাই।
আতকে উঠল জোহার
– সেটা কীভাবে সম্ভব লানা? তোমাকে দেখলেই চিনে ফেলবে সোহা। আর তাছাড়া তোমার বাড়ির কেউতো তোমাকে চিনবেই না।
লানা নিজের হাতের কব্জিতে বাঁধা সুতোসমেত কাপড়ের পুটলিটা দেখল। তার মনে কি চলছে আন্দাজ করে সাবধান হল জোহার। বলল
– তুমি কি ওটা খুলতে চাচ্ছ লানা? তুমি বুঝতে পারছ, ওটা খুললে শেষ সুযোগটা পেয়ে যাবে সোহা। আর এবার সুয়োগ পাওয়া মানে….
চমকে তাকাল লানা, না না তা কি করে সম্ভব? এটা খোলা মানেই তাদের আবার ট্রান্সফর্ম। এবার সোহা আর হাতছাড়া করবে না সুযোগ। তাছাড়া লানা পেছন থেকে ক্রমশ আসতে আসতে এখন বর্তমানকে ছুঁয়ে ফেলেছে। ডক্টর পার্থ বলেছিল, এমন একটা দিন, যেদিন তাদের ট্রান্সফর্মটা বর্তমানের নির্দিষ্ট একটা সময়ে বা দিনে ঘটবে। সেদিন সোহা তাকে মেরে সম্পূর্ণ স্থায়ী হবে তার শরীরে। সুতরাং এখন সে সুযোগটা তাকে না দেয়াই উচিৎ।
যদিও লানা, সোহার শরীরে নিরাপদ নয়। সোহা হয়ত, সোহার শরীরেই মারতে চাইবে লানাকে। কিন্তু তবু, মুন আর জোহারের কাছে পৌঁছতে হলে সোহাকে তার নিজের শরীরে আসতে হবে। তাই এদিক থেকে স্বস্তি যে, যতদিন লানা সোহার শরীরে আছে, সে হয়তো ওদের ক্ষতি করতে পারবে না।
লানার মনটা ছুটে যাচ্ছিল বারবার নিজের বাড়িতে। সে ইমাদের নাম্বারটা মনে করতে পারছে না। তার এখন ইমাদকে খুব দরকার। বাড়ির কিছু খবরাখবর জানতে হবে তাকে। বাড়িতে ইচ্ছে করলেই ফোন করতে পারে সে। কিন্তু কে চিনবে তাকে, কিংবা কে জানে ফোনটা যদি সোহাই রিসিভ করে?
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও চিন্তাভাবনা করেও অবশেষে লানা সিধান্ত নিল, সে যাবে তাদের বাড়িতে। জোহার বাঁধা দিল, কিন্তু তাকে বোঝাল লানা, এবং পড়ন্ত বিকেলে একাই চলল নিজেদের বাড়িতে। বলে গেল
– মুনের খেয়াল রেখ। আমি যাব আর আসব।
নতুন রূপে এই শহরে লানার বিচরণ। সোহার শরীরে এ তার এক নতুন অভিজ্ঞতা। বাড়ির কাছাকাছি এসে কেমন ভয় এলো মনে। তাকে যদি ঢুকতে না দেয় ? তাকে তো চিনবে না এ বাড়ির কেউ। তাছাড়া নিজের কি পরিচয় দেবে লানা? লানা গেটে দাঁড়োয়ানের কাছে জানতে চাইল তার মমের নাম ধরে, তিনি বাড়িতে আছেন কিনা। জানা গেল মম বাড়িতে নেই। ইনফ্যাক্ট, মম ড্যাডের মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই চলে গিয়েছিল নিজের ডেরায়। বাড়িতে শুধু লানা ম্যাডাম আছেন তবে এই মুহূর্তে তাকে পাওয়া যাবে না। কারণ তিনি একটু বেড়িয়েছেন।
লানা সাহস পেল। বলল, সে হাশেমের সাথে দেখা করতে চায়।
দাঁড়োয়ান ইন্টারকমে হাশেমের সাথে কথা বলল এবং একটু পরে হাশেমের পারমিশনে লানা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল।
লানা যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুন করে দেখছে নিজেদের বাড়িটা।
এ ক’দিন বহু পরিচিত, অপরিচিত লোকজন এসেছে এ বাড়িতে। সুতরাং হাশেম ভেবেছিল, বড় সাহেবেরই কোন পরিচিত কেউ।
লানা কোন ভূমিকায় গেল না। বসার ঘরে প্রবেশ করেই চারিদিকে তাকিয়ে বলল
– এতবড় অঘটনটা কি করে ঘটে গেল হাশেম আঙ্কেল, বলতো? ড্যাডি আত্মহত্যা করেছেন গলায় ফাঁস লাগিয়ে, তোমার বিশ্বাস হয়?
হাশেম কুঞ্চিত চোখে চট করে তাকাল লানার দিকে। লানা বলল
– পুলিশ, পুলিশ কি খুনের কোন আলামত পায়নি ড্যাডের ঘরে?
– কে… কে… আপনি? কি বলছেন এসব? কে আপনার ড্যাড?
– হাশেম আঙ্কেল, তুমি চিনতে পারছ না আমাকে? আমি লানা…
লানার কন্ঠ অপরিচিত হলেও তার আকুতিটায় কিছু একটা ছিল। গভীর চোখে, কাছে এসে হাশেম তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে। লানা বলল
– দেখো, দেখো আমি লানা। কিন্তু এই যে শরীর বা চেহারাটা দেখছ, এটা আমার নয়।
– কি সব বলছেন, বলুনতো? আমি তো আপনাকে চিনিই না। আপনি যদি এদের পরিচিত কেউ হন, তাহলে বসেন। চা, কফি খান। খেয়ে চলে যান। উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলে লাভ নেই। উল্টোপাল্টা কথা বলে হাশেমকে বিভ্রান্ত করা যায় না।
অসহায় বোধ করল লানা। তখনই ট্রে হাতে ঢুকল জেসি। লানা দ্রুত তার সামনে গিয়ে হেসে বলল
– জেসি…, কেমন আছ জেসি। আমাকে চিনতে পারছ? আমি তোমার ম্যাম….
জেসির বোঝার কথা নয়।
দ্বিধান্বিত হাশেম। বুঝল, কিছু একটা ব্যাপার আছে। সে জেসিকে জোরে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিল ভেতরে। হাশেম রাগত বলল
– কি যা তা বলছেন বলুনতো। এ বাড়িতে এমনিতেই হাজারটা প্রবলেম। আপনি চলে যান। এসব অবান্তর কথাবার্তা এখন ভালো লাগছে না।
– জানি হাশেম আঙ্কেল, জানি। মম্ নিশ্চই চলে গেছেন আবার। নীল এখনও ফেরেনি দেশে। লানা নামে অদ্ভূত কেউ এসে ছড়ি ঘোরাচ্ছে বাড়িতে। এমন সব কাণ্ড করছে যা তোমাদের ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসা লানা কখনই করত না।
হাশেমের চোখে বিস্ময়। তার নীরবতার সুযোগে বলতে লাগল লানা
– তোমাকে বলেছিলাম হাশেম আঙ্কেল, আমার সাথে একটা অদ্ভূত ব্যাপার হয়। আমি হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি, আমি নই, আমি অন্য কারো শরীরে। আর পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, সেও যায় আমার শরীরে। এভাবে চলতে থাকে আমাদের যাওয়া আসা। সে যেমন এখানে লানা হয়ে এখানকার সবকিছুতে জড়িয়ে গেছে। আমিও সোহা নামে তার জায়গায়, অনেকের সাথে জড়িয়ে গেছি।
– অবিশ্বাস্য। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বড় সাহেবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আপনি এসেছেন তার মেয়ে হয়ে, সম্পত্তি হাতাতে…?
লানা এগিয়ে এসে হাশেমের অবিশ্বাসী চোখের দিকে তাকাল, ছলছল চোখে বলল
– পাঁচ বছর বয়সে তোমার পিঠে যে গ্লাস ছুড়ে মেরেছিলাম, কাটা দাগটা তো এখনও আছে। তবু অবিশ্বাস করবে?
হাশেমের মুখ থেকে অস্পষ্ট বেড়িয়ে এলো
– আপনি… মানে, কিকরে জানলেন?
– একমাত্র তুমি আর আমিই তো জানতাম হাশেম আঙ্কেল। মম্ বকবে বলে তুমি কাউকে বলনি। আমাকেও বলতে বারণ করে দিয়েছিলে..
– ছোটমনি….? এ কিকরে সম্ভব…?
– সম্ভব হয়ে গেছে হাশেম আঙ্কেল। তবে সেদিন তোমার একটা বিশ্বাস আমি গ্রহণ করে উপকৃত হয়েছিলাম। নিজের পজিটিভ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে সত্যিই যে অসাধ্য সাধন করা যায় তার প্রমান পেয়েছিলাম আমি। ছোট্ট একটা বাচ্চা আর একজন সাদা মনের মানুষের জীবন রক্ষার দায় এখন আমার মাথায়। নিজের জীবনের তোয়াক্কা করছি না। কি আর আছে হারাবার আমার বল?
লানা সোফায় বসল। জেসি টেবিলে কফি রেখে গেছে। লানা কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করল। বলল
– আহ, কতদিন এই কফিটা মিস করেছি।
হাশেম বলল
– কিন্তু সে তো সব শেষ করে দিয়েছে ছোটমনি। বড় সাহেবকে…
– জানি, সোহাই করেছে এটা। এবং এও জানি সমস্ত আলামতও গায়েব করেছে সে। অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে ওর।
– আমি দেখেছি। কিন্তু কিচ্ছু বলার সাহস পাইনি। আমি বুঝতে পারছিলাম তোমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি, ওটা তুমি নও। এর সমাধান কী?
– জানিনা হাশেম আঙ্কেল। কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে সমাধান যেটাই হোক আমাদের মধ্যে কোন একজন কে সরে যেতে হবে। মৃত্যুতে আমার ভয় নেই। বেঁচে থেকে কিইবা পেলাম বলতো? কিন্তু ভয় এখন মুন আর জোহারকে নিয়ে।
লানা এরপর হাশেমকে মুন আর জোহারের ব্যাপারে খুলে বলল। হাশেম এতবড় তাজ্জব ঘটনা জীবনে শোনেওনি, দেখারতো প্রশ্নই আসে না।
লানা টেবিলের নিচে একটা পেপার পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিল। জানতে চাইল, কি এটা?
হাশেম এগিয়ে এসে দেখে বলল
– এই খামটা আজ দুপুরে এসে পৌঁছেছে। এটা পড়েইতো ওই মেয়েটা, কি যেন নাম বললে…? সোহা…. তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল বাইরে।
লানা কৌতূহলী হয়ে কাগজটা মেলে ধরল চোখের সামনে। এটা একটা উকিলের চিঠি। এতে লেখা আছে, ব্লু সি বিচের প্রক্তন কর্ণধার, মিস্টার জোহার এখন বাংলাদেশে। লানা চাইলে তারা ব্যাংকের মধ্যস্থতায় একটা মিটিং এরেঞ্জ করতে পারে।
লানার কপালে ভাজ পড়ল। বলল
– কই এরকম নোটিশতো জোহার পায়নি। নাকি জোহার খেয়াল করেনি? নাকি সোহাই তার উকিলকে বলে জোহারের গতিবিধি জানার জন্য খোঁজ রাখতে বলেছিল। উকিল কোন না কোন উপায়ে জেনে গেছে জোহারের দেশে আসার খবরটা।
লানার মাথায় হঠাৎ মনে হল বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এই চিঠি পেয়ে যদি সোহা তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে যায়, তাহলে সে কোথায় যেতে পারে?
এমনতো নয়, সোহা যখনই জানতে পেরেছে জোহার এসেছে তখনই চলে গেছে নিকুঞ্জভিলায়? কেননা, এই সুতোটা লানার হাতে থাকায় সোহা চাইলেও ট্রান্সফর্ম হতে পারছিল না। আজ চিঠি পেয়ে আর এক মুহূর্তও তাই দেরী করেনি।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল লানা। বলল
– সর্বনাশ হাশেম আঙ্কেল। সোহা নিশ্চই চলে গেছে নিকুঞ্জভিলায়। ও নিশ্চই ক্ষতি করার চেষ্টা করবে মুন আর জোহারের।
– তাহলে? পুলিশকে খবর দিব?
লানা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল
– পুলিশকে কি বলবে তুমি? পুলিশ কী এসব বিশ্বাস করবে? না তুমি কিছু প্রমান করতে পারবে?
– হু… তাই তো? তাহলে?
– হাশেম আঙ্কেল আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। আর শোন, এ বিষয়ে তুমি কাউকে কিচ্ছু বলবে না। তাহলে আরও জটিলতা তৈরি হতে পারে।
হাশেম সন্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
নিকুঞ্জভিলায় ঢুকতে কোন অসুবিধা হয়নি সোহার। চোখের সন্মোহনী শক্তি কাজে লাগিয়ে দাঁড়োয়ানকে এক প্রকার ঘুম পারিয়ে দিয়েছে সে । শুনশান নীরবতা চারিদিকে। বাড়ির গেট পেরিয়ে বাগান, যে বাগানে গাছপালা অযত্ন অবহেলায় জঙ্গল প্রায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে সদর দরজার দিকে।
মুনকে ঘুম পাড়িয়ে, একমগ কফি নিয়ে একটা বইয়ে বুদ হয়েছিল জোহার। মুন ঘুমাচ্ছে উপরের একটা কামরায়, জোহার নিচে। লিভিংরুমের একটা রকিং চেয়ারে বসে বই হাতে চোখদুটোও লেগে আসছিল। যদিও মনে মনে ছিল উদ্বেগ, লানার জন্য। লানা ঠিকঠাক ফিরে আসবে তো?
এখন সন্ধ্যা হয় হয়। ঘরে আলো জ্বালেনি জোহার। বিশাল জানালায় অস্তমিত সূর্যের শেষ আলো। অনাগত আশঙ্কায় নিস্পৃহতা এলেও, ওই আলোটাও ভালই লাগছিল তার।
কারো পায়ের শব্দে চমকে তাকাল জোহার। লানা ফিরে এলো কি?
তাকিয়ে দেখল, দরজায় এক অপরিচিত মেয়ে। ঠোঁটে চিকন একটা হাসি, চোখে ধূর্ততা।
– কে আপনি?
সোহার হাসি প্রশস্ত হল। কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল
– আমি কে…. আন্দাজ কর তো ডার্লিং….?
বুকটা ধড়াস করে উঠলেও অসম্ভব চিন্তাটাও এলো মাথায়। বলল
– আপনাকে চিনতে পারছি না, কে আপনি? কীভাবে এলেন এ পর্য়ন্ত?
ঘর ফাটিয়ে হাসল সোহা। জোহারের মনে তীব্র আশঙ্কা জমা হচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বলল
– আপনি কে…?
আচমকা থেমে গেল সোহা। জোহারের আরও কাছাকাছি এসে গভীর চোখে তাকাল জোহারের দিকে, হিসহিস করে বলল
– ভালো করে খেয়াল কর ডার্লিং। আমি… আমি….আমি তোমার প্রিয়তমা স্ত্রী
উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে জোহারের। হঠাৎ সোহা জোহারের কলারে হাত দিল।
বলল
– লানাকে দেখনি বুঝি একটিবারও? দেখনি, অথচ তারই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ? সংসার করছ রীতিমত? বাই দ্য ওয়ে, লানার সাথে তোমার ওসব হয়নি? শোওনি লানার সাথে…?
ছিটকে সরিয়ে দিল জোহার, সোহাকে। বলল
– ছি….
– ছি….?
ব্যাঙ্গাত্মক হাসল সোহা।
– সোহা….?
– এইতো চিনতে পেরেছ। চিনতে যে তোমাকে হবেই জোহার। আমি যে তোমার বিবাহিতা স্ত্রী, মুনের মম্। বাই দ্য ওয়ে, মুন কোথায়? মাই সুইটি কিড…
সোহা ঘুরে দাঁড়িয়ে চারিদিকে খুঁজল, তারপর উপরে ওঠার সিঁড়িতে পা দিয়ে বলল
– অবেলায় মেয়েটাকে ঘুমানোর অভ্যেস করিয়েছ। নিশ্চই ওপরে ঘুমাচ্ছে, তাই না?
সোহা জোহারের জবাবের অপেক্ষা না করে গটগট করে উঠে গেল ওপরে। শঙ্কিত গলায় ডাকল জোহার। আর পিছু পিছু ছুটল সেও
– সোহা, দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমার মেয়েকে ধরবে না তুমি….খবরদার…
সোহা ততক্ষণে উঠে গেছে ওপরে। জোহার পৌঁছে দেখল, বেডরুমে ঘুমন্ত মুনকে তুলে কোলে নিয়েছে সোহা।
– কি করতে চাইছ সোহা? কেন তুললে ওকে? ও ঘুমাচ্ছে। রাখো ওকে….
সোহা আচমকা জোরে বিছানায় ছুড়ে মারল মুনকে
বলল
– নাও…রাখলাম….
ব্যাথায় কেঁদে উঠে বসল মুন। বিস্ময়ে দিশেহারা জোহার দৌঁড়ে যেতে চাইল মুনের কাছে। কিন্তু সোহা যেতে দিল না। দু’হাতের তালু দিয়ে তীব্র ধাক্কায় সরিয়ে দিল জোহারকে। জোহার ছিটকে পড়ে গেল দরজায়। যেন অসুরের শক্তি সোহার শরীরে। কিন্তু ঠিক কি করতে চাইছে সোহা?
পড়ে গিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে জোহারের। গুরুতর আঘাত লেগেছে তার বুকে। দূর থেকে জোহার দেখছে, মুনকে জাপটে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সোহা। জোহার খুব চেষ্টা করছে ওঠার। কিন্তু পারছে না। কোথায় নিয়ে গেল সোহা, মুনকে? আচমকা পিহুর কথা মনে পড়ল জোহারের। সোহা কোন অঘটন ঘটাবে নাতো?
জোহার খুব কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল। তার চোখদুটো ঘোলা লাগছে। সামনে কে ও? লানা… নাকি সোহা?
লানা দৌঁড়ে এসে ধরে ফেলল জোহারকে। জানতে চাইল
– জোহার কি হয়েছে তোমার? মুন কোথায়?
লানা উঁকি দিল ঘরের মধ্যে। বিছানায় নেই মুন। মনের মধ্যে অশনিসংকেত। সে জোহারকে ছেড়ে দৌঁড়ে গেল ছাদের সিঁড়িতে।
মুন দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিশে, স্থির। সোহা অনতিদূরে। ছাদে উঠে এসে দূরে থমকে দাঁড়িয়েছে লানা। শরীর কাঁপছে তার। চিৎকার করে হাত বাড়িয়ে মুনকে নিষেধ করল লানা,
– না মুন না, নড়বে না…. মুন?
লানার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসল লানারূপি সোহা। বলল
– হাউ সুইট…এইতো, মুনের মম্ চলে এসেছে। মুন এবার লং জাম্প করে দেখাবে তার মমকে। তাই না মুন…?
মুন একটুও নড়ছে না। লানা চিৎকার করে ডাকছে মুনকে। মনে হল সে একটুও শুনতে পাচ্ছে না। কি হবে এখন, ও কি সন্মোহিত?
লানা তীব্র চোখে তাকাল সোহার দিকে। তারা একে অপরের শরীরে মুখোমুখি, এই প্রথম। লানা দেখছে তার নিজের শরীরে, নিজের চোখদুটো কি ধূর্ত, নিজের ঠোঁটে কি অমানবিক, পৈশাচিক একটা হাসি।
কিচ্ছু মাথায় আসছে না। কি করনীয়? কীভাবে সে থামাবে সোহাকে?
সোহাও একাগ্র তাকিয়ে আছে লানার দিকে। তার চোখে কৌতূহল। নিজের শরীরে লানাকে দেখে হয়ত সেও খানিকটা রোমাঞ্চিত। লানা দ্রুত ভাবল। কিন্তু তার আগেই কঠিন হয়ে গেল সোহার মুখ। সে হিংস্র মুখে তীব্র গতিতে এসে দুহাতে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল লানার বুকে। সোহার শক্তি আর আঘাতের জোরটা এতই বেশি যে, লানার হয়তো কয়েক হাত পেছনে ছিটকে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবে, লানা নয় বরং সোহাই ছিটকে পড়ল কয়েক হাত পেছনে
পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে দেখল সোহা, লানাকে। তার ঠোঁটের কোণায় রক্ত। মুখ দিয়ে রাগে গড়গড়, জান্তব একটা শব্দ বের হচ্ছে। লানা নিজেও বিস্মিত। এটা কীভাবে হল?
সোহা নিজের ভুল শুধরে নিল পরক্ষণেই। সে উঠে এবার দৌঁড়ে আসছে লানার দিকে আঘাত করতে। লানা স্থির। তার মাথা দ্রুত কাজ করছে।
সোহার পড়ে যাওয়ার কারণটা বুঝে গেল সে। খুব কাছে এসে লানাকে আক্রমণ করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে লানা সুতোবাঁধা তার হাতটা জাগিয়ে শুধু হালকা স্পর্শ করল সোহাকে।
যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হল সোহা। ছিটকে পড়ে গেল আবার। সাহস পেল লানা। এবার সে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সেহার দিকে। সোহা উঠে বসেছে। তার চোখে এখন বিস্ময় আর ভয়।
লানা কাছাকাছি যাবার আগেই উঠে দৌঁড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল সোহা। একবার কার্নিশে দাঁড়ানো সন্মোহিত মুনের দিকে তাকিয়ে লানার দিকে দেখল সে। তারপর দৌঁড়ে নিচে চলে গেল সোহা। লানা এক মুহূর্তও দেরী না করে ছুটে গিয়ে ধরল মুনকে। স্পর্শ করার সাথে সাথে ঘুম ভাঙল মুনের। লানা কসরত করে, টেনে তুলে আনল মুনকে। হঠাৎ তার মনে হল জোহারের কথা। জোহার ঠিক আচে তো নিচে?
মুনকে নিয়ে লানা যখন দোতলায় এলো, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জোহারকে করিডোরে টেনে এনে তার বুকের ওপর বসে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে সোহা। লানা দিশেহারা, সে মুনকে রেখে হাতের কাছে পাওয়া একটা ফুলদানী তুলে নিয়ে পেছন থেকে গিয়ে সজোরে মারল সোহার মাথায়।
সোহা টলে পড়ে গেল পাশে। লানা জোহারের মাথাটা তুলে নিয়ে জোহার… জোহার….
বলে ডাকতে থাকল। যদিও জোহারের কোন সাড়া নেই। নিস্তেজ তার শরীর যেন প্রাণহীন।
সোহা উঠে বসেছে আবার। সে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে লানার দিকে। লানা ক্রুদ্ধ মুখে এবার সুতো বাঁধা নিজের হাতটা উঁচিয়ে ধরল সোহার দিকে। সোহা ভয়ার্ত চোখে গোঙাতে শুরু করল। পিছু হটতে হটতে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে গেল সে ।
লানা তার পিছু নিতে পারল না। কারণ জোহারকে এই মুহূর্তে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। লানা জোহারের মাথাটা কোলের উপর নিয়ে জোরে জোরে ডাকল, কোন সাড়া পেল না। কি হল জোহারের? ও বেঁচে আছেতো?
দ্রুত সিধ্বান্ত নিতে হবে। মাথায় আসছে না কিছুই। লানা এরপর নিরুপায় হয়ে, কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই যে কাজটা করল তা হল, সে নিজের হাতের সুতো বাঁধা কাপড়ের পুটলিটা খুলে জোহারের গলায় পড়িয়ে দিল।
এতে কি হবে জানে না সে। আদৌ কোন ফল পাবে কিনা অনিশ্চিত।
মুন চলে এসে বসেছে তার ড্যাডের পাশে। সেও বুঝি আঁচ করতে পারছে কিছু বিপদ। মুন জোহারের বুকের ওপর উপুড় হয়ে চাঁপ দিল। মুখের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল
– ড্যাডি…. ড্যাডি…. ওঠ….
মুনের বেশ কয়েকবারের দাপাদাপি ও ডাকে যেন নড়ে উঠল জোহার। নিশ্বাস এলো তার বুকে। কাশতে কাশতে উঠে বসল সে। চারিদিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল লানার দিকে।
লানা আশ্বাস দিল, সোহা নেই এখানে। জোহার নিজের গলায় ঝোলানো সুতোটার দিকে তাকালো অবাক চোখে।
লানা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল
– এটা থাক তোমার কাছে। এটা তোমাদের রক্ষা করবে। মুনকে কখনও একা হতে দেবে না। সবসময় চোখে চোখে রাখবে। জোহার একহাতে জড়িয়ে নিল মুনকে।
মধ্যরাতে কারো পায়ের আওয়াজে ঘুম ভাঙল লানার। ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু এটা কোন জায়গা, চিনতে পারছে না সে। তার স্পষ্ট মনে আছে, সে শুয়েছিল জোহারের ঘরে। জোহার আর তার মাঝখানে ঘুমাচ্ছিল মুন। নিরাপত্তার খাতিরেই এক বিছানায় ছিল তারা। কিন্তু এটা কোথায়? সে এখানে এলো কি করে? মাথার পেছনে তীব্র ব্যথা। লানা হাত দিয়ে অনুভব করল, তার মাথায় ব্যান্ডেজ।
চকিতে কালকের সব ঘটনা মনে পড়ে গেল। সোহা কি তবে ট্রান্সফর্ম হয়ে গেল? কিন্তু কীভাবে সম্ভব? তার হাতে তো সুতোটা আছে….
লানার হঠাৎ মনে পড়ল, সুতোটাতো সে জোহারকে পড়িয়ে দিয়েছিল। তারাহুড়ো আর জোহারের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় এটা একটুও খেয়াল ছিল না যে, ওই সুতোটাই ছিল এতগুলো দিন তার আর সোহার ট্রান্সফর্মের মাঝখানে বাঁধা।
সোহা চলে গেছে নিজের শরীরে। কী হবে এখন? নিকুঞ্জভিলায় কী ঘটছে জোহার আর মুনের সাথে?
( চলবে)