চোরাবালি পর্ব ২১

0
157

#চোরাবালি_২১
রেশমা আক্তার

লানার বাবা, হায়দার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক, মিস্টার হায়দার আহমেদ গত পরশু রাতে নিজ বাড়ির বেডরুমে, সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গত দু’দিন থেকে এ বাড়ির ওপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা চলে গেছে। কিন্তু সব ঝড়ের পরই প্রকৃতি বাড়াবাড়ি রকমের শান্ত হয়ে যায়। লানাদের বাড়িতেও তাই হয়েছে।

লানা এখন বসে আছে ড্রইংরুমের সোফায়। তার সামনে মুখোমুখি সোফায় বসে আছেন পুলিশের উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকর্তা। লানার চোখদুটো ফোলা, বোঝাই যাচ্ছে সে অনেক্ষণ কেঁদেছে। তার পাশের আসনে বসে আছে তার মম। পুলিশ অফিসার হ্যাট নামিয়ে নিয়েছেন হাতে। তার মুখটাও দুঃখী দুঃখী। তিনি আসলে এসেছেন সমবেদনা জানাতে। হায়দার সাহেব সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তি। বাংলাদেশের টপ শিল্পপতিদের একজন। তার মত মানুষ ফ্রাসট্রেশনে এমন কাজ করে ফেলবেন, ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।

মমের কিছু বলার নেই। সেও শোকাহত তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ ড্যাডের সাথে সেপারেশন থাকায় কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারলেন না। তাই এ ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই। মম শুধু ড্যাড সম্বন্ধে তথ্য দিয়েছেন যে, ড্যাড প্রচন্ড আত্মকেন্দ্রিক, মদ্যপ আর স্বার্থপর টাইপ মানুষ ছিলেন। বিজনেস আর বিদেশে ট্রিপ ছাড়া তার ব্যাক্তিগত জীবন বলে কিছুই ছিল না। বিবাহিত জীবনে তাদের কোন বনিবনা ছিল না ঠিকই কিন্তু একজন প্রাক্তন স্ত্রী হিসেবে এবং বিজনেস পার্টনার হিসেবে লানার বাবার মৃত্যুতে তিনি শোকাহত।

এ বাড়িতে হায়দার সাহেবের এমন মৃত্যুটা আত্মহত্যা নাকি খুন সেটা নিয়ে পুলিশ তদন্ত চলছে। এবাড়িতে প্রায় হাফডজনের বেশি সাহায্যকারী, প্রত্যেককে আলাদা করে ডেকে কথা বলেছে পুলিশ। সর্বশেষ লানাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল,
সে কাউকে সন্দেহ করে কিনা।
লানা জানিয়েছে, সে কাউকে স্বন্দেহ করে না।

পুলিশ অফিসার তাদেরকে সমবেদনা জানালেন। হায়দার সাহেবের আত্মীয় শুভানুধ্যায়ী, বিজনেস, অফিসের লোকজন আসা যাওয়া করছে ঘনঘন। অফিসার চলে গেলে লানা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।
সবকিছু সামাল দিচ্ছে এ বাড়ির পুরাতন, বয়স্ক কেয়ারটেকার বা ম্যানেজার হাশেম। সে গম্ভীর মুখে, নিঃশ্বব্দে সবকিছুর তদারকী চালিয়ে যাচ্ছে। আর দূর থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে লানার ওপরে। গত একসপ্তাহে লানার স্বভাবে অনেক পরিবর্তন দেখেছে হাশেম। সবচেয়ে বেশী
পরিবর্তন দেখেছে জেসি। প্রথম একদিন সকালে কফি নিয়ে লানার ঘরে ঢুকলে জেসি লানার ভয়ঙ্কর চেহারাটা দেখে।

ঘুম ভেঙে লানা চারিদিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করে। জেসির হাত থেকে গরম কফির পাত্রটা নিয়ে জেসির গায়েই ছুড়ে মারে। এরপর সামনে যা পায় লানা সব একটা একটা করে ছুড়ে মারে জেসির দিকে। জেসি কাটা, রক্তাক্ত কপাল আর আহত হাত নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে নেমে আসে নিচে। হাশেম আঙ্কেলের সামনে পড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।

– হাশেম আঙ্কেল, ম্যাম পাগল হয়ে গেছে। আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে, আমাকে আপনি বাঁচান

লানার ঘরে তখন ঝনঝন শব্দে একটার পর একটা জিনিস ভাঙছে। হাশেম বিস্মিতমুখে উঠে গেল উপরে। হাশেমকে দেখে একটা কাচেঁর শোপিস ছুড়ে মারতেই খপ করে সেটা ধরে ফেলল হাশেম। বিস্মিত লানা থেমে গেল মুহূর্তে, হাশেমের চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কিছু।

হাশেম বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছিল কিছু। তার মুখ থমথমে, চোখদুটো সন্মোহনী, স্থির। অদ্ভুতভাবে স্থির হয়ে গিয়েছিল লানা। শান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়েছিল ধপাস করে। দু’ হাতে মাথা চেপে ধরে বলল
– আই’ম সরি…। জানিনা, আমার যে কি হয় মাঝেমাঝে।
হাশেম জোরে জোরে ডাকল জেসিকে।
ভয়ে ভয়ে উঠে এলো জেসি। হাশেম গম্ভীর ও আদেশের স্বরে বলল
– ঘরটা পরিষ্কার করে ফেল

জেসি দোনোমনা করল
– কিন্তু হাশেম আঙ্কেল…ম্যাম যদি

হাশেম হাত তুলে থামিয়ে দিল জেসিকে। বলল
– ভয় নেই তোর, ছোটমনি তোকে মারতে চায়নি। তাছাড়া ছোটমনি তোকে শুধু শুধু কেনইবা মারবে? তোকে মেরে তার লাভ কি? বরং…. ক্ষতি…। বিরাট ক্ষতি

শেষের কথাগুলো লানার প্রতি হুশিয়ারীর মত শোনাচ্ছিল।

লানা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল হাশেমের দিকে। হাশেম কী কিছু ইঙ্গিত করছে তাকে?

এরপর শান্ত হয়ে গিয়েছিল লানা। না, ঠিক লানা নয়, সোহা। হাশেম নজর রাখছিল তার ওপর সবসময়। সোহার গতিবিধি সব অন্যরকম। এমন সময় হায়দার সাহেব ফিরেছিলেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। সোহা কয়েকদিনে হায়দার সাহেব তথা লানার ড্যাডের সাথে বেশ ভালো সময় কাটাল। হায়দার নিজেও অবাক। তার মেয়ে তাকে সময় দিচ্ছে, একসাথে ব্রেকফাস্ট করছে। রাতে ফিরলে ডিনার সার্ভ করছে, এসব কিছুর সাথে অপরিচিত তিনি।

সেদিন ডিনারে ‘ ব্লু সি বিচ’ সম্বন্ধে কথা হল। হায়দার সাহেব মেয়ের ওপর খুশি। বললেন
– বিজনেসে তোমার আগ্রহ আমার ভালো লেগেছে লানা। তোমার মম আমাকে অবশ্য নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আমি বিষয়টা ক্ষতিয়ে দেখেছি। ঠিকঠাক গাইড করলে কোম্পানিটা বেশ ভালো রেভেনিউ জেনারেট করবে বলে আমার মনে হয়। আমি ফান্ড ট্রান্সফার করে দিয়েছি। ওদের তরফে উকিল সাহেব বাকিটা দেখছে।

লানার চোখে যেন হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। মুখের খাবার শেষ করে বলল

– ড্যাড, ডিডটা তুমি পোস্টপনড কর।
– মানে…?
– আমার আর ‘ ব্লু সি বিচ’ এ ইন্টারেস্ট নেই।
– কেন?
– ভেবে দেখলাম, ওরকম একটা কম্পানি কেন আমি কিনব? কি লাভ? আমিতো চাইলে এরচেয়ে লাভজনক কিছু করতে পারি।

– কিন্তু আমিত এটা নিয়ে এনেকটা এগিয়েছি। ইনফ্যাক্ট, এটাতে আমি অনেক পজিটিভ দিক দেখতে পেয়েছি। আই’ম ইন্টারেস্টেড। যদিও কম্পানিটা আমি তোমার নামে কিনছি

– আমি চাই না কম্পানিটা ফারদার রান করুক। বেটার, তুমি আমাকে আমার অংশের প্রপার্টিটা দিয়ে দাও। আমি ইউ এস এ তে গিয়ে সেটল হতে চাই।
হায়দার সাহেব অবাক চোখে দেখছে লানাকে। তার মেয়েকে খুব কাছ থেকে জানার বা বোঝার সুযোগ সে সত্যিই পায়নি। তবে লানা যে এতটা একগুঁয়ে, খামখেয়ালী আর অদূরদর্শী ভাবতে পারেনি।

– আমি কী ভুল শুনলাম? তুমি কি প্রপারটির ভাগ চাইছ?
– ইয়েস, আফটার অল, আমি, আমরাইতো তোমার সবকিছুর উত্তরাধিকারী। তো আমিতো আমার অংশেরটা চাইতেই পারি

হায়দার সাহেব হাসলেন এবং পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন
– তোমাকে যা ভেবেছিলাম, তুমি তা নও। তুমি একদম তোমার মমের মত। স্বার্থপর, লোভী, কাণ্ডজ্ঞানহীন।
লানার মুখটা থমথম করছে। হায়দার সাহেবের চোখেও রাগ দেখা যাচ্ছে। সে বলল
– এক কাজ কর, তোমার মম তো বিজনেসের অর্ধেক শেয়ারহোল্ডার। তুমি বরং তার উত্তরাধিকার দাবী কর। কিন্তু যতদিন আমি বেঁচে আছি আমি আমার প্রপার্টিতে হাত দিচ্ছি না। আগে নিজের যোগ্যতা প্রমান কর।

লানার চোখদুটো জ্বলে উঠে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। সে হেসে বলেছিল, এতক্ষণ আসলে সে মজা করেছে। কফি সার্ভ করে, সে তার ড্যডকে সহজ করার চেষ্টা করেছিল।

দূরে সটান হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে এসবকিছু দেখছিল হাশেম। সবকিছু এলোমেলো লাগছিল তার কাছে। কেন যেন মনে হচ্ছিল এ লানা নয়, কিংবা যদি এ লানাও হয়, লানার ওপর লানার নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

সচেতন হয়ে গিয়েছিল হাশেম। রাতদিন সবসময় নজর রাখতে শুরু করেছিল লানার গতিবিধির ওপর। আর তারপর সেদিন গভীর রাতে, লানা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে ধীর, সন্তপর্ণে চলে গিয়েছিল তার ড্যাডের ঘরে। নিচে, আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল হাশেম। ঘন্টা খানেক পর ফিরে এলেও, কোন স্বন্দেহ জন্মেনি হাশেমের মনে। পরদিন সকালে বড় সাহেবের লাশ ঝুলতে দেখা গিয়েছিল ফ্যানের সাথে।
কিভাবে কি হল, কে করল কিছুই মেলাতে পারছে না। বিশালদেহী, বলশালী হায়দার সাহেবকে কেউ খুন করে ঝুলিয়ে দিয়ে যাবে, আবার সেটা লানার মত একটা ক্ষীনাঙ্গী মেয়ে, ভাবতেই পারেনি হাশেম।
পুলিশ বা কারো কাছে মুখ খোলেনি হাশেম। কারণ সে যা বলবে তা ভিত্তিহীন। বরং স্বন্দেহের তীরটা তার দিকেই চলে আসা স্বাভাবিক। সে অপেক্ষা করছিল ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কি আসে দেখার। কিন্তু পুলিশ যখন কোন আলামতই পেল না, তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল হাশেম। বুঝতে পেরেছিল, এ কোন সাধারণ খুনী নয়।

এর কয়েকদিন পরই ইমাদ এসেছিল লানাদের বাড়িতে। লানাই ডেকে এনেছিল অবশ্য। কারণ চিটাগং, শাহের অপমৃত্যুর ফাইলটা রি ওপেন হয়েছে। পুলিশ নাকি শাহেরের লাশ যেখানে পড়েছিল সে জায়গায় লানার হাতের ব্রেসলেট খুঁজে পেয়েছে। তাছাড়া এর মধ্যে কে বা কারা অভিযোগও তুলেছে লানার ব্যাপারে। পুলিশ তাই খোঁজ খবর করছে। কয়েকবার পুলিশ বাড়িতেও এসেছিল। লানা তাই পরামর্শের জন্য ডেকে এনেছে ইমাদকে।

ইমাদ হাঁটাহাঁটি করছিল বাগানে, প্রশস্ত চত্বরে। নেমে এসেছিল লানা। ইমাদ কি তাকে একটু এভয়েড করছে?
সৌজন্য আলাপ হল। দুজনে বসল শ্বেত পাথরের চেয়ারে। তাদের জন্য কফি চলে এলো। সামনের টেবিলে সব রেখে চলে গেল পরিচারিকা। ইমাদ রহস্যময় হাসল। বলল

– কি ব্যাপার বলত, হঠাৎ এত আপ্যায়ণ?
– ইমাদ তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলছ?
– কই নাতো
লানা আহত গলায় বলল
– আসলে ড্যাডির মৃত্যুর পর, আমি বড্ড একা হয়ে গেছি
– কিন্তু আমি যতদূর জানি, তোমার মম ড্যাডের সাথে তোমাদের সম্পর্ক তেমনও ছিল না যাতে তুমি এতটা ভেঙে পড়তে পার। নইলে নীলের কথাই ধর, এতবড় খবরটা শুনে একটা বার এলো না।

– নীল একটা বিজনেস ট্রিপে আছে। ওর সাথে কথা হয়েছে আমার।
– ও, তাই নাকি? বাহ, তোমাদের জন্য অবশ্য এমনটা ঠিক আছে। তারপর বল, হঠাৎ জরুরী তলব কেন?

– ইমাদ, তোমার হেল্প প্রয়োজন আমার।
– কেমন?
– শাহেরের ব্যাপারটায় পুলিশ আবার খোঁচাখুঁচি শুরু করেছে। আমার হাতের ব্রেসলেট নাকি পাওয়া গিয়েছিল স্পটে।
হাসল ইমাদ
– সেতো ঠিক আছে। তুমিতো ছিলে শাহেরের সাথে। ইনফ্যাক্ট শাহেরের মৃত্যুটা কিন্তু খুবই রহস্যজনক।

– আমার থাকা আর শাহেরের বডির পাশে আমার ব্রেসলেট পাওয়া, ব্যাপারটা এক নয়।
– আমি কি করতে পারি?
-তুমি পুলিশের এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে বাঁচাও। তুমি স্টেটমেন্ট দাও যে, সে রাতে আমি তোমার সাথে ছিলাম।

হো হো করে হাসল ইমাদ। হাসি থামিয়ে বলল
– খুব নির্বোধ পেয়েছ আমাকে তাই না? ভেবেছ, তোমরা যখন যেভাবে খুশি শুধু আমাকে শুধু ইউজ করবে। সেটা আর হচ্ছে না লানা
– মানে?
– মানেটা খুব সহজ। যে কারণে আমি নীলের কথায় বা প্রপোজালে তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম, সেটা ছিল একটা বিজনেস ইন্টারেস্ট। নীল বলেছিল, তোমার প্যারেন্টসের প্রপার্টিতে ওর কোন ইন্টারেস্ট নেই। সবকিছুর ওনার হবে একসময় তুমি। অথচ তুমি আমাকে পাত্তাই দিলে না। কোথাকার কোন স্বপ্নে পাওয়া জোহার, তার জন্য লাইফ বরবাদ করতে চললে।

লানার চোখদুটোতে যেন জমা হচ্ছিল আগুন। ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল সে ইমাদের দিকে। ইমাদের খেয়াল ছিল না সেদিক। সে বলেই যাচ্ছিল

– তোমাকে, বিয়ে করতে হবে আমায়। বিয়ের পর তোমার সমস্ত বিজনেসের পাওয়ার দিতে হবে আমাকে। তাহলেই আমি তোমাকে হেল্প করব। নইলে….
ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল লানা ইমাদের দিকে
– নইলে… কি?
– নইলে, সে রাতে শাহেরের সাথে তোমার গোপন অভিসার ফাঁস করে দেব আমি পুলিশের কাছে। আর…
বিস্ময়ে, কুঞ্চিত কপালে ভাজ তুলে প্রশ্ন লানার
– আর…?
– আর সেই সোহা…ব্লাডি বিচ…..। লানা সেজে আমার সাথে শুয়ে, আমাকে ইউজ করল ওর যত ভিডিও ক্লিপ আছে সব ছেড়ে দিব মিডিয়ায়…
কথাটা বলেই নিজের মোবাইলে ভিডিও অন করে তুলে ধরল লানার চোখের সামনে….

বিস্ময়ে, বিমুঢ় সোহা গভীর দৃষ্টিতে দেখল ভিডিও ক্লিপ। মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে ছিনিয়ে নিল ফোনটা। তারপর সজোড়ে আছাড় মারল পাথরে। চৌঁচির হয়ে গেল ইমাদের ফোন। ইমাদ হতবাক তাকিয়ে থাকল সেদিকে কিছুক্ষণ। তারপর হো হো করে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল।

হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলল
– একটা মোবাইল ভেঙে কি করবে তুমি? অমন একশ’টা জায়গায় সেভ করা আছে ওগুলো। লানা, অনেক ঘুরিয়েছ আমাকে। এবার তোমার ঘোরার পালা….

সোহা ঘুরে দাঁড়াল ইমাদের মুখোমুখি। ক্রুর হেসে বলল
– ব্ল্যাকমেল করছিস আমাকে? এতবড় সাহস তোর…?

ইমাদ লানার চোখের দিকে তাকাতেই চমকে গেল। কেমন জ্বলজ্বল করছে লানার চোখদুটো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের তালু দিয়ে ইমাদের বুকে প্রচন্ড ধাক্কা মারল সোহা। ইমাদ ছিটকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল কিছুটা দূরে। সম্বতি ফিরল ইমাদের। লানা এগিয়ে আসছে একটু একটু করে তারদিকে। কি নিষ্ঠুর একটা হাসি ওর ঠোঁটের কোণায়। এতবড় ভুলটা কি করে করল ইমাদ?

লানা তাকে পই পই করে বলে দিয়েছিল, প্রতিবার দেখা হলে ইমাদ তার কাছে একটা কোড জানতে চাইবে। কোডটা আসলে ইমাদের মোবাইল পাসওয়ার্ড। নিজের ধান্ধা করতে গিয়ে ইমাদ সব ভুলে বসে আছে। অতি লোভে অন্ধ ইমাদ নিজের সমস্ত কিছু বলে গেছে অকপটে এমনকি গালিও দিয়েচে সোহাকে। কি হবে এখন…?
ইমাদ বসে বসেই পিছু হটছে। ও… নো… এতো সোহা…! দ্রুত ভাবল ইমাদ। এমন দিন দুপুরে সোহা কি তার কোন ক্ষতি করতে পারবে? লানার ফোনটা টেবিলে বেজে উঠল এ সময়ে। সামান্য হোচট খেল সোহা। এই সুযোগে কোন রকম উঠে দৌড় দিল ইমাদ গেটের দিকে। সোহা তীব্র স্বরে চিৎকার করে ডাকল ইমাদকে। ইমাদ পড়িমরি করে কোনরকম বাইরে এসে গাড়িতে উঠল।

ইমাদ ভুল ড্রাইভ করছে। বেশ কয়েকবার অন্য গাড়িতে ঠুকে গেল তার গাড়ি। এদিক সেদিক করে কোন রকমে নিজের বাসায় ফিরল সে। দাঁড়োয়ানকে বলল। অপরিচিত কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়া হয়। প্রচণ্ড ভয় আর তাড়াহুড়োয় ভুলে গেল যে, লানা তার পরিচিতজনদেরই একজন।

বাড়িটাতে একা থাকে ইমাদ। তার পরিবার পরিজন থাকে অন্যত্র। ইমাদ এসে সারাদিন টেনশনে কাটাল বাড়িতে। নিজের ভুলের জন্য নিজেকে অভিসম্পাত করল। লানা একটা ভদ্রসভ্য মেয়ে, তাকে ব্ল্যাকমেল করে প্রপার্টিটা দখল করা যেত অনায়সে। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এরই মধ্যে ট্রান্সফর্ম হবে সোহা। কিন্তু আজ যে হারে সোহাকে ক্ষেপিয়েছে সে, তাতে সোহা কি তাকে ছেড়ে দেবে? সারাটা দিন বিক্ষিপ্ত কাটল ইমাদের।

সন্ধ্যা নাগাদ ইমাদের মাথা কাজ করতে শুরু করল। এক মগ ধোয়া ওড়া গরম কফির মগ হাতে এসে বসল রকিং চেয়ারটাতে। কয়েকটা অঙ্ক কষল সে। সে যদি এখন লানার নামে পুলিশ কমপ্লেইন করে যে, লানাই শাহেরকে খুন করেছে। তাহলে লানারূপি সোহা এ্যারেস্ট হবে। সোহা লকাপে থাকলে ইমাদ টেনশন ফ্রি থাকবে। কিন্তু তাতে একটা প্রবলেম আছে। লানা ফেঁসে যাবে। সেক্ষেত্রে লানার কাছে থেকে ইমাদের লাভের হিসেবটা আর থাকবে না। সে না থাকুক। আপাতত লানাকে না ফাঁসালে সোহার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না ইমাদ।

কফিটা ধীরে সুস্থে শেষ করে থানায় ফোনটা করবে ভাবছে ইমাদ। ঠিক তখনই কলিং বেল বাজল নিচে। কফিটা ছলকে পড়ল ইমাদের গায়ে।
ইমাদ উঠে গেল। কে আসতে পারে এ সময়ে? দাঁড়োয়ানকে তো বারণ করেছিল সে। ইমাদ নিচে নামল। দরজাটা লক করা ছিল কিনা মনে নেই ইমাদের। সে সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই দেখতে পারল, প্রধান দরজাটা খুলে ঢুকছে সোহা।
আতঙ্কিত ইমাদ। বলল
– লানা, তুমি এখানে? কিন্তু আমি জানি তুমি লানা নও….। তুমি তো সোহা….। তাহলে আমাকে কেন মারবে বল? আমিতো তোমার কোন ক্ষতি করিনি…..? আমার তো বোঝাপড়া ছিল লানার সাথে…. বিলিভ মি। আমি তোমার কোন বদনাম করিনি।

হাসছে সোহা। জোরে… ঘর ফাটিয়ে হাসছে। ইমাদ আতঙ্কে উপরে উঠে গেল। সোহা জোরে জোরে বলল
– কেন ভয় পাচ্ছ ইমাদ। আমি তো সোহা, তুমি জানো। আমিতো মারব লানাকে, তোমাকে নয়। তুমি তো আমার প্রেমিক। ওই যে সেবার সাজেকে, আমরা কত মজা করলাম। তুমি আমি….হা হা হা হা…

বিকট আওয়াজে হাসছে সোহা। ইমাদ উপরের কোন একটা ঘরে আত্মগোপন করেছে। সেখান থেকেই চিৎকার করল সে। বলল
– আমাকে মারলে তুমি ফেঁসে যাবে সোহা। পুলিশ তোমাকে ছেড়ে দেবে না। তাছাড়া তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। যা আছে সেটা লানার সাথে। তুমি আমাকে মারবে কেন? আমরা তো বন্ধু হতে পারি। আফটার অল আমাদের টার্গেট তো একজন, লানা…

সোহা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে ওপরে। তার হাত পিছনে, সেখানে লুকানো একটা ধারাল চাকু। মুখে বলল
– এগজ্যাক্টলি….। হাউ ক্যান আই হার্ম ইউ… ডার্লিং…? এসো… বেরিয়ে এসো। এসো আমরা সেই আগের মত বন্ধু হয়ে যাই। আজ সারারাত আমরা মজা করব। সেই আগের মত….

ইমাদের মনে হল, সে বোঝাতে পরেছে সোহাকে। তাইতো, এত সহজ যুক্তি কে না বুঝবে? তার অন্তরঙ্গতা হয়েছিল সোহার সাথে। লানার সাথে নয়। সোহা কেন তাকে মারবে?

– ইমাদ, মাই ডার্লিং… সুইটহার্ট…! এসো… বেরিয়ে এসো….
ভরসা পেল ইমাদ। তাছাড়া এমন মোহময় ডাকে সাড়া না দেওয়ার কোন কারণ নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মত বেরিয়ে এলো ইমাদ। সোহাও হাসল মোহময়। একটু একটু করে এগিয়ে গেল ইমাদের দিকে। কাছাকাছি হতেই সোহা জড়িয়ে ধরল ইমাদকে। গলে গেল ইমাদ। তীব্র ভয় পাল্টে গেল তীব্র আবেগে।
সোহা ইমাদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল। লানাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। ওর শরীরে এখন বিপদ আমার। ওর বাবাকে মারার আগে সমস্ত প্রপার্টি লানার নামে শিফট করে নিয়েছি। আসছে পঁচিশে সেপ্টেম্বর আমার আর লানার মাঝখানের সময়ের বেড়াজালটা ভেঙে এক হয়ে যাবে। আমি আমার বডিতে লানাকে শেষ করে লানার বডিতে পার্মানেন্ট হব। তারপর সমস্ত প্রপার্টি অন্যত্র ট্রান্সফার করে অন্য করো শরীরে পার্মানেন্ট হব। আর এর মধ্যে সেই ক্ষমতা চলে আসবে আমার হাতে। দুটো পিওর ব্লাড কানেশন স্যাক্রিফাইস করে আমি হয়ে উঠব অপ্রতিরোধ্য। জোহার আর মুন। মাই ফ্যামিলি হা হা হা হা হা…..

ইমাদকে জড়িয়ে ধরেই হাসছে সোহা। ইমাদ ভয়ার্ত। সে কি সব ঠিক শুনছে? একটা মানুষ, তাও আবার মেয়েমানুষ, এত নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর হতে পারে?

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইমাদের পাঁজরের নিচে ঢুকে গেল চাকুটা। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে ইমাদ শুনতে পেল একজন ক্রুর, নিষ্ঠুর মেয়োনুষের হাসি।
( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here