#চোরাবালি_২০
রেশমা আক্তার
লানা এখন বসে আছে ডাইনিং টেবিলে, রিজভি আহমেদের সামনে। লানা খাচ্ছে এবং মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে তার কথাগুলো।
ইতিমধ্যে সে রিজভিকে কয়েকবার বলেছে যে, সে আসলে লানা, সোহা নয়। রিজভি বিশ্বাস করেনি।
লানা খাবার শেষ করল। বড় পেন্ডুলামের ঘরিটার দিকে দেখল। লানার হাতে সময় আছে মাত্র দশ মিনিট। সে গলা পরিষ্কার করে বলল
– ড্যাড, আমার হাতে সময় খুব কম। আজকে তৃতীয়দিন, আমি তোমাকে একই কথাটা বলছি। জোহার আর মুনের সামনে বড় একটা বিপদ। আজ পিকনিকে গেলে ওদের একটা এক্সিডেন্ট হবে। আজ তিনদিন যাবৎ এই একই ঘটনা ফিরে ফিরে আসছে। আমরা সবাই একটা লুপে আটকে আছি। প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর…ড্যাড
রিজভির মনে হল এই একই কথা এর আগেও সে শুনেছে সোহার মুখে। তবু অবান্তর ভাবনা ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইল। বলল
– গল্পটা তোমার নতুন। ইন্টারেস্টিংও বটে। তবে তোমার এসব বাজে কথায় আমি মুনের আনন্দটা মাটি করতে পারব না।
লানা উঠে দাঁড়াল উত্তেজনায়, বলল
– পিকনিকের চাইতে মুনের বেঁচে থাকাটা বেশী জরুরী ড্যাড। কেন বুঝতে পারছ না, আজ ওদের গাড়িটা ব্লাস্ট হয়ে যাবে। মুন জোহার কেউ থাকবে না বেঁচে। ড্যাড, গত তিনদিন ধরে আমাদের সবার সাথে এই একই ঘটনা ঘটছে, এটা একটা লুপ। এটা ভাঙতে হবে, নইলে জোহার আর মুনকে বাঁচানোর সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর। তাছাড়া, আমি কেন শুধু শুধু বাঁধা দিব ওদেরকে। আমি সোহা নই। সোহার যদি মনে কোন খারাপ মতলব থাকবেই তাহলে ও কেন যেতে বাঁধা দেবে, একবার ভাবো…
রিজভিও উঠে দাঁড়াল। কাগজটা ভাজ করে রাখল টেবিলের অন্যদিকে। রাগত স্বরে বলল
– কারণ শুভ কিছু তোমার ভালো লাগেনা। সবকিছুতে একটা বাগড়া দেয়া তোমার স্বভাব। অন্ধকারই তোমার প্রিয় জায়গা। তাই এসব পিকনিক, শপিং, ঘোরাফেরা তোমার পছন্দ নয়। শোন সোহা, আজ কিছুতেই ওদেরকে বাঁধা দেবেনা তুমি। তোমরা পিকনিক থেকে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসো, কি বলতে চাও শুনব আমি।
রিজভি চলে যাচ্ছিলেন।
লানা ছুটে এসে দুহাত প্রসারিত করে বাঁধা দিল রিজভিকে।
– ড্যাড, লানা নামের একটি মেয়েকে তুমি চেন, মনে করে দেখ…
রিজভি মনে করার চেষ্টা করল। আসলে সে সোহার ওপর এতটাই বিরক্ত যে, কাউকে মনে করার অবস্থায় ছিল না। লানার একটা হাত সরিয়ে দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললেন
– এই নামে আমি কাউকে চিনি না।
চূড়ান্ত অসহায় বোধ করল লানা। সে ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় শেষ প্রায়। পিছনে হটতে হটতে সে কিছুটা জোরে জোরে বলতে লাগল,
– মনে কর ড্যাড, বাংলাদেশের একটা বিশাল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিকের একমাত্র মেয়ে লানা, কেন…. কিসের প্রয়োজনে একটা ব্যাংকরাপটেড কোম্পানি ‘ব্লু সি বিচ’ কিনে নিতে চেয়েছিল? কিসের স্বার্থে? কে সে, তার নাম কি?
থমকে দাঁড়িয়েছে রিজভি সিঁড়িতে।
লানা প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্বেও ঢুকে গেল নিজের ঘরে। পারল না সে রিজভিকে বোঝাতে।
জোহার আর মুন হাসছে। জোহার এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
– সারপ্রাইজ..! ড্যাডের তরফ থেকে এই গাড়িটা মুনের জন্য উপহার। মুন আজ এটাতে চড়ে পিকনিকে যাবে।
লানা গাঢ় চোখে তাকাল জোহারের দিকে। বলল
– জোহার, তোমার কি মনে পড়ে না যে, এই একই ঘটনা বারবার আমাদের সাথে ঘটছে?
জোহারের মুখটা গম্ভীর হল। সে চারিদিকে তাকিয়ে কিছু উপলব্ধি করতে চাইল। স্বন্দিহান গলায় বলল
– হ্যা মাঝেমাঝে আমার হয় এমন …। ডেজাভু…। মনে হয় একই ঘটনা এর আগেও ঘটেছিল।
লানা জোহারের হাত চেপে ধরল
– জোহার গত তিনদিন ধরে এই একই ঘটনা ঘটছে আমাদের সাথে। আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। একটা ভয়াঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটছে, আমাদের গাড়িটা বিস্ফোরিত হচ্ছে। তারপর আবার আমরা আজকের সকালে ফিরে আসছি….
জোহার হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হো হো করে হেসে ফেলল।
– সোহা, আমি জানি পিকনিকটিকনিকে যাওয়ার কোন ইচ্ছে তোমার নেই। তুমি আমার আর ড্যাডের জোড়াজুড়িতে যাচ্ছ। দেখ আর তো মাত্র দু’চারটা দিন। আমরা ফিরে যাব দেশে। সেখানে অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। প্লিজ আজকের দিনটা নষ্ট করনা।
– জোহার আমি কেন পিকনিক ক্যানসেল করতে চাচ্ছি তুমি একবারও বোঝার চেষ্টা করবে না?
জোহার থমথমে মুখে তাকাল গাড়িটার দিকে, তারপর হাত ধরল লানার, বলল
– ঠিক আছে, তুমি ভাবছ নতুন গাড়ি, আমি হ্যান্ডেল করতে পারব কিনা তাইতো? আচ্ছা বাদ দাও আমরা বরং অন্য একটা গাড়িতে যাব। তাহলে নিশ্চই তোমার দুর্ঘটনার ভয় থাকবে না?
জোহার লানাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল গ্যারেজে। জানতে চাইল, কোন গাড়িটায় যেতে চায় লানা?
লানার নিজের ওপর যেন কোন নিয়ন্ত্রনই নেই। হাত উঁচিয়ে দেখাল, কালো রঙের গাড়িটাকে। জোহার গিয়ে বসল গাড়িতে।
মুন বসেছে সামনে, জোহারের পাশে। লানা একাই পেছনে। গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ করে। মিউজিক সিস্টেমে বাজছে দারুন একটা লাউড টোন। জোহার মিউজিকের সাথে সাথে মাথা দোলাচ্ছে, গাইছেও সাথে মাঝেমাঝে। মুন খুব মজা পাচ্ছে। সেও চেষ্টা করছে বাবার সাথে। লানার বুকটা টিপটিপ করছে। সে শক্ত দু’হাতে আঁকড়ে আছে সিট। জোহারকে ডেকে বলল
– জোহার মিউজিক বন্ধ কর। আমার কিছু জরুরী কথা আছে তোমার সাথে।
লানার গলার স্বরে ছিল কিছু একটা। জোহার মিউজিক বন্ধ করল।
লানা বলল
– জোহার, একটু মনে করার চেষ্টা কর, তোমার কি মনে হচ্ছে না, ঠিক একই ঘটনা আমাদের সাথে বারবার ঘটছে?
– মানে?
– মানে আমরা একটা লুপে আটকে আছি। ঘুরেফিরে আমরা প্রতিদিন ঠিক এই গাড়িটাতেই পিকনিকে যাচ্ছি, একটু পরে একটা পাম্পে গাড়ি থামবে, তারপর তুমি আর মুন খেতে নামবে। ফিরে এসে গাড়ির স্পিড বাড়াবে। গাড়ি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পাথরে ধাক্কা খাবে। আমাদের এ্যাকসিডেন্ট হবে….
– এসব কি বকবক করছ সোহা? এসব আজগুবি কথাবার্তা আসে কোত্থেকে তোমার মাথায়? ঘরের মধ্যে থেকে থেকে তোমার মাথাটা গেছে। প্লিজ কোন নেগেটিভ কল্পনা কর না। পিকনিকে যাচ্ছ, টেনশন ফ্রি থাকো।
জোহার রাগত স্বরে কথাগুলো বলে মিউজিকটা আবার লাউড করে দিল এবং লানার কথাবার্তার প্রতিবাদ স্বরুপই হয়ত গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। লানা সিট আঁকড়ে আতঙ্কিত চোখে চেয়ে থাকল সামনে।
একটু পরে তারা পাম্পের কাছে এসে থামল। জোহার, মুনকে নিয়ে নেমে উঁকি দিল পেছনে। বলল
– তুমিও এসো আমাদের সাথে?
লানা না সূচক মাথা নাড়ল।
জোহার আর মুন চলে যাবার পরপরই সেই অদ্ভুত লোকটা এলো। লানা আজ গাড়ির কাঁচ নামায়নি। তবুও লোকটা জানালায় এসে হাত চাপড়ে গ্লাস নামাতে বলল। লানা বসে থাকল শক্ত হয়ে। লোকটা কি কি যেন বলছে। আর হাতে তুলে একটা রশিতে ঝোলানো কাপড়ের পুটলি দেখাচ্ছে। লানার অসহ্য লাগছে লোকটাকে। সে দু’হাতে কান চেপে, চোখ বন্ধ করে বসে থাকল। কিন্তু হঠাৎ তার মনে অন্য কিছু ঘটল। লোকটা তার কাছে খাবার কেনার টাকা চাচ্ছে এবং বিনিময়ে তাকে কিছু দিতে চাচ্ছে। কি সেই জিনিস? এটা অন্য কোন কিছুর ইঙ্গিত নয় তো?
লানা তড়িতে নিজের ব্যাগে হাত দিল। সেখানে ডলার, কয়েন যা ছিল একমুঠি বের করে জানালার কাঁচ নামাল
সুযোগ পেয়ে লোকটাও হাত ঢুকিয়ে দিল গাড়ির ভেতরে। তার হাতে সেই ময়লা, পুরনো কাপড়ের পুটলি। লানা খপ করে জিনিসটা নিয়ে নিল। তারপর একহাতে নিজের মুঠি আলগা করে দিল জানালার বাইরে।
লোকটা হাত টানতেই জানালার কাঁচ উঠে গেল উপরে।
লানা মুঠোয় পোড়া জিনিসটা দেখল। কালো রশিটা পেঁচিয়ে গেছে লানার কব্জিতে। কি আছে এই পুটলিতে?
এমন সময় জোহার এসে ঢুকল গাড়িতে। গাড়ি আবার স্টার্ট হল, মিউজিকও। লানা এবার জোর করে মুনকে নিজের পাশে বসিয়েছে। জোহার খাবার এগিয়ে দিল। লানা দ্রুত নিজের খাওয়া শেষ করল। মিনিট বিশেকের মধ্যে তারা সেই জঙ্গলের পথটায় চলে এলো।
লানা এসময় একটা অদ্ভুত কাজ করল। মুনের সিটবেল্ট খুলে নিজের হাতের সাথে একটা কাপড় দিয়ে মুনের হাতটা বাঁধল। মুন খুব বিরক্ত। সে বাঁধা হাতে থাকতে চায় না। সে তার ড্যাডকে নালিশ জানাল। জোহার বলল
– এসব কি করছ সোহা বলত? তোমার সবকিছু অদ্ভুত।
জোহার বুঝল, সোহার পাগলামীতে বাঁধা দিয়ে লাভ নেই। শুনবে না ও। সে মুনকে চিয়ার আপ করতেই মিউজিক বাড়িয়ে দিল আর গাড়ির স্পিডও। কারণ জোরে গাড়ি চালালে মুন খুব খুশি হয়।
লানা আতঙ্কিত। বলল
– জোহার স্পিড কমাও, আমার ভয় লাগছে। এ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে কিন্তু
– আরে, সোহা পিকনিকে এসে একটু লং ড্রাইভের থ্রিল নিতে দাও। তুমি বরং চোখ বন্ধ করে বসে থাক।
লানা সত্যিই মুনের হাতটা শক্ত করে, চেপে ধরে নিজের চোখ বন্ধ করল। সে জানে এরপর খুব দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটবে। একটা বন্য হরিণ গাড়িচাপা পড়বে। জোহার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারাবে আর তারপর সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। লানা কোন কথা বলছে না। গাড়িটা হঠাৎ কিছু টপকাল, আর তারপর বাঁক খেয়ে ঘুরে সোজা হল। চোখ খুলে লানা এখন অপেক্ষা করছে সুযোগের। মুনকে নিয়ে লাফিয়ে পড়তে হবে।
জোহার চিৎকার করে বলল
– সোহা, আমি গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। স্পিড কমছে না কেন?
লানাও চিৎকার করল। বলল
– এসব ঘটবে আমি তোমাকে আগেই সতর্ক করেছিলাম জোহার।
– কিন্তু তুমি আগে থেকে কী করে জানলে এসব?
– এই ঘটনা আমাদের সাথে আজ নিয়ে তৃতীয়বার ঘটছে জোহার…
জোহার সামনের বাক থামাতে থামাতে বলল
– কিছুটা ঝাপসা মনে আসছে যেন সোহা। এসব কি হচ্ছে? গাড়িটা কি ব্লাস্ট হতে যাচ্ছে? ও মাই গড….!
লানা দেখতে পাচ্ছে সামনে, দূরে সেই বিশাল পাথরটা। গাড়িটা হয় পাথরে ধাক্কা খাবে, নয় পাশে পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো পথে নেমে গিয়ে উল্টে যাবে।
– জোহার আমি মুনকে নিয়ে লাফ দিচ্ছি। বিদায় জোহার….
কথা শেষ করার আগেই লানা লাল রঙের গাড়িটাকে পাশ কাটাতে দেখল। উপরে উন্মুক্ত গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন রিজভি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর ক্ষিপ্র গতিতে জোহারের গাড়িটায় ধাক্কা দিয়ে ঘুরিয়ে দিল রিজভি। সামনে পাথরটার কাছাকাছি হয়েও রিজভির গাড়ির ধাক্কায় বাঁক নিয়ে পাশের একটা পাথরে প্রচন্ড ধাক্কা খেল গাড়িটা।
জোহারদের গাড়িটা উল্টে গেছে। লানার বুকের মধ্যে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে মুনকে। গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আছে তারা। মুনের কোন সাড়া নেই। চোখ খুলে কেবল নিজের শরীরের তীব্র যন্ত্রণাটাই টের পেল লানা। জোহার, জোহার কোথায়? ও ঠিক আছে তো? ড্যাড…? ড্যাড কি আছে আসেপাশে? তাহলে নিশ্চই তিনি বসে নেই, নিশ্চই বের করার ব্যবস্থা করবেন তাদের।
দূরে পুলিশ কারের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। আতঙ্কিত লানার চোখদুটি। গাড়িটা তার আগেই ব্লাস্ট হবে নাতো? সে চিৎকার করতে চাইল, পারল না। সব কি আগের মতই ঘটবে? না, তা কি করে হয়? সে তো পেরেছে লুপটা ভাঙতে।
ড্যাডের গলা শোনা যাচ্ছে। ড্যাড নাম ধরে ধরে ডাকছেন তাদের। কিন্তু সাড়া দিতে পারছে না লানা। কেমন নিস্তেজ, অন্ধকার হয়ে আসছে তার চারিদিক।
লানার জ্ঞান ফিরেছিল হাসপাতালের কেবিনে। খুব বেশী আহত ছিলনা সে। সামান্য কাটাছেড়া, মুনেরও তাই। তবে মাথায় আঘাত পেয়েছে জোহার। তার জ্ঞান ফিরতে সময় লেগেছে দু’দিন।
রিজভিকে অনেক জরিমানা গুনতে হয়েছে এ্যাক্সিডেন্ডের জন্য। তবু জোহারকে বাঁচানো গেছে এ এক মস্ত পাওয়া।
জোহার আজ সকালে উঠে বসেছে। তার চোখদুটি এখন বন্ধ। অদূরে একটা চেয়ারে বসে আছে রিজভি। বেডে আধশোয়া জোহার। তার পাশেই একটা চেয়ারে মুনকে কোলে নিয়ে বসে আছে লানা। জ্ঞান ফেরার পর থেকে মুন তার মমের কোল থেকে নামছে না। গলা জড়িয়ে থাকছে সারাক্ষণ। এখন মুন ঘুমাচ্ছে লানার কোলে।
লানার কব্জিতে সেই কালো সুতা জড়ানো ময়লা কাপড়ের ছোট্ট পুটলিটা এখনও পেঁচানো। কেন যেন খুলতে সায় দেয়নি মন। রিজভি তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে লানার দিকে। তার এই জীবনে বহু অদ্ভূত ঘটনা ও বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে সে। কিন্তু এমন একটা বিষয় যে চাক্ষুষ সে সামনাসামনি দেখবে স্বপ্নেও ভাবেনি।
সোহা যে আসলে এই মুহূর্তে ঠিক সোহা নয় ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে তার। ভাগ্যিস সেদিন ওরা পিকনিকে বেড়িয়ে যাবার পর সোহার বলে যাওয়া কথাগুলো ফিরে ফিরে বাজছিল কানে। কিছুটা খটকা লেগেছিল তার মনেও। তারপর ল্যাপটপ খুলে লানার ব্যাপারে খোঁজ খবর করতেই বেড়িয়ে এসেছিল অনেক তথ্য। সবচেয়ে বেশি চমকে গিয়েছিল সে, তার প্রিয় বন্ধু, ডক্টর পার্থর একটা পারসনাল মেসেজ সিন করে।
ডক্টর পার্থর মেসেজে লানার ব্যাপারে বলা আছে অনেক কিছু। মৃত্যুর আগে ডক্টর পার্থ লানার অস্তিত্বের ব্যাপারে জানিয়ে গেছেন রিজভিকে। মেসেজের সারমর্ম ছিল এটাই যে, যদি কখনও লানা নামের কেউ তার কাছে এসে সাহায্য চায়, তাহলে রিজভি যেন তাকে বিশ্বাস করে। এ যাবৎ সোহার সমস্ত কর্মকান্ড একটার পর একটা জানিয়েছে পার্থ, রিজভিকে। তার নিজের জীবনও যে সংকটাপন্ন তাও জানিয়েছিল। কিন্তু আজ মুন আর জোহারও বিপদাপন্ন। এমতাবস্থায় রিজভিকে দু’টোর যেকোন একটা অপশন বেছে নিতে হবে। হয় সোহা, নয় মুন আর জোহার। সোহাকে আড়াল করার আর কোন উপায় নেই। সোহা এখন বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। সোহার ধ্বংস তাই অনিবার্য। রিজভি যেন লানা নামের মেয়েটিকে সাহায্য করে। যে কিনা আসতে পারে সোহার রূপ ধরেই, সোহার শরীরে, যে কেন দিন। ”
এই মেসেজ দেখে রিজভি আর এক মুহূর্তও দেরী করেনি সেদিন। সামনে যে গাড়িটি ছিল সেটা নিয়েই ছুটে গেছে এক্সিডেন্ট স্পটে। আর সেখানে গিয়ে লানার সত্যতারও প্রমান পেয়ে গেছে সে।
আজ হাসপাতালে বসে জোহারকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা হয়েছে। কিছুটা বলেছে লানা নিজে, কিছুটা রিজভি। জোহার লানাকে বিশ্বাস করত কিনা স্বন্দেহ আছে তবে রিজভি কি নিজের মেয়ে সম্বন্ধে মিথ্যে বলবে? মেলাতে পারেনি জোহার। তবে চোখ বন্ধ করে হিসেব কষতেই মিলে গিয়েছিল অনেক কিছু।
সোহাকে অল্প বয়সে একা, একজন জ্ঞাতী বোনের অধীনে রেখে রিজভির আমেরিকায় ফিরে আসা, সোহার বহুরূপী আচরণ, বাংলোয় একটার পর একটা রহস্যময় মৃত্যু, ডক্টর পার্থর সবসময় সোহাকে সমর্থনে প্রবৃত্তি, তাছাড়া এই যে এতবড় প্রপার্টি এবং ‘ ব্লু সি বিচ’ এক নিমিষেই জোহারের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে আসা। আবার ‘ ব্লু সি বিচের’ ভরাডুবিতেও রিজভির নিরুদ্বেগ, নিস্পৃহতা, সবকিছু অস্বাভাবিক লেগেছিল বৈকি। রিজভি চায়নি সোহাকে নিয়ে ইউ এস এ তে আসুক জোহার। একমাত্র মেয়ে হওয়া সত্বেও তার থেকে সবসময় দূরে থাকার প্রবনতাই দেখেছে জোহার সবসময়।
আর এই যে সোহা বসে আছে তার মেয়েকে বুকে নিয়ে রাতদিন। একেও অচেনা লাগছে জোহারের। আজ এক নিমিষেই বাংলোতে লানার, সোহা হয়ে আবির্ভাবের প্রতিটা দিন আলাদা করতে পারছে জোহার। মনে পড়ছে কতটা আলাদা অনুভূতি ছিল লানার সাথে দেখা হওয়ার, কথা হওয়ার এমনকি লানাকে স্পর্শের।
জোহার ভাবছে, কেবলই ভাবছে।
রিজভি বলল
– তোমরা আর এখানে দেরী কর না জোহার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যাও।
জোহার চোখ খুলল
– কিন্তু ড্যাড, সোহা যদি আবার এসে মুনের ক্ষতি করতে চায়? আমি ওকে কীভাবে চিনব? কীভাবে বাঁধা দেব? কী করে রক্ষা করব মুনকে? আমার মাথা কাজ করছে না। আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না, এতগুলো বছর আমি যার সাথে কাটালাম, যে আমার সন্তানদের মা, সেই আমাদের শেষ করে দিতে চায়? সোহাই আমার পিহুর খুনী? সোহা আসলে কি?….
তীব্র ঘৃণা আর রাগে বিকৃত হল জোহারের মুখ।
জোহার আবার বলল
– ড্যাড, সোহা তো যেকোন মুহূর্তে চেঞ্জ হয়ে আসতে পারে। আমি কীভাবে আইডেন্টিফাই করব, কে সোহা আর কে লানা?
রিজভি চিন্তিত হল। বলল
– তোমাকে খুব সাবধান হতে হবে রিজভি। তোমার যেকোন দুর্বলতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। সোহা যদি আর একবার ইউ এস এ তে আসার সুযোগ পায় তাহলে আমাকে আর তোমার মমকে শেষ করে দেবে। আমি এ শহর ছেড়ে দু’ একদিনের মধ্যেই অন্যত্র চলে যাচ্ছি।
লানা চিন্তিত স্বরে বলল
– কিন্তু ড্যাড, আমাকে তো যেতে হবে। তাছাড়া ওদিকে সোহা যে কি তান্ডব চালাচ্ছে কে জানে? অলরেডি ও আমার খুব কাছের একজন বন্ধুকে মেরে ফেলেছে। আমার পরিবারের পরিচিতি, আমার পরিচিতি ব্যবহার করে ও কার যে কি সর্বনাশ করছে কে জানে।
– বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাদের এই ট্রান্সফরমেশনটা তো তোমাদের ইচ্ছেতে সম্ভব নয়…
লানা নিজের কব্জির সুতোটার দিকে তাকাল, বলল
– আগে আমাদের ইচ্ছেতে ছিল না ড্যাড, কিন্তু আমার মনে হয় এখন সেটার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে।
– কীভাবে?
লানা অবাক চোখে নিজের হাতটা দেখতে দেখতে বলল
– ড্যাড, আই’ম নট শিওর, বাট আই গেজ, দিস থ্রিড মে বি দ্য রিজন
রিজভি আর জোহার একই সাথে তাকিয়ে আছে লানার হাতের সুতোয় বাঁধা পুটলিটার দিকে।
রিজভি জানতে চাইল
– কি আছে ওটাতে? কোথায় পেলে?
লানা মুনকে জোহারের পাশে শুইয়ে দিয়ে নিজের হাত থেকে খুলে নিল সুতোটা। আস্তে আস্তে সুতো বাঁধা পুটলিটা খুলে ফেলল। খুব অস্বাভাবিক হলেও সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো একটা কয়েন সদৃশ্য ধাতব বস্তু। লানা উল্টেপাল্টে দেখে অবাক হল। খুব অস্পষ্ট হলেও কয়েনের একপিঠে একটা সর্পাকৃতির ট্যাটু আঁকা দেখতে পেল। এমনি একটা ট্যাটু ঢাকায় লানার কাছেও আছে। তবে সেটা একটা ছবি। নীলকুঞ্জ থেকে চুরি করেছিল সে আর ইমাদ। এই ট্যাটুটা কি কোনক্রমে সোহার সাথে রিলেটেড?
জোহার ধীরে ধীরে উঠে এলো দেখার জন্য।
লানা কয়েনটা রিজভির হাতে দিল। রিজভি হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে কয়েনটা, ঠিক তখনই একটা ঝাঁকুনি খেল লানা। বিস্মিত জোহার আর রিজভি। লানা কেমন নেতিয়ে পড়ছে। জোহার ধরে ফেলল লানাকে। লানার চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে যেন
দ্রুত সিধ্বান্ত নিল রিজভি। সে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। জোহারকে বলল ধরে থাকতে লানাকে। রিজভি কি মনে করে, কয়েনটা লানার হাতের মুঠোয় দিয়ে চেপে ধরল হাত। কয়েকবার ঝাঁকুনি খেয়ে আবার চোখ খুলল লানা। সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে।
লানা ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল
– ড্যাড, কি হচ্ছে এসব?
রিজভি একগ্লাস পানি এনে ধরল লানার মুখে। লানা ঢকঢক করে পানিটা শেষ করল। রিজভি বলল
– এটা তুমি পেলে কোথায়?
– সেদিন এ্যাকসিডেন্টের দিন পাম্পের ওখানে একটা লোক জোর করে এটা দিয়েছিল আমাকে। বদলে ডলার চাইছিল। ভিখিরি টাইপ অথবা পাগল….
রিজভির কপালে ভাজ পড়ল। বলল
– অদ্ভূত! কোন না কোনভাবে নিশ্চই এটা সোহার সাথে সম্পর্কিত। তুমি এটা হাতছাড়া কোরনা। লানা মাই চাইল্ড, আমাকে যখন ড্যাড বলে ডেকেছ, মুনকে বুকে টেনে নিয়েছ। তুমি এ সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন কর না। নিজের মা তার সন্তানের জন্য প্রাণঘাতী হয়েছে। হতভাগ্য মুন। মুনকে তুমি রক্ষা কর। তার জন্য তোমাকে যদি কোন বড় ও জটিল সিধ্বান্ত নিতে হয়, নিবে। আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে তোমার সাথে।
( চলবে)