চোরাবালি পর্ব ১৮

0
165

#চোরাবালি_১৮
রেশমা আক্তার

নতুন জায়গায় লানার ধাতস্থ হতে সময় লাগল কিছুক্ষণ। ঘড়িতে বাজে সাড়ে দশটা। তার মানে সে কেবল ঘুম থেকে জেগে উঠল। কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, সে এখন ইউ এস এ তে। ঘর থেকে বের হয়ে কি দেখতে পাবে, কাদের সাথে দেখা হবে জানেনা সে। এখানে কি মুন আর জোহার আছে? ওরা কি এখানে বেঁচে আছে? লানা কি পেছনে, ঠিক সময় মত এসে পৌঁছতে পেরেছে?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই লানা বিছানা থেকে নিচে নামল। ঠিক এমন সময়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জোহার। বলল
– তুমি উঠে গেছ? বেশ, শোন আমি মুনকে নিয়ে একটু শপিং এ যাচ্ছি, কাছেই। দু’একটা দরকারি জিনিস আনতে হবে। গতকালকের প্ল্যান মনে আছে তো?

লানা মনে হল জোহারের কোন কথা শুনতে পায়নি। তার চোখদুটো চিকচিক করছে। সে আচমকা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল জোহারকে। চোখ বন্ধ করে বলল
– তুমি ঠিক আছ জোহার? মুন, মুন ঠিক আছে?

জোহার বিস্মিত, বলল
– হঠাৎ আমাদের আবার কি হবে? কি হল তোমার বলতো? কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছ বুঝি?

লানা আরও শক্ত ও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকল জোহারকে। কোন কথা বলতে পারল না সে। জোহারও এবার একান্তে জড়িয়ে নিল লানাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেল চুলে। বলল

– হঠাৎ হঠাৎ তোমার যে কি হয় সোহা, একদম চিনতে পারি না। এ যেন অন্য কেউ। যে আমাকে, মুনকে তীব্রভাবে চায়, ভালোবাসে। আসলে সারাক্ষণ তোমার বিরক্তি, অবজ্ঞা আর নিতে পারছিলাম না। কেন অমন কর বলতো?

লানা ছেড়ে দিল জোহারকে। জোহার হাসল। নিজেও আলগা হয়ে দাঁড়াল। বলল
– মুন অপেক্ষা করছে গাড়িতে। আমি যাব আর আসব। তুমি এদিকটা গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে থেক। তোমার হাতে মাত্র দু’ঘন্টা। সব রেডি আছে। আমি এসে শুধু তুলে নেব তোমাকে।

লানা কৌতূহলী কন্ঠে বলল
– কোথায় যাচ্ছি আমরা?
অবাক গলায় জোহার বলল
– কেন, কালকের প্ল্যান ভূলে গেলে? আজ আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। এখান থেকে ঘন্টা দুই ড্রাইভ করলে দারুন একটা সাইট আছে। আমি, তুমি আর মুন যাচ্ছি। মুন তো খুব এক্সাইটেড। পিকনিকের জিনিসপত্র কিনতেই আমরা বের হচ্ছি। তুমি আর দেরী কর না। নইলে ফিরতে কিন্তু রাত হয়ে যাবে।

জোহার তার ওভারকোট টা গায়ে জড়িয়ে নিল। যাবার সময় আচমকা লানেকে টেনে নিয়ে চুমু খেল ঠোঁটে । শিহরিত হল লানা। কিন্তু মনে আরও একটা অনুভূতি কাজ করল, ভয়। কি হতে যাচ্ছে আজ, কে জানে?

জোহার আর দাঁড়াল না। লানাকে কিছু বলার সুয়োগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে। লানা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। সম্বতি ফিরলে গিয়ে বসল বিছানায়। ভাবল কিছুক্ষণ, তার পর ওয়াশরুমে একটু ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলো ঘর থেকে।

জোহার চলে গেছে। লানা বের হয়ে এলো একটা বড় ড্রয়িংকাম ডাইনিং স্পেসে। একপাশ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। চমৎকার, অভিজাত জিনিসপত্রে সজ্জিত একটা বাড়ি। লানা হাঁটতে হাঁটতে সামনে চলে এল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সে দেখছে চারদিকে। একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বসে আছেন ডাইনিং টেবিলে। তার সামনে ধোয়া ওড়া কফির কাপ। হাতে নিউজপেপার। তিনি কাপ তুলে ছোট একটা চুমুক দিয়ে রাখলেন। দেয়ালে বিশাল পেন্ডুলামের একটা দেয়াল ঘড়ি। এখন বাজে পৌনে এগারোটা।
স্টেরিওতে একটা চমৎকার সুর বাজছে। মনে হল খুব পরিচিত। কিন্তু লানা ঠিক মনে করতে পারল না।
একজন ইউনিফর্ম পরা লোক একটা প্লেট এনে রাখল টেবিলে। লানার দিকে এসে নরম স্বরে বলল
– গুড মর্নিং ম্যাম
লানা সন্মতিসূচক মাথা নাড়ল। লোকটা চলে গেল ভেতরের দিকে। লানাকে কি নাশতা দেয়া হল? সে কী গিয়ে বসবে টেবিলে? আর এই যে ভদ্রলোক, উনি কে? উনিই কী তবে রিজভি আহমেদ, সোহার বাবা?
লানা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। রিজভি চোখ তুলে বললেন
– গুড মর্নিং
লানাও বলল
– মর্নিং
লানা,সাহস পেল কিছুটা। সে টেবিলে রাখা প্লেটের কাছে চেয়ার টেনে বসল।

প্রচন্ড ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। আগে কিছু খেতে হবে তাকে
প্লেট থেকে খাবার তুলে মুখে দিল সে। রিজভি গভীর মনোযোগী নিউজপেপারে। স্টেরিওতে এখন গান বাজছে, রবীন্দ্রসংগীত। রিজভি বাংলা গান শোনেন? লানা অবাক চোখে তাকাল রিজভির দিকে। রিজভির পুরো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। লানা গলা পরিষ্কার করল। তাতেও ধানভঙ্গ হল না রিজভির।

লানার মনে পড়ল, সে এখানে এসেছে অল্প সময়ের জন্য। এটা একটা সুযোগ। প্রতিটা মুহূর্ত তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সময় নষ্ট কারা যাবে না। লানা এবার জোরে গলা পরিস্কার করল। বলল
– আঙ্কেল, আপনার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে

রিজভি পেপার নামিয়ে কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে। লানা সেটা অগ্রাহ্য করে বলল
– আঙ্কেল, আপনার হয়ত অবিশ্বাস্য লাগবে। কিন্তু আমি এখন যেটা বলব সেটা একদম সত্য একটা ঘটনা।
রিজভির চোখে কৌতূহল। লানা বলল

– আঙ্কেল, আমি কিন্তু সোহা নই। আমার নাম লানা। আমি এসেছি কিছুটা এ্যাডভান্স সময় থেকে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। একদিন সকালে হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম, আমি আর আমার শরীরে নেই, আমি জেগে উঠেছি সোহা নামের অন্য একটি মেয়ের শরীরে। ঠিক একইভাবে সোহা জেগে উঠেছে আমার শরীরে। আমি বাংলাদেশে, ঢাকায় থাকি। কিন্তু এরপর আমি প্রায়ই হঠাৎ হঠাৎ সোহার বডিতে জেগে উঠতে শুরু করলাম। এভাবেই বেশ কয়েকবার চলল আমাদের আসা যাওয়া। আঙ্কেল আমি যা বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন?

রিজভির চোখে হতাশা দেখা গেল। বললেন
– সোহা, প্লিজ তুমি নতুন করে কোন নাটক তৈরি কর না। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে সারাক্ষণ যা হচ্ছে। এর চাইতে বেশী কিছু আর নিতে পারব না।

– আঙ্কেল প্লিজ বিলিভ মি। আমি লানা। আমি বাংলাদেশে ‘হায়দার গ্রুপ অফ ইন্ডাষ্ট্রিজ’ এর মালিকের একমাত্র মেয়ে। আমি যা বললাম সব সত্যি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি সোহা সম্বন্ধে সব জানি। সোহা যে একের পর এক অপকর্মে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে তাও জানি। ও নিজের বলতে আর কাউকে রাখবে না। মুন, জোহার, আপনি, আপনার স্ত্রী এমনকি আমি, কেউ বাদ পড়বে না। সবাইকে শেষ করবে ও। প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করুন

– বিশ্বাস করলাম। তারপর কি? কি চাও তুমি আর? তোমাকে তো আমি সব দিয়েছি। আর কি এমন আছে যার জন্য তোমাকে এসব ছলনা বা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে?

– আঙ্কেল আমি মিথ্যা বলছি না। আমি আপনাকে কিভাবে বোঝাব জানি না। তবে আপনি আমার ওপর একটু বিশ্বাস রাখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।

– এ গল্পটা তোমার নতুন। ইন্টারেস্টিংও বটে। বাই দ্য ওয়ে, তোমাদের না আজ কোথায় যাবার কথা? জোহার ফিরে আসল বলে। তুমি বরং তৈরি হয়ে নাও।
লানা নিরুপায় বোধ করল। ঘোর লাগা গলায় বলল
– সোহা, মুন আর জোহারকে মেরে ফেলবে আঙ্কেল, প্লিজ আপনি সোহাকে থামান। কেবল আপনিই পারেন ওকে থামাতে

রিজভি গম্ভীর মুখে নিউজ পেপারটা ভাজ করে রাখলেন। সোহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বললেন

– সেই তখন থেকে কি আঙ্কেল আঙ্কেল করে যাচ্ছ? আবার নতুন করে কি মতলব আঁটছ বল তো? জোহার তোমার রক্ষা কবচ। এমন একটা মানুষ সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাবে না তুমি। ওর কোন ক্ষতি করলে তোমার পায়ের তলায় আর মাটি পাবে না সোহা। আর মুন? সে তোমার সন্তান। একটা বাচ্চা হারিয়েছ তুমি। আমি সতর্ক করছি তোমায়, যদি মুনের কিছু হয় তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেব না সোহা…

লানা কিছুক্ষন তাকিয়ে বলল

– এগজ্যাক্টলি আঙ্কেল। আমিওতো সেটা বলতে চাচ্ছি। সোহা এখন মুন আর জোহারকে শেষ করবে। আজ, আজই হয়ত সেই ভয়ঙ্কর এক্সিডেন্টটা ঘটতে চলেছে। আপনি জোহারকে থামান। নইলে সোহা কি যে করবে….

রিজভি রাগত মুখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন
– এসব বাজে চিন্তা যেন আর তোমার মাথায় না আসে সোহা। আমি অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েছি, অনেক যন্ত্রণা সয়েছি, অনেক প্রিয়জন হারিয়েছি। আজও শুধু আটকে আছি তোমার ড্যাডি ডাকটার মায়াজালে। নিজের ভালো চাইলে বাজে চিন্তা ছাড়ো। নিজের পরিবার নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা কর। মুন পিকনিকে যাবে বলে খুশিতে লাফাচ্ছে। আর তুমি এই সকালবেলা কি শুরু করলে?

রিজভি আর থামলেন না। গটগট করে ওপরে উঠতে লাগলেন। লানার বুঝতে সময় লাগল। সে দিশেহারা গলায় জোরে জোরে বলল
– আঙ্কেল প্লিজ যাবেন না। আমার কথাটা বিশ্বাস করুন। একটু শুনুন, আপনার সাথে আমার আরও কথা বলার আছে…

রিজভি চোখের আড়ালে চলে গেলেন, তাকালেন না বা ফিরলেন না আর।
লানা ঠিক করল, সে কিছুতেই আজ এই পিকনিকে যাবে না। কি জানি হয়ত আজই ঘটতে চলেছে সেই দুর্ঘটনা।

লানা নিজের ঘরে ফিরল। সোহার ওয়ারড্রব হাতড়ে কাপড় নিল, চেঞ্জ হল। তৈরি হয়ে নিল। মনে হল এসব কেউ তাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। কারণ সে পিকনিকে যেতে চায় না। একজন উর্দি পরা লোক এসে জানিয়ে গেল, নিচে গাড়িতে সব জিনিস তুলে দেয়া হয়েছে, জোহারও চলে এসেছে। লানাকে ডাকাছে ওরা।

লানা মনে মনে দ্রুত ভেবে নিল। সে জোহারকে ব্যাপারটা কীভাবে বুঝিয়ে বলবে। বিশ্বাস না করলেও, এ্যাক্সিডেন্টের ভয় দেখালে একটু হলেও বাঁধা তো আসবে।
বাইরে এসে দেখল দু’তিনজন উর্দি পরিহিত নারী পুরুষ হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রিজভি কে দেখা গেল না। সে কি আসবে না তাদের বিদায় দিতে?

একটা ঝা চকচকে নতুন গাড়ি সামনে দাঁড়িয়ে। উপরটা খোলা। মুন বসে আছে পেছনে। জোহার সামনে। দুজনেই হাসছে। জোহারকে খুব সুন্দর লাগছে। চোখের সানগ্লাস খুলে এসে সামনে দাঁড়াল জোহার, বলল

– সারপ্রাইজ..! ড্যাডের তরফ থেকে এই গাড়িটা মুনের জন্য উপহার। মুন আজ এটাতে চড়ে পিকনিকে যাবে।
লানা স্বন্দিহান চোখে গাড়িটা দেখল। তার কেমন জানি সবকিছুতে মনটা কু গাইছে। আজ সকালে এসে হঠাৎ পিকনিকের আয়োজন, নতুন গাড়িতে লং ড্রাইভ, এসব কিছুই কী সেই ভয়ঙ্কর রোড এক্সিডেন্টের আলামত? লানা

হঠাৎ জোহারের হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল
-জোহার, এই গাড়িটাতে আজ যাচ্ছি না আমরা

– মানে?
– মানে, এ গাড়িটা একদম নতুন, তুমিও এখানকার রাস্তাঘাটে নতুন। সো, আমি ভরসা পাচ্ছি না।
– কি তখন থেকে নতুন নতুন করছ সোহা। ভুলে গেলে, তোমাকে দেশে একা রেখে আমাকে কতবার আসতে হয়েছে ইউ এস এ তে? আমি কি আজ নতুন ড্রাইভ করছি? তবে তোমার ভয় পাওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। ভয় নেই, আমি আস্তে চালাব।

জোহার, লানার হাত ধরে টানলো কিন্তু লানা নড়ল না। বাঁধা পেয়ে জোহার আবারও ফিরে তাকাল। সোহার মুখটা থমথম করছে। সোহার মুডকে খুব ভয় পায় জোহার। মুন আর সোহাকে নিয়ে সুন্দর আনন্দঘন মুহূর্তগুলি জোহারের জীবনে খুব অল্প। আজ বহুদিন পর এখানে এসে একটু গতানুগতিক জীবনের বাইরে নতুন স্বাদ পাচ্ছে জোহার, তাও রিজভির কল্যাণে। মুনকে উপলক্ষ করে প্রায় প্রতিদিনই রিজভির কোন না কোন প্ল্যান থাকে। সোহা যদিও একা একা থাকতে পছন্দ করে, কিন্তু রিজভির কঠিন শাসনের মুখে কেমন কুকড়ে যায় সোহা। বাধ্য হয় তাদেরকে সঙ্গ দিতে।

আজ সকালটা জোহারের জন্য একটা নতুন পুলক নিয়ে শুরু হয়েছে। আজ সকালে সোহাকে জড়িয়ে ধরে থাকা কয়েকটা মুহূর্ত, সোহার ঠোঁটে অল্প সময়ের সেই মাদকতা জোহারের মনে নতুন করে ভালোবাসার প্লাবন বয়ে এনেছে। হৃদয়ের নরম পলিতে আবারও জন্মাতে শুরু করেছে বিশ্বাস আর ভরসার দূর্বাঘাস।
জোহার জানেনা এর স্থায়িত্ব কতটুকু। তবু আজ তার মনে হচ্ছে, আজ যা হবে খুব ভালো হবে।

জোহার কাতর স্বরে বলল
– সোহা প্লিজ আজ এমন কিছু করনা যাতে পিকনিকটা ক্যানসেল হয়ে যায়। মুন খুব কষ্ট পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, ড্যাড ভয়ঙ্কর রেগে যাবেন।
লানার মুখটা নরম হল। বলল
– জোহার, জোহার আমার মনে হচ্ছে আজ খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।
– কিচ্ছু খারাপ ঘটবে না সোহা। ওসব তোমার মনের ভয়। তুমি সারক্ষণ ঘরের কোণে থাক বলে বের হতে ভয় পাও। চল তো…

জোহার হাত ধরে টানলো আবার। নিচে নেমে এলো লানা। লানার মনে হল, সে কিছুতেই পারবে না এ যাত্রাটা বয়কট করতে। ভবিতব্যকে থামানোর কোন ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। কিন্তু এই যে লানা এখানে এলো, জোহার আর মুনের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে, নিশ্চই কোন সুযোগ সে পাবে। এ পিকনিক ক্যানসেল না হলেও এ্যাকসিডেন্ট তো থামানো যেতে পারে। লানা এবার দৃঢ় গলায় বলল
– ঠিক আছে, পিকনিকে আমি যাচ্ছি…

জোহার আর মুন হইহই করে উঠল
পরমুহূর্তেই লানা বলল
– কিন্তু এক শর্তে। এই নতুন গাড়িটাতে যাচ্ছি না আমরা
– মানে?
– আমার ভয় লাগছে জোহার। প্লিজ তুমি অন্য গাড়ি নাও। যেটা তুমি এখানে ড্রাইভ করতে অভ্যস্ত। প্লিজ এটাতে যেও না।

জোহার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হতাশ মুখে। তারপর বলল ঠিক আছে চল। তুমি বল কোনটাতে যাবে।

লানাকে নিয়ে জোহার গ্যারেজে এলো। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তিনটা গাড়ি। লানার চোখ আটকে গেল কালো একটা গাড়িতে। কোন কিছু না ভেবেই সে আঙুলিনির্দেশ করল কালো গাড়িটার দিকে। জোহার এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

মুন বসেছে সামনে জোহারের পাশে। লানা একাই পেছনে। গাড়ি চলছে শাঁ শাঁ করে। মুন নিজের মনে বকবক করছে। মিউজিক সিস্টেমে বাজছে দারুন একটা লাউড টোন। জোহার মিউজিকের সাথে মাথা দোলাচ্ছে, গাইছেও সাথে মাঝেমাঝে। মুন খুব মজা পাচ্ছে। সেও চেষ্টা করছে বাবার সাথে। লানার বুকটা টিপটিপ করছে। সে শক্ত দু’হাতে আঁকড়ে আছে সিট। মাঝেমাঝে সাবধান করছে জোহারকে।

গাড়িটা অনেক্ষণ পর লোকালয়ে ছেড়ে, খোলা প্রান্তরে ছুটছে। একটু পর তাদের গাড়িটা একটা পাম্পে এসে দাঁড়াল। জোহার মুনকে বলল
– আইসক্রিম…?
মুন উল্লাসে চিৎকার করে উঠল।
তারা গাড়ি থেকে নামল। কিন্তু নামল না লানা। জোহার বেশি জোর করল না। সোহার মুডের ওপর ভরসা নেই তার।

লানা মনে মনে অনেকগুলো ব্যাপার ভাবল। সে ঠিক করল, মুনকে সে এবার সামনে বসতে দেবে না। তার সাথে পেছনে বসাবে। লাউড মিউজিকটাও বন্ধ করাবে, এতে জোহারের মনয়োগ নষ্ট হবার ভয়টা থাকবে না।

লানা গাড়ির একটা গ্লাস নামিয়ে দিল। কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না কোথাও। চারিদিকটা কেমন যেন শুনশান। হঠাৎ আচমকা জানালায়
একজন বয়স্ক লোক এসে চমকে দিল লানাকে। লোকটা কোনদিক থেকে এলো বোঝা গেল না। লম্বা তামাটে চুলগুলো ময়লা, অবিন্যস্ত ঢেকে আছে আংশিক মুখ। কোটরাগত দুটি চোখ। ভীষণ নোংরা পোশাক আর দাঁতগুলো। রহস্যময় হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে লানার দিকে।
– গিভ মি সাম ডলারস, আই’ল গিভ ইউ সামথিং

লোকটার হঠাৎ আবির্ভাবে লানা এতটাই চমকে গিয়েছিল যে, সে কাঁপছিল থরথর করে। লোকটা কি পাগল? কি বিশ্রী আর দুর্গন্ধ গায়ে। লানার বমি পাচ্ছে। সে উঁকি দিয়ে চারিদিকে কিছু খু্ঁজল, কেউ নেই কোথাও। জোহারও আসছে না। লোকটা যদি গাড়িতে উঠে পড়ে? লানা জোর করে গ্লাস তুলে দিতে চাইল, পারল না। লোকটা একটা হাত ঢুকিয়ে রেখেছে ভেতরে। সে এবার নরম গলায় বলল

– হেই, গিভ মি ডলারস, আই’ল গিভ ইউ সামথিং….মাই ডার্লিং , সুইটহার্ট….

ঘিনঘিন করে উঠল লানার শরীর
– হোয়াট…? আই ডোন্ট নিড এনিথিং… জাস্ট লিভ মি এলন…
লানা জোর করে আবার গ্লাস তুলে দিতে চাইল। পারল না। লেকটা ইতিমধ্যে অন্য হাতে পকেট থেকে একটা মাদুলি টাইপ, সুতোয় বাঁধা একটা নোংরা কাপড়ের পুটলি বের করে দেখাল। বলল

– আই’ল গিভ ইউ দিস…, গিভ মি ডলারস। আই’ম হাংগ্রি…
লানা চিৎকার করল, বলল

– আই ডোন্ট নিড এনিথিং। গো এওয়ে প্লিজ….

নিরুপায় লানা বুঝল, সে বিপদে পড়তে যাচ্ছে। ঝামেলা এড়াতে একহাতে নিজের গলায় ঝোলানো ছোট্ট ব্যাগটা হাতড়াল, যা পেল ছুড়ে মারল বাইরে। লোকটা হাত বের করে ছুটে গেল মাটিতে পড়া ডলার আর কয়েনগুলোর দিকে।

দূরে জোহার আর মনুকেও আসতে দেখা গেল। লানা ইতিমধ্যে গ্লাস তুলে দিয়েছে। সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। চোখ বন্ধ করে কেবল অপেক্ষা করছে জোহারের আসার

জোহার আর মুন একটু পরে ফিরে এলো বেশ কিছু খাবারের প্যাকেট হাতে। লানা ঘামছে ঠান্ডাতেও। জোহার বলল
– আর ইউ অল রাইট?
লানা সামান্য হাসল, বোঝাতে চাইল সব ঠিক আছে।

গাড়ি স্টার্ট দিল। জোহার একটা খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিল সোহার দিকে। লানা হাত বাড়িয়ে নিল সেটা।

গাড়ি আবার ছুটছে। নিঃশ্বব্দে খাচ্ছে তারা। লানার লাউড মিউজিক বন্ধ করার কথা আর মনে এলো না একবারও। তার সাথে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বিভীষিকার মত আচ্ছন্ন করে রাখল তাকে কিছুক্ষণ। লোকটা নিঃসন্দেহে পাগল, উন্মাদ। লানা ছোট্টবেলা থেকে এই একটা জিনিস ভয় পায়। তা হল রাস্তার পাগল।

গাড়ি ঢুকে গেছে পার্ক এরিয়ায়। সবকিছু ন্যাচারাল। নিবিড় অরণ্য, পাহাড়, ঝর্ণা, পশুপাখি। একটু দূরে দূরে মাইলফলকের মত নানান ধরনের সতর্কবাণী। কেউ যেন প্রকৃতির কোন জিনিস ক্ষতি না করে। জোহারের গাড়ি চলছে একটা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গার মধ্যদিয়ে একটা সরু, সর্পিল রাস্তায়। গাড়ির স্পিড মাত্রাতিরিক্ত। লানা সতর্ক করল জোহারকে।

– জোহার, আস্তে চালাও। তুমি তাড়াহুড়ো করছ।

হাসছে জোহার। মুন উৎসাহ দিচ্ছে তার ড্যাডকে আরও জোরে চালাতে। মুনের মজা দেখার লোভেই হয়ত জোহার আরও সামান্য স্পিড বাড়াল। শংকিত হল লানা। সে এবার দু’হাতে মুন আর জোহারের আসন দুটি পেছন থেকে আঁকড়ে ধরেছে। কাতর কন্ঠে সে জোহারকে বলল
– জোহার বি কেয়ারফুল। আস্তে চালাও, আমার ভয় লাগছে। মুন, তুমি পেছনে চলে এসো, মমের কাছে…
মুন অবাধ্য হল, সে কিছুতেই পেছনে বসবে না।

জোহার আস্বস্ত করল, বলল
– আরে সোহা, এমন ফাঁকা জায়গায় ড্রাইভ করার থ্রিলটাই যদি না নিতে পারি তাহলে পিকনিকের মজা কোথায় বল? তুমি চোখ বন্ধ করে বসে থাক। আমি আর মুন এনজয় করি… হুর.. রে…..!

মুনও আনন্দে চিৎকার করছে। লানা শংকিত। এ্যাক্সিডেন্টের সমস্ত আলামত প্রকাশ পাচ্ছে একটু একটু করে। কিন্তু সে সোহা নয়, সে লানা। সে এখানে এসেছে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটা থামাতে অথবা মুন আর জোহারকে বাঁচাতে।
সে সুযোগ সে নিশ্চই পাবে। প্রকৃতির এত আয়োজন বৃথা হতে পারে না।

লানা এবার তীব্র ও রাগত গলায় বলল
– জোহার, আমি বলছি আস্তে চালাও, স্লো কর গাড়ি।
জোহার এবার গম্ভীর হল, বলল
– সোহা, আমি স্পিড কমাতে পারছি না কেন যেন
– হোয়াট?
– হ্যা, চেষ্টা করছি। তুমি মুনকে পেছনে নিয়ে যাও।

লানা স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। মুনকে পেছনে নিতে হবে অথচ সে নিচ্ছে না। কেমন বিশ্রী অনুভূতি আসছে মনে। জোহার এবার কিঞ্চিৎ জোরে বলল
– সোহা, মুনকে পেছনে নাও। গাড়ি কন্ট্রোল হচ্ছে না।

মুন ভয় পেয়েছে। সে এবার কাঁদছে শব্দ করে।
লানা মুনের দিকে হাত বাড়াবার বদলে দরজার হাতলে হাত রাখল।
হঠাৎ ধুম করে গাড়ীর সামনে কিছু একটা দৌড়ে এলো। গাড়ির চাকা চলে গেল জিনিসটার ওপর দিয়ে। গাড়িটা প্রচন্ড একটা বাঁক খেয়ে এবার ছুটছে এলোমেলো।
লানা চিৎকার করল
– জোহার কি ছিল ওটা? গাড়ি থামাও

জোহার প্রাণপণ গাড়িটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে করতে বলল
– একটা হরিণ গাড়িচাপা পড়ল সোহা। আমাদের ভয়ঙ্কর বিপদ। তুমি মুনকে বাঁচাও। ওকে নিয়ে লাফিয়ে পড়

জোহার যেন সামনে নিজের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিল। বনভূমি ছাড়িয়ে গাড়ি এখন উঁচুনিচু পাথুরে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে হোঁচট খাচ্ছে। জোহারের হাতের স্টেয়ারিং ঢলঢল করছে। জোহার অবিশ্বাস্য চোখে দেখছে সেটা। এটা হবার কথা নয়। গাড়িতে কী কোন যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল আগে থেকেই?

সামনে একটা বড় পাথরের দিকে ছুটছে গাড়ি। নিশ্চিত ভবিতব্য, চৌঁচির হয়ে যাবে গাড়িটা। লানা অনেকক্ষণ থেকে দরজাটা ঝাঁকাচ্ছে। তার মন বলছে, মুনকে টেনে আনতে হবে পেছনে। অথচ সে তা না করে দরজা খুলে নিজেই ঝাপ দিল বাইরে। কয়েকটা উল্টি খেয়ে পাথরে ধাক্কা লেগে স্থির হল সে। আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটা তীব্র বেগে গিয়ে ধাক্কা খেল বিশাল পাথরটার সাথে। প্রথমে উল্টি খেল দুইবার , তারপর স্থির হল। গাড়ির ভাঙা অংশগুলো বিচ্ছিন্ন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। লানার চোখের সামনে অদূরেই বিধ্বস্ত গাড়িটা।

লানা চিৎকার করে জোহার কে ডাকছে। ডাকছে মুনকেও। কারও সাড়া নেই। কিন্তু এভাবে তো শেষ হতে পারে না সবকিছু। লানা তো এই এক্সিডেন্ট থামাবে বলেই এসেছিল? কেন পারল না সে? কেন সে মুনকে টেনে নিল না সময়মত? তাহলে অন্তত মুনকে নিয়েতো সে লাফিয়ে পড়তে পারত? কি হয়েছিল তখন তার? কেন নিয়ন্ত্রন ছিল না নিজের ওপর? কেন স্বার্থপরের মত শুধু নিজের লাফিয়ে পড়ার কথাই মনে হল?

লানা হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও পড়ে গেল ধপাস করে। তার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। কিন্তু তাকে পড়ে থাকলে চলবে না। কেউ না কেউ চলে আসবে সাহায্য করতে নিশ্চই। তার আগে জোহার আর মুনকে বের করার চেষ্টা করতে হবে তাকে। লানা প্রাণপণ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। দূরে কোথাও পুলিশের গাড়ির হুইসেল শোনা যাচ্ছো।
লানার ঠোঁটে স্মিত হাসি। তার মানে কেউ আসছে হেল্প করতে। এক পা টেনে সামনে এগোলো লানা। আর তখনই প্রচন্ড বিস্ফোরণে, আগুনের গোলায় উড়ে গেল গাড়িটা। প্রচন্ড ধাক্কায় পেছনে বহু দূরে এসে ছিটকে পড়ল লানা। মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল তার দুনিয়াটা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here