#চোরাবালি_১৭
রেশমা আক্তার
পুরো একটা দিন লাগল আঘাতটা বুঝতে। লানা স্থবির, শান্ত অথচ প্রচণ্ড প্রলয় চলছিল তার বুকের মধ্যে। এরপর আর যেন কিছুই করার নেই। কিছু ভাববার নেই। সবকিছুর ইতি ঘটে গেছে।
লানা হাঁটু মুড়ে বসে থাকল বিছানায় ঘন্টার পর ঘন্টা।
একরাশ শূন্যতা নিয়ে বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে থাকল অন্ধকারে। বাথরুমে শাওয়ারের নিচে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকল, কতক্ষণ খেয়াল রইল না। বিছানায় পড়ে চিৎকার করে কাঁদল অনেকক্ষণ। ব্যথাবোধ, কষ্ট, হারানোর যন্ত্রণা সব ছাপিয়ে একটা পরাজয়, হেরে যাওয়া অনুভূতি কুড়ে খেতে লাগল তাকে। কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিল না খবরটা।
অতঃপর হাতজোড় করে ধ্যানস্থ হয়ে চোখ বন্ধ করল, মনে মনে বলল, সাহায্য কর। আমাকে সাহায্য কর প্লিজ। যা যা ঘটেছে, আমার ইচ্ছেতে কিছুই ঘটেনি। কার ইচ্ছেতে ঘটেছে তাও জানি না। আজ এভাবে সোহাকে জিতিয়ে দিও না প্লিজ। মরে যেতে আমার ভয় নেই। হয়ত সোহার হাতে এবার আমারও মৃত্যু হবে। কিন্তু আর একটা সুযোগ আমায় দাও। যে করে হোক মুন আর জোহারকে আর একটাবার দেখার সুযোগ দাও।
বিকেলের দিকে ফোন এল ইমাদের, বলল
– লানা ব্লু সি বিচের যে ইনফরমেশনগুলো চেয়েছিলে, মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছি। একটু চেক কর।
লানা অনিচ্ছা সত্বেও ল্যাপটপ নিয়ে বসল। তার ইনবক্সে ইমাদের কোন মেইল খুঁজে পেল না। বিরক্ত লানা ফোন দিল ইমাদকে। ইমাদ জানাল, সে তার পুরনো আইডিতে মেইল করেছে। লানা নিজেও ভুলে গিয়েছিল যে তার পুরনোও আরও একটা ইমেইল এ্যাড্রেস আছে।
নিজের পুরনো আউডির ইনবক্সে ঢুকে বিস্ময়াভিভূত হল লানা। ইমাদের মেইলের কিছু নিচে ডক্টর পার্থর মেইল। তার মানে ডক্টর পার্থ তাকে বিশ্বাস করেছিল। সে আপাতত ইমাদের মেইলের কথা ভুলে গেল।
ডক্টর পার্থর ব্যাগে সেদিন চিরকুটটা গোপনেই রেখেছিল লানা। ডক্টর পার্থ যখন কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না তাকে। যখন কোন ক্রমেই তার পেট থেকে কোন কথা বের হচ্ছিল না তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না লানার। সে তার একটা মেইল আইডি দিয়ে লিখেছিল, ” ডক্টর পার্থ, প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।
লানা।”
যদিও ডক্টর পার্থ আর নেই। তবু মৃত্যুর আগে তিনি হয়ত চেয়েছিলেন কিছু বলে যেতে।
ডক্টর পার্থ লিখেছেন,
” মিস এ্যালানা,
তোমাকে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। আবার ইচ্ছে হয় না। মনে হয় এটা সোহারই কোন ট্র্যাপ। কিন্তু ইদানিং সোহার সাথে ট্রান্সফরমেশনের যে অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটছে, তার প্রমান পেয়ছি আমি। যেটাতে আমার মনে হয়েছে তোমার অস্তিত্ব থাকলেও থাকতে পারে। ভাবলাম, আমার সময় তো শেষ। যদি কোন উপায়ে জোহার আর মুনটা বেঁচে যায়। তাই সোহার ব্যাপারে কিছু জানাতে চাই তোমাকে। যদিও এতে কোন লাভ নেই, তবুও শেষ চেষ্টা।
লানাকে নিয়ে যখন রিজভি আর রেখা দেশে ফিরল, তখন ওর বয়স আট কি নয়। মজার ব্যাপার হল, রিজভি আর রেখা দীর্ঘদিন ছিল নিঃসন্তান। আমি নিজেও অনেক চিকিৎসা দিয়েছি তাদের। আমেরিকায় চলে যাবার বারো বছর পর হঠাৎ এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরলে আমার কৌতূহল জন্মেছিল। তাছাড়া ওদের মেয়েটার চেহারার সাথে বাবা মা কারোও কোন মিল ছিল না। সোহা ধবধবে ফর্সা, বাদামী চোখের শেতাঙ্গদের মত দেখতে। তাছাড়া মেয়েটার কথাবার্তা, চালচলন আর পাঁচটা সাধারণ শিশুদের মত ছিল না। শুরুতে কিছু বলতে চাইত না রিজভি। কিন্তু দিনদিন সোহার ভেতরকার অস্বাভাবিকতা বেড়েই চলছিল। যেটা চেপে রাখা আর সম্ভব ছিল না। রিজভি আমার খুব কাছের বন্ধু, কিন্তু আমি ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এবার তাকে মুখ খুলতেই হল। একদিন চেঁপে ধরতেই রিজভি স্বীকার করল, সোহা আসলে ওর নিজের মেয়ে নয়।
দীর্ঘ নিঃসন্তান জীবন নিয়ে রেখা একটা সময়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গিয়েছিল সে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিল, তারা যেন একটা শিশু দত্তক নেয়। কারণ, রেখাকে সুস্থ করতে হলে তার সামনে একটা বাচ্চাকে রাখতে হবে। রেখা যদি বুঝতে পারে তার একটা বাচ্চা আছে, তাহলেই তার অবস্থার উন্নতি সম্ভব। একটা বাচ্চার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছিল রিজভি। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে, কে দেবে বাচ্চা। কোথায় পাবে তারা একটা বাচ্চা। তবু খোঁজাখুঁজি চলল, বহু অর্থ বিনিয়োগ হল। কাঙ্ক্ষিত বয়সের বাচ্চা পাওয়া গেল না।
একবার এক তুষার ঝড়ের রাতে বিজনেসের কাজে দুর্গম এক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে রিজভির গাড়িটা বিকল হয়ে যায়। সে রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় মারা পড়ত হয়ত রিজভি। গাড়ি থেকে নেমে কোন একটা আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়েছিল সে। অচেনা পথে বেশ কিছুদূর যেতেই সামনে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে, গিয়ে দড়জায় কড়া নেড়ে আশ্রয় চাইল। দরজা খুলে দিয়েছিল একটা মধ্যবয়সী লোক। তার হাঁটু ধরে পাশে দাঁড়িয়েছিল দুই বছরের একটা মেয়ে শিশু।
সে রাতে আশ্রয় পেয়েছিল রিজভি। ঘরের মধ্যে ফায়ারপ্লেসে দাউদাউ করে জ্বলছিল আগুন। চারিদিকে অদ্ভুত সব জিনিসপত্র ছড়ানো আর ঘরের মধ্যে নেশা ধরে যায় এমন একটা তীব্র গন্ধ। কেমন অদ্ভুত লাগল রিজভির। বাড়িটা কোন সাধারণ বসবাসের বাড়ির মত নয়। পরিচিত হতে গিয়ে জানতে পারল, লোকটা একজন তান্ত্রিক, তার নাম জন এলিট। টপাটপ করে রিজভির ভূত ভবিষ্যত বলে দিচ্ছিল সে। বিস্ময়ে স্তম্ভিত রিজভি। ভয়ও পাচ্ছিল।
গরম পানীয় দিয়ে রিজভিকে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচাল জন। লোকটির ভদ্রতার সুযোগ পেয়ে নতজানু হয়ে পা চেঁপে ধরল রিজভি। বলল, তোমার দেখা যখন পেয়েই গেছি, একটা উপায় তোমায় করে দিতেই হবে। আমি নিঃসন্তান, একটা বাচ্চা না পেলে আমার স্ত্রীকে আর বাঁচানো যাবে না। তুমি একটা কিছু কর। এমন কিছু দাও যাতে আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়।
লোকটি তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল রিজভিকে। যেন পড়তে পারছিল তার ভেতরটা। বলল, হবে না।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল রিজভি। বলেছিল
– এ কথা বল না প্লিজ। আমার বিশাল ঐশ্বর্য্য ধূলায় লুটাবে। তুমি যা চাও তাই পাবে। কিছু একটা কর।
লোকটির অট্টহাসিতে কেঁপে উঠেছিল চারিদিক। বলেছিল
– ওসব টাকা পয়সা দিয়ে আমার কি হবে? আমার দরকার ক্ষমতা। আর সে ক্ষমতা এখন হারাতে বসেছি আমি।
– মানে?
লোকটি কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। বলল
– ওসব বুঝবি না তুই।
– তুমি বুঝিয়ে বললেই বুঝব আমি। যদি তাতে তেমার লাভ হয়,
লোকটি স্বন্দিহান চোখে তাকাল রিজভির দিকে। বলল, আমি যা যা বলব, করতে পারবি?
আশা জাগল রিজভির মনে, বলল
– পারব
লোকটি গম্ভীর মুখে পায়চারী করল কিছুক্ষণ, তারপর বলল
– এই যে মেয়েটি দেখছিস, এ আমার বোনের মেয়ে। আমার বোন এডি, তন্ত্র সাধনার অনেক উঁচু স্তরে পৌঁছে গেছে। কিন্তু এখন তার মোক্ষলাভের সময়। আর এজন্য তাকে অনেক ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ড করতে হচ্ছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গেছে সে। কিন্তু একবার সে এ ক্ষমতা পেয়ে গেলে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে।
– কি করতে চাও তুমি?
লোকটি উত্তেজিত গলায় বলল
– থামাতে চাই তাকে
– কীভাবে?
লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফিসফিস করে বলল
– পল, এডির স্বামী ছিল। দু’ মাস আগে এডি তাকে শিক বিদ্ধ করে মেরে ফেলেছে।
প্রায় আর্তচিৎকার করে উঠল রিজভি।
– কেন?
লোকটির বড় বড় চোখে ঘৃণা, রাগ আর হতাশা একসাথে খেলা করে গেল। বলল
– স্যাক্রিফাইস….। এ সাধনায় জীবন্ত নরনারী সাক্রিফাইস করতে হয়।
– পুলিশে খবর দাওনি কেন?
আবারো ঘর কাঁপিয়ে হাসল লোকটি। বলল
– পুলিশ কিচ্ছু করতে পারবে না। এটা ব্ল্যাকম্যাজিক। শুধু,শুধু কতগুলো মানুষের প্রাণহানি হবে। এসব পুলিশের কর্ম নয়।
– তাহলে?
– পলের লাশের ওপর বসে টানা সাতদিন ধ্যান করেছে এডি। ভয়ঙ্কর সে সাধনা।
বিকৃত হল রিজভির মুখ। এসব কি শুনছে সে? এ কোন জায়গায় এসে পড়ল রিজভি? তার কোন বিপদ হবে নাতো? এই দুর্যোগের রাতে এমন একটা ফাঁদে পড়ে গেলে নিজেকে বাঁচানোর কোন পথই খোলা থাবে না তার। সে কি এখান থেকে পালাবে? লোকটা নিজের নাম বলেছ জন এলিট। সে নিজেও কোন ধান্ধা করে বসবে নাতো?
জন শব্দ করে হাসল অহেতুক। বলল
– কিরে, ভবছিস আমি তোকে ফাঁদে ফেলেছি?
অপ্রস্তুত হল রিজভি। লোকটা কি তার থট রিড করতে পারছে? জন বলল
– ভয় নেই, এডি আজ বাড়িতে নেই। শিকার ধরতে গেছে। তবে শিকার না পেলে আজ স্যাক্রিফাইস করবে এই মেয়েকে, এডির নিজের গর্ভজাত সন্তান, সারা কে।
জন আর রিজভি দুজনেই বেদনার্ত চোখে তাকাল সারার দিকে। কি আশ্চর্য সুন্দর বাচ্চাটি, যেন দেবশিশু। লালচে চুল, বাদামী চোখ। গোলাপী ঠোঁট। কি নিস্পাপ দৃষ্টি। রিজভি আর্তনাদ করে উঠল। বলল
– কি বলছ তুমি? এসব কি সত্যিই হতে পারে?
জনের গলা দৃঢ় হল। বলল
– এডি আর মানুষ নেই। সে একটা উইচ্। নিজের বাচ্চাকে স্যাক্রিফাইস করতে পারলে সে হয়ে যাবে অমর, বিশাল ক্ষমতাধর।
রিজভি কাতর গলায় বলল
– তুমি বাঁচাচ্ছ না কেন? কেন এই শিশুটিকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছ না?
হতাশ হল জনের মুখ, বলল
– আমি পারব না। আমি এডির মত শক্তিধর নই। তবে আমি নিজেকে বাঁচাতে পারি, এই শিশুটিকে নয়।
রিজভি নিশ্চুপ, নিশ্চল চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। বলল
– আমায় দেবে?
চমকে উঠল জন। উত্তেজনায় কি বলবে ভাষা পেল না।
– তুমি নেবে?
– হ্যা নিব। আমার একটা বাচ্চা চাই?
জন উত্তেজিত, বলল
– হবে হবে.. তোমারও হবে। আমি কথা দিচ্ছি।
যদি সারাকে বাঁচাও তবে আমি দেব তোমায় মন্ত্রপূত সন্তান।
বিস্ময়াভিভূত হল রিজভি।
জন বলল,
– আজ এক্ষুণি তুমি সারাকে নিয়ে পালিয়ে যাও। এডি আসার আগে, দ্রুত।
– কিন্তু এডি যদি খুঁজে পায়? তাহলেতো শেষ করে দেবে আমাদের দু’জনকেই?
– আমি সামলাব, আমি আটকাব। ও আমার কিছু করতে পারবে না।
রিজভির আর ভাবার সময় ছিল না। একটা শিশুকে বাঁচিয়ে যদি নিজের করে পাওয়া যায়, যদি এ বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে রেখা বেঁচে যায়? তাছাড়া জন তো বলেছেই ও সামলাবে।
রিজভি বলল
– আমি রাজি।
জন, রিজভির চোখের দিকে স্থির তাকাল। বলল
– একটা কথা আরও বলছি তোমায়। সারা কিন্তু কোন সাধারণ মেয়ে নয়। এডির দীর্ঘ তন্ত্র সাধনার ফল। হতে পারে ও তোমার সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির পথ খুলে দেবে। আবার ও কিন্তু তোমার ধ্বংসেরও কারণ হতে পারে
এতসব বোঝার সময় ছিল না আর বুদ্ধিও কাজ করছিল না রিজভির। সে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির ছোট্ট হাতটা ধরল। মেয়েটিও ধরল রিজভির হাত। জন এক ঘটি পানিতে হাত ডুবিয়ে রিজভির চারিদিকে ঘুরছে আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। কয়েক ফোঁটা ছিটিয়ে দিচ্ছে রিজভির দিকে। অতঃপর ঘটিটা এগিয়ে ধরল রিজভির ঠোঁটের কাছে। রিজভি পান করল।
জন পাত্রটা তুলে রেখে এসে সারার সামনে নিচু হয়ে বসল। বিড়বিড় করে বলল
– হি’জ ইওর ফাদার ফ্রম নাউ । হি সেভড্ ইউ। ইউ’ল গেট আ নিউ ফ্যামিলি, নিউ মম্। ন্যাভার হার্ম দেম।
সারা নিশ্চল তাকিয়ে থাকল। হয়ত বুঝল।
জন এসে দরজা খুলে দিল। বাইরে প্রচন্ড ঠাণ্ডা। গাড়িটা ফেঁসে আছে বেশ দূরে। মেয়েটিকে নিয়ে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাকে। জনের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় জন, রিজভির হাতের মুঠোয় একটা কাঠের চৌকোণা বাক্স ধরিয়ে দিল। বলল
– যতদিন বেঁচে থাকবে, এই মেয়েটির সাথে সাথে এটাও রক্ষা করবে। তবে সারার থেকে দূরে রাখবে এটা।
– কি এটা?
– এখন আর সময় নেই। এডি ফিরে এলো বলে। তোমরা পালাও।
গাড়িটা খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল। অনেকটা ঢেকে গেছে বরফে। কিন্তু রিজভি গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিতেই আশ্চর্যজনকভাবে স্টার্ট হল গাড়িটা। মেয়েটিকে পাশে বসিয়ে নির্বিঘ্নে গাড়ি ছোটাল রিজভি। প্রচণ্ড তুষারঝড় যেন পাথরের খন্ড হয়ে ছুটে আসছে গাড়ির পেছনে। বারবার আঘাত হাণছে গাড়ির ডিকিতে। বার কয়েক ব্রেকফেইল হতে হতেও সামলে নিল রিজভি। এডি কি তবে ধাওয়া করেছে তাদের। জীবন বাজি রেখে ছুটছে রিজভির গাড়ি। উপড়ে ধড়াস ধড়াস করে কিছু ছুটে এসে পড়ছে যেন। হঠাৎ হঠাৎ লক করা দরজার পাল্লা খুলে যাচ্ছে পেছনে। গাড়ি এঁকেবেঁকে ছুটছে কেবল। এ যেন মরণপণ ছুটে চলা।
কতক্ষণ এভাবে বৈরী আবহাওয়ার সাথে যুদ্ধ করেছে যানে না রিজভি। ভোর নাগাদ ঝড় থামল। রিজভির গাড়িটাও লোকালয়ে এসে পৌঁছল। শহরের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ড্রাইভ করে বাড়ি পৌঁছল তারা।
সারাকে পেয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল রেখা। রিজভি এসে সারাকে দেখিয়ে বলেছিল। এই যে, এটা হল তোমার মেয়ে।
– আমার মেয়ে?
– হ্যা, ওকে মানুষ কর। কখনও ভেব না, ও তোমার নিজের মেয়ে নয়।
রেখা বুকে টেনে নিয়েছিল সারাকে। ঘটা করে মেয়ের নাম রেখেছিল সোহানা আহমেদ, ওরফে সোহা।
কিন্তু ভয় ছিল । সারার লিগ্যাল মা এডি। খুঁজতে চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে সে। এডি খুঁজেছিল, তবে অন্যভাবে। এডি কোন সাধারণ মানুষ নয়। তার শক্তি অন্য মাত্রার। সে তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করত অন্যভাবে।
এরপর প্রায়শই সোহাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির আনাচে কানাচে বা অন্ধকারে পাওয়া যেত। খুঁজে পাওয়ার পর সোহা কিছু মনে করতে পারত না। বছর খানেক কেটে গেল। সোহার অন্ধকারে থাকার অভ্যেস বাড়তে থাকল।
রেখা খুব চেপে ধরলে বলত, মম্ ডাকছে আমাকে।
– আমিই তো তোমার মম্
– আরেকটা মম্ আছে।
রেখা কিছু বুঝতে না পারলেও রিজভি কিছুটা পারত আন্দাজ করতে। এডি তার তন্ত্রবলে মেয়েকে খোঁজার চেষ্টা করছে। রিজভি সোহাকে নিয়ে একটু ভয়ে ভয়েই থাকত।
কিন্তু তেমন কিছু হল না কয়েক মাসে। তবে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে সোহার জন্য কিছু নকল অথচ লিগ্যাল কাগজপত্র তৈরি করতে হল রিজভিকে।
বছর খানেকের মাথায় সন্তানসম্ভবা হল রেখা। সোহাকে নিয়ে অন্য স্টেটে চলে গেল রেখা আর রিজভি। এরপর রিজভির বাবা মারা গেলেন বাংলাদেশে। ওরা যখন দেশে ফিরে আসে তখন সোহা নয় বছরের আর রিজভির ছেলের ছয়।
চিটাগং এ রিজভির বাবার বিশাল পৈত্রিক সম্পত্তি। বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র উত্তরাধিকার রিজভি। ভেবেছিল এখানেই বাকি জীবনটা থেকে যাবে। কিন্তু এই বাংলোতে সোহাকে নিয়ে ঘটতে থাকল একটার পর একটা দুর্ঘটনা। রিজভি এ সময় প্রচন্ড মানসিক অস্থিরতায় ভূগতে শুরু করল। কোন উপায় না পেয়ে সব শেয়ার করল আমার সাথে।
আমি ভেবেছিলাম সোহা কোন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝলাম আসলে ও কিছু সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নিয়ে জন্মেছে। যা বহু সাধনা আর চেষ্টায় অর্জন করে, যারা ব্ল্যাকম্যাজিক প্রাকটিস করে তারা। সোহার কর্মকান্ডগুলো চাপা দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছিল রিজভি। রেখা এসবের কিছু জানত না। রিজভির ভয় ছিল, যেহেতু সে সোহাকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেছিল জনের কাছে। আর সে প্রতিজ্ঞা রক্ষার শর্তেই তিহামের জন্ম। সুতরাং রিজভির ভয় ছিল, সোহার কিছু হলে তিহামের ক্ষতি হতে পারে।
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বাংলোয় তিহামের মৃত্যু হয় সোহার হাতেই। এতদিন সোহার অপকর্মগুলো ঢাকতে ঢাকতে শেষপর্যন্ত নিজের প্রাণপ্রিয় বাচ্চাটার মৃত্যু আর সহ্য করতে পারল না রিজভি। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার। সোহার প্রতিও মায়া পড়ে গিয়েছিল ততদিনে।
কিছুদিন পর রেখা কনসিভ করল আবার। কিন্তু সে বাচ্চাটাও পেটে মারা গেল, একটা দুর্ঘটনায়। রিজভির মন উঠে গেল। সে সিধ্বান্ত নিল আর দেশে নয়। তারপরের সব তো তুমি জানো।
আমেরিকায় ফিরে রেখা আবার আগের মত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দিনদিন তার অবস্থা খারাপ হতে থাকল। শুনেছি রেখা এখন বেঁচে আছে কোনমতে। বোঝা গেল, রেখার সুস্থতার জন্য সোহা অনিবার্য, আবার সোহার উপস্থিতি মৃত্যুর সাথে জীবনযাপনের মত। তবুও রিজভি আর সোহাকে ফিরিয়ে নেয়নি।
এদিকে জোহারের মত একটা সুযোগ্য মানুষের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে রিজভি, সোহার বাবা হবার দায় মিটিয়েছে।
কিন্তু সোহা থেমে নেই। সে তার মায়ের সব গুণ নিয়ে জন্মেছিল। তবে তাকে মায়ের মত অত পরিশ্রম করতে হয়নি। মায়ের চাইতেও অনেক বেশী পাওয়ারফুল সে। আর এখন সেইমতই সেও তার মোক্ষলাভের পথে। সেও তার সন্তানদের স্যাকরিফাইস করে সাধন লাভ করতে চায়। আর তার এসব অপকর্মে সদা সর্বদা মদত দিয়ে গেছি আমি। কারণ আমার কোন উপায় ছিল না। আমার দুটি ছেলে মেয়ে আছে। আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল একই কারণে, সোহার হাতে। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় জড়জড় হয়ে গেছি আমি। কিন্তু নিরুপায়।
তবে আজকাল মনে হচ্ছে সোহার মতলব ভালো নয়। আমাকে তার আর প্রয়েজন নেই। যাকে তার প্রয়োজন নেই তাকে সে সরিয়ে দেয় পথ থেকে। আমি জানি, এরকম চলতে থাকলে ওর পরিবারের কেউ থাকবে না একসময়।
আজ তোমাকে আর বলতে দ্বিধা নেই। সোহা আজ আমাকে রেগে শূন্যে তুলে আছাড় মেরেছে। আমি হয়ত মরেই যেতাম। জোহার এসে পড়ায় প্রাণটা নিয়ে কোনরকম বাংলো থেকে ফিরেছি। আমার ওপর রাগের কারণ একটাই, আমি মুন আর জোহারকে ছেড়ে দিতে বলেছিলাম।
সোহা আমাকে ছাড়বে না। তোমার কথা বিশ্বাস হল এখন। যদি তুমি সত্যি হও তবে এ মেইলটা নিশ্চই তোমার কাজে লাগবে। সোহা সম্বন্ধে যা জানি বললাম। তবে সবচেয়ে ভালো জানে রিজভি। একমাত্র রিজভিই জানে সোহার আসল দুর্বলতা। তবে বাৎসল্যবোধ তার হাত পা বেঁধে রেখেছে। এখান থেকে বের হতে পারলে সে হয়ত বাঁচাতে পারত মুন আর জোহারকে, তোমাকেও। তুমিই সোহার শেষ লক্ষ্য। সে এখন অন্য মানুষের মাঝে, অন্য টাইমজোনে আসা যাওয়া করতে পারে। এটা তার শক্তি নাকি প্রকৃতির খেলা আজও জানি না আমি। পারলে খুঁজো, সোহাকে থামানোর উপায় খুঁজো।
বিদায়
ডক্টর পার্থ।
সারাদিন নিজের ঘরে পড়ে থাকল লানা। কোন উপায় পেল না খুঁজে। আর খুঁজেও বা কি লাভ? জোহার আর মুন নেই। শেষরক্ষা হয়নি। সোহা এখন তাকে মেরে তার শরীরে অভিষিক্ত হবে। আর কোন উপায় জানা নেই তার।
রাত হল। লানা নীর্জীব, শুধু ভাবছে আর ভাবছে। আচ্ছা ডক্টর পার্থর শেষ কথাগুলো যদি সত্যি হয়। যদিও সম্ভাবনা জিরো, তবুও যদি লানা আর সোহার এই ট্রান্সফরমেশনটা প্রকৃতিগত হয়। তাহলে ধরে নেয়া যায় সোহা যতই শক্তিধর হোক না কেন, কিছুটা শক্তি লানারও আছে। সোহারটা সোহা জানে, লানা হয়ত নিজের পাওয়ার সম্বন্ধে অজ্ঞাত। নইলে সেদিন ঘুমের ঘোরে নিজ প্রচেষ্টায় সোহার শরীরে যেতে পারত না, আর মুনকেও বাঁচাতে পারত না। ডোনাকে মারা, আয়নায় লিখে রাগ প্রকাশ করাই প্রমান করে, ব্যাপারটায় সোহার হাত ছিল না। ইচ্ছেটা ছিল সম্পূর্ণ লানার।
নতুন এ চিন্তাটা শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহের মত আলোড়িত করল লানাকে। সে বিছানায় উঠে বসল। কড়জোরে বন্ধচোখে মিনতি করল।
– প্লিজ…প্লিজ গড, গিভ মি ওয়ান মোর চান্স। প্লিজ।
গভীর চিন্তায় ধ্যানস্থ হল লানা। কতক্ষণ কেটে গেছে সময় মনে নেই।
গাড়ির হর্ণ বাজছে কোথাও বারবার। এতরাতে কে এলো? এ বাড়িতে এতরাতে এভাবে তো কারও হর্ণ বাজানোর কথা নয়। হঠাৎ, সম্ভাবনার আশায় শরীরে অবশ করা এক অনুভূতি এলো। চিটাগং বাংলোয় নয় তো সে?
চোখ খুলল লানা। ঘরটা অচেনা। জোহার বা সোহার ঘর নয়। ঝকঝকে, পরিপাটি, একটা বিশাল, অচেনা ঘর। সামনে দেয়ালে কয়েকটা হলিউড স্টারদের পোস্টার সাঁটা। বিছানাটা শ্বেতশুভ্র, নরম, গা ডুবে যাওয়া ভাব। টেবিলে একটা ডিজিটাল ক্লক। নিচে লেখা নিউজার্সি, ইউ এস এ।
( চলবে)