চোরাবালি পর্ব ১৬

0
150

#চোরাবালি_১৬
রেশমা আক্তার

লানার চিৎকারটা কানে গিয়েছিল জেসির। সে দৌড়ে উপরে এসে সব দেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল লানার দিকে। লানাও জেসির চোখের ভয়টা দেখতে পেল।
– জেসি, আমি ওটা করিনি.. বিলিভ মি…

জেসি একবার বিছানায় রক্তাক্ত ডোনার দিকে আরেকবার লানার দিকে তাকাল, সে কি বিশ্বাস করছে আর কি অবিশ্বাস করছে না, বুঝতে চেষ্টা করছে লানা।

জেসির পেছনে ইতিমধ্যে আরও দু’তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে। এরা সবাই বাড়িতে বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত। সবার গায়েই ইউনিফর্ম। এদের মধ্যে একজন হল হাশেম আঙ্কেল, ষাটোর্ধ। উনি কত বছর ধরে এ বাড়িতে আছেন, জানে না লানা। তবে উনি এখন আর কোন কাজ করেন না, এদের সবাইকে পরিচালনা করেন।

হাশেম আঙ্কেল বললেন
– রাতে কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন ছোটমনি?

লানা সজোরে মাথা দু’দিকে নাড়াল
– হাশেম আঙ্কেল বিশ্বাস কর, আমি এটা করিনি

হাশেম আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল
– করলেও আপনাকে এজন্য কেউ কিছু বলবে না ছোটমনি। আপনি ঘাবড়াবেন না। এই কে আছিস, এগুলো পরিষ্কার করে ফেল।

পরিচারকরা যে যার মত কাজে লেগে পড়ল। লানা বসে পড়েছিল একটা ডিভানের ওপর। হাশেম আঙ্কেল পেছনে হাত বেঁধে পায়চারী করতে করতে দেখছে চারিদিক। জেসি দাঁড়িয়ে আছে লানার কাছাকাছি।

লানা তীব্র অস্বস্তি আর কষ্টে ভুগছে। প্রথমত, সবাই মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ভাবছে, লানাই ডোনার এই অবস্থা করেছে। এ ঘরে আর কারও অস্ত্বিত্ব অবান্তর। দ্বিতীয়ত, ডোনা লানার খুব প্রিয় পোষা কুকুর। তার মৃত্যু লানার জন্য অসহনীয়।

মিনিট বিশেকের মধ্যে বিছানা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘরে জেসি আর হাশেম আঙ্কেল আছে এখনও। মম্ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর হাশেম আঙ্কেলের খবরদারি বেড়ে গেছে। ড্যাডও বেশীরভাগ সময় বাইরে থাকেন। সুতরাং বাড়ির যেকোন সিধ্বান্ত নেয়া এবং হুকুমদারী করার পূর্ণ ক্ষমতা ও অধিকার দেয়া আছে হাশেম আঙ্কেলকে।

হাশেম আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছেন এখন সেই আয়নাটার সন্মুখে। তার কপালে ভাঁজ।

লানা উঠে গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে। বলল
– হাশেম আঙ্কেল, এই যে লেখাটা দেখছ, এটাও আমি করিনি। এসব আমি কেন করতে যাব বল? ডোনা আমার খুব প্রিয়, ওকে মেরে ফেলার কথাতো আমি ভাবতেই পারিনা।

লানার গলাটা ধরে এলো।

হাশেম এবার অন্যদিকে চলে গেল। লানা মনে মনে ভাবল
এটা কি তবে সোহার কাজ? হ্যা, সোহা তো আসে তার জায়গায়। অনেক পরে হলেও সোহার অস্তিত্ব টের পেয়েছে লানা। কাল মুনকে বাঁচাতে এক প্রকার জোর করেই লানা যেতে পেরেছিল সোহার শরীরে। এটাই কি সোহার রাগের কারণ? সেও এসে কাছে যাকে পেয়েছে তার ওপর শোধ তুলে গেছে। ডোনাকে মেরে হুশিয়ারী জানিয়ে গেছে তাকে।

হাশেম ফিরে এসে দাঁড়াল তার সামনে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
– জ্বীনের আছর হইতে পারে
– কি…? হোয়াট ইজ জ্বীন…?

– জ্বী ছোটমনি, মানুষের ওপর জ্বীনের আছর হয়। একথা সত্য।
লানা দিশেহারা বোধ করল
– ওহো হাশেম আঙ্কেল, ওসব নয়। এটা অন্য ব্যাপার। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না।

– আমি বুঝতে পারছি ছোটমনি। জ্বীন ভূত তো আছে দুনিয়ায়। তেনারা সুযোগ পেলে মানুষের ওপর আছর করে। মানুষ তখন তাই করে যা তেনারা চায়…

– আছর করে মানে কি?
– আছর করে মানে হলো তেনারা মানুষের শরীরে ঢুকে মানুষকে দিয়ে অপকর্ম করায়

লানার কপালে ভাঁজ পড়ল, বিড়বিড় করে বলল
– কি বললে তুমি হাশেম আঙ্কেল, আবার বলতো? একজনের শরীরে ঢুকে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আরেকজন?
– হ্যা.. পারে তো।

লানা অন্যমনস্ক হল। বলল
– ধরে নাও তেমনি কিছু হয়েছে আমার সাথে। তবে সে জ্বীন, ভূত নয়। আমারই মত আরেকজন মানুষ।

জেসি আমতা আমতা করে বলল
– ম্যাম, হাশেম আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন। আমারও মনে হয় আপনার ওপর কিছুর আছর হয়েছে। কাল সন্ধ্যায় আমি যখন কফি নিয়ে ঢুকলাম, আপনি হঠাৎ রেগে গেলেন। কফি ছুড়ে মেরে হঠাৎ এসে আমার গলা চেপে ধরলেন। আপনার চোখদুটো মনে হচ্ছিল ফেটে বেরিয়ে আসবে। আমি অনেক কষ্টে আপনার হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।

লানা স্তম্ভিত। বলল
– কি বলছ জেসি, আমি ওটা ছিলাম না। তুমি আজ পর্যন্ত আমাকে কখনও দেখেছ এমন করতে?

জেসি দু’দিকে না সূচক মাথা নাড়ল। হাশেম তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল চারিদিকে। তারপর বলল, আপনাকে আমি একটা তাবিজ এনে দিচ্ছি ছোটমনি। তাবিজটা সবসময় নিজের সাথে ধারণ করবেন। জ্বীন, ভূতের চৌদ্দ গুষ্টি বাপ বাপ করে পালাবে।

লানা দুহাতে মাথা চেপে ধরে আবার বসে পড়ল ডিভানে। বলল
– ওসবে কিচ্ছু হবে না হাশেম আঙ্কেল। আমি আসলে তোমাদের বোঝাতে পারব না, আমার সাথে ঠিক কি হয়।

হাশেম আর লানাকে ঘাটাঘাটি করল না। সে জেসিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করে চলে গেল।

লানা আজ আর নিজের ঘরে গেল না। ব্রেকফাস্টের পর নীল যে ঘরটাতে থাকত, সেখানে গিয়ে বসল নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে।
ব্লু সি বিচ ক্রয়ের সমস্ত বন্দোবস্ত প্রায় শেষ। উকিল সাহেব যদিও ফাইনাল করেননি। তবু আজ কালের মধ্যেই ভাল খবর পাওয়া যাবে, আশা করা যায়।

লানার হঠাৎ ডক্টর পার্থর কথা মনে পড়ল। লোকটা যদি আগেই তার সতর্কবাণী শুনত। এই লোকটাই পারত তাকে একটু সাহায্য করতে। লানা ডক্টর পার্থর সোশ্যাল আইডি খুঁজল। অল্পতে পেয়েও গেল। আইডি লক। নিরাশ মনে বেড়িয়ে এলো।
দুপুরের পর ইমাদকে নিয়ে একটু বের হল লানা। আজ ইমাদ তার বাইক নিয়ে এসেছে। লানা বসেছে পেছনে। ইমাদ জানতে চাইল, হঠাৎ জরুরী তলব? কোথায় যাবে?

লানা বলল
– আজ এক জায়গায় নিয়ে যাব তোমাকে।

ইমাদ কথা বাড়াল না, লানার নির্দেশনায় বাইক চালিয়ে তারা চলে গেল ধানমন্ডি এলাকায়। অনেক ঘুরে,খুঁজে অবশেষে তারা এসে থামল একটা তিনতলা পুরানো বাড়ির সামনে। বাড়িটার ভেতরে অনেকখানি বাগান। মনে হয় ঠিকঠাক যত্ন নেই অনেককাল। আগাছা, লম্বা লম্বা ঘাসে চারিদিক কেমন সবুজ হয়ে আছে। মনেই হয় না ধানমন্ডির মত জায়গায় এত সবুজে আবৃত একটা বাড়ি থাকতে পারে।

ইমাদ বলল
– এটা কাদের বাড়ি নিয়ে এলে?

লানা গেটের দিকে এগিয়ে গেল। ফাঁকা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। কারো সাড়াশব্দ পেল না। কয়েকবার ডাকল
– কেউ আছেন? গেট টা একটু খুলুন না?

কিন্তু কোন জবাব এলো না। মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করল, সেবার বাংলোর মত যদি দাড়োয়ান ঢুকতে না দেয়? তাছাড়া একটা বাড়িতে অচেনা লোকজন চাইলেই ঢুকতে দেবে কেন?

লানা ঘুরে দাঁড়াল ইমাদের দিকে। বলল
– ইমাদ, এই তালাটা তোমাকে খুলতে হবে।
ইমাদ হতভম্ভ
– কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া তালাটা ভেতর থেকে দেয়া। ভেতরে তো হাতই ঢুকবে না।

লানা চারিদিকে তাকাল। রাস্তাটা নিরিবিলি হলেও প্রায়ই পথচারী আসা যাওয়া করছে। বেশীক্ষণ উঁকিঝুঁকি মারলে লোকজন স্বন্দেহ করবে। লানা বলল

– তোমাকে যে করে হোক দেয়ালটা টপকাতে হবে।
– বাট… হাউ?
– প্লিজ ইমাদ, কিছু একটা ভাবো। যে করে হোক আমাদের ভেতরে ঢুকতে হবে।
ইমাদ চারিদিকে ভালো করে দেখল। উঁচু প্রাচীরের ওপরে তীক্ষ্ণ, ধারাল শিক গাঁথা। আ্তকে উঠল সে। লানাকে দেখিয়ে বলল
– ইম্পসিবল…
লানাও নিরুপায় বোধ করল। কিন্তু এ বাড়িতে ঢুকতেই হবে। যে করে হোক, সোহা সম্বন্ধে একটা ক্লু খুঁজে পেতেই হবে তাকে। যদিও এখানে তা নাও পেতে পারে, তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।

ইমাদ এবার গেটে জোরে জোরে ধাক্কা মেরে চিৎকার করল

– বাড়িতে কেউ আছেন? গেটাটা একটু খুলুন। জরুরী দরকার।
বার কয়েক চিৎকার করতেই ভেতরে কোথাও সাড়া মিলল
– কে?…. কি চাই…..?
ইমাদ দ্রুত লানাকে কিছু ব্যাপার বুঝিয়ে দিল। লানা টপ করে কয়েক হাত পিছিয়ে গেল এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল।

গেট খুলে দিল মধ্যবয়সী একজন লোক। স্বন্দীহান দৃষ্টি তার।
– কি ব্যাপার?

ইমাদ ইতিমধ্যে তার বাইকের হিডেন বক্স থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে লোকটাকে কাছে ডাকল। বলল
– এ বাড়িতে মিস্টার জোহার নামে কেউ থাকে?

জোহারের নাম শুনে এগিয়ে এলো লোকটা। ইমাদ কাগজপত্রগুলো ওলোটপালট করতে করতে বলল
– জোহার সাহেবের নামে কিছু নোটিশ আছে…

দাড়োয়ান চিন্তিত মুখে দেখতে লাগল কাগজপত্রগুলো। আর এদিকে লানা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

যাক এবার ইমাদ ওদিকটা সামলাক। লানার ভয় ছিল যেকোন মুহূর্তে ধরা পড়ে যাওয়ার। কারণ, বাড়ির ভেতরে কেউ আছে কিনা, থাকলেও ক’জন আছে কোন ধারণা নেই তার।

সদর দরজা চাপ দিতেই খুলে গেল। পুরনো বাড়ি, তবে ভেতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নিয়মিত সাফসুতর করা হয় নিশ্চই। সেক্ষেত্রে চাকরবাকর থাকার কথা। যত ভয়ই থাকুক না কেন, লানাকে ঢুকতেই হবে ভেতরে। নিচতালাটা শুধুই হল ঘরের মত। ড্রইং আর কিচেন। মাঝখান দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি। লানা পা টিপে সন্তর্পণে উঠো গেল দোতলায়। দোতলায় তিনটা বেডরুম আর একদিকটা খোলা বিশাল বারান্দা। লানা পরপর দুইটা ঘরে ঢুকে দেখে নিল। চোখে পড়ার মত কিছু পেল না। সাধারণ ও খুব সামান্য আসবাব। যতটুকু না হলেই নয়। তৃতীয় ঘরটাতে ঢুকে থ হয়ে গেল সে। দেয়ালে টানানো হাস্যময়ী এক দেবশিশুর ছবি যেন। এই কি তবে পিহু। আহা কি সুন্দর দেখতে। মুনের সাথে চেহারায় অনেকটা মিল। লানা ঘরে ঢুকে পায়চারী করল। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল সব। বিছানা, সাইড টেবিল। ডিভান, কেবিনেট। একটা বড় জানালা। লানা জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পর্দা সরানো ঠিক হবে কিনা ভাবছে। ইমাদটা কোথায় রয়ে গেল জানার কৌতূহল হল। লানা সামান্য ফাঁকা করল পর্দাটা। এদিক দিয়ে বাড়ির সামনেটা দেখা যায়। গেট টা ভেতর থেকে লাগানো। দাঁড়োয়ানকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ইমাদ কি তাকে রেখে চলে গেল নাকি?

লানাকে দেরী করলে চলবে না। ইমাদ নিশ্চই অপেক্ষা করছে বাইরে। তাছাড়া বের হবার উপায়ও বের করতে হবে তাকে। যেকোন অসাবধানতা কেলেঙ্কারী ঘটাতে পারে।

লানা পাশ ঘুরতেই প্রায় আতকে উঠল। লানার আতঙ্কিত মুখে হাত চাপা দিল ইমাদ। ধীরে ধীরে ধাতস্থ হল সে। ইমাদ মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, পানি খেতে চেয়েছিলাম। দাঁড়োয়ান ভেতরে যেতেই, বাইকটা দূরে সরিয়ে রেখে এসে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। লুকিয়ে দেখলাম, পানি নিয়ে এসে আমাকে না পেয়ে ভেবেছে চলে গেছি। গেটে তালা লাগিয়ে বাড়ির পেছনে কোয়ার্টারে গিয়ে ঢুকেছে। আমিও নিশ্চিন্তে, তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম এখানে।

– যদি কেউ দেখে ফেলত?
– কেউ নেইতো
– কি করে বুঝলে? থাকতেও পারত
কাঁধ ঝাঁকাল ইমাদ। বলল
– বাদ দও, কিছু পেলে?

লানা সরে এসে আবার ছবিটার সামনে দাঁড়াল। বলল
– এখনও তেমন কিছু চোখে পড়েনি। এই ছবিটা জোহারের বড় মেয়ের। মাত্র তিন বছর বয়সে রহস্যময়ভাবে ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয় বাচ্চাটার।
ইমাদ পাশে এসে দাঁড়াল লানার।
লানা আবার বলল
– বাচ্চাটা অন্ধ ছিল, জানো?
– কি বলছ? তিন বছরের একটা অন্ধ বাচ্চা তিনতলার ছাদের ওপর থকে রেলিং টপকে পড়ে গেল?
– সেটাইতো রহস্য ইমাদ। তবে সে রহস্যের উত্তরটাও জানা। শুধু এই খুনীকে পাকড়াও করার অপেক্ষা।
বেডসাইড টেবিলটার ওপর তিনটা ফটোফ্রেম উল্টে রাখা। ইমাদ সবচেয়ে বড় ফ্রেমটা তুলে ধরল। সেখানে জোহার, সোহা আর পিহুর ছবি। দ্বিতীয় ফ্রেমটা তোলার পর দেখা গেল শুধু সোহাকে। তারপর সবচেয়ে ছোট ফ্রেমটায় দেখা গেল একটা গোলাকার বৃত্তের ছবি। মনে হয় একটা লোগো। গোলাকার ছবির মাঝখানে সর্পাকৃতির একটা ট্যাটু। ফ্রেমগুলো রেখে এবার তারা পিছু ফিরল। লানা নিরাশ মুখে হাত বাড়াল কেবিনেটে। কেবিনেট প্রায় ফাঁকা। তবে ভেতরে দেয়ালে দেয়ালে আঁকা অদ্ভুত সব চিত্র। যার কোন মানে হয় না। লানার মনে পড়ল, ঠিক এমনটা সে বাংলোয় সোহার কেবিনেটের ভেতরও দেখেছিল। এগুলো কি? সোহার কোন মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি? কোন তন্ত্রমন্ত্র? নাকি এরও অজানা কোন অর্থ আছে। যা কেবল সোহার কাছেই অর্থবহ?
ঘুরে দাঁড়িয়ে লানা দেখল ইমাদ তখনও ফটোফ্রেম নিয়ে পড়ে আছে।
– কি অত দেখছ ইমাদ। চলো উপরটা দেখে আসি, যদি কিছু পাই।
ইমাদ ছোট ফ্রেমটা হাতে নিয়ে লানাকে দেখিয়ে বলল
– এই লোগোটা দেখছ লানা? অদ্ভুত না?
– এতে অদ্ভুতের কি আছে?
– আছে, কোথাও কিছু একটা আছে
– মানে?
ইমাদ কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করল, বলল
– ঠিক এমন কিছু একটা আমি অন্য কোথাও দেখেছি লানা।
– কোথায়?

ইমাদ ভাবল, বলল
– তোমার পেছনে, ঘাড়ে…
লানা চট করে নিজের ঘাড়ে হাত দিল। বলল
– আমার ঘাড়ে…?
– না… না… ঠিক তোমার ঘাড়ে নয়। ওটা ছিল সোহা। আমি সোহার ঘাড়ে, ঠিক চুলের নিচটাতে স্কিনের ওপর এই ট্যাটু টা দেখেছি।

লানা নিজের ঘাড়ের কাছের চুল সরিয়ে দেখাল ইমাদকে বলল
– দেখ তো, আছে এখানে?

ইমাদ ভালো করে দেখল, বলল
– নাহ্, তেমার ঘাড়ে আসবে কোত্থেকে। ওটা তো ছিল সোহার

– ইমাদ, তুমি লোগোটা কয়বার দেখেছ সোহার ঘাড়ে ? হতে পারে ওটা টেমপরারি
– বেশ কয়েকবার দেখেছি। টেমপরারি নয়, আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছি। জিজ্ঞেসও করেছিলাম। সোহা রহস্যময় হেসেছিল। জবাব দেয়নি।
– না, হতে পারে না
– কেন?

– কারণ আমি কখনই অমন ট্যাটু আঁকিনি ঘাড়ে। আর সোহা যখন আমার শরীরে আসে তখন আমার শরীরেই তো থাকার কথা ছিল ট্যাটুটা।
– ঠিক বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। তবে আমি শিওর, ওটা পার্মানেন্ট ট্যাটু ছিল এবং ফটোর এই লোগোটাই ছিল।

চিন্তার ভাজ পড়ল লানার কপালে। বলল

– তার মানে কি ট্যাটুটা অপরিবর্তনীয়?
– মানে?
– মানে, সোহার আত্মা আমার ভেতরে এলেও ওই লোগোটা ছেড়ে আসতে পারে না। ব্যাপারটা অদ্ভুত। একটা উল্কি, সোহার ঘাড়ে। আমার শরীরে স্থানান্তরিত হবার পরও উল্কিটা থেকে যায়। যাবার পর উল্কিটাও সাথে চলে যায়। কই, সোহার শরীরে যাবার পর আমার কোন চিহ্ন তো সোহার শরীরে পাইনি?

– কি সব আত্মাটাত্মা বলছ… আমার কেমন ভুতুড়ে ফিলিং হচ্ছে। ভয় লাগছে কিন্তু

– মজা করো না ইমাদ। ব্যাপারটায় কিছু একটা নিশ্চই আছে। ওটা তাহলে শরীরে আঁকা কোন সাধারণ উল্কি নয়।

ইমাদ হাত থেকে ফ্রেমটা ছুঁড়ে মারল টেবিলে। বলল
– বাদ দাও তো, চল উপরটা দেখে আসি।

লানা একটু দোনোমনা করে বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। তিন তালাটা প্রায় অন্ধকার। বিশাল একটা হলরুম। মনে হয় কোন পার্টি হল। লানা ঘুরেফিরে ছাদে উঠে এলো। ইমাদও পিছনে। বেশি দূরত্বে যেতে পারল না তারা। নিচে কেউ দেখে ফেলার ভয়ে।
কোমর সমান উঁচু রেলিং এ ঘেরা ছাদ। এখানে আর কিইবা থাকবে দেখার। তবু জোহারের ডায়েরী পড়ে এই ছাদটা দেখার ইচ্ছে ছিল লানার। লানা যেন কল্পনা করতে পারছে, ছাদ থেকে পিহুর পড়ে যাওয়াটা। ইমাদের স্পর্শে আতকে উঠল সে। ইমাদ বলল
– এবার ভালোয় ভালোয় ফেরা যাক।

লানা সন্মতি জানিয়ে নেমে এলো নিচে। আসার সময় দোতলা থেকে ট্যাটু আঁকা ফটোফ্রেমটা আনতে ভুলল না। লানাকে লুকিয়ে রেখে ইমাদ গেল বাড়ির পেছনটাতে। প্রায় মিনিট দশেক পর ফিরল হাতে একটা চাবি নিয়ে।

খুব দ্রুত তালা খুলে প্রথমে লানা পরে ইমাদ বের হলো। গেট বন্ধ করতে যাবার আগেই হাঁক শোনা গেলো দাঁড়োয়ানের। চাবিটা তালায় ঝুলিয়েই পড়িমড়ি করে দুজনেই দৌড়। একদৌড়ে গলির ওমাথায়। বাইকটা এখানেই ছিল। এক মুহূর্ত দেরী না করেই বাইক স্টার্ট করে উল্টোদিকে ছুটল ইমাদ।

ইমাদের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে বসে কিছুক্ষণ কথা হল দুজনার। কফি খেয়ে ইমাদ বিদায় নিল। লানা তিন বাই তিন, স্কয়ার সাইজ ফ্রেমটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর সেটা সাইড ব্যাগে পুরে বাসায় ফিরল।

নিজের ঘরে ফিরে অবাক হল সে। জেসি আর হাশেম আঙ্কেলের ব্যবস্থাপণায় রুমের চেহারা পাল্টে গেছে। বিছানাটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। নতুন সব ফার্নিচার কিনে আনা হয়েছে। লানার ঘরে আরবি হরফে লেখা বিশাল একটা ফলক লাগানো হয়েছে।
লানা হাশেম আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল
– এটা কি?
– এটা আয়াতুল কুরসী। অত্যন্ত শক্তিশালী। এটা ঘরে থাকলে জ্বীন ভূত কিচ্ছু আছর করতে পারবে না।
হাসল লানা।
– হাশেম আঙ্কেল, আমাকে জ্বীন ভূত কিচ্ছু আছর করেনি। এই যুগে দাঁড়িয়ে এসব হাস্যকর কথাবার্তা বলবে নাতো। দুর্বল লোকেরা এসব বিশ্বাস করে। ভূত আসলে আমাদের মনে।
– এই কথাটা ঠিক বলেছেন ছোটমনি। আসল ব্যাপার ওইটাই। আমাদের মনে একটা পজিটিভ আর একটা নেগেটিভ পাওয়ার থাকে। আমরা পজিটিভ চর্চা করলে পজিটিভ পাওয়ার বাড়ে আর নেগেটিভ চর্চা করলে নেগেটিভ পাওয়ার বাড়ে।

লানা ভ্রু কুচকে বলল
– কি বললে, আবার বলতো কথাটা?

হাশেম দেয়ালের ফলকটার দিকে তাকিয়ে বলল
– মনে করেন, এইটা একটা পজিটিভ পাওয়ার। আপনি শুধু মনে মনে এটার উপর বিশ্বাস রাখবেন। আর কিচ্ছু করতে হবে না।

লানা অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখল ফলকটা।
হাশেম আঙ্কেল লেখাপড়া জানা, বয়স্ক মানুষ। এ বাড়ির একজন গার্জেন এর মত। লানা তার ওপর আর কথা বাড়াল না। কেন যেন হাশেম আঙ্কেলের কথাটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।

পরদিন সকাল নাগাদ সুখবরটা পেল লানা। তার উকিল ‘ব্লু সি বিচ’ কেনার সমস্ত ডকুমেন্টস তৈরি করে ফেলেছে। এখন শুধু জোহারের আসার অপেক্ষা। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে লানা। কম্পানিটা সে জোহারকে গিফট করতে চায়। কিন্তু দিতে চাইলেই জোহার নেবে কেন? আচ্ছা থাক, জোহার না নিলে না নেবে। লানা কম্পানিটা মুন কে দিয়ে দেবে। যতদিন সম্ভব লানাই হ্যান্ডেল করবে। তারপর মুন বড় হলে, ‘ব্লু সি বিচ’ হবে মুনের।

সন্ধ্যা নাগাদ লানা আর থাকতে না পেরে জোহারের উকিলকে ফোন দিল। জানতে চাইল, জোহার ঠিক কবে ফিরছে?
উকিল সাহেব একটু দোনোমনা করলেন। তারপর স্তিমিত কন্ঠে জানালেন।
– ম্যাডাম, আসলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে..

একটা হার্টবিট যেন মিস করল লানা। ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইল
– কি হয়েছে…?
উকীল সাহেব ধীরে ধীরে বললেন,
– মিস্টার জোহার ইউ এস এ তে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
– না…! কিসব বলছেন আপনি?

লানার আর্তচিৎকারে উকিল সাহেব যেন হতভম্ভ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন

– ঘটনাটা সত্যি ম্যাডাম। গত সোমবার বিকেলে জোহার সাহেব তার পরিবার সমেত একটা রোড এক্সিডেন্টের শিকার হন। এ্যাকসিডেন্টে জোহার সাহেব আর তার মেয়ে স্পটডেড। শুধু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেছে তার ওয়াইফ, সোহানা আহমেদ সোহা।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here