#চোরাবালি_১২
রেশমা আক্তার
লানা হতভম্ভ! ডক্টর পার্থ এসব কি বলছেন? উনি সব জানতেন? তার মানে, সোহা ছোটবেলা থেকেই ওরকম? লানা দ্রুত আরও কিছু ভাবল। মনে হল, একমাত্র ডক্টর পার্থই সোহা সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিতে পারবেন। কিন্তু সোহা সম্বন্ধে উনি ঠিক কি কি জানেন তা বের করবে কিভাবে লানা?
লানা বলল
– ডক্টর, আপনাকে কীভাবে বুঝাই বলুনতো? আপনার ভীষণ বিপদ সামনে। সোহা আপনাকে টার্গেট করেছে মারবে বলে।
পার্থ, দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে লানার দিকে। বললেন
– তুমি কি চাও বলতো সোহা ? এত মৃত্যু দেখেও কি তুমি তৃপ্ত নও?
লানা চোখে হতাশা। সে নিরুত্তর তাকিয়ে রইল পার্থর দিকে। ডক্টর পার্থ বললেন
– আমি যখন থেকে তোমার ভেতরের এই অদ্ভুত ক্ষমতা সম্বন্ধে জেনেছি তখন থেকে সবসময় তোমাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছি। তুমি কেন আমাকে মারতে চাও? তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে, আর কারো প্রাণহাণি করবে না। তবে?
– এগজ্যাক্টলি ডক্টর, কিন্তু একটাবার বিশ্বাস করুন। আমি সোহা নই, আমি লানা। একদিন হঠাৎ ঘুমজেগে আমি দেখলাম, আমি সোহার শরীরে এই বাড়িতে। এরপর প্রায়শই চলল এই আসা যাওয়া। প্রথমে আমি এটাকে স্বপ্ন ভেবেছিলাম। পরে বেশ কয়েকবার আসা যাওয়া করতেই প্রমান পেলাম, এসব সত্যিই ঘটছে। শুধু তাই নয়, সোহা ট্রান্সফর্ম হচ্ছে আমার শরীরে। আমাদের দুজনার এই যাওয়া আসার মাঝে শুধু সামান্যকিছু সময়ের ব্যবধান। প্রথম এসেছিলাম ফার্স আগস্ট, দু’ হাজার উনিশে। অথচ আমি এসেছিলাম দু’ হাজার বাইশ থেকে। আমার বর্তমান সময় ঠিক থাকছে কিন্তু এখানে আমি আসছি একেকবার একেক সময়ে।
– এসব কি উল্টোপাল্টা বলছ সোহা?
– একদম উল্টোপাল্টা বলছি না ডক্টর। আপনার মনে আছে? জোহার আর সোহার এনিভার্সেরির কথা, সেবার? তারপর মুনের বার্থডে? আপনি কি সোহার আচরণে কোন পার্থক্য দেখেননি ডক্টর?
পার্থ মনে করার চেষ্টা করলেন, বললেন
– সেই পরিবর্তন তো এমনিতেও হতে পারে। তুমি তো প্রতিনিয়ত কোন না কোন অভিনয় করে যাচ্ছ। অসুস্থ হবার নাটক, মানসিক ভারসাম্যহীনতার নাটক। এখন আবার কেন তুমি নিজেকে ডুয়েল ক্যারেক্টার কনসিডার করছ সোহা?
– আমি ইচ্ছে করে করছি না ডক্টর, প্রথমে আমিও এটা নিজের মানসিক সমস্যা ভেবে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সব প্রমানিত। আমার কাছে প্রমান আছে ডক্টর।
– কি কি প্রমান আছে তোমার কাছে সোহা.. ওকে…. সরি…লানা?
লানা একটু ভাবল, ডক্টর পার্থকে সোহার লুকানো নোটবুকটার কথা কি বলা যায়? যদি সোহাকে বলে দেয়? তারপর সোহা যদি সচেতন হয়ে যায়?
লানা কথা ঘোরাল, বলল
– ডক্টর, সোহার অস্বাভাবিকতা তো আপনি স্বীকার করেছেন, তাহলে কেন বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, এমন ট্রান্সফরমেশন সোহার পক্ষে অসম্ভব নয়?
চিন্তিত হলেন পার্থ। বললেন
– আমাকে ভাবতে হবে। চট করে আমি তোমাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিছুই করতে পারি না। দেখি পায়ের জখমটা দেখাও। ড্রেসিং লাগতে পারে। আমাকে যেতে হবে। ।
লানার খুব কান্না পাচ্ছে। লোকটা তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেন? চোখের পানিটা ফেরত পাঠিয়ে সে মাথা ঝাঁকাল, বলল
– ডক্টর আমি সোহা নই, লানা। আমার পায়ে কোন জখমটখম নেই। আপনি ওসব বাদ দিন, কোথায় যাবেন, যান।
ডক্টর পার্থ স্থির চোখে তাকালেন। বললেন
– আচ্ছা তবে তো প্রমান হয়েই যাবে, তুমি লানা নাকি সোহা…
লানার দৃষ্টিও স্থির হল। সত্যি, তার পায়ে কিসের জখম বা কি ব্যাপার তাতো দেখা হল না। লানা তার ঢোলা ট্রাউজারটা হাঁটুর দিকে ওঠাতেই আঁতকে উঠল। হাঁটুর নিচে একটা দগদগে জখম। উন্মুক্ত, ব্যান্ডেজ ছাড়াই। ওপরে সাদা পাউডারের মত কিছু লাগানো হয়েছে মনে হচ্ছে।
ডক্টর স্বান্তনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন। তুমি বিছানায় উঠে বস, আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি।
লানা বসতে বসতে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল,
– এখানে কি হয়েছিল আমার?
ডক্টর পার্থ এ প্রশ্নে সামান্য টললেন মনে হল।
একটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের টানাপড়েন যেন। পায়ে কাজ করতে করতে বললেন,
– এটা এক ধরনের সেল্ফহার্ম…
– সেল্ফহার্ম মানে…?
– নিজের পায়ে নিজেই ফুটন্ত পানি ঢেলে দিয়েছিলে।
– মানে?
ডক্টর পার্থ হাসলেন, ব্যাঙ্গাত্মক
– রুমকি সঠিক সময় থামিয়ে না দিলে, পানিটা মুনের গায়ে পড়ত। আর এই থামিয়ে দেয়াটাই রুমকির মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
– ডক্টর…? কি বলছেন আপনি?
– আমি বলছি, তুমি এবার থামো সোহা! আর কত? নিজের একটা সন্তান চলে গেছে। একটা পশুও নিজের সন্তান চেনে। আর তুমি মা হয়ে… এসব কেন করছ সোহা…? নিজের পরিবারটা শেষ করে দিও না
– উফ্…. আপনি থামুন ডক্টর। সত্যিই ঘেন্না হচ্ছে আপনাকে। একটা খুনী, পিশাচকে আপনি দিনের পর দিন সাহায্য করে গেছেন। তাকে আর তার অপরাধগুলোকে আড়াল করেছেন। কেন বলুনতো? কেন আপনি ওকে ধরিয়ে দিলেন না পুলিশের হাতে। যথেষ্ট প্রমান তো ছিল আপনার হাতে। বরং উল্টো আপনি ওকে আরও মানুষ মারার সুযোগ করে দিচ্ছেন?
ডক্টর পার্থ বিচলিত বোধ করলেন। তীক্ষ্ণচোখে দেখলেন লানাকে। তবুও যেন দ্বিধামুক্ত হতে পারলেন না।
– এখনও সময় আছে ডক্টর, সোহাকে থামান। নইলে আপনিও রক্ষা পাবেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা মুন, ওই শিশুটার কথা ভাবুন। জোহারের কথা ভাবুন। নিজের স্ত্রীকে সে ভীষণ ভালোবাসে ডক্টর। সে আপনাকে বিশ্বাস করে। এতগুলো প্রাণহাণীর করণ হবেন, শুধু আপনি?
– আ’ম হেল্পলেস সোহা… ও আচ্ছা.. লানা…
– কিসের ভয় আপনার? এতদিন আপনি সোহাকে হেল্প করেছেন তাও তো সে আপনাকে মারার কথা ভাবছে। একটা উপায় ভাবুন ডক্টর। সোহার সাথে এই যে আমার ট্রান্সফরমেশন, এটা কি সোহার ইচ্ছেতে হয়েছে নাকি প্রকৃতিগত?
– প্রকৃতিতে কোন অনিয়ম নেই। প্রকৃতি অনিয়ম সহ্য করে না।
– কিন্তু প্রকৃতি অফুরন্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং খেয়ালী, এটা তো মানেন ডক্টর। এ পৃথিবীতে এমন হাজারটা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের উদাহরণ রেখেছে প্রকৃতি নিজেই।
ডক্টর পার্থ যেন অন্যমনস্ক, বললেন
– অদ্ভূত! দুজন মানুষ, একে অপরের শরীরে জেগে উঠছে। আমি এখনও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না…
লানা হতাশ কন্ঠে বলল
– আপনাকে বিশ্বাস করানোর উপায় আমার জানা নেই ডক্টর। তবে আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমরা সবাই সোহার শিকার হওয়ার অপেক্ষায়। কে আগে কে পরে আমরা জানি না। তবে সোহা সম্বন্ধে যদি সব খুলে বলতেন, হয়ত একটা উপায় আমরা পারতাম খুঁজে বের করতে।
ডক্টর পার্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নত করলেন। তার হাতের কাজ শেষ। সে নিজের ব্যাগ গুটিয়ে নিল।
যাবার সময় বলল
– আমার হাতে কিছু নেই।
ডক্টর পার্থ চলে গেলেন। নিরুপায় আর হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল লানা।
একদিনে বুঝবেন না ডক্টর পার্থ। তাকে আরও বোঝাতে হবে। কিন্তু ততটা সময় কি পাবে লানা?
মুনের ওই ছোট্ট শরীরে ফুটন্ত পানি ঢালতে চেয়েছিল সোহা? ও কি মানুষ? অবশ্যই না। ভাবতেই টনটন করে উঠল পায়ের জখমী জায়গাটা। উহ্ শব্দ করে বসে পড়ল লানা। এই একটু আগ পর্যন্তও লানা জানত না তার পায়ে এত বড় একটা জখম। নিজের ক্ষত জায়গাটা দেখে তবু খুশি হল মনে মনে। ভাবল, একদম উচিৎ শিক্ষা হয়েছে সোহার।
কিন্তু রুমকি না হয় একবার বাঁচিয়েছে মুনকে। নিজেও সে কারণে প্রাণ দিয়েছে। এরপরে কে রক্ষা করবে মুনকে? আচ্ছা জোহার কি সোহার উদ্দেশ্য কিছুটা বুঝতে পেরেছিল? নইলে মুন কে অমন আগলে আগলে রাখছে কেন? জোহার কেন মুনকে নিয়ে দূরে কোথাও সরে যাচ্ছে না? এই মেয়েটাকে ভালোবেসে, তার সাথে ঘর করবে বলে এত স্যাক্রিফাইস করছে লোকটা। অথচ লোকটা জানে না যে সোহার হাতেই ঘটতে চলেছে তার মৃত্যু।
লানা হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেল। টাল সামলাতে না পেরে ধড়াস করে গিয়ে পড়ল কেবিনেটের পাল্লায়। লানার শরীরের ভারে পাল্লার স্লাইড সরে গেল। লানা ঢুকে গেল একগাদা হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কাপড়চোপড়ের মধ্যে। নিজের পতন নিশ্চিত হলে চোখ খুলল লানা। গায়ে জাপটে থাকা কাপড়গুলো দূরে ছুড়ে মারল বাইরে ফ্লোরে। পায়ে ক্ষতটাতে লেগেছে খুব। লানা দাঁত পিশে সহ্য করার চেষ্টা করল যন্ত্রণাটা। সে বসে পড়েছে একটা বিশাল ফাঁকা কেবিনেটের ভেতর। এদিকটা কখনও খুলে দেখেনি লানা। কেমন একটা ধূপ- ধূপ গন্ধ। লানা চারিদিকে দেখল, দেয়াল কেবিনেটের বড় একটা অংশ ফাঁকা। উপরে কিছু কাপড় হ্যাঙ্গারে ঝুললেও নিচটা ফাঁকা। লানা সেখানেই বসে পড়েছে। নিচে কিছু বিচিত্র আঁকাআঁকি। কিছু কাগজে বিচিত্র ম্যাপ আর নকশা। কেবিনেটের ভেতরকার দেয়ালগুলোতেও রঙিন চক দিয়ে বিভিন্ন ছবি আঁকা, তবে সেগুলোর নির্দিষ্ট কোন আকৃতি নেই। তবে কয়েক জায়গায় সাপের মত কিছু আঁকা আছে। লানা তার সামনের কাপড়গুলো সরালো। বিস্ময়ে বড় বড় হল তার চোখ। অনেকগুলো মানুষের মাথা সদৃশ্য ছবি আঁকা
আর কিছু ছবি ক্রস দিয়ে কাটা।
লানার মনে পড়ল, আজ জোহার বলেছিল, সোহা অন্ধকারে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, মনে হয় কোন ধ্যান করছে।
এসব কি? কোন ব্ল্যাক ম্যাজিক টাইপ কিছু?
সোহা কি তন্ত্রমন্ত্র করে নাকি। এই জামানায় এসব হয়? কি হচ্ছে এসব? জোহার কি এসব খোঁজ রাখে না? বাড়ির কোথায় কি চলছে, কোথায় কি আছে, জোহারের কি কোন হুশ নেই?
লানা অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। সে ছুড়ে ফেলা কাপড়গুলো আবার নিয়ে এসে জায়গামত রাখল। কেবিনেটের পাল্লা ঠিকমত রেখে, গুছিয়ে নিল নিজেকে। তাকে জোহারের মুখোমুখি হতে হবে। যে করে হোক জোহারকে সাবধান করতে হবে। সাথে তার আরও একটা বিষয় মনে এলো। শাহের এখন হসপিটালে। যেহেতু সোহার টার্গেট ছিল শাহেরকে মেরে ফেলা, তাহলে এখন কি সোহা চাইবে শাহের সারভাইব করুক? শাহেরের কোন বিপদ হবে নাতো?
লানা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিচে নামল। জোহার কোথায় জানে না সে। সেকি একবার যাবে জোহারের ঘরে?
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হবে। লানা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে জোহারের নাম ধরে বার দুয়েক ডাকতেই বেরিয়ে এলো জোহার।
– জোহার… জোহার আমার তোমার সাথে কথা আছে জরুরী… প্লিজ নিচে এসো।
জোহার বিস্মিত চোখে তাকিয়ে নেমে এলো নিচে। এমন গলায়, নাম ধরে সোহা তাকে ডাকেনি কখনও।
সামনে মুখোমুখি হতেই লানা জোহারের হাত ধরে নিয়ে টেবিলে বসাল। মুখোমুখি বসে বলল
– জোহার, আমার কিছু কথা তুমি মন দিয়ে শোন। বিশ্বাস কর বা না কর, কথাগুলো মাথায় রেখে দাও।
– হঠাৎ কি হল তোমার সোহা?
– জোহার শোন, প্রথমত, আমি এখন সোহা নই। আমি লানা। আমি এসেছি দু’ হাজার বাইশ থেকে। তোমার এখনকার সময়ের সামান্য আগের সময় থেকে। এটা কিভাবে, তার ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দিতে পারব না।
– আজ আবার কি শুরু করলে?
– জোহার প্লিজ, বললামতো বিশ্বাস করতে হবে না, শুধু শোন আর মাথায় রাখো। দ্বিতীয় কথা হল, এ বাড়িতে সোহার কিছু গোপন ব্যাপার স্যাপার আছে, একটু নজর দিলেই কিছু রহস্য বুঝতে পারবে তুমি। তৃতীয়ত, খুব সাবধান। মুন আর তোমার খুব বিপদ। সোহা থেকে মুনকে একটু সাবধানে রাখবে।
জোহার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। একটু ভারাক্রান্ত গলায় বলল
– প্লিজ স্টপ দিজ ননসেন্স, সোহা। আমার মনটা একদম ভালো নেই। আমাদের প্রিয়, স্বপ্নের ‘ব্লু সি বিচ’ ব্যাংক বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। তিনমাস সময় দিয়েছে যদিও। কিন্তু তাতে কোন সুরাহাই হবে না। আমেরিকায়, তোমার বাবাকে জানিয়েছিলাম। তিনি কোন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। বরং এসব ব্যাপারে তার যে কোন ইন্টারেস্ট নেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। তোমার ওপর রাগটা তার যায়নি এখনও। তাই ভাবছি, সশরীরে তোমাদের নিয়ে একটাবার যাব আঙ্কেলের কাছে। পুরো ব্যাপারটা শুনলে যদি বোঝেন….
লানা, জোহারের হতাশাটা বুঝতে পারল। বলল
– ব্যাংকের কাছে কত দেনা আছে তোমার?
জোহার মাথা নাড়াল না সূচক। চোখ বন্ধ করে বলল
– ওসব শুনে তোমার দরকার নেই। আমি বড্ড অযোগ্য প্রমান হয়ে গেলাম সোহা, তোমার বাবাকে মুখ দেখাবার কোন পথ নেই আর আমার
– তাহলে যাচ্ছ কেন জোহার। এসো আমরা দুজনে মিলে চেষ্টা করি। একটা না একটা পথ নিশ্চই বের হবে। ‘ব্লু সি বিচ’ কে আবার আগের জায়গায় ফেরানো যাবে নিশ্চিত।
জোহার অপলক, কৌতূহলে তাকিয়ে থাকে সোহার দিকে। সেবার তার অফিসের একজন এমপ্লয়ি একটা পেনড্রাইভ দিয়ে বলেছিল, ” বস, এই পেনড্রাইভটা ম্যাডাম কে একটু পৌঁছে দেবেন। ম্যাডাম চেয়েছিলেন।”
ভেতরে কি আছে জানতে চাইলে ছেলেটি যা বলল, তাতে আক্কেলগুড়ুম জোহারের। সোহা নাকি তার কম্পানীর সমস্ত হিসেব আর বর্তমান স্ট্যাটাসটা দেখতে চেয়েছে।
অবাক করা ব্যাপার হল, সোহা কখনই কম্পানীর কোন ব্যাপারে আগে নাক গলায়নি। দ্বিতীয়ত, সোহা ভালোমত কলেজের গন্ডিই পার করেনি। তার পক্ষে এ কৌতূহল অমূলক তো বটেই। তবু পেনড্রাইভটা নিয়েছিল জোহার। এনে সোহাকে দিয়েওছিল। সোহা সেটা তাচ্ছিল্যপূর্ণভাবে নিয়েছিল এবং পরবর্তিতে সেটা মুনের খেলনার সরঞ্জামে গড়াগড়ি খেতে দেখা গেছে। মনে মনে হেসেছিল জোহার। কি জানি, কম্পানীর দুরবস্থার কথা শুনে হয়ত কষ্ট হয়েছিল সোহার। তাই না বুঝেই ওসব করেছে।
তবে এই যে আজও সোহা কেমন সহমর্মীর মত কথা বলছে, ঘুরে দাঁড়াবার কথা বলছে, অমূলক হলেও ভালো লাগছে।
জোহার নিজের দুহাতে, লানার দুটি হাত চেপে ধরল। ঝুঁকে এসে বলল
– কম্পানী হয়ত বাঁচাতে পারব না সোহা। কিন্তু বিশ্বাস কর, এই যে তুমি পাশে থাকতে চাইছ, আশা- ভরসার কথা বলছ, এটুকু থাকলেই আমার চলবে। আমি আবার নতুন করে পারব ঘুরে দাঁড়াতে।
– জোহার, আমি থাকি বা না থাকি, তুমি থাকবে, মুন থাকবে। তোমরা নতুন করে বাঁচবে। তোমাদের ওপর কোন অমঙ্গলের ছায়া আসতে পারবে না। শুধু একটু আমার কথাটা শোন।
– কি বলতে চাইছ?
– তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে, এই যে আমাকে দেখছ, এই আমি তোমার স্ত্রী সোহা নয়। আমি লানা। একটা অদ্ভুত উপায়ে আমি আর সোহা হঠাৎ হঠাৎ একে অপরের শরীরে জেগে উঠছি। তুমি কি আমার উপস্থিতি বা সোহার ব্যবহারে কখনও কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করনি জোহার? মনে কর, মনে করে দেখ সেই যে সন্ধ্যায়, আমি তোমাকে গান শুনিয়েছিলাম? সেই যে হাতে হাত রেখে অনেকটা সময় হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা? তারপর সেবার তুমি আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলে, সোহা আর তোমার এ্যানিভার্সেরী…? আর সেবার যে ঝড় বৃষ্টির রাতে, তোমার অনেক জ্বর হলো, কি ভীষণ কাঁপুনী, আমি সারারাত তোমাকে শক্ত করে ধরে থাকলাম…. জড়িয়ে….? তারপর, সেদিন সন্ধ্যায়, উপরে আমি বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রকিং চেয়ারে। তুমি এলে… আমাকে কাছে টানলে…..
নিজের অজান্তেই, কথা বলতে বলতে লানার দু’ চোখ ছাপিয়ে গেছে কখন, টের পায়নি লানা।
জোহার কপাল কুঁচকে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় তাকিয়ে আছে লানার দিকে। হয়তো মেলানোর চেষ্টা করছে।
লানার অপ্রস্তুত লাগছে জোহারের সে অবিশ্বাসী দৃষ্টির কাছে। সে সংকুচিত হল। আড়ষ্ট গলায় বলল
– বিশ্বাস কর জোহার, আমি তখনও ভেবেছিলান ওসব আমার স্বপ্ন। স্বপ্নে আমি জোহার নামক একজন মানুষের স্ত্রী হয়ে উঠছি, মুনের মা হয়ে উঠছি। এ সংসারটাকে নিজের সংসার ভেবেই কেটে গেছে কতদিন। বাট বিলিভ মি, আমি জেনে বুঝে তোমার এতটা কাছে আসিনি।
জোহারের প্রশ্নাতুর, কৌতূহলী চোখে কোন ভাবান্তর নেই। লানা ভাবল, সে হয়ত পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পেরেছে জোহারকে।
বলল
– জোহার, আমাদের হাতে সময় নেই। সোহা আমাদের কাউকে ছাড়বে না। প্লিজ তুমি মুনকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। সোহা মেরে ফেলবে তোমাদের।
লানা নিজের মাথার মধ্যে আবার সেই ভোঁতা যন্ত্রণাটা টের পেল। তার শরীর টলছে। তবে কি যাবার সময় হয়ে গেল? না, সে আরও কিছুক্ষণ থাকতে চায় জোহারের সামনে। জোহারকে তার আরও কিছু বলার আছে। এরপর ফিরে আসাটা কঠিণ হতে পারে। অতীত অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে লানার বর্তমানের দিকে। লানার কেন জানি মনে হচ্ছে জোহারের সাথে দেখা হবে না আর। জোহার চলে যাবে আমেরিকায়। কিন্তু জোহার কি বিশ্বাস করল তাকে? ও তো কোন কথাই বলল না।
লানা উঠে দাঁড়িয়েছে। নিজের মাথা চেপে ধরে বলল,
– জোহার… বিলিভ মি। ডক্টর পার্থ, সোহার ব্যাপারে সব জানেন। এ বাংলোতে আরও অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে। তুমি খুঁজো।
জোহার টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– তুমি টলছ কেন, আর ইউ ওকে সোহা?
লানা সত্যিই টলছে। জোহার দ্রুত গিয়ে ল্যান্ডলাইনে কল দিলো ডক্টর পার্থকে
– ডক্টর, সোহার শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ করেছে।…. হ্যা…. কি সব উল্টোপাল্টা বলছে… মনে হচ্ছে ওর সেই ডুয়েল পারসনালিটি ডিসঅর্ডারটা ফিরে আসছে আবার। ডক্টর প্লিজ একবার আসুন। সোহা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমি রাখছি ডক্টর….
(চলবে)