হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব ৩০+৩১

0
395

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩০]

ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই। নিরিবিলি এলাকা যেন আরও গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। দূর দূরান্ত থেকে কোনো রকম হাক-ডাক শোনা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র নির্জন রাস্তায় নিয়ন আলো বিস্তৃত।

সিদাত প্যান্টের পকেটে হাত জোড়া পুরে ল্যাম্পপোস্টের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ভাসছে তরীর মুখখানা। বর্তমানে তরীদের এপার্টমেন্টের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সে। কেন দাঁড়িয়ে আছে জানে না, তবে তীব্র অস্থিরতায় সে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। সিদাতের চুলগুলো এলোমেলো, মুখটাও কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। অফিস থেকে সোজা এখানেই এসেছে সে। বাইকটা তার কাছাকাছি পার্ক করে রেখেছে।

সিদাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা তুলে তরীদের এপার্টমেন্টের দিকে তাকাল। আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। তরীকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা ভালোই কাবু করেছে তাকে। কিন্তু সে তরীর বাবার মুখের ওপর কী বলবে? আকবর সাহেবের মতো লোককে বলবে, সে তরীকে ভালোবাসে? এটা শুনলে তো আরও দূরে সরিয়ে রাখবে তরীকে। কেমন দম বন্ধকর পরিস্থিতি সিদাতের। আগে কখনো এরকম অনুভূতি হয়নি। পেতে পেতে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার শূন্যতা সহ্য করার ক্ষমতা ক’জনের আছে?

জয়ার আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। হাতে কারো স্পর্শ অনুভব করতেই সে পাশ ফিরে তাকাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারল না। পারলে হয়তো দেখতে পেত তার বিধ্বস্ত ছোটো ছেলেকে। জয়া তাও সিদাতের নিজস্ব পারফিউমের জন্যে তাকে চিনে ফেলল। মা যতই অচল হোক না কেন, সন্তানের ঘ্রাণেই সে উপলব্ধি করতে করতে পারে তার পাশে কোন সন্তান আছে।

সিদাত জয়ার দিকে তাকাতেই কিছুটা চমকালো। আমতা আমতা করে বলল,
–“ঘুমাওনি?”

জয়া কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। সিদাত চটজলদি নিজের চুল ঠিক করে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে মায়ের দৃষ্টি সীমানার কাছাকাছি গেল। জয়া ছেলের মুখটার দিকে অপলক চেয়ে রইলো। সিদাতের নাক লাল, চোখ জোড়াও কেমন যেন, লাল লাল! চোখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তা, বিষাদ ফুটে ওঠেছে। জয়া সেই চোখ পড়ে নিল। মা নাকি সন্তানকে দেখেই ধারণা করতে পারে তার ভেতরে কী চলছে। এবারও এই প্রবাদের ব্যতিক্রম হলো না। সিদাত হাসি-মুখে নানা কথা বলছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার তরীকে নিয়ে বলছে না, আগের মতো প্রাণখোলা নেই তার ছেলে।

এসব চিন্তা করে জয়াও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সিদাত কোনো রকমে শেষে বলল,
–“মা, খুব ঘুম পাচ্ছে। তুমিও ঘুমাও। আমি যাই হুঁ?”

বলেই সিদাত মায়ের হাতের পিঠে চুমু দিয়ে চলে গেল। আর জয়া নির্ঘুম সময় কাটাতে লাগল।

তরী আগের মতোই চলাচল করছে। তবে আগের মতো সিদাতকে পথে দেখতে পায় না। তরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এতে। তবে তাও কিছু একটা ফাঁকা লাগছে তার নিকট। তবে তরী তোয়াক্কা করল না। সবসময়ই নিজের মতো চলাফেরা করে। সিদাতকে যে আকবর সাহেব মেনে নিবে না এটা তরী আগে থেকেই জানত।

আরও এক সপ্তাহ কেটে গেল। হঠাৎ আকবর সাহেবের মোবাইলে কল এলো। ঘুমন্ত আকবর সাহেবের এতে ঘুম ভেঙে যায়। কোনো রকমে মোবাইলটা হাতে নিয়ে পিটপিট করে তাকালো। এরপর ধীরে-সুস্থে উঠে বসে বিছানার পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাল। আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। আকবর সাহেব হাই তুলে কল রিসিভ করল। সালাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে-ই ওপাশ থেকে কেউ অস্থির হয়ে বলল,

–“দোহাই লাগে ভাই সাহেব। আপনি প্লিজ একটু কষ্ট করে আপনার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আসুন। এক অভাগা স্বামীর এই অনুরোধটা পূরণ করুন ভাই সাহেব। আমি আপনাকে হাসপাতালের ঠিকানা বলছি!”

আকবর সাহেব যেন আকাশ থেকে পরল এই ধরণের কথা শুনে। আকবর সাহেবের বুঝতে বাকি নেই এটা কার গলা। ব্যস্ত হয়ে আকবর সাহেব ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত প্রায় আড়াইটা। আকবর সাহেব বলল,
–“কিন্তু হঠাৎ, হাসপাতালেই কেন?”

সাঈদ সাহেব ভাঙা গলায় বলল,
–“আমার স্ত্রীর অবস্থা ভালো না। আজ দু’দিন যাবৎ হাসপাতালে ভর্তি। এখন অবস্থা ক্রিটিকাল। আপনার মেয়েকে দেখতে চাইছে। দয়া করে আসুন ভাই সাহেব। নয়তো আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না!”

আকবর সাহেবও ভড়কে গেল। কোনোরকমে বলল,
–“আসছি!”

আকবর সাহেব চটজলদি স্ত্রীকে ডেকে তুলল। কামরুনকে অল্প করে ঘটনা বুঝিয়ে দিয়ে তরীকে ডাকতে চলে গেল। তরী ঘুমায়নি আজ। স্কেচ করছিল বারান্দায় বসে। হঠাৎ এত বিকট কড়াঘাত শুনে তরী ভীষণ ভড়কালো। তরী সব গুছিয়ে জলদি করে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই আকবর সাহেব ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

–“তাড়াতাড়ি তৈরি হও মা। হাতে সময় নেই।”

–“কিন্তু কোথায় যাব বাবা?”

আকবর সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–“হাসপাতালে।”
বলেই আকবর সাহেব ব্যস্ত হয়ে ছুটল নিজের ঘরের দিকে।

—————
হাসপাতালে কেবিনের বাইরে করিডরে প্রায় কম-বেশি সবাই উপস্থিত। ফিরোজা একপাশে বসে কাঁদছে। জয়া তার একমাত্র বান্ধুবী। জয়ার সাথে তার সখ্যতা আজীবনের। ফিরোজার বিপদে একমাত্র জয়াই তাকে কাছে টেনে নিয়েছে। সারাজীবন জয়ার জন্যে করে গেলেও তার ঋন শোধ হবে না। সেই পরম বন্ধুর এত করুণ অবস্থা কীভাবে সহ্য করবে সে?

সিদাত এবং সাইফ এদিক সেদিক ছুটছে। মাঝেমধ্যে সিদাত নিজেকে সামলে বাবাকেও সামলাচ্ছে। অত্যন্ত কঠোর, শক্ত মানুষটা আজ কেমন ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। ফিরোজার পাশে দিয়া এবং দিয়ার মা। জয়ার অসুস্থতার কথা শুনে দিয়ার বাবা-মাও ছুটে এসেছে। অনয় আসতে পারেনি। অফিসের কাজে সে ঢাকার বাইরে গিয়েছে।

মিনিট দশেকের মাঝেই আকবর সাহেব তরীকে নিয়ে ছুটে এলো। সিদাত তাদের দেখে ঢোঁক গিলে কোথাও চলে গেল। আকবর সাহেব সাঈদ সাহেবের কাছে এগিয়ে এসে তার পাশে বসল। তাকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। সাইফ তাদের দেখতেই দ্রুত সিদাতকে ধরে আনলো। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
–“মা তরীকে দেখতে চাইছে! চাইলে আপনারা দুজনও ভেতরে আসতে পারেন। ডাক্তারের থেকে অনুমতি নিয়েছি!”

তরী আকবর সাহেবের দিকে তাকাল। আকবর সাহেবের মুখখানাও বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে। আসার পথে সে কয়েকবার বলেছিল,
–“সিদাতের মায়ের কিছু হলে আমি নিজেকে বোধহয় ক্ষমা করতে পারব না মা!”

তরী এই কথার অর্থ বুঝেনি। তবে সিদাতের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তরী সে-কথার অর্থ বুঝতে পেল। অতঃপর তারা পাঁচজন ভেতরে প্রবেশ করল। ডাক্তার, নার্স ছোটাছুটি করছে। জয়ার মুখে অক্সিজেন মাস্ক। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে না। এই প্রথম তরী সিদাতের মাকে দেখল। জয়ার এই করুণ অবস্থা থেকে তরীর চোখ জোড়া ভেঙে পড়ল। ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। আড়চোখে সিদাতের দিকে তাকাল একবার।

সাঈদ সাহেব তরীকে নিয়ে জয়ার সম্মুখে আনল। তরী সঙ্গে সঙ্গে তার নিকাব খুলে ফেলল। সাঈদ সাহেব তরীকে দেখিয়ে বলল,
–“এইযে দেখ জয়া। তোমার ছোটো বউমাকে নিয়ে এসেছি!”

জয়া দেখল নীরবে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন এলো না। তবে ধীরে ধীরে সে কিছুটা ঝিমিয়ে এলো। সাঈদ সাহেব পিছে ফিরে করুণ নয়নে আকবর সাহেবের দিকে তাকাল। তরীকে জয়ার কাছে রেখে সাঈদ সাহেব আকবর সাহেবের কাছে এগিয়ে গেল। ভাঙা গলায় হাত জোর করে বলল,

–“দয়া করে আপনার মেয়েটিকে আমার ছেলের বউ করে দিন ভাইজান। আমার স্ত্রী যখন শুনেছে আপনি না করে দিয়েছেন তবে থেকেই নানান দুশ্চিন্তায় আজ সে হাসপাতালে ভর্তি। দয়া করে তার চাওয়াটা পূরণ করুন ভাইজান। আমার ভুলের শাস্তি আমার ছেলে আর স্ত্রী কেন ভুগবে? আমি আর এই অশান্তি নিতে পারছি না।”

সাঈদ সাহেব খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। আকবর সাহেবও এই কঠিন পরিস্থিতিতে ডুবে গিয়েছে। সাঁতরে কিছুতেই আলোর দেখা পাচ্ছে না। তবে এই কঠিন মুহূর্তে এসেও সবটা আল্লাহ্’র উপর ছেড়ে দিলেন। আকবর সাহেব তরীকে কাছে ডাকলেন। তরী আবার নিকাব বেঁধে বাবার কাছে এগিয়ে এলো। আকবর সাহেব অধরে কিছুটা ফাঁক করে সাঈদ সাহেবের সামনেই তরীকে বলল,

–“আজ তোমাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে মা!”

তরী জিজ্ঞাসু নজরে বাবার দিকে তাকালো। আকবর সাহেব থেমে আবার বলল,
–“তোমাকে সিদাতকে বিয়ে করতে হবে। তুমি কী এতে রাজি? তোমার মতামত এই বিয়েতে অবশ্যই প্রয়োজন!”

তরী একপলক সিদাতের দিকে তাকালো। শূন্য নজরে মায়ের দিকে চেয়ে আছে সিদাতের পানে। এই সিদাত-ই সেদিন হাস্যোজ্জ্বল মুখে তরীকে বলেছিল,
–“জানো, আমি খুব ভাগ্যবান। আমি দুই মা পেয়েছি। এবার তুমিও ভাগ্যবতী হবে, কারণ আমার তরফ থেকে জোড়া মায়ের ভালোবাসা পাবে।”

তরীর কানে কথাগুলো বারবার বাজছে যেন। আজ সিদাতের এক মায়ের অবস্থা ভালো না। এই মা-ই নাকি তরীকে না দেখেই নিজের ছেলের জন্যে পছন্দ করেছে। তার জন্যে হাসপাতাল অবধি পৌঁছে গিয়েছে। তরী দম ফেলে বলল,
–“আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা!”

সাইফ যেন কাজী আগে থেকেই ঠিক করে বসে ছিলো। তরীর মতামত শুনে সাইফ তৎক্ষণাৎ কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বিয়ে এক্ষুণি তার মায়ের সামনেই হবে। এদিকে সিদাত অনুভূতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো মধ্যেই সেরকম আনন্দ নেই, উচ্ছাস নেই। শুধুমাত্র এই পরিস্থিতিতে এসে যেন জয়া একটু হাসার চেষ্টা করল।

অবশেষে বিয়ে সম্পূর্ণ হল। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে যে কেউ সেরকম সামলে উঠতে পারেনি। আসলেই, পরিস্থিতি মানুষকে কতটা অসহায় করে তোলে। সিদাত, তরী এক সঙ্গে এগিয়ে যায় জয়ার কাছে। জয়া চোখের সামনে সিদাতের বিয়ে দেখলো, তার সকল চাওয়া যেন পূরণ হয়ে যায়। দিয়া তরীকে নিকাব খুলতে বললে তরী নিকাব খুলে ফেলল। দিয়া জয়ার হাত ওঠাতে সাহায্য করলো। কম্পিত হাতে তরীর মাথায় স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যদিই দিয়া-ই জয়ার হাত নাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জয়ার মন থেকে স্নেহ, দোয়া আসছে। মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে সহস্র কথা বলেছে সে। হাজারো যন্ত্রণা যেন এই সুখের কাছে কিছুই না। সে তরীকে পছন্দ করে ভুল করেনি, তা নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করল। তরী জয়ার হাতটা তার হাত জোড়ার মুঠোয় নিয়ে খুবই নরম গলায় বলল,

–“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন মা!”

জয়া হঠাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল। অতি সুখে তার চোখের কোণ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

তরীর চাওয়াটা বোধহয় পূরণ হল না। সকল ছেলেরা যখন ফজরের নামাজ পড়তে চলে গেল তখন জয়ার অবস্থা আবারও খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তার’রা আবার তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তরী এখনো জয়ার হাত ধরে বসে আছে। মনে-প্রাণে দোয়া করছে মানুষটাকে সুস্থ হয়ে ওঠার কামনায়। দিয়ার চোখ জোড়া ভিজে যাচ্ছে বারবার। খবর পেয়ে ছেলেরা দ্রুত চলে আসে। তারা সবাই কেবিনে আসতেই জয়া হঠাৎ কেমন নিথর হয়ে গেল। চোখ উলটে গেল তার। কথা বলতে না পারা জয়া হঠাৎ-ই মিনমিন করে কালেমা পড়লো। অতঃপর…

হঠাৎ চারপাশে কান্নার শব্দ বেড়ে গেল। আকবর সাহেব ব্যথিত চিত্তে জয়ার দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
–“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩১]

বেশ কিছু নিউজ চ্যানেলে শিরোনাম ঘুরছে। সংসদ সদস্য সাঈদ আহমেদের স্ত্রী অনেকদিন অসুস্থ থাকার পর মূর্ছা গিয়েছেন। সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে এবং সমালোচনার তুঙ্গে সাঈদ আহমেদের দুই স্ত্রী এক সাথে এতদিন এক ছাদের নিচে ছিল। সাধারণ মানুষকে মৃ*ত্যুতে শোকাহত হওয়ার বদলে কৌতুহলী দেখাচ্ছে বেশি।

সাঈদ সাহেবের বাড়ির বাইরে সাংবাদিক’রা ভীড় করছে। তারা যেকোনো মূল্যে সাঈদ সাহেব, সাইফ কিংবা সিদাতের সাথে একবার দেখা করে প্রশ্ন করতে চাইছে। এদের প্রশ্নগুলা অযাচিত! যা একজন মানুষকে আরও ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে। এজন্য এদের কারো সাথেই দেখা করেনি। নিজেদের সময়গুলো তারা নিজেদের মধ্যেই ব্যয় করছে। আপনজন সাঈদ সাহেবদের খুইয়েছে তাই তারা জানে আপনজন হারানোর কষ্ট কী!

জয়ার লাশ ভেতরের রুমে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে মহিলারা বসে আছে। পরিবারের মানুষ ব্যতীত সকলেই কোরআন পড়ছে। জয়ার কাছে-পিঠে আগরবাতি জ্বলছে। তরী চোখে পানি নিয়ে কুরআন পড়ছে। তরীর বাবা সকালেই কামরুন নাহার এবং সাবিয়াকে নিয়ে এসেছে।

তারা বিয়ে নিয়ে কিছু বলার আগে এরকম একটি ঘটনা ঘটে যাবে সত্যি কল্পনা করেনি। আসলেই, মৃত্যু কখনো কাউকে বলে কয়ে আসে না। আর উপরওয়ালার কী রহমত! জয়া তার মৃত্যুর আগে যেটাকে সবচেয়ে বেশি করে চেয়েছে সেটাই পূর্ণ করে গেল।

তরীর পাশাপাশি তরীর মা এবং বোনও কুরআন পড়ছে। ফিরোজাকে দিয়া সামলাচ্ছে। দিয়ার মাও কুরআন পড়ছে এবং থেমে থেমে ফিরোজাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। সিদাত বা সাইফ কাউকে-ই দেখা যায়নি।

সাঈদ সাহেব পুরুষদের মাঝে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে এখনো। তার চোখ জোড়া অসম্ভব লাল। ঘোলাটে চোখে একমনে বাড়ির বাইরে রাখা খাটিয়ার দিকে চেয়ে আছে। আকবর সাহেব সাঈদ সাহেবের কাঁধে হাত রাখতেই সাঈদ সাহেব দুই হাতে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগল। তার জীবনের প্রথম নারী, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্ত্রীকে সে নিজ চোখে ম*তে দেখল। এই ব্যথা, এই যন্ত্রণা সে কাউকে দেখাতে, বোঝাতে পারবে না। কত কত সুখময় স্মৃতি, কত কত ভালোবাসার দিনগুলি।

গতকালও তার হাত ধরেছিল, চোখে চোখে কথা বলেছিল, অথচ আজ! কিছু সময়ের ব্যবধানে এই মানুষটাকেই চিরজীবনের জন্যে মাটির নিচে রেখে আসতে হবে। এই যন্ত্রণা সে কী করে সহ্য করবে? কী করে সম্ভব এসব সহ্য করা?

সাইফ কোনো রকমে চোখ-মুখ লাল করে মেহমান সামলাচ্ছে। তার বাবাকেও সামলাচ্ছে। এই কঠিন সময়ে সে নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রেখেছে। কিন্তু বারংবার সে তার কাঠিন্য হারিয়ে ফেলছে। মাকে হারিয়ে সে কী করে স্বাভাবিক থাকবে? কিন্তু তাও, এই কঠিন সত্যটি মেনে নিয়ে তাকে চলতে হচ্ছে।

এখন খুব আফসোস হচ্ছে নিজের প্রতি, কেন সে তার বাবার মতো হলো না? হলে হয়তো এখন মন খুলে কাঁদতে পারত। বুকের এই ব্যথায় সাইফ লুকিয়ে দুটো সিগারেটও খেয়েছে। কিন্তু এই কষ্ট, ক্ষত, মায়ের শূন্যস্থান কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব নয়।

সিদাতকে তাদের কারো মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। কোথায় আছে সেটাও কেউ জানে না। সাইফ চারপাশটা লক্ষ্য করে তার মায়ের রুমটার দিকে গেল। সেখানে তরী আছে।

সাইফ দরজার সামনে দাঁড়াতেই তার মায়ের মৃত ফ্যাকাসে সুন্দর মুখখানা দেখতে পেল। সাইফ না চাইতেও এবার কান্না থামাতে পারল না। মুখে কঠিন ভাবে হাত চেপে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল। দেয়ালে পিঠ এলিয়ে কতক্ষণ কেঁদে কান্না থামাল। যতই হোক, পুরুষ মানুষের কান্না কাউকে দেখাতে নেই৷ সাইফ চোখ মুছে দরজা থেকেই তরীকে ডাকল। তরী ভেতর থেকে সাড়া দিল। সাইফ বলল,

–“আমার মনে হচ্ছে এখন সিদাতের পাশে তোমার থাকা উচিত। একটু বেরিয়ে আসবে?”

তরী মায়ের হাতে কুরআন শরীফটা দিয়ে মুখ ঢেকে বেরিয়ে এল। সাইফ তরীর দিকে তাকাল না। নিজের কান্না দমাতে চারপাশে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,
–“আমার পেছনে এসো!”

তরী সাইফের পিছে হাঁটছে আর শব্দহীন কাঁদছে। কী করে সিদাতকে বোঝাবে? সিদাতের পাশে গিয়ে বসবে? সবকিছুর জন্যে তরী নিজেকেই বারবার দায়ী করছে। অনুশোচনায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছে। মানুষটা তাকে কত ভালোবাসত,

আর সেই মানুষটাকে ভালোবাসা দেওয়ার বদলে এভাবে দূরে সরিয়ে দিলো। দূরে সরিয়ে দেওয়ার ফলাফলস্বরূপ দুজন সন্তান তার মা হারাল, একজন স্বামী তার স্ত্রী হারাল। এদিনেই কেন এমন হলো? তরী কী করে নিজেকে ক্ষমা করবে?

সাইফ তরীকে নিয়ে ছাদে এলো। সিদাত ছাদের এক কোণে বসে আছে পাথরের মূর্তির মত। তাকে দেখে তরীর বুকের চিনচিন ব্যথাটা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সাইফ মাথা নিচু করে বলল,
–“আমার ভাইটাকে সামলাও বোন।”

সাইফ চলে গেল। তরী সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার হাঁটু জোড়া অসম্ভব রকম কাঁপছে। মাথা ভনভন করছে। এই ছেলেটাকেই দু’দিন আগে হাস্যোজ্জ্বল দেখেছিল। মাকে নিয়ে তারই মুখে গল্প শুনেছিল। অথচ আজ? মানুষটা কেমন বদলে গেল। তরী তার মাকে হারানোর ব্যাপারটা কল্পনাতেও আনতে পারে না। সেখানে সিদাত তার মাকে হারিয়েছে। ব্যাথাটা কোনো মলমে সারার মতো নয়। ব্যথার মলমটাই তো ওপারে চলে গেল।

তরী কম্পিত পায়ে সিদাতের দিকে এগিয়ে গেল। বারবার নাক টেনে অশ্রু সংবরণ করতে চাইছে তরী। কোনো রকমে সিদাতের পাশে বসতেই সিদাত তরীর দিকে না তাকিয়েই ভাঙা গলায় বলে ওঠে,

–“জানো নিকাব রাণী, যখন ছোটোবেলায় আমরা দুই ভাই চাঁদ দেখতে চাইতাম তখন এখানটায় বসে থাকতাম। মা এক থালায় ভাত এনে এখানেই খাইয়ে দিত। আমাদের মাঝে কত কত গল্প হত। মা বারবার রাজকুমারদের গল্প শোনাত৷ আমরা শুনতাম, শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও যেতাম। ঘুম ভাঙলে দেখতাম আমরা বিছানায়। কাজের লোকেদের থেকে শুনতাম মা-ই আমাদের দুই ভাইকে ছাদ থেকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিত। আমি এবং সাইফ ভাই আসলেই খুব ছোটো ছিলাম। স্কুল লেভেলে আসার পর বাবা এসব গল্প করত আমাদের সাথে। বাবা বলত ছোটোবেলার এই মধুর স্মৃতি ভুলতে দিতে নেই। আমাদের উচিত সেগুলো ভেবে আনন্দিত হওয়া।”

সিদাত থেমে যায়। তার ভেতরকার ঝড়টা সে কিছুতেই থামাতে পারছে না। ঝড়ের তান্ডবে সিদাত নিজেকে একদমই স্থির রাখতে পারছে না। অথচ বাহির থেকে সিদাতকে শোকে পাথর অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। তরী নীরবে কাঁদল। সিদাত বুঝলও না। সে একমনে মায়ের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোয় ঘুরা-ফেরা করছে। তার মা নেই এটা সে কল্পনাও করতে পারছে না। সিদাত নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে হঠাৎ বলে ওঠে,

–“তোমাকে জড়িয়ে ধরে কষ্টের মাত্রাটা একটু কমাতে চাচ্ছি তরী। অনুমতি দিবে?”

তরী কিছু বলার ভাষা পেল না। এই পরিস্থিতিতে অন্য কিছু ভাবারও সময় পেল না। অনুমতি দিয়ে দিল। সিদাত চট করে তরীকে জড়িয়ে ধরল। তরীর ওড়নার ওপর দিয়ে-ই তরীর কাঁধে মুখ গুজল। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও সিদাত নিজেকে সামলাতে পারল না। কেঁদে উঠল শব্দ করে। সিদাত কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,

–“আমার মা এভাবে কেন চলে গেল তরী? আমি তো কিছু করিনি, তবে আমার উপর মায়ের কী এমন অভিমান? আমাদের সবার সাথে কিসের অভিমান? আমি পারছি না তরী, মা নেই ভাবতে পারছি না। মা ছাড়া আমি কার সাথে আমার মনের কথা গুলো শেয়ার করব, কে আমাকে মায়ের মত করে বুঝবে? মা কেন আমাদের পরিবার টাকে অসম্পূর্ণ রেখে চলে গেল। তুমিও তো চলে এসেছিলে, তবে মা কেন চলে গেল?”

সিদাত কাঁদছে। খুব কাঁদছে। তরীর ওড়না ভিজে যাচ্ছে সিদাতের অশ্রুতে। আর তরীর অশ্রুতে ভিঁজছে সিদাতের শার্ট। সিদাতের কান্নায় তরীও নিজেকে সামলাতে পারেনি। এমন মুহূর্তে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ বা বাক্য আছে কী না সেটা তরীর জানা নেই। তবুও তরী সিদাতকে বলল,

–“এভাবে কাঁদবেন না। আম্মা কষ্ট পাবেন। প্লিজ কাঁদবেন না। আম্মার জন্যে দোয়া করুন। যাতে আল্লাহ্ পরাপারে আম্মাকে ভালো রাখে। এই দোয়াতেই আম্মাকে মনে রাখুন। দোয়া ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই। সবাইকেই একদিন ম*রতে হবে।”

————————

মাগরিবের পরপর জানাজা হল। সাঈদ সাহেব-ই বেশি দেরী করতে চাননি। বুকের ব্যথা চেপে কবরে লাশ নামালো দুই ভাই। সিদাতের চোখে আবারও জল ভরে এলো। দুয়েক ফোঁটা অশ্রু কাফনে পরল। সিদাত মনে মনে বলল,

–“আম্মা, একসময় তুমি কোলে-পিঠে আমাদের মানুষ করেছ। আজ দেখ, তোমাকে আমরা চার হাতে এই মাটিতে শোয়াচ্ছি। আল্লাহ্ তোমাকে খুব খুব ভালো রাখুক আম্মা। জান্নাতবাসী হও।”

যখন কবর থেকে দুই ভাই উঠে এল, তখন ধীরে ধীরে কবর খানা বাঁশ, কাঠ দিয়ে ঢেকে দিল। অতঃপর মাটি দেওয়া শুরু হল। সেদিকে চেয়ে সিদাত চোখ বুজল। বিদায় দিলো মাকে।

বাড়ির পরিবেশ গুমোট, থমথমে। কারো মুখে হাসি নেই, ঠিক মতো কথা নেই, চুলোয় খাবার তোলা হয়নি। মাটি দেওয়ার পরপর অনেকেই ফিরে গেছে তাদের নিজস্ব গন্তব্যে। জয়ার ভাই, বোনেরাও এসেছে। তারা আজ থেকে গেছে। এখন কম-বেশি সকলেই জেনে গেছে সিদাতকে জয়া বিয়ে দিয়েছে। কার সাথে দিয়েছে সেটাও টুকটাক জানে।

পরিবারের লোকদের অনুপস্থিতিতে রান্নাঘরটা দিয়ার মা, কামরুন নাহার, তরী এবং আরও কিছু মহিলা স্বজন সামলাচ্ছে। তরী যথা-সম্ভব তাদের সাহায্য করছে। সবটাই তরীর মা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে এই পরিবারকে আপন করে নেওয়াটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তরীও একমনে তাই করার চেষ্টা করছে। তরী কখনো কোনো কিছু নেতিবাচক ভাবে নেয়নি। কাজ-কর্ম বেশ ভালোই জানে সে।

মাঝেমধ্যে ভার্সিটি অফ থাকলে সে মাকে বসিয়ে রাখত। আর সে সব কাজ করত। এই মুহূর্তে এসব কিছু আয়ত্ত্বে থাকলেও তরী বিব্রত, ইতঃস্তত সকলের এমন কোণা চোখে তাকানোতে। যদিও সে পুরুষদের দিকে একদমই যায়নি। সাঈদ সাহেব নিজেই নিষেধ করেছে তরী যেন সেদিকে না যায়। তরীর এরকম হেফাজত করাটা সে নিজের দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছে।

দিয়া সবেই রুম থেকে আসল। সাইফ কবরস্থান থেকে ফিরে বিধ্বস্ত হয়ে পরেছিল। তাকে সামলে, শাশুড়িকে সামলে সেও রান্নাঘরেই চলে আসে। দিয়া আসতেই কামরুন নাহার এবং দিয়ার মা তাদের কাজ দিয়া, তরীকে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরোজার কাছে চলে গেল। হাতে করে খাবার নিতেও ভুলেনি তারা। ফিরোজাকে খাইয়ে দিতে হবে৷ এখনো অবধি কিছুই মুখে তুলেনি সে। তরী খুবই নিচু গলায় দিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

–“সকাল থেকে কিছু খাননি আপনি আপু। কিছু খেয়ে নিন। খুব ধকল গেছে আপনার ওপর দিয়ে!”

দিয়া হাসল তরীর কথা শুনে। বলল,
–“সকাল থেকে তো তুমিও খাওনি। নিজের চিন্তাও কিন্তু করতে হয়। খাব, রান্না শেষ হলে সবাইকে একসাথে নিয়ে খাব। আর কথা বলার সময় আপনি বলার প্রয়োজন নেই। আমি খুব সম্ভবত তোমার চাইতে দেড়-দুই বছরের বড়ো হব।”

তরী শুনল। উত্তরে হাসার চেষ্টা করল।
রাতে সবাইকে একসাথে বসিয়ে খাওয়ানো হল। সিদাত, সাইফ বা সাঈদ সাহেব কেউ-ই মুখে খাবার তুলতে চাচ্ছিল না। কিন্তু নানান কথা বলে তাদের খাওয়ানো হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া হলেও সে রাতে অনেকেই ঘুমালো না। কারো চোখেই ঘুম এলো না। মেয়েরা ভেতরে এবং ছেলেরা বৈঠক ঘরের এখানে সেখানে এলোমেলো হয়ে বসে-ই রাত পার করল।

আকবর সাহেব বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল, কিন্তু সাঈদ সাহেবের করুণ অনুরোধ তাকে ফিরতে দেয়নি। একপ্রকার লজ্জায় আড়ষ্ট ছিল সে। যতই হোক এটা এখন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি, এভাবে থেকে যাওয়া চলে না। কিন্তু পিরিস্থিতি এমন ভাবে বাধ্য করেছে যে এসব লজ্জা, আড়ষ্টতা একদিনের জন্যে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।

ফজরের সময় ছেলেরা সবাই নামাজের জন্যে মসজিদ চলে যায়। আর মেয়েরাও ঘরে নামাজ পড়ে নেয়। আজ যেন সকলের মোনাজাতে একমাত্র জয়া-ই ছিল। ফিরোজা খুব কষ্টে বিলাপ এবং কান্না থামিয়েছিল। নামাজের মোনাজাতে এসে তার ফোঁপানোর শব্দ শোনা গেল এবং টেনে টেনে বিলাপ করতে লাগল।

তার এহেম কান্ডে তার আশেপাশের উপস্থিত সবাই নীরবে কেঁদে ওঠে। কতটা বেদনাময় সময় গুলো। দুঃখ, বিষাদের রাতগুলো যেন থমকে যায়। এই মুহূর্তে যেন সময়ের কোনো তাড়া থাকে না। সময় চায় এই দুঃখ, যন্ত্রণা, বেদনা দীর্ঘ হোক, আর সে থেমে যাক।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here