হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব ২৮+২৯

0
378

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৮]

নতুন বাসায় আসার পর গোছগাছে-ই প্রায় তিন দিন চলে গেল তরীদের। নতুন বাড়িটা খুব ভালো পরিবেশে। চারপাশে বাড়ি-ঘর তেমন নেই। কিছুটা দূরে দূরে নতুন, নতুন ভবনের ইন্সট্রাকশন চলছে। এবার তাদের ফ্ল্যাটটা পাঁচ তলায়৷ সিঁড়ির সাথে আধুনিক লিফটও আছে। ভাড়াটা বেশি হলেও আকবর সাহেব এই পরিবেশকেই খুব নিরাপদ অনুভব করল। এই ভবনটাও নতুন।

তরী খোলা বারান্দায় গিয়ে শান্তির শ্বাস গ্রহণ করল। দমকা হাওয়ায় তরীর ভেজা চুল গুলো উড়ছে। এই বারান্দায় তরীকে ওড়না দিয়ে মুখ লুকিয়ে আসতে হবে না। একে তো পাঁচ তলা। আশেপাশের তেমন বিল্ডিং-ও নেই যে তরীকে অন্য কেউ দেখতে পারবে। আগে রাস্তার পাশে বেলকনি ছিলো বিধায় রাত ছাড়া যেতেই পারত না। এখন মনে হচ্ছে সবকিছু সুন্দর, স্বচ্ছ।

সেই পথে হওয়া ঘটনা এখন অবধি তরী ভুলতে পারে না। ভোলা সম্ভব কিনা তরীর জানা নেই। তবে এই ভয়ংকর স্মৃতি তার মস্তিষ্কে পুরো জীবনের মতো থেকে যাবে। সত্যি বলতে সে সাইফ এবং সিদাতের প্রতি কৃতজ্ঞ। সিদাতের প্রতি সন্তুষ্টও। সিদাতের বলা কথাগুলো তার কানে সবসময় তরঙ্গিত হয়। তরীর কেমন মোহময় লাগে। এই মোহটা উপলব্ধি করতেই সেদিন সিদাতকে তরী ব্লক করে দিয়েছে। এবং প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থেকেছে এই ভেবে, না জানি সিদাত আবার তাকে কোন নাম্বার দিয়ে কল দেয়। কিন্তু তরীর সেই আতঙ্ক অবশ্য খামাখাই ছিলো।

তরী মা*রা-মা*রিকে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু সেদিন সোলেমানের ব্যবহার, কাজ এতটাই বিশ্রী এবং জঘন্য ছিলো যে তরী মনে মনে না চাইতেও তাকে খুব ভয়াবহ অভিশাপ দিয়ে ফেলেছে। যে পুরুষ নারীকে সম্মান করতে জানে না, নারীকে সর্বদা ছোটো করে এবং নিজের চাহিদা মেটানোর বস্তু মনে করে সেই পুরুষ আর যাই হোক, মানুষের কাতারে পরতে পারে না। সোলেমাবনের বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ভঙ্গি এবং আচরণ উভয়-ই অসুলভ। তরীর যদি সোলেমানের সাথে বিয়েও হতো তবুও তরী ভালো থাকত না, আর না সোলেমান ভালো হতো। এজন্যে তরী মাবুদের কাছে লাখ লাখ শুকুরিয়া করে। সাথে ক্ষমাও চায় এমন অভিশাপ দেওয়ার জন্য।

——————
সিদাত চেষ্টা করল তরীদের খুঁজে বের করার। সাইফকেও জানালো। কিন্তু সাইফ ইদানীং খুব ব্যস্ত। সিদাত দিনকে দিন কেমন অস্থির হয়ে যাচ্ছে। একসময় সাইফ সিদাতকে কল দিত! আর এখন সিদাত সাইফকে কল দেয়। বারবার জিজ্ঞেস করে,
–“তুমি কী এই ইহজনমেও ফ্রী হবা না ভাইয়া?”

সাইফ তখন সিদাতের অধৈর্য হওয়া গলা শুনলে মিটিমিটি হাসে। হাসি কোনোরকমে আটকে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
–“মিটিং আছে, আমি ফ্রী হলে কল দিব!”

বলেই সিদাতকে কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দেয়। সাইফ তখন চাপা হেসে দিয়ার হাত ধরে হাঁটতে লাগে। আসলে এসব মিটিং, কাজ, ব্যস্ততা সবকিছুই বাহানা৷ সাইফ তো এসেছে বউ, শ্বশুরদের নিয়ে দিয়ার দাদু বাড়ি বেড়াতে। অথচ সিদাত জানে সাইফ রাজনৈতিক কাজে কোথাও গিয়েছে। অস্থির সিদাত খেয়াল-ই করছে না সাইফ ছাড়া এ-বাড়িতে দিয়াও নেই।

দিয়া মাথা তুলে সাইফের হাসির দিকে চাইলো। ভুরু কুচকে বলল,
–“ছেলেটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছ কেন?”

–“শুধু, শুধু কী বলো? এগুলা ওর পানিশমেন্ট। তুমি তো জানো না এই ছেলে আমাকে কতবার নাকে দড়ি দিতে ঘুরিয়েছে। একটু বিরহ সহ্য করুক। বিরহ না হলে আবার প্রেম-ট্রেম জমে না!”

দিয়া চট করে সাইফের হাত ধরে দূরে সরে দাঁড়ায়। সাইফকে পথ দেখিয়ে দিয়ে চাপা হেসে বলল,
–“তুমিও তবে ঢাকা চলে যাও। এরপর ভাইয়ের সাথে বসে বসে বিরহ সহ্য করো। নয়তো আমি বুঝব কী করে তুমি আমায় কেমন ভালোবাসো?”

দিয়ার এরকম কথায় সাইফের মুখখানা দেখার মতো ছিল। মুখ ভার করে বলল,
–“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমি কী তোমার প্রেমিক নাকি? আমি তোমার বর! বউকে ফেলে আমি কেন খামাখা ঢাকা যাব?”

–“প্রেমিক হলেই কেন বিরহ সহ্য করতে হবে? বিরহ সহ্য করার স্পেশাল অনুভূতি তো বরদের পাওয়া উচিত। তুমি যাও, আমি আব্বা-আম্মার সাথেই ফিরব!”

–“যাব না।”

–“যাবে। আমার সামনেই ম্যানেজার ভাইয়াকে কল দিচ্ছ তুমি ব্যাস!”

–“সিদাতের জন্যে এসব করছ তো? বরের চাইতে দেবর প্রিয় হয়ে গেলো?”

–“নাহ! সুযোগের সৎ ব্যবহার করছি। তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা! প্রেক্টিক্যালি টিকোনি এখনো!”

সাইফ গোমড়া মুখে বাড়ি ফিরতেই সিদাত চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
–“আমাকে টেনশনে ফেলে, কাজের বাহানা দিয়ে এভাবে বউয়ের সাথে ঘুরতে চলে গেছ তুমি ভাইয়া!! ম্যানেজার না বললে তো আমি জানতেই পারতাম না। এদিকে যে আমার বউয়ের জায়গাটা ফাঁকা সেদিকটা দেখছ না!? এত স্বার্থপর কবে হলা তুমি?”

সাইফও রেগে যায়। সব কথা উপেক্ষা করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“শুধুমাত্র তোর জন্যে আমার বউ আমাকে ধরে বেঁধে ঢাকা পাঠিয়ে দিলো৷ নয়তো কত সুন্দর টাইম স্পেন্ড করতাম। এটা তোর স্বার্থপরতা না? পড়ছিস তো প্রেমে কয়েকদিনের। এতেই কান ঝালা-ফালা না করলে তোর হয় না?”

দুই ভাইয়ে দাঙ্গা লাগল বউ নিয়ে। একজন বিয়ে করে একা, আরেকজন বিয়ে না করে বউ ছাড়া একা। একজন আরেকজনের দুঃখ বলে বলে ঝগড়া করতে ব্যস্ত। ফিরোজা খাতুন মুখে হাত দিয়ে হা করে দুই ভাইয়ের ঝগড়া দেখছে। সাইফ শেষমেষ চেঁচিয়ে বলল,
–“তোর ওই রাণী কই আছে, বলতাম না যাহ। দূরে যাহ!”

বলেই হনহন করে উপরে চলে গেল। আর সিদাত চুল ঠিক করতে করতে অফিস চলে গেল। সিদাতের আরও একটা দিন কেটে গেলো তরীকে ছাড়া। দুই ভাই-ই বিরহে সারা রাত পুড়লো। সাইফের জুবুথুবু অবস্থা। দিয়া তার ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। এসবের কোনো মানে হয়? বউ ছাড়া জীবন এত অন্ধ, অন্ধ জানলে সে বিয়েই করত না!

তরী ভার্সিটির গেটের কাছাকাছি আসতেই ভীষণ রকম চমকালো। সিদাত দাঁড়িয়ে আছে। সিদাতের চেহারা মাস্ক দ্বারা আবৃত থাকলেও সিদাত প্রায় পুরোটাই তরীর চেনা। তরী ভেতরের তীব্র কম্পন অনুভব করল। ভীত চোখে কয়েক পলক চেয়ে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করলো। তরী চলে যেতে নিলেই দূর থেকে অস্ফুট স্বরে নিজের নাম শুনতে পেলো। এটা কার ডাক তরী তা জানে। তবুও কোনোরকমে একটি রিকশা নিয়ে সে দ্রুত পালায়। তরী চায় না সিদাত তাকে খুঁজে পাক, তরীর বর্তমান বাড়ির ঠিকানা জানুক। তরী এবং সিদাত দুজনেই দুই মেরুর মানুষ। তাদের দেখা হওয়াটা-ই অসম্ভব ব্যাপারের মধ্যে পরে।

—-
ছুটির দিনে অনয় সিদাতকে ডেকে পাঠালো। আপাতত অনয় ছাড়া আর কোনো গতি নেই। শহরে প্রায় অনেক জায়গাতেই তরীকে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু সিদাত কোথাও পায়নি। সেদিন ভার্সিটিতে তরীকে একপলক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার। কিন্তু তরী যেন ভীড়ের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল সিদাত। অনয়ের কাছেও এতদিন আসেনি। বাসাতেই থেকেছে, মায়ের সংস্পর্শে থেকেছে সে।

কলিংবেল চাপতেই সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললো না। সিদাত দূরবীন বাইরে থেকে চেপে রাখলো যাতে অনয় তাকে না দেখতে পায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে অনয় দরজা খুলতে দেরী করছে। সিদাত বিরক্তিতে কপাল কুচকাল। অনয় তো এত দেরী করে দরজা খোলে না। আজ সমস্যা কী?

সিদাত আবার কলিংবেল চাপল। এক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। সিদাত কিছু বলতে নিবে তখনই দরজার পেছন থেকে মাথা বের করা মানুষটিকে দেখতে পায়। তরী সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলো। এবং সিদাতের মুখের ওপরই দরজা লাগিয়ে দিলো। আকবর সাহেব রোজ এই সময়ে বাড়ি ফিরে। এজন্যে তরী তার বাবাকে-ই ভেবেছিল। কামরুন নাহার অর্থাৎ তরীর মা তরীকে বারবার রান্নাঘর থেকে বলছিল দরজা খুলতে, কারণ তারও ধারণা ছিলো আকবর সাহেব-ই এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে এমন কিছুর মুখোমুখি হবে তরী কল্পনাও করেনি। তার বুক কাঁপছে, দুরুদুরু শব্দ হচ্ছে ভেতরটায়।

সিদাত তখনো স্ট্যাচুর মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জোড়া বদ্ধ দরজায় আবদ্ধ। দ্বিতীয় বারের মতো তরীর মুখখানা সে স্বচক্ষে আবারও দেখতে পেলো। কিন্তু তার মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এরূপ আকস্মিক ঘটনায়!

তখনই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে অনয় বেরিয়ে এলো। অনয়ের পেছন পেছন সাইফ। অনয় চওড়া হাসি দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,
–“কেমন লাগলো সারপ্রাইজ, দোস্ত? ঝাকানাকা না?”

সিদাত বাস্তবে ফিরে এল। ঘাড় বাঁকিয়ে দুজনকে পরখ করে বল,
–“পেটে পেটে তাহলে এই ছিলো?”

অনয় এবং সাইফ দুজনে একসাথে হেসে ওঠে। সিদাত গরম চোখে তাদের দিকে চেয়ে আছে। এরা সব কিছু জানতো অথচ সিদাতের সাথে এতদিন ধরে মজা নিয়েছে? সাইফ হাসি থামিয়ে বলল,
–“তোর ভাবী বলেছে বিরহ বেদনা না পেলে নাকি প্রেম-ট্রেম হয় না। এজন্য তোর মনের রাস্তা এতদিন যাবৎ পরিষ্কার করছিলাম। অথচ এদিকে আমার মনের রাস্তা পরিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও তোর ভাবী আমাকে বিরহ বেদনায় টইটম্বুর করে রেখেছে। এবার অন্তত বিরহ কাটুক, তোর অভিশাপও আমার গায়ে না লাগুক!”

অনয় এবারও হাসলো। সাইফ আবার বলল,
–“আমি কিন্তু এখানে এসেছি বিরিয়ানি খেতে। অনয়, বাবুর্চি গিরি শুরু কর। অনেকদিন তোর হাতের বিরিয়ানি খাওয়া হয় না। আর হ্যাঁ সিদাত! বাবাকে আমি সবটা জানিয়েছি। বাবা এখন তরীদের পারিবারিক খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আশা রাখছি বাবা কিছুদিনের মধ্যেই ওদের বাসায় আসবে।”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৯]

আকবর সাহেব কিছুটা গম্ভীর হয়ে বসে আছে সাঈদ সাহেবের সম্মুখে। সাঈদ সাহেব অধীর আগ্রহে আকবর সাহেবের পানে চেয়ে আছে। সাঈদ সাহেবের পাশে আজ ম্যানেজার নেই। ম্যানেজার সাহেব নিচে গাড়িতে বসে আছে।

সাঈদ সাহেব আকবর সাহেবের পরিবার সম্পর্কে যা শুনেছে এবং যা উপলব্ধি করেছে, তাতে ম্যানেজার সাহেবকে এখানে আনাটা ঠিক মনে করেনি। তবে সাঈদ সাহেবের সাথে ফিরোজা খাতুন এসেছে। বোরকা পরিহিত ফিরোজা খাতুন আকবর সাহেবের পাশে বসার অনুমতি পেল আজ অনেক দিন পর।

কামরুন নাহার সালাম জানিয়ে নাস্তার ট্রে রেখে চলে গিয়েছে। পুরোপুরি যায়নি অবশ্য। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আকবর সাহেবের মাথায় বহু চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিবাচক মত তিনি দিতে পারছে না। সাঈদ সাহেব ব্যাপারটি বুঝতে পেরে বলল,

–“আপনি মেয়ের বাবা। আপনি অবশ্যই নিজের মেয়ের ভালোটা চিন্তা করবেন। এজন্য বলবো তাড়াহুড়ো করে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের ব্যাপারে, আমার ছেলের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিন। শুধু অনুরোধ করব, আমার পেশাকে বিবেচনা করে আমার ছেলেকে না করে দিবেন না। দরকার পড়লে আপনি যেকোনো শর্ত রাখতে পারেন। তবুও আপনার মূল্যবান মেয়েকে আমার মেয়ে করে দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি!”

আকবর সাহেব সরাসরি কিছু বললেন না। শুধু জোরপূর্বক হেসে বলল,
–“আপনারা নাস্তা নিন।”

সাঈদ সাহেব অধরে হাসি লেপ্টে চা হাতে নিলো। আর ফিরোজা দুটো আঙ্গুর ফল নিকাবের মধ্যে দিয়েই মুখে নিল। একসময় ফিরোজা বিব্রত হয়ে বলল,

–“আপনি যদি কিছু মনে না করেন ভাই সাহেব, তাহলে আমি কী আপনার বড়ো মেয়েটাকে একপলক দেখতে পারি?”

আকবর সাহেব না করতে পারলেন না। হেসে বলল,
–“জি, নিশ্চয়ই। বাহিরেই আমার স্ত্রী আছে। সে আপনাকে নিয়ে যাবে!”

ফিরোজা খাতুন উঠে গেল। লিভিং-রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই কামরুন নাহারের মুখোমুখি হল। কামরুন নাহার পর্দার আড়ালে থেকেই স্বামীর কথা শুনতে পেয়েছে। এজন্য ওনি মুচকি হেসে বলল,
–“আমার সাথে আসুন!”

তরী বেশ বিধ্বস্ত হয়ে রুমে বসে আছে। সে কখনো কল্পনাও করেনি সাঈদ সাহেব প্রস্তাব নিয়ে আসবে। তার জল্পনা-কল্পনার মাঝেই কামরুন নাহার ফিরোজাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। তরী চটজলদি মাথায় কাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে সালাম দিলো ফিরোজাকে। ফিরোজা তরীর সালামের উত্তর নিয়ে তরীর কাছাকাছি এলো। প্রাণভরে তরীকে দেখে ফিরোজা বলল,
–“আমাকে মনে আছে মা? আগেও সম্ভবত আমাদের দেখা হয়েছে।”

তরী কিছুটা ইতঃস্তত হয়ে ছোটো শব্দে বলল,
–“জি আন্টি, মনে আছে!”

ফিরোজা খাতুন বেশি কিছু বলল না। অপেক্ষায় রইল আকবর সাহেবের মতামতের। তরীকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কল্পনাতেই হঠাৎ তার ছোটো ছেলে সিদাতের সাথে তরীকে দাঁড় করালো। কী মিষ্টি লাগবে দুজনকে। ফিরোজা কামরুন নাহারের দিকে খুব বিনয়ী স্বরে বললো,

–“আপনার মেয়েটাকে আমার এক দেখাতেই ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এখন দোয়া করি তরীর বাবা রাজি হয়ে যাক। আমার ছোটো ছেলেটা খুব ভালো। আমার বিশ্বাস তরীর ছায়া হয়ে রবে সে।”

কামরুন নাহার শুধু হাসলো। সে দেখেছে সিদাতকে। দেখতে-শুনতেই ভালোই সুপুরুষ। শুধু তাদের চাহিদা গুলো ভিন্ন। সিদাত যদি তাদের মেয়েকে সেই চাহিদা অনুযায়ী মেয়ের পাশে থাকতে পারে তাহলে বিয়ে নিয়ে অবশ্যই ভাবা যায়। কিন্তু কোথায় যেন একটা দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। ভীষণ বড়োলোক কী না, তাদের তো আবার সখ, আহ্লাদ অন্যরকম।

সাঈদ সাহেব আকবর সাহেবকে আরও জানালেন কিছু সত্য৷ সিদাতের মা সম্পর্কেও ধারণা দিলেন। এও জানানো হলো সিদাতের মা তরীকে পছন্দ করেছে৷ শয্যাশায়ী স্ত্রীর চাওয়া তো সে অপূর্ণ রাখতে পারে না। সাঈদ সাহেব একে একে সময় নিয়ে সবটা খুকে বললেন। তার মনে চেপে রাখা সেই ঘটনা গুলোও বললেন। সব শুনে আকবর সাহেব স্তব্ধ। কী বলার ভাষা পেলেন না। পরিস্থিতি এবং সময় মানুষকে ঠিক কোন পর্যায়ের বাধ্য করে সেটার জলন্ত উদাহরণ যেন সাঈদ সাহেব।

সেদিনের মতো সাঈদ সাহেব বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে জানালেন,
–“আমার মনে হয়েছে আপনার সবকিছু জানা জরুরি, এজন্যে আমি আপনার থেকে কিছুই লুকাইনি। যাতে করে পরবর্তীতে অন্যদের মুখে সব জানার পর আমাদের ভুল না বুঝেন। আর আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম!”

আকবর সাহেবের মন জুড়ে নেতিবাচক ধারণা গুলোই বেশি এসেছে। তিনি স্ত্রীর সাথে সব আলোচনা করলেন। মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তিনি। সিদাত এমনিতেও ভালো হলেও আকবর সাহেব সিদাতকে তার মেয়ের জন্যে পছন্দ করছেন না। সিদাত প্রতিদিন মিডিয়া পাড়ায় ওঠা-বসা করছে, পরিবার সুলভ হলেও রাজনীতিতে যুক্ত। সেখানে মেয়ে কতটুকু সুরক্ষিত তার উত্তরও নেই।

সাবিয়া তো খুব অবাক হয়ে তরীর দিকে চেয়ে আছে। তরী তখন মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাবিয়ার এরকম চাহনি তরীকে বারবার বিব্রত করছে৷ তরী ঘাড় বাঁকিয়ে গরম চোখে সাবিয়ার দিকে চাইলো। সাবিয়া তখনো নজর সরালো না। মাদ্রাসা থেকে ফেরার পর মায়ের মুখে যা শুনেছে তাতে তার বিস্ময় চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। এখনো সেই অবিশ্বাস্য, বিস্ময় ভাব থেকে বেরুতে পারছে না সাবিয়া।

তরী কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
–“সমস্যা কী?”

সাবিয়া অস্ফুট স্বরে বলল,
–“সিদাত ভাইয়ার বাবা এসেছে? এটা কী সত্যি?”
–“একবার যা শুনেছিস তা আবার রিপিট করতে হবে কেন?”

–“আমার জানো বিশ্বাস হচ্ছে না।”

–“বিশ্বাস না হলে অন্য কোথাও গিয়ে বসে থাক, অন্তত আমার সামনে বসে এভাবে তাকিয়ে থাকিস না!”

সাবিয়া নীরবে অমান্য করল তরীর কথা। সে ওখানেই থম মেরে বসে রইলো। আর তরী না পেরে উঠে চকে গেলো বারান্দায়।

————
সাঈদ সাহেব অনেকদিন পর জয়ার কাছে এসে বসেছে। জয়া সাঈদ সাহেবের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। তার চোখ জোড়া জলে টইটম্বুর। সাঈদ সাহেবের হাতে মুঠোয় জয়ার হাত। জয়া অন্য রকম ভালো লাগা অনুভব করছে। সাঈদ সাহেব স্ত্রীর হাত ধরে খুবই নরম গলায় বলল,

–“তোমার চাওয়া আমি আবারও নিজ হাতে পূরণ করে আসলাম। সত্যি তোমার পছন্দ সুন্দর। কী করে পছন্দ করলে এমন রত্নকে?”

জয়া যেন কান্নার মাঝেও হাসতে চাইলো, খিলখিল করে৷ এর মানে কী সিদাতের সেই নিকাব রাণী বউ হয়ে আসবে তার বাড়ি? সে চেয়ে দেখবে তরীকে? ততদিন অবধি বেঁচে থাকবে তো? হাজারো যন্ত্রণার মাঝেও অন্য রকম সুখ অনুভব করছে জয়া। অবশেষে তার পরিবারটা পূর্ণতা পাবে।

তরী পথে আপনমনে হাঁটছে। প্রস্তাব আসার পর থেকেই আকবর সাহেবকে দুশ্চিন্তার মধ্যেই দেখছে সে। কী প্রয়োজন ছিলো এই মুহূর্তে প্রস্তাব দেওয়ার? তরী তো আহামরি কেউ নয়। সিদাতের জন্যেও মেয়ের অভাব হবে না। তাহলে সব ছেড়ে সিদাত কেন-ই বা তাকে বেছে নিল? আকবর সাহেব তো জানে না সিদাত মদ্যপান করে তারই ঘরে ঢুকেছে। এটা কিছুতেই মুখ ফুটে বলার মতো নয়। নয়তো আকবর সাহেব হুলুস্থুল ঘটাবেন। এছাড়া তার বাবা রাজিও হবে না, এটা তরী জানা আছে। সিদাত মেনে নেওয়ার একটা কারণ থাকলেও মেনে না নেওয়ার কারণ অসংখ্য।

তরী হঠাৎ গলা খাঁকারির শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরে ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে চাইল। সিদাত হাঁটছে তার পাশে। অধরে লেপ্টে আছে চওড়া হাসি। কী যেন বড়ো কিছু হাসিল করেছে সে। সিদাতকে দেখে তরী কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। তবে কিছু বলল না, এড়িয়ে গেল। আর যাই হোক, রাস্তাটা তার নিজের নয়। যে কেউ এই পথ দিয়ে চলতে পারে।

সিদাত ভীষণ সন্তুষ্ট। সে তার বাবার আশ্বাসে ইতিমধ্যে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছে তরীকে নিয়ে। এজন্যে নিজের কথা বলতে দ্বিধা নেই এখন। সে সর্বপ্রথম-ই বলল তার মায়ের কথা।

–“তরী জানো, আল্লাহ্ আমাকে দুটো মা উপহার দিয়েছেন। কতটা ভাগ্যবান আমি বুঝতে পারছ? তুমিও ভাগ্যবতী হবে, একসাথে ডাবল ভালোবাসা পাবে। জানো, আমার মা-ই তোমাকে পছন্দ করেছে। মায়ের সাথে রোজ গল্প করতাম তোমায় নিয়ে। এরপর ব্যাস, এত আয়োজন হয়ে গেল!”

দুই মা! এই কথাটা তরীকে ভীষণ রকম নাড়িয়ে তুললো। না চাইতেও তার পা জোড়া থেমে যায় বিস্ময়ে। তরীকে থামতে দেখে সিদাত ফিরে তাকাল। তরী চোখ কপালে তুলে তার দিকেই চেয়ে আছে। সিদাত হাসল। বলল,

–“আমার বাবার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করছ বোধহয়?”

তরী আবারও অপ্রস্তুত হলো। নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে ছোটো শব্দে বলল, “না, তো!”

সিদাত হাসল। তরীকে হাঁটতে ইশারা করলে তরী আবার হাঁটতে লাগল। মুখ ফুটে বলতে পারল পারল না “আমার পিছু ছাড়ুন।”

কিন্তু কৌতুহল, আগ্রহের কারণে সেটা মনেই থেকে গেল। সিদাত বিশেষ কিছু বলল না। শুধু ধোয়াশাময় কিছু কথা বললো,

–“আমার বাবা চরিত্রহীন নয় নিকাব রাণী। বরং আমার বাবা একসময় শ্রেষ্ঠ হাসবেন্ডের তালিকায় ছিলেন। এখনো আছেন। তবে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে। এই “চরিত্রহীন” কথাটা বলতে কত কষ্ট হয় জানো?”

তরী নীরব ভূমিকা পালন করছে। সিদাত আবার বলল,
–“আমার মা শয্যাশায়ী। অচল হয়ে বিছানায় পরে আছে। আমার আরেক মাকে তো দেখেছ-ই। তোমার বাসায় গিয়েছিল। তাদের দুজনের সম্পর্ক খুব নিবিড় জানো। ছোটো মাকে দেখে আমি শিখেছি, সৎ সবসময় দূরে ঠেলে দেয় না। মমতার সাথে আগলেও নেয়। আমার এক মা অচল এবং আরেক মা সচল। তবে আমি দুজনকেই ভালোবাসি। ভালোবাসাটআ তাদের জন্যে পরিমাপ করাটা মুশকিল!”

তরী এবারও নীরব। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
–“এসব আমাকে বলছেন কেন? নিজের কথা বাইরের মানুষদের বলতে নেই!”

সিদাত হাসল। তরীর দিকে একপলক চেয়ে বলল,
–“যার জন্যে আমার হৃদয় খাচা ভেঙে পালিয়েছে, এক নারীকে হৃদয় জুড়ে ঠাঁই দিয়েছে, সে আর যাই হোক বাইরের মানুষ হতে পারে না!”

–“কী করে নিশিত হচ্ছেন আমার বিয়ে আপনার সাথে-ই হবে? বিয়ে ছাড়া কোনো বেগানা নারী, পুরুষ আপনজন হতে পারে না!”

–“চিন্তা করো না। সেটাও হয়ে যাবে। কারণ আমার মন বলে বিয়ে একদিন আমাদের হবেই। আমার অসুস্থ মায়ের দোয়া মাবুদ ফিরিয়ে দিবেন না! আমার সেই আস্থা আছে!”

সিদাতের এতটা আত্মবিশ্বাস দেখে তরী আর কঠিন গলায় কিছু বলতে পারল না। এড়িয়ে গেলো সিদাতকে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। সিদাতও তরীর সাথে তাল মেলালো। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলল,

–“এইযে নিকাব রাণী শোনো, তোমার জন্যে হৃদয় এনেছি ভেজা। সেই ভেজা হৃদয়ে উষ্ণতা ছড়ানোর দায়িত্বটাও দিতে এসেছি।”

তরী তাও সিদাতকে এড়িয়ে চলল, কোনো কথা শুনেনি ভাব করে হাঁটছে। সিদাত আবারও ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
–“তোমার স্কেচ নিয়েও আমার কোনো আপত্তি নেই নিকাব রাণী। তোমাকে জুড়ে থাকা সবকিছুই আমার পছন্দের, ভালো লাগার।”

——————-
তরীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সিদাত নিজের বাড়ি ফিরে দেখলো বৈঠকঘরে সাঈদ সাহেব, সাইফ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। সাইফের পেছনেই দিয়া বিমর্ষ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা মোটেও সুবিধা লাগলো না সিদাতের। এগিয়ে গেল সেদিকে। সাইফ সিদাতকে দেখে মলিন চোখে চেয়ে রইল। সিদাত সাইফের চোখের ভাষা বুঝল না বরং জিজ্ঞাসু নজরে চেয়ে রইলো। সিদাত তার বাবার দিকে তাকালো। সাঈদ সাহেব মাথা তুলে চায় সিদাতের পানে। নীরবতা ভেঙে সিদাত বলে ওঠে,

–“কিছু হয়েছে কী বাবা?”

সাঈদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিন্তু জবাবে কিছুই বললেন না। মিনিটখানেক সময় নিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–“তরীর বাবা কল করেছিল। বিয়েতে পরিষ্কার করে “না” করে দিয়েছে। সঙ্গে এটাও বলেছে আমাদের এই পরিবেশ তাদের মেয়ের জন্য নয়!”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here