হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব ২৬+২৭

0
385

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৬]

তরী ফুটপাতের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছে ফিরতেই কারো সঙ্গে ধাক্কা খেল। যার ফলে তার হাতে থাকা স্কেচবুক আর পেন্সিলগুলো পরে যায়। তরী অপ্রস্তুত হয়! সামনে তাকাতেই ভড়কালো। সিদাত মাথা নিচু করে স্কেচবুকের পেজটির দিকে চেয়ে আছে। তরী শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত সেগুলো উঠিয়ে তার ব্যাগে পুরে নেয়। সিদাত অবাক স্বরে বললো,

–“তোমার স্কেচ তো দারুণ নিকাব রাণী!”

তরী বিব্রত হলো। মিথ্যাও বলতে পারল না। এজন্যে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“যা দেখেছেন তা ভুলে যান!”
বলেই সিদাতের পাশ কেটে যেতে নিলে সিদাত বলল,
–“প্রতিভা ভুলতে নেই। তোমার স্কেচ সত্যি-ই সুন্দর। তুমি কী চারুকলা থেকে পড়ছো?”

তরী জবাব দিলো না। সে চলতে লাগলো। সিদাতও তার পিছে পিছে হাঁটছে। তরী প্রথমে সেভাবে খেয়াল করেনি। কী মনে করে পিছে চাইতেই সিদাতকে পেলো। সিদাত অমায়িক হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। তরী সিদাতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
–“ভুলে যেতে বলেছি ভুলে যাবেন!”

–“কেন? আঁকিবুঁকি তোমার টপ সিক্রেট নাকি?”

তরী মুখে কিছু না বললেও সিদাত যা বোঝার বুঝে নিল। সিদাত হেসে প্রসঙ্গ পালটে বলল,
–“ট্রুলি বলি নিকাব রাণী? তোমাকে দেখলে আমার চক্ষের শান্তি মিলে। এমন কেন হয়?”

তরী হকচকালো। মাথা তুলে সিদাতের চোখের দিকে চাইলো। পরমুহূর্তেই বিব্রত হয়ে পরলো সে। এই চোখ জোড়ায় অন্য রকম কিছু ছিল, যা তরীকে কেমন চমকিয়ে দেয়। তরী কোনো রকমে বললো,
–“আমার পিছু নেবেন না!”

বলেই তরী চলে গেলো। সিদাত সত্যি-ই পিছু নেয়নি। পাশের টঙে গিয়ে বলল,
–“আমাকে দুই কাপ চা দিন তো। হৃদয় ম্যাজম্যাজ করছে!”

দোকানদার অবাক চোখে চাইলো সিদাতের দিকে। কী ম্যাজম্যাজ করছে, তা বোধহয় বুঝতে পারেনি। সিদাত ভুরু কুচকে বলল,
–“তাকিয়ে আছেন যে?”
–“কী ম্যাজম্যাজ করছে বললা?”

সিদাত মাথা চুলকালো। আমতা আমতা করে বলল,
–“নাথিং, চা দিন। দুধ মেশানো চা কিন্তু!”

সিদাত চা দুই কাপ নয়, বরং পাঁচ কাপ খেলো। এক নাগাড়ে নয় অবশ্য। থেমে, থেমে। দুশ্চিন্তা, দোটানা, অস্থিরতা সব একসাথে তার ওপর হামলে পরেছে। এজন্যই এই চা খেয়ে মন ও মস্তিষ্ক ঠিক করতে চাইছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! মাগরিবের আযান পড়েছে। সিদাত চায়ের বিল পে করে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনয়কে ভয়েজ মেসেজ দিলো,

–“প্লিজ ভাই! তুই আজ আমার অফিসে আয়। অস্থির লাগছে। সলিউশন না পেলে আজকে আমি হোস্ট করতে পারবো না। জলদি আসিস!”
সিদাত মসজিদে ঢুকে পরলো।

—————
সিদাত তার মায়ের পাশে বসে আছে। জয়া আজ চোখ বুজে রয়েছে। সিদাতের উপস্থিতিতেও তিনি চোখ খুলছে না। চাপা অভিমানে জর্জরিত তিনি। সিদাত হতাশ হয়ে বলছে,
–“কথা বলবে না আমার সাথে? বিয়ে করবো না বলেছি দেখে এত রাগ?”

জয়া চোখ মেলল না।
–“আম্মা, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। সবে তো ভাইয়ার বিয়ে হলো। একটু তো সময় দাও আমায়?”
জয়া তাও উত্তর দিলো না। হঠাৎ দিয়া পেছন থেকে বলে ওঠে,

–“মা ততক্ষণ রাজি হবে না, যতক্ষণ না তোমার গার্লফ্রেন্ডকে সে নিজের ছোটো ছেলের বউ হিসেবে দেখছে!”

সিদাত পিছে ফিরে বললো,
–“মেয়েটা মোটেও আমার গার্লফ্রেন্ড নয় ভাবী। জাস্ট চেনা-জানা।”
–“সেই একই হলো। মায়ের চাওয়াটা পূর্ণ করাটা এখন তোমার দায়িত্ব!”

–“পূর্ণ করবো কী করে বলো ভাবী? সামান্য বন্ধুত্ব করতে গিয়েছিলাম, এতেই আমার মুখের ওপর বলে দিলো আমি নাকি মাতাল হয়ে তার বাসায় ঢুকেছি, তাই আমাকে মেনে নিবে না। আমি মোটেও ইচ্ছাকৃত মাতাল হইনি এটা তাকে কে বুঝাবে?”

জয়া এবার চোখ মেলে তাকালো। দিয়া হেসে দিলো। হাসি বজায় রেখে বলল,
–“দারুণ, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! মা, আপনার পছন্দ আছে!”

জয়া পলক ফেললো। সিদাত কিছুক্ষণ আপনমনে তার মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। মিনিটখানেক সময় নিয়ে বললো,
–“ওকে, ফাইন। করবো ওকে বিয়ে। তবে আমার কিছুটা সময় চাই।”

—–
–“এত ডাকাডাকি কেন?”
সিদাতের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। সিদাত চাপা স্বরে বললো,
–“আই থিংক, তুই রাইট!”

অনয় ভুরু কুচকে বলল,
–“প্রেমে পড়াটা?”
–“খাচা ভেঙে মন পালানোটা!”
সিদাতের এরূপ স্বীকারোক্তি শুনে অনয় হো হো করে হাসতে শুরু করলো। বলল,
–“একই তো!”
সিদাত আবার বললো,
–“বিয়ে বাড়িতে না গেলেই হতো। ওখানেই চব্বিশ ঘন্টা ঘুরঘুর করতো, মন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না!”
–“তাহলে আর চিন্তা কিসের? তুই কী খুশি হোসনি?”

এই পর্যায়ে এসে সিদাত হাসলো। বলল,
–“খুশি না হওয়ার কী আছে? অস্থির ছিলাম তোকে বলার জন্যে। দ্যাট’স ইট। আমি যথেষ্ট হ্যাপি নিকাব রাণীর মতো একজনকে পেয়ে। কেউ সাধনা করেও এরকম মেয়ে পায় না রে!”

–“তাহলে আর সমস্যা কী? ঝামেলা তো মিটেই গেলো!”

সিদাত হাসলো। পরমুহূর্তে অনয়কে বললো,
–“আমার আম্মা তরীকে পছন্দ করেছে আমার বউ রূপে!”
অনয় যেন আকাশ থেকে পরলো সিদাতের কথা শুনে। সিদাতের অধরে তৃপ্তির হাসি ঝুলছে। অনয় অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
–“সত্যি?”
–“হ্যাঁ! মা-ই জেদ ধরেছে আমার বউ দেখার। অবশ্যই তরীকে। কিন্তু বাবাকে বলব কী করে?”
–“বাবাকে বলার আগে শ্বশুরের মন জিততে হবে। শ্বশুর মেয়ে না দিলে তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার বন্ধু। এজন্যে আগে শ্বশুরকে প্রায়োরিটি দিতে হবে! সে পটে গেলেই ভেবে নে তোর লাইফ সেট!”

—————————-
সিদাত অনয়ের সাথে কলে কথা বলতে বলতে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। হঠাৎ অদূরে চাইতেই দেখলো আকবর সাহেব বাজারের ভারী ব্যাগ বয়ে হাঁটছে। সিদাত অনয়কে কল কাটতে বলে চোখের সানগ্লাস খুলে ফেললো। চুল ঠিক করতে করতে আকবর সাহেবের দিকে চলে গেল। প্রথমেই অমায়িক হাসি দিয়ে সালাম দিলো আকবর সাহেবকে। আকবর সাহেব হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
–“তুমি সিদাত না?”
–“জি আঙ্কেল। বাজারের ব্যাগটা আমায় দিন, আপনার বোধহয় কষ্ট হচ্ছে।”

–“আরে না, না। আমি পারবো।”
–“সেটা তো বললে চলে না আঙ্কেল। প্লিজ না করবেন না, আমাকে দিন!”

আকবর সাহেবের থেকে একপ্রকার জোর করে ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। এরপর দুজন একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন ব্যাপারে গল্প করতে লাগলো। সিদাত আকবর সাহেবের কাছে মাদ্রাসার ঠিকানা চাইলে আকবর সাহেব বলল,
–“হঠাৎ? কেন বাবা?”

–“একচুয়ালি আঙ্কেল, হঠাৎ নয়। আগামী সপ্তাহেই আমার দাদীর মৃত্যুবার্ষিকী। এজন্য বাবা প্রতিবারের মতো চাচ্ছেন কিছু মাদ্রাসায় মিলাদ পড়িয়ে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্যে৷ এতিমখানাতেও খাবার রান্না হবে। তাই আমি মাদ্রাসার ঠিকানা যোগাড় করছি!”

আকবর সাহেব সন্তুষ্ট হলেন সিদাতের কথা শুনে। যাক, অন্তত এই ধরণের ছেলেরা টাকা ওড়ায় না। খুবই নেক চাওয়া এগুলো। আকবর সাহেব সায় জানিয়ে ঠিকানাটা বলে দেয়। সিদাতের এখানে মিলাদ নিয়ে আকবর সাহেবকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছে নেই।

আজ ছুটির দিনে সকাল সকাল বের হয়েছেই এসব কারণেই। সাইফ বাজার, আয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখছে আর সে সর্বপ্রথম এতিমখানা, মাদ্রাসার খোঁজ করতে বেরিয়েছে। আকবর সাহেবের বাজার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে সে চলে গেলো মাদ্রাসায়।

পরের সপ্তাহে খুব সুন্দর ভাবে মিলাদ পড়ানো হলো। সাঈদ সাহেব নিজে সিদাতের নির্ধারিত এতিম খানা এবং মাদ্রাসাগুলোতে চক্কর দিয়েছিলেন। বাচ্চারা খুব খুশি হয়েছে সাঈদ সাহেব, সাইফ এবং সিদাতকে পেয়ে। তরী খবর কিছু কিছু জানলেও সেরকম কোনো পতিক্রিয়া করেনি। আকবর সাহেবের মুখেই শুনেছিলো।

তরী ছাদের এক পাশে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বিকালের শীতল বাতাস তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনে চোখ মেলে চাইলো। পাশে চাইতেই চমকালো। বিস্ময়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যায় তরী। সিদাত পশ্চিমাকাশে চেয়ে আছে আগের মতোই। তরী ভুরু কুচকে সিদাতের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তে পিছে ফিরে তরী অন্য দিকে যেতে নিলে হঠাৎ সিদাত উচ্চস্বরে বললো,
–“বিয়ে করবে আমায়?”

তরীর পা জোড়া না চাইতেও থমকে গেল। হতভম্ভ সে। পিছে ঘুরে সিদাতের দিকে তাকাতেই সিদাত মুচকি হেসে বললো,
–“এই প্রস্তাবই সরাসরি তোমার বাবাকে গিয়ে দিব। তুমি আমার মায়ের পছন্দ। আমার মায়ের পছন্দ আমি খোয়াতে পারি না নিকাব রাণী!”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ পর্বটা মন মতো সাজাতে পারিনি মনে হচ্ছে। ছোটো করে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত! ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৭]

সেদিনের পর তরীর বাসার বাইরে বা ছাদে অকারণে যাওয়াটা নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়েছে। অবশ্যই সিদাতের জন্যে নয়। অন্য এক কারণে। বাড়িওয়ালা তার বখাটে ভাতিজার জন্যে তরীর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সে নাকি প্রায়-ই ছাদে ওঠলে তরীকে দেখতো। যুবতী মেয়ে যতোই নিজেকে ঢেকে চলাচল করুক না কেন, কিছু পুরুষদের নজর তাদের ওপর পরেই। এজন্য আকবর সাহেব ইদানীং ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন।

যেই বাড়িতে ভাড়া থাকছে সেই বাড়িতেই এরকম একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। আকবর সাহেব প্রস্তাবে “না” করে দিলেও ওই ছেলে নির্ঘাত তার মেয়ের পিছু নিবে, মেয়েকে উত্ত্যক্ত করবে। মেয়েকে নিয়েই আকবর সাহেবের যত দুশ্চিন্তা। একজন মেয়ের বাবা হিসেবে সে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন তার মেয়েকে নিয়ে, মেয়ের সুরক্ষা নিয়ে। নয়তো আজকাল যা দিন পরেছে, কোথাও মেয়েদের সুরক্ষা নেই। ওদিকে সিদাত অস্থিরতায় কাহিল এই ভেবে যে তরী তাকে নীরবে রিজেক্ট করেছে।

রাতে ঘুম হয় না তার, খাওয়া-দাওয়া ঠিক ভাবে হয় না। তার নিজস্ব হৃদয় তার বেঁচে থাকাটাই কেমন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ মন বন্ধু নাকি শত্রু? উত্তর পায় না সিদাত। সাহস করেও সিদাত তার বাবাকে কিছু বলতে পারে না। বাবাকে খোলামেলা এসব বলা সম্ভব? সে তো আর সাইফ নয়, তার যথেষ্ট জড়তা কাজ করে বাবার সম্মুখে। একজন মানুষ কথা বলায় যতই পটু হোক না কেন সে কোনো এক জায়গায় গিয়ে ঠিকই থমকায়। সিদাতের বেলায় হয়েছে ঠিক সেরকম।

যবে থেকে তরীকে নিয়ে উপলব্ধি করতে শিখেছে ঠিক তখন থেকেই তার কাঙ্খিত চোখ জোড়া তাকে খুঁজে বেড়ায়। সেদিন ছাদের ঘটনার পর আর চোখের দেখা মিলেনি তরীর। সেই থেকেই সিদাত ব্যাকুল। সে প্রতিনিয়ত বুঝতে পারে তরী শুধু তার মায়ের পছন্দ নয়, তরী তার বাজে রকম পছন্দের। যেই পছন্দকে সিদাত খুইয়ে ফেলবে ভাবলেই চোখ জোড়ায় অন্ধকার দেখে। অনয়ের বলা টিপসে সে অনয়ের বাসাতে এখন তেমন যায় না বললেই চলে।

বাঙালি মেয়ের বাবারা ছেলেদের নিজের বাড়ি থেকে বন্ধুর বাসায় পড়ে থাকাটা মোটেও ভালো ভাবে নেয় না। ওদিকে অনয়টাও নাকি বাসা চেঞ্জ করবে, কয়েক মাস পর তার বিয়ে। এজন্যে আরও সাজানো-গোছানো ভালো বাসাতে কিছুদিনের মধ্যেই যাবে। তখন সিদাতের কী হবে?

————–
আকবর সাহেব চিন্তিত মনে বাসা থেকে বের হতেই দেখলো অনয়ের ফ্ল্যাট থেকে জিনিসপত্র নামছে। আকবর সাহেব ভুরু কিঞ্চিৎ কুচকালো। অনয় হঠাৎ বেরিয়ে আসতেই তাকে দেখতে পেলো। অনয় চওড়া হাসির সাথে সালাম দিয়ে খুবই নম্র গলায় বলল,
–“কী অবস্থা স্যার?”

আকবর সাহেব তার পেশাগত দিক দিয়ে একজন শিক্ষক। এজন্য অনয় তাকে স্যার বলেই সম্বোধন করে। আকবর সাহেব ম্লান হেসে বললো,
–“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। হঠাৎ বাসা বদলাচ্ছো যে?”

এই মুহূর্তে এসে অনয় কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরে। মাথা চুলকে লাজুক হেসে বললো,
–“একচুয়ালি স্যার, মাসখানেক পরেই বিয়ে তো। এজন্যে ভালো পরিবেশে…”

আকবর সাহেব অনয়ের ইনিয়ে বিনিয়ে বলা কথার অর্থ বুঝে মুচকি হাসলো। পরমুহূর্তে কী ভেবে আবার চিন্তিত হয়ে পরল। বলল,
–“তোমার চেনা-জানা ভালো পরিবেশে কোথাও বাসা আছে? আসলে আমিও কিছুদিন যাবৎ চাচ্ছি এই বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও শিফট হবো। থাকলে জানিও তো!”

অনয় বেশ চমকালো। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“হঠাৎ? কোনো সমস্যা?”

–“না, বাবা। তেমন কিছু না। তবে বাসা চেঞ্জ করাটা খুব জরুরি! আমিও সময়, সুযোগ পাচ্ছি না নতুন বাসা খোঁজার। এজন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তোমাকে বললাম।”

———–
তরী গলির মুখে রিকশা থেকে নেমে আপনমনে হাঁটতে লাগলো। বাসার পথ মিনিমাম পাঁচ মিনিট। এজন্যে হেঁটেই যাওয়ার সিদ্ধান্তি নেয় তরী। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ কিছু বখাটে তরীর পথ আটকে দাঁড়ায়। তরী এতে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। তবে সে নিজেকে নীরবে সামলে নিলো। মাঝের একদম সামনের ছেলেটাকে তরী চিনে। এটাই বাড়িওয়ালার সেই বখাটে ভাতিজা। বখাটে সোলেমান সিগারেট ফুঁকে তরীর দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি দিলো। তরী আগেই নজর অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখেছে। এসব ছেলেদের দিকে তাকাতেও তরীর ঘেন্না করে। সোলেমান বিদঘুটে গলায় বলল,
–“চাইছিলাম পর্দানীরে বিয়ে করে ভালো হবো। কিন্তু কেউ চায়-ই না আমি ভালো হই। এটা কী ঠিক বলো তো?”

তরী অস্বস্তিতে পরে গেলো। সৎ সাহস টুকু পাচ্ছে না এদের সবাইকে একসাথে দেখে। হাঁটু জোড়া ইতিমধ্যে কাঁপতে শুরু করেছে তার। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে কম্পিত গলায় বলল,
–“পথ ছাড়ুন!”

তরীর ভীতিগ্রস্ত কন্ঠস্বর শুনে সোলেমান হো হো করে হেসে উঠলো। সোলেমানের সাথে তার চ্যালারাও না বুঝেই হাসিতে তাল মেলাল। তরী তার হাত জোড়া মুঠি বদ্ধ করে এদিকে সেদিক কিছু একটা খুঁজতে থাকল। কিন্তু সেরকম কিছুই নজরে পরছে না।

সোলেমান হাসি বজায় রেখেই তরীর দিকে দুই কদম এগিয়ে এলো। তরী ভয়ে পিছিয়ে গেলো। সোলেমান বলল,
–“বাহ! ভয় লাগছে আমাকে? তা তোর হুজুর বাপের ভয় লাগেনি আমার প্রস্তাবে না করার সময়? বুঝে নাই তার একটা “না” তে আমি তোর কী হাল করতে পারি? তোর তো বেহাল করবোই সাথে তোদের সবগুলাকেও বাড়ি ছাড়া করব। তখন রাস্তায় বসে পর্দা চর্চা করিস কেমন?”

সোলেমানের এই ধরণের বিশ্রী কথায় তরী কেঁদে দিল। বলতে চাইল, “তোরা আল্লাহ্কে ভয় কর!”

সোলেমান তরীর হাত ধরতেই নিবে ওমনি কেউ তার হাত ধরে ফেলে। তরী “আল্লাহ্” বলে চিৎকার দিয়ে সরে আসে ভয়ে। চোখ জোড়া বন্ধ। সোলেমান রাগাম্বিত হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো সিদাত ধরে আছে তার হাত। সিদাতের পেছন থেকেই সাইফ মাথা বাঁকিয়ে সোলেমানের দিকে চেয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বলল,

–“ভালো আছো ছোটো ভাই?”

সাইফের গলা শুনে তরী চোখ মেলে তাকায়। সিদাত, সাইফকে একসাথে দেখে ভীষণ অবাক হয়। তার চাইতেও বেশি অবাক হয় সোলেমান সহ তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। সিদাতের চোখ জোড়া রাগে টগবগ করছে। সে মুহূর্তেই সোলেমানের হাত মুঁচড়ে দিলো। সোলেমান দাঁত, চোয়াল খিঁচে চাপা আর্তনাদ করে উঠল। সিদাত ভীষণ গম্ভীর গলায় বলল,
–“এত সাহস এসব নোংরা চিন্তা-ভাবনা মাথায় আনার, তাও আবার নিকাব রাণীকে নিয়ে? তোর এই হাত যদি তোর গলায় না ঝুলিয়েছি…”

বলেই আরও জোরে মুঁচড়ে ধরলো। সাইফ চট করে সকলের ছবি তুলে নিলো মোবাইলে। সেই ছবি গুলো জুম করে দেখতে দেখতে বললো,
–“ওয়াও! বাট একটু হাসলে ছবি গুলো আরও সুন্দর লাগতো!”

বিপদ অতি সন্নিকটে তা চ্যালাগুলোর বুঝতে বাকি রইলো না। এজন্যে যে যেদিকে পারে সেদিকেই ছুটে পালিয়েছে। একজন চেয়েছিলো সাইফের মোবাইল ছিনিয়ে ভাঙার। কিন্তু সবকিছু কী এত সহজ?

———-

পুরো মহল্লায় খবর ছড়িয়ে গেলো। বখাটে সোলেমান সহ আরও কিছু ছেলেরা হাসপাতালে ভর্তি। সকলেই বাজে রকম আহত। কে বা কারা এই কাজ করেছে তা কেউ জানে না। তবে এটুকু জানা গেছে সোলেমান কোনো এক মেয়েকে বাজে ভাবে উক্ত্যক্ত করছিলো, এজন্যই তাদের এ দশা।

কিন্তু মেয়েটি কে, কী তার পরিচয় তার কিছুই জানা যায়নি। সোলেমানের বাবা, চাচারা থানা-পুলিশ অবধি গেছে কিন্তু কেউ-ই বিশেষ সুবিধা দিতে পারেনি।

এসবটাই সামলাচ্ছে সাইফ এবং সাঈদ সাহেবের ম্যানেজার। আর এদিকে সিদাত তরীকে একের পর এক কল দিয়ে-ই যাচ্ছে। সিদাতের কাছে সেই প্রথম দিকেই তরীর নাম্বার ছিলো। কিন্তু সিদাতের কখনো প্রয়োজন পড়েনি তরীকে কল দেওয়ার। তরীর পছন্দ, অপছন্দ সবসময়ই খেয়াল রেখেছে সে। কিন্তু সেই ঘটনার পরপর তরীকে সে অনবরত কল করছে। তীব্র দুশ্চিন্তা তাকেও জেঁকে ধরেছে। ওই ঘটনা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং জঘন্য। যা তরীর মস্তিষ্কে খারাপ আঘাত আনতে পারে। তরীর মতো মেয়ে কখনোই এই ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। এজন্য এই ঘটনা মেনে নেওয়া তার পক্ষে ভীষণ দুঃসাধ্য ব্যাপার।

তরী প্রথমদিন সিদাতের কল ধরেছিলো যেদিন রাতের মধ্যে সোলেমান সহ তাদের সাথের গুলাকে ধরে উদুম মা* দেওয়া হয়েছিলো। সবই করেছে সাঈদ সাহেবের খুবই পুরানো লোক। স্বয়ং সিদাত করিয়েছে। এগুলা না করলে আগামী দিন তরীর মতো আরও মেয়েরা এদের কবলে পরবে। সবাই তো সবসময় তাদের বাঁচাতে আসবে না। এছাড়াও তরী এখন সিদাতের প্রাণ। প্রাণে কেউ খারাপ চিন্তায় স্পর্শ করতে আসলে তাকে অবশ্যই শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা সে রাখে।

তরী কল রিসিভ করার পরপর সিদাত শুধু এইটুকুই বলেছিলো,
–“এসবের চরম মূল্য চুকাতে হবে ওদের। শুধু কালকে থেকে চোখ-কান খোলা রেখো। সময় মতো সুন্দর খবর পেয়ে যাবে!”

ব্যাস! এটুকুই। তরীর অবস্থা আর জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি। তরী তৎক্ষনাৎ সিদাতকে ব্লকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। যা সিদাত বোঝা সত্ত্বেও মনে ক্ষীণ আশায় অসংখ্যবার কল করে চলেছে। কিছুদিন পর সিদাত সেই বাড়ি যাওয়ার পর জানতে পারে তরীরা বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও শিফট হয়েছে। এ খবর শোনার পরপর সিদাতের মাথায় যেন পুরো আকাশটা দুম করে ভেঙে পরলো।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

বিঃদ্রঃ খুবই তাড়াহুড়োয়, চোখে ঘুম নিয়ে লিখেছি। তাই ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here