হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব ২২+২৩

0
366

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২২]

দিয়ার সামনের সোফায় তার দুজন কাজিন বোন বসে আছে। দুজন অবাক চোখে নজর বুলাচ্ছে চারপাশে। বাড়ীর প্রতিটি কোণে কোণে যেন সৌখিনতা জ্বলজ্বল করছে। লিপি বলে উঠলো,
–“তোর কী ভাগ্য রে দিয়া। এত বড়ো শ্বশুরবাড়ি!”

দিয়া ওদের দিকে শূন্য নজরে চেয়ে রইলো। থমথমে সুরে বললো,
–“যদি সিদাতের জন্যে তোমরা এসে থাকো তাহলে তোমাদের লাক আসলেই খারাপ। সিদাত সচরাচর বাড়ি থাকে না। আজও নেই!”

লিপির পাশে বসা সুমির মুখখানা ভার হয়ে গেলো এ-কথা শুনে। লিপি হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–“কে বলেছে আমরা সিদাতের জন্যে এসেছি? ওর তো শুনেছি গার্লফ্রেন্ড আছে। নিজের মুখেই বলেছিলো। আমরা এসেছি আমাদের বোনের সাথে দেখা করতে। নাম্বার কেন বন্ধ করেছিস?”

দিয়া বিরক্ত হলো। ওদের এসব মধু ভরা কথা দিয়ার গায়ে বিঁধছে। এজন্য দিয়া বেশি কথা বাড়ালো না। খুবই নরম গলায় বললো,
–“আমি এখন ভার্সিটি যাবো। তোমরা আসতে পারো!”

লিপি দিয়ার এ-কথা শুনে চরম অপমানবোধ করলো। রেগে-মেগে উঠে দাঁড়ালো। সুমিকে টেনে দাঁড় করিয়ে বললো,
–“চল তো সুমি! বড়োলোক বর পেয়ে তার অহংকার বেড়ে গেছে। এর সাথে দেখা করতে আসাটাই ভুল হয়েছে!”
–“কিন্তু আপু সিদা..”

লিপি সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙানি দিলো বোনকে। সুমি দমে গেলো। দিয়া বাঁকা হেসে বললো,
–“আমার ভাব বরাবরই একটু বেশি আপা। তা কী তুমি ভুলে যাও? আমার আম্মু-আব্বুর সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করার দরকার নেই। আল্লাহ্ হাফেজ!”

ওরা চলে গেলো দিয়াকে গা* দিতে দিতে। ওরা চলে যেতেই দিয়া দারোয়ানকে কল দিয়ে বললো, ওদের দেখলে যেন ভেতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়। দিয়া অনেক সহ্য করেছে। এরা যে কখনো ভালো হবার নয় তা দিয়া হারে হারে বুঝেছে। মা-বাবাকেও নিষেধ করে দেয় যাতে ওরা কেউ দিয়ার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা চাইতে আসলে যেন তাদের ঠিকানা না দেয়। বাবা-মা নরম মানুষ। ভুলভাল বুঝিয়ে তাদের মানিয়ে নিলেও দিয়া এত নরম নয়। আপনজনরা যে ঘা এখনো দিয়ে যাচ্ছে সেটা দিয়া নীরবে গিললেও সহ্য করবে না।

ফিরোজা খাতুন আসলো হাতে নাস্তা নিয়ে। সোফা খালি দেখে ভারী অবাক হলো। দিয়ার উদ্দেশ্যে অবাক সুরে বললো,
–“একি! মেহমান কোথায়?”

দিয়া হাসার চেষ্টা করলো। আর যাইহোক তাদের এই নিচু রূপ শ্বাশুড়িকে বলাটা অস্বস্থি জনক। এজন্য দিয়া সত্যটা চেপে বললো,
–“হঠাৎ-ই জরুরি কাজ পরে যাওয়ায় ওদের যেতে হয়েছে!”

ফিরোজা তার বানানো পায়েশ এবং নুডুলসের দিকে তাকালো। দিয়া সব বুঝতে পেরে ফিরোজার কাছ থেকে খাবারের টলিটা নিজের কাছে নিয়ে বললো,

–“চলুন ছোটো মা, আজ দুই মা এবং এক মেয়ে মিলে এগুলো খেতে খেতে আড্ডা দিবো!”

–“কিন্তু তোমার ভার্সিটি?”

–“আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে। আপনি-ই বলুন, আমার ভাগ্য কত ভালো। আমি একসঙ্গে দুই মা পেয়েছি!”

ফিরোজা সন্তুষ্টির সাথে হাসি দিলো। আসলেই বড়ো ছেলের বউ হিসেবে দিয়া পারফেক্ট। বড়ো বউয়ের মতোই তার কথা-বার্তা, সকলকে আগলে নেওয়ার মতো দারুণ ক্ষমতা আছে তার। এটা ফিরোজা অস্বীকার করতে পারবে না। তবে দিয়া এখনো নতুন। সে জানে দিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাদের সাথে মানিয়ে চলার।

——————-
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরপর সকল মেয়েরা সাজগোছে ব্যস্ত হয়ে পরে। আজ মেহেদী অনুষ্ঠান। রাজিব তার মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনো কমতি রাখছে না। এজন্যে মেহেদী অনুষ্ঠানের ব্যাপারটাও সে হাসি-মুখে মেনে নিয়েছে। সাবিয়া তার মায়ের পাশে ঘুমোচ্ছে। কামরুন নাহার একটু চোখ বুজে শুয়ে আছে তাদের নির্ধারিত রুমে। আর আকবর সাহেব রাজিবের কাজে টুকটাক সাহায্য করছে।

সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে তরী পুকুর পাড়ে আসে। ওড়নায় আড়াল থেকে স্কেচবুক, ইরেজার এবং দুটি পেন্সিল বের করলো। চারপাশে তাকিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এখানে বিয়ে বাড়ির গ্যাঞ্জাম নেই। তাই একাকী এই পরিবেশের সাথে সময় কাটানোই যায়। সাজ গোছে কোনো কালেই তরীর আগ্রহ ছিলো না। এজন্য সে এভাবেই সময় কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া অনেকদিন যাবৎ স্কেচটাও করা হয় না। প্রিয় সখ অনেকদিন না করলে হাসফাস লাগে, অস্থির অনুভব হয়।

তরী তার সম্মুখে থাকা পুকুরপাড় এবং তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছগুলোর স্কেচ করতে লাগলো। তরীর অধরে মুচকি হাসি। খুবই ফুরফুরে মেজাজে সে স্কেচ করছে।

একে তো ভিন্ন পরিবেশ, গরম-ঠান্ডা আবহাওয়া, তার ওপর আজ পুকুরে গোসল করেছে। এতসব সিদাতের শরীর মানতে পারেনি। তার ঠান্ডা লেগে যায় এসবের কারণে।

মিরাজ ওকে মেডিসিন এনে দিয়েছে। মেডিসিন বলতে জাতীয় ওষুধ, নাপা এক্সটিন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরপরই একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিয়েছিলো সে। কিন্তু তাও নাক সুঁড়সুঁড় করছে, কাশিটাও অল্প-স্বল্প থেকে গেছে। মিরাজ রুমে নেই। সে নিচে কাজে ব্যস্ত।

সিদাত রুমে থাকা বড়ো জানালাটার সামনে এসে দাঁড়ালো। দো’তলা থেকে গাছ-গাছালি দেখা যাচ্ছে। পুকুরের এক অংশও দেখা যায়। পুকুরে চোখ যেতেই সিদাত জাম গাছের নিচে কাউকে অস্পষ্ট দেখলো বোধহয়।

গায়ের জামাটার রঙ দেখেই বুঝতে পারলো এটা তরী। কিন্তু এই ভর দুপুরে তরী পুকুরপাড়ে কী করছে? মন কেমন খচখচ করছে। অস্থির অনুভবও হচ্ছে। সিদাত সেখানে না দাঁড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। তরীর থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয়। তরীকে ভুলতে সে বাসায় কল লাগালো। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে তেমন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য নিরুপায় সিদাত মোবাইল বিছানার একপাশে ফেলে ধপ করে শুয়ে পরলো। সিলিং ফ্যান ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। আর মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হচ্ছে তরীময় কল্পনা, ভাবনা।

রাতের বেলা ছাদে উচ্চস্বরে গান বাজছে। সাবিয়া মুখ ঘুচে বসে আছে রুমে। তরী তাকে নিজ হাতে মাস্ক পরিয়ে দিচ্ছে। সাবিয়া মৃদু গলায় বললো,

–“না গেলে হয় না আপু? আমার গান-বাজনায় অস্বস্থি হচ্ছে। আবার যদি আমাদের কেউ ব্যঙ্গ করে? আমার ভালো লাগে না তাদের কথা শুনতে। খুব গায়ে লাগে।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
–“উপায় নেই। যেতেই হবে। তুই গান-বাজনা শুনেও না শোনার ভান করে থাকিস। আব্বার মত, আমরা কিছুতেই তাদের আনন্দে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আর কেউ কিছু বললেই বা কী? কারো কথাতেও কান দেওয়ার দরকার নেই। ওদের মুখ আছে, বলবেই।”

সাবিয়া চুপ করে গেলো। হয়তো তরীর কথাগুলো নিয়ে বারবার ভাবছে। তরী আরেকবার নিজেকে আয়নায় পরখ করে বললো,
–“চল। মৌসুমী আপা বোধহয় অপেক্ষা করছে!”

তরী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো তরীর ফুপি, ফুপা, শাওন, সানিয়া এসেছে। ওদের দেহে তরীর চোখ জোড়া চিকচিক করে উঠলো। ওরাও যে আসবে তরী তো ভাবতেই পারেনি। তরী ডাকলো শাওনকে। শাওন এবং সানিয়া তরীকে দেখতে পেলে ওরা খুশিতে ওই অবস্থাতেই উপরে এলো। সানিয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তরীকে। সানিয়া কলেজের জন্যে হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করছে। এজন্য সে বাসায় সেরকম থাকে না। তরীকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই সানিয়া আহ্লাদী গলায় বললো,

–“কতদিন হলো তোমাকে দেখি না আপু। কেমন আছ?”

তরী মুচকি হেসে বললো,
–“ভালো। চল। উপরে যাই আমরা!”

শাওন ভ্রু কুচকে সাবিয়ার দিকে চেয়ে আছে। সাবিয়া শাওনকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে,
–“কেমন আছো ভাইয়া?”
–“ভালো আছি। তবে তোর এই বেশভূষা অবাক করছে!”

সানিয়া তৎক্ষণাৎ শাওনের পিঠে দুম করে মা*লো। বয়সের তুলনায় শাওন সানিয়ার থেকে কিছুটা লম্বা হয়ে গিয়েছে। এজন্যে চুল টানার বদলে পিঠে-ই মা*লো। চোখ রাঙিয়ে বললো,
–“আজেবাজে কথা বললে আম্মার কাছে বিচার দিবো কিন্তু। সবসময় সাবিয়াকে খ্যাপাশ কেন?”

শাওন দাঁত কেলিয়ে হাসলো। সাবিয়া মাস্কের মধ্যেই গাল ফুলালো। শাওনটা আসলেই বেশি বেশি।

তরীর ফুপির সাথে রাজিবদের সম্পর্ক ভালো। এজন্যে রাজিব ওদেরকেও দাওয়াত দিয়েছে। এবং খুব করে অনুরোধ করেছে যেন বিয়ের প্রত্যেক অনুষ্ঠানেই তারা উপস্থিত থাকে। এজন্যে তারাও বারণ করেনি। ভাবলো কয়েকদিন এখানেই বেড়ানো যাক।

ছাদে আসতেই উচ্চস্বরে গান-বাজনায় তরীর মাথা ধরে গেলো। শাওনকে দিয়ে মিরাজকে ডেকে এনে গানের স্বর কিছুটা কমাতে বললো। মিরাজ তরীর সমস্যা বুঝতে পেরে গানের শব্দ কমানোর জন্য চলে গেলো। মিরাজ তরীর থেকে দুই বছরের বড়ো। মাস্টার্স প্রথম বর্ষে আছে সে।

সিদাত হেসে হেসে কথা বলছিলো। এমন সময় গেটের দিকে চোখ যেতেই সে কিছু থমকালো। বাহারী আলোয় তরীর চোখ জোড়া খুব সুন্দর লাগছে। তরীর চোখ নিভু নিভু, ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকানো। এতেই সিদাতের কাছে তরীকে অনবদ্য লাগছে। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নজর ফিরিয়ে নিলো। ঠিক তখনই সাবিয়া তরীকে খোঁচা দেয়। তরী ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো সাবিয়ার দিকে। সাবিয়া দূরে ইশারা করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,

–“ওইযে দেখো আপু। সিদাত ভাই। এতক্ষণ তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো!”

এ-কথা শুনে তরী কিছুটা চমকালো। সাবিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে কিছুটা দূরে তাকাতেই সিদাতকে দেখতে পেলো। তরীর কিছু ভাইদের সাথে বেশ হাসি-মুখেই কুশল বিনিময় করছে। গায়ে তার বাদামী পাঞ্জাবি জড়ানো। সানিয়া হঠাৎ পাশ থেকে বলে ওঠে,

–“আরে ওটা আরজে সিদাত মনে হচ্ছে না? হায় আল্লাহ্! আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব? এই শাওন, আমাকে একটা চিমটি কাট তো!”

সাবিয়া চাপা হাসি দিলো। তার অবচেতন মনে আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে। সানিয়া সিদাতকে সরাসরি দেখেই কুপোকাত। অথচ সাবিয়া এবং তরী তাকে প্রতিনিয়ত দেখেই চলেছে। মনের ভেতর নিজেদের বিশেষ মনে হলো।

শাওন সানিয়ার হাতে চিমটি না কেটে সিদাতের দিকে আগালো। সানিয়াও ঘোরের মধ্যে শাওনের পিছু পিছু চলতে শুরু করে। সানিয়ার জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তরী এবং সাবিয়াও তাদের পিছু নিলো। শাওন সিদাতের সামনে দাঁড়িয়ে না থেমে গড়গড় করে বলতে লাগলো,

–“হ্যালো ভাইয়া, আমি শাওন। মনে আছে আমাকে? আমার বোন আপনার উপর ইম্প্রেসড, আপনার নাম্বার চাইছে।”

সানিয়া কাছাকাছি-ই ছিলো। শাওনের শেষ কথাগুলো কানে প্রবেশ করতেই সানিয়া স্তব্ধ, হতবাক হয়ে পরলো। হুঁশ এলো তার। হা করে চেয়ে রইলো শাওনের দিকে। সে আবার এ-কথা কখন বললো? একেই বোধহয় বলে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা!

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৩]

মুহূর্তে-ই সিদাতের আশেপাশে থাকা ছেলেরা অর্থাৎ মৌসুমীর ভাইয়েরা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। সিদাত হতভম্ভ এরকম কথা শুনে। তরী বেশ চমকে তাকালো শাওনের দিকে। শক্ত গলায় শুধালো,
–“সানিয়া মোটেও এরকম কিছু বলেনি। কেউ হাসবেন না। শাওন মজা করছে।”

তরী থেমে গিয়ে গলায় আরও কিছুটা কাঠিন্য ফুটিয়ে শাওনের উদ্দেশ্যে বললো,
–“বোনকে সম্মান করতে না পারো, অন্তত মানুষের কাছে তাকে হাসি পাত্রী বানিও না!”

সানিয়া লজ্জায় সটান মে*রে দাঁড়িয়ে ছিলো। তরী সানিয়ার হাত ধরে অন্যদিকে চলে গেলো। তরীর কথাগুলো শাওনের কানে পৌঁছাতেই তার মুখ ভার হয়ে গেলো। সে তো শুধু মজা নিচ্ছিলো। তাই বলে তরী তাকে এত কঠিন কথা বলে গেলো?

তরী সানিয়ার মন ভালো করতে মৌসুমীর কাছে নিয়ে গেলো। মৌসুমীর আশেপাশে মেহেদী পরানোর জন্যে মেয়েরা রয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে তরী বললো যাতে সানিয়াকে মেহেদী পড়িয়ে দেয়। রাজি হলো সেই মেয়েটি। মুহূর্তে-ই সানিয়ার অধর জোড়া প্রসারিত হলো। তা দেখে তরীও হাসলো।

মৌসুমীকেও ভীষণ খুশি দেখা যাচ্ছে। মৌসুমীর খুশি দেখে তরী একটু শান্তি পেলো। মৌসুমী হাত দিয়ে তরীকে কাছে ডাকলে তার দিকে এগিয়ে গেলো তরী। মৌসুমী বললো,

–“জানিস, ঢাকা থেকে আমার ননদ, আর কিছু দেবর’রা আসছে। আমার দারুণ অনুভূতি হচ্ছে রে তরী! শুনেছি ওরা আমার বেনারসি, অলংকার, নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব একসাথে আজ-ই নিয়ে আসছে!”

মৌসুমীর পাশে বসা মৌসুমীর সেই খালার মেয়ে আনিকা বললো,
–“কিছু ভাগ আমাকেও দিও আপু। না জানি কোন মার্কেট তুলে আনছে!”

মৌসুমী সে-কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিলো। এমন সময় সেই মেয়েটি-ই আবার বললো,
–“ওরা আসলে আমরা কিন্তু সবাই মিলে নাচবো! ঠিকাছে তরী?”

তরীর চোখ কপালে উঠে যায় এ-কথা শুনে। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো আনিকার দিকে। নিজেকে ধাতস্থ করে হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
–“আরে ধুর। কী সব বলছো?”

তরী সাবিয়াকে খোঁজার বাহানায় সেখান থেকে চলে এলো। গা ঘিনঘিন করছে তার। তরী যেতেই মৌসুমী ধমকালো আনিকাকে। বললো,

–“তরীকে নিয়ে সমস্যা কী তোদের? ওর পিছে কেন লাগিস? জানিস না ও ব্যতিক্রমধর্মী? কেন নিচু কথা বলে ওকে অস্বস্থিতে ফেলিশ?”

আনিকা হাসলো। পৈশাচিক হাসি। মৌসুমীর কথা গায়ে না মেখে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,

–“কাকে কী বলছো আপু? এই মেয়ে পর্দাশীল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী? আমার তো এগুলা কল্পকথা ছাড়া কিছুই মনে হয় না। এত প্রেক্টিসিং মুসলিম হলে কখনোই এত গান-বাজনা দিয়ে ঘুরে বেড়াত না। এগুলা হুদাই ঢং করে মানুষদের দেখানোর জন্যে। যাতে সবার নজর, আকর্ষণ অর দিকে যায়। শহুরে মেয়ের মতলব বুঝি না ভাবছো? হাহ্!”

মৌসুমী আবার ধমকালো। আনিকা শুনলো না। সে নিজের মতো বলেই যাচ্ছে। এসব বলে সে ভেতরটা নরম করতে চাইছে। যেন তার মন জুড়ে তরীর জন্যে নীরব ক্ষোভ পুষে রেখেছে। যা প্রকাশ করার মোক্ষম সুযোগ সে পেয়েছে। মৌসুমীর অপর পাশে বসা সানিয়া আনিকার দু’একটা অস্পষ্ট তিক্ত বাণী শুনতে পেলো। কিন্তু সে কিছু বললো না। মূর্খদের সাথে তর্কে জড়াতে নেই।

এশার আযানের ঠিক পরপর-ই মৌসুমীর শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন এলো। তরী এবং সাবিয়া তখন নামাজ পড়তে নিচে চলে গেছে। আযানের সময় থেকে গান-বাজনা বন্ধ। রাজিব সাহেবের কড়া নির্দেশ, নামাজের সময় শেষ না হওয়া অবধি গান বাজানো যাবে না।

সিদাত দেখেছে আযানের সময় তরীকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে চলে যেতে। কেন যাচ্ছিলো তা বোধহয় সিদাত ধারণা করতে পেরেছে। এজন্যে দু’একটা হাঁচি দিয়ে শাওনকে নিয়ে সেও মসজিদের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। শাওন তো সেই খুশি। তার পছন্দের আরজে তাকে নিয়ে মসজিদে যাবে, একসাথে নামাজ পড়বে। এমন হলে শাওন বারবার মসজিদে যেতে রাজি।

তরী সালাম ফিরিয়ে খাটের দিকে তাকাতেই কিছুটা চমকে গেলো। খাটে বসে একটি অল্প বয়সী মেয়ে তরীদের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। তরী অপ্রস্তুত হয়ে নজর ফিরালো। মেয়েটি তরীর সম্পূর্ণ অপরিচিত। তরী চোখ বুজে মোনাজাত শেষ করে আবার খাটে তাকাতেই দেখলো মেয়েটি আগে মতোই চেয়ে আছে।

তরী জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তার কিছুক্ষণ বাদে সাবিয়াও জায়নামাজ নিয়ে দাঁড়ালো। তরী মেয়েটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারে মেয়েটি হয়তো সানিয়ার বয়সী। সাবিয়া মেয়েটির দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। অস্ফুট স্বরে বললো,

–“তোমাকে তো চিনতে পারলাম না!”

মেয়েটা হাসলো। বললো,
–“আমি সাদিয়া। মৌসুমী ভাবীর একমাত্র ননদ। তোমরা?”

তরী এবার চিনতে পারলো। আলতো হেসে বললো,
–“মৌসুমী আপু আমাদের মামাতো বোন!”

মেয়েটার চোখ-মুখ চকচক করে উঠলো। খুশি মনে আওড়ালো,
–“লম্বা জার্নি করে আমি ভীষণ ক্লান্ত। বলা বাহুল্য একটু অসুস্থ হয়ে পরেছি। বিশ্রামের জন্যে আমাকে এই ঘরে পাঠানো হলো। আমি রুমে এসে দেখি তোমরা দু’জন নামাজ পড়ছো। দেখতে কী যে ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছে ক্লান্তি সব ধুঁয়ে মুছে সাফ!”

তরী আবারও হাসলো। সাদিয়ার সাথে ওরা দুজন পরিচিত হয়ে নিলো। সাদিয়া খুশি-মনে ওদেরকে নিজের সঙ্গী করে ফেললো।

ছাদে আসতেই আবারও গান-বাজনা শুরু হলো। সাদিয়ারা ঘন্টা দুয়েক থেকে আবারও রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। সাদিয়ার সাথে আসা ছেলেগুলো বড্ড উশৃঙ্খল ছিলো। তরীর তো ওদের মোটেও ভালো লাগেনি। তবে তরীর বোনে’রা হাসি-তামাশা করছিলো খুব।

সিদাত সারাদিন কোনোরকমে থাকলেও বাইরের ঠান্ডা বাতাসে তার গায়ে জ্বর বাঁধলো। ছাদে তখনো হৈচৈ চলছে। সিদাতের শরীর খারাপ লাগায় সে নিচে চলে এসেছে। বিছানা গা এলিয়ে দিতেই আর মাথা তুলে বসার মতো অবস্থা হলো না তার। কোনোরকমে পাঞ্জাবি বদলে একটি টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলো। উপরের সিলিং ফ্যানটা বন্ধ।

গান-বাজনায় আর থাকতে পারছিলো না তরী। মাথা অসম্ভব ব্যথা করছে তার। এজন্যে সাবিয়াকে মায়ের কাছে রেখে মৌসুমীর ঘরের দিকে যাচ্ছিলো পেইন কিলারের জন্যে। মৌসুমী জানিয়েছে তার ঘরে পেইন কিলার আছে। হঠাৎ সিদাতের ঘরে চোখ যেতেই দেখলো সিদস্ত কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। চেহারাটাও কেমন শুকিয়ে আছে।

এর মাঝে সিদাত একবার হাঁচি দিলো, খুঁক খুঁক শব্দে কাশলো। তরী চেয়েও সিদাতকে এড়িয়ে যেতে পারলো না। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে নীরবে পর্যবেক্ষণ করলো সিদাতকে। তবে তরী রুমের ভেতরেও প্রবেশ করলো না।

সানিয়া শাওনকে এড়িয়ে চলছে। বড্ড অভিমান জমেছে তার মনে। ছোটো ভাইটা এভাবে বেফাঁস কথা বলে তাকে এভাবে লজ্জায় ফেলবে বুঝতে পারেনি। এজন্য সানিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাওনকে এড়িয়ে চলবে। তবে শাওনের মোটেও এই ব্যবহার পছন্দ হচ্ছে না। বারংবার বোনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে সে।

–“এই আপু। শোন না!”

সানিয়া শাওনের ডাকে দাঁড়ালেও জবাব দিলো না। শাওন থেমে আবার বললো,
–“স্যরি আপু। আমি বুঝতে পারিনি আমার মজাটা এরকম হয়ে যাবে। আর কখনো করবো না এরকম মজা। প্লিজ কথা বল।”

সানিয়া ভারী গলায় বললো,
–“ব্যস্ত আছি। অন্য হাতের মেহেদী ওঠাতে হবে। পরে কথা বল!”

সানিয়া চলে গেলো। শাওন হতাশ নজরে সানিয়ার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। এমন সময় তরী চাপা স্বরে শাওনকে ডাকলো। বললো,
–“জলদি আসো। তোমার সাথে আমার কাজ আছে!”

তরী শাওনকে নিয়ে সিদাতের রুমের দরজায় দাঁড়ালো। শাওন ভেতরে গিয়ে সিদাতের গালে, কপালে হাত রাখলো। মুহূর্তে-ই সে চমকালো। অস্ফুট স্বরে তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
–“সিদাত ভাইয়ার যে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তরী আপু!”

তরী নামটা সিদাতের কান দিয়ে প্রবেশ করলো। কোনোরকমে চোখ মেলে চাইলো সে। নিভু নিভু নজরে এপাশ ওপাশ চেয়ে শেষে দরজায় তার নজর আটকালো। অস্পষ্ট গলায় শুধালো,
–“নিকাব রাণী!”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here