#আষাঢ়ে_প্রণয়
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
রিধি রুমে ঢুকেই মেঝেতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ মা আসতেই সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।
-‘রিধি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়। সবাই এখনই বেরিয়ে পড়বে।’ বলেই চলে যেতে নিলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফিরে বলে উঠল,
-‘এ কী রিধি। তোর চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন!’
-‘মা আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি বরং না যাই?’
-‘তোর মাথা ব্যথা বেশিক্ষন থাকবে না। ওষুধ খেয়ে নেয়। দ্রুত আয়।’ বলেই তিনি প্রস্তান করলেন।
রিধি জানে তার মা অনেক কঠোর। পরে হয়ত সন্দেহ করবে। রিহান ভাইয়ের মা নেই। তাই তো রিধির মা সুলতানা বেগম একদম নিজের মতো করেই রিহানকে ভালোবাসেন। বিয়ে থেকে নিয়ে সব একহাতেই সামলাচ্ছেন তিনি। এখন যদি না যায় তাহলে মা রেগে যাবে। তাই রিধি চুপ মেরে গেল। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রেডী হয়ে মনকে শক্ত করে সবার সাথে বেরিয়ে পড়ল।
.
.
তিশা আপুকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। রিহান ভাইয়ের সাথে তিশা আপুর বসার পর থেকেই রিধির কান্না পাচ্ছে। তিশা আপুর পাশেই তার অসুস্থ মা হুইল চেয়ারে বসে আছে। তার পাশেই মকবুল শেখ দাঁড়িয়ে আছে। তিশা আপুর বাবা নেই আর রিহান ভাইয়ের মা নেই। রিহান ভাইয়ের মা আর তিশা আপুর মা দুজন দুজনের বোন ছিলেন। রিহান ভাইয়ের মা যখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তখন তিনি মকবুল শেখকে তার একটা ওয়াদা রাখার প্রতিশ্রুতি দেন, তার বিধবা ছোট বোনটার একমাত্র মেয়েকে যেন তিনি রিহানের বউ হিসেবে ঘরে তুলে। মকবুল শেখও তার প্রানপ্রিয় স্ত্রীর ওয়াদা মেনে আজকে এই বিয়ের আয়োজন করলেন কিন্তু এসবের ব্যাপারগুলো শুধু বড়োরাই জানতো, রিহান-রিধি কেউই জানতো না। যার ফলে আজ দুজন মানুষ না বুঝেই এতটা কষ্ট পাচ্ছে।
রিধি আর কিছু না ভেবে মলিন চোখে তার সামনে একসাথে বসা রিহান ভাই আর তিশা আপুর দিকে তাকিয়ে রইল।
বিয়ের কবুল বলার সময় রিহান এক ফলক চোখ তুলে ভিড়ের মাঝে রিধির দিকে তাকালো। রিধি ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। রিহান তাকাতেই সে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে পেছন ফিরে চলে আসতে নিলো। সবাই রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে কবুল বলার জন্য। রিহান দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিধির দিকে আরেক ফলক তাকালো। যে চাহনীতে স্পষ্ট অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। যেন রিহান বোঝাতে চাচ্ছে এখনো সময় আছে রিধু। রিধি পিছু ফিরে গেল। সে শুনতে পারবে না রিহান ভাইয়ের কবুল বলা। এখন থেকেই এমন লাগছে তবে বাকি জীবন সে কীভাবে থাকবে?
রিধির এতসব ভাবনার মাঝে পেছনে আশেপাশের আওয়াজ কানে বাজতে লাগলো। সবাই রিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কবুল বলার জন্য। সবার ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। সবার জোরাজোরিতে রিহান কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কবুল বলতে নিবে সেই সময়ই রিধির মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে কী তাহলে সহ্য করতে পারছে না! এমন কেন লাগছে তাহলে? সে কী পারবে না অন্য মেয়েদের মতো নিজের সুখটা বিসর্জন দিতে! সে কী এতোই স্বার্থপর হয়ে গেল? পেছনে থাকাতে কারোর দৃষ্টি রিধির উপর পড়লো না। রিধি পড়ে যেতে যেতেই শেষবারের মতো রিহান ভাইয়ের দিকে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। সবার দৃষ্টি যখন রিহানের দিকে, তখন রিহানের দৃষ্টি তার প্রাণেশ্বরীর দিকে। রিধির পড়ে যাওয়াটাও রিহানই দেখলো।
—-
রিধি চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালে’র ব্যাডে আবিষ্কার করলো। পাশেই রিধির মা সুলতানা বেগম মেয়ের হাত ধরে বসে আছে। সিহান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সিহান বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে তার বোনটার কী হলো! রিহানের বিয়ের কথা চলাকালীনের পর থেকে তার এই চঞ্চল বোনটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল।
-‘কিরে মা! কী হয়েছে তোর? আমিও এতো তাড়াহুড়োর মধ্যে তোর খাবারের খেয়াল রাখতে পারিনি আর তুইও সেই সুযোগে আর খাস নি। তুই বুঝিস না? ওই ফ্ল্যাটে আমি একজন দেখাশোনা ছাড়া আর কেউ নেই। রিহানের মায়ের মতো করে সব কিছু আমাকেই গোছাতে হচ্ছে যার ফলে আমার তোর প্রতি তেমন খেয়াল ছিল না। তুই কী এখনো ছোট? তুই যে এখনো সুযোগ পেলেই খাবারের এমন অনিয়ম করিস যার ফলাফল আজকের এই হাসপাতালের ব্যাডে। তোর বাবা জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখছিস? আর করবি না এমন। আর এতো কীসের টেনশন করিস? এই বয়সে মাথায় এতো কীসের চাপ দিস? ডাক্তাররা এসব কী বলে গেল!’ সুলতানা বেগম বলে উঠল রিধিকে উদ্দেশ্য করে।
-‘আহ মা, রিধি মাত্রই উঠল এমন করছো কেন?আই বোন, এগুলো খেয়ে নেয়। তোর খাবারের অনিয়মের জন্য এমন হচ্ছে। এগুলো খেয়ে ওষুধ খেয়ে নেয়। তারপর আমরা চলে যাবো বাসায়।’ বলেই সিহান রিধির দিকে স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ এগিয়ে দিল।
রিধি ভাইয়ের দিকে ঝাপসা চোখে একবার তাকিয়ে খেয়ে নিলো।
খেতে খেতেই হঠাৎ খেয়াল হলো, আচ্ছা সে তো বিয়ের স্থানেই পড়েছিল । তাহলে রিহান ভাই কী একবারও দেখলো না! এক ফলকের জন্যও রিধিকে দেখতে আসলো না! মানুষটার কথা ভাবতে গিয়েই তার কবুল বলতে নেয়ার চেহারাটা চোখে ভেসে উঠলো। হয়ত বিয়ে করে তার নতুন বউয়ের সাথেই আছে। এখন আর রিধির কথা ভাবার সময় নেই। রিধির চোখ বেয়ে হঠাৎ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
রিধিদের ক্যাবিনের বাইরে দরজার কাঁচটা দিয়ে রিহান এক ফলক রিধির দিকে তাকালো। সে আজ চাইলেও রিধির পাশে যেতে পারছে না। মাত্র একদিনের ভেতর মেয়েটার চেহারা একদম শুকিয়ে গিয়েছে। রিধিকে সর্বপ্রথম তার চোখেই পড়েছিল। সে যে তার রিধিকে না দেখে এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারবে না। তাই তো ছুটে আসলো।
ডাক্তার ক্যাবিন থেকে বের হওয়ার পর পরই রিহান ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল রিধির ব্যাপারে। রিধির কান্নারত মুখ দেখে রিহানের ইচ্ছে হলো এখনই গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে রাখতে কিন্তু এই সময়টা এখনো আসেনি। রিধির দিকে তাকাতে তাকাতে রিহানের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ভেতরে সিহানকে উঠে যেতে দেখে রিহান তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সরে গেল কিন্তু সিহান খেয়াল করে ফেলল। রিহানকে এখানে দেখে সিহানকে চিন্তাগ্রস্থ দেখালো। কিছু একটা ভেবে তার কপাল কুঁচকে গেল। সে দ্রুত বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক তাকালো কিন্তু রিহানকে আর দেখা গেল না।
রিধির হঠাৎ মনে হলো দরজার কাঁচ দিয়ে ওই পাশে রিহান ভাইয়ের মতো কাউকে জানি সরে যেতে দেখেছে। রিধি দরজার দিকে আবারো দৃষ্টি দিল। কই না, এখন তো আর দেখা যাচ্ছে না! হয়ত তার দেখার ভুল। রিহান ভাইয়ের আজ বিয়ে হয়েছে, সে তিশা আপুকে ছেড়ে কেন রিধির জন্য এখানে আসবে!
সিহান ফিরে এসে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রিধিকে ধরে হাসপাতালের সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পূর্ণ করে বোনকে গাড়িতে তুলে দিলো। অবশ্য হাসপাতালের কতৃপক্ষ একদিন রেখেই রিধিকে ছাড়তে চেয়েছিল কিন্তু রিধি হাসপাতালে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে ভেবে সিহান জোর করে নিয়ে এসেছে।
রিধির পাশে সুলতানা বেগম উঠে রিধিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। তিনি বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করেই মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। আশেপাশের এগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে নিজের মেয়েটার দিকেই ভালোভাবে নজর দিতে পারলো না যার ফলে তার মেয়ে আজ এমন পরিস্তিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, এসব ভেবেই তার নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হলো। মেয়ের সাথে অতটা ফ্রি না হওয়াতে মেয়ে তার থেকে যথেষ্ট দুরুত্ব বজায় রেখে চলতো। সুলতানা বেগমও আর নজর দেয়নি কিন্তু এখন বুঝতে পারছে। তার জন্যই হয়ত তার মেয়ে আজ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি এসব ভাবতেই ভাবতেই রিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। রিধি একদম ছোট বাচ্চার মতো গুটিসুটি মেরে তার মায়ের বুকে স্থান নিয়েছে।
হঠাৎ রিধি তার মায়ের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে আশেপাশে তাকালো। তার মনে হলো, রিহান ভাই এখনই তার গাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছে কিন্তু এদিক সেদিক তাকানোর পরও সে রিহান ভাইয়ের কোনো অস্তিত্ব দেখতে পারেনি। তার মস্তিষ্কে এখন শুধুই রিহান ভাই চলাফেরা করে। রিধি মলিন হাসলো। সব তার ভ্রম।
বাসায় ফিরতেই দুতলার ফ্ল্যাট ডিঙিয়ে উঠার সময় মকবুল শেখকে দরজায় চিন্তাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। রিধিকে দেখতেই তিনি তার চিন্তার চেহারায় কোনোমতেই একটা হাসি টেনে আনলো। সিহানের কাছ থেকে তিনি রিধির সব খবরাখবর নিয়েছেন। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
-‘কিরে মা, খানা পিনা ঠিকমত না খেলে চলবে? ঠিকমত খাবি তো মা।’
রিধি ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়তেই মকবুল শেখ সিহানকে রিধির সাথে যেতে বললেন। রিধিকে সিহান ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মকবুল শেখ আর সুলতানা বেগমের কথোপকথন শুনে থমকে গেল।
-‘ভাইসাব, আপনাকে এমন চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে ক্যান? আপনি এভাবে দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন যে?’
-‘রিহান বাসায় ফেরেনি এখনো। ছেলেটার মোবাইলও বন্ধ।’ মকবুল শেখ থমকে যাওয়া কণ্ঠে বলল।
রিধি যেতে যেতেই বড়ো মামার এমন কথা শুনে থমকে গেল। তার মানে হাসপাতালে রিহান ভাইকে দেখা তার ভ্রম ছিল না, সেটা সত্যিই রিহান ভাই ছিল! কিন্তু এখন এসব করে কী হবে! উল্টো দুজনের মাঝে তৃতীয় জন হিসেবে তিশা মেয়েটাই কষ্ট পাবে।
সিহান বোনের থেমে যাওয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রিধি এবার হেঁটেই রুমের ভেতর প্রবেশ করলে সিহান বলে উঠল,
-‘বোন তুই গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে। আমার একটু কাজ আছে। বাইরে যাচ্ছি।’
রিধি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সিহান দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। সে ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানে তার ভাই এখন রিহানকে খুঁজতে যাচ্ছে আর খুঁজে পাবেও। রিধির মাঝে মাঝে ভয় হয়, যদি রিহান ভাই সিহান ভাইকে এসব কিছু বলে ফেলে তাহলে সিহান ভাই কী করবে তা রিধি ভাবতেও পারে না। রিধির কারণেই এই একটা মাত্র কথা রিহানভাই সিহানভাইকে বলেনি এতো কাছের ভাইয়ের মতো হয়েও। রিধিই ওয়াদা নিয়েছিল রিহানের কাছ থেকে – যাতে রিহান রিধির ভাই সিহানকে কথাটি না বলে। যদি মকবুল শেখ রাজি হয় তাহলে রিধির পরিবার জানবে এদের প্রণয়ের কথা। কিন্তু রিহান মকবুল শেখকে তাদের দুজনের কথা বলার আগেই এসবকিছু ঘটে গেল। রিধি আর কিছু না ভেবে রুমে চলে গেল। রাত ঘনিয়ে আসছে। সিহান রিহান কেউই বাড়িতে ফেরেনি। রিধির দুশ্চিন্তা হতে লাগলো।
#চলবে ইন শা আল্লাহ
(আসসালামু আলাইকুম। রি-চেক করা হয়নি। আমার একটা স্বভাব হচ্ছে আমি মানুষের কথা বেশি শুনি। কেউ আমাকে ইমোশনালি কোনো কথা বললেই আমি সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়। যেমন এই গল্পটি দেওয়ার সময় ভেবেছিলাম এটা বাস্তবতা সাপেক্ষে লিখবো আর এন্ডিংটা পুরোপুরি অন্যরকম হবে কিন্তু সবখানে কিছু ইমোশনাল কথা শুনে আমারো আর ইচ্ছে হয়নি এন্ডিং ঐভাবে দেওয়ার। কিন্তু গল্পটা নতুন ভাবে ভিন্ন এন্ডিংয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আপনাদের জন্য পারলাম না। এই মানুষের কথা বেশি শুনি এজন্যই বোধহয় প্রতি পদে পদে ভুল করি। কিন্তু কী আর করার! গল্পঃ লিখছি আমি পাঠকদের জন্যই। তাই অন্য রাইটারদের মতো ভেবে রাখা এন্ডিংটা দিতে পারলাম না। পাঠকদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলাম। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখবেন দয়া করে। দ্রুত আরেক পর্বে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করবো। প্লিজ যারা পড়েন রেসপন্স করবেন। ভালোবাসা নিবেন।)