আষাঢ়ে প্রণয় পর্ব ১

0
699

আজ রিহান ভাইয়ের হলুদের রাত। রিধির ভেতরে র”ক্ত’ক্ষরণ হচ্ছে। সকাল থেকে নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক রাখলেও এখন আর পারলো না। সে কোনোমতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রুমে এসে পড়লো। বিছানায় শুয়ে বালিশ চাপা দিয়ে রইল । ফ্ল্যাটের বাইরে ব্যালকনি দিয়ে বিয়ের লাল-নীল বাতিগুলো ঝলঝল করছে। সেই আলোতে অন্ধকার রুমটা নানারঙে মাতিয়ে উঠছে। রিধি বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে আসলো। গ্রিলের বাইরে লাল নীল বাতিগুলো একবার পরম আদরে ছুঁলো। না চাইতেও চোখ গড়িয়ে পানি ঝরে পড়লো। বাতিগুলোর দিকে আরেকবার তাকালো। যখন থেকে মানুষটার প্রতি অনুভূতি জন্মালো তখন থেকে এই বাতিগুলো তার সুখের স্বপ্ন ভেবে এসেছিল কিন্তু কে জানতো এই বাতি যেদিন জ্বলবে সেদিন রিধির ভেতরে রক্তক্ষরণ হবে! এমন কেন হলো নিয়তিটা?

গভীর রাতে হঠাৎ অনুভব করলো রিধির পায়ের ধারে কেউ একজন বসে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। রিধি জানে এটা রিহান ভাই। সে ওভাবেই চোখ বন্ধ করে রইল। পারবে না সে আর মায়া বাড়াতে। রিহান ভাইয়ের আজকের পর থেকে হয়ত এভাবে ব্যালকনি দিয়ে আর আসা হবে না রিধির রুমে।
রিধির চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছে।

‘আমি জানি রিধু। তুই ঘুমোসনি। চল না, আমরা কোথাও পালিয়ে যায় !’

রিধি চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে রইল। সে আজ উঠবে না। আর কোনো মায়া বাড়াবে না মানুষটার প্রতি। মানুষটা তার সাড়া না পেয়ে হয়ত চলে যাবে। রিধি চোখ বন্ধ করে রইল।

রিহান তার হাতটা আলতো করে রিধির পায়ের উপর রাখলো।
রিহানের ছোঁয়ায় রিধি পা নাড়িয়ে নিতে চাইলো। তা দেখে রিহান চোখ বন্ধ রিধির দিকে তাকালো।

‘তাকাবি না?’
রিধি কোনো জবাব দিল না।

‘শেষবারের মতো একটু তাকা রিধু?আজকের পর থেকে তো আর আসবো না। মাঝ-বিরাতে আর কোনোকিছু’র আবদার ধরবো না তোর কাছে। কী জানি আমাদের সাধারণ সম্পর্কটাও হয়ত মিলিয়ে যাবে!’ রিহানের কণ্ঠ অসহায় দেখালো।

রিধি চোখ খুলে ফেলল। সে পাশ ফিরে চোখ মুছে শোয়া থেকে উঠে বসলো। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

‘আপনি চলে যান রিহান ভাই। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।’

‘এখন আর আমার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না?’

রিধি তবুও ফিরল না। তার আজ এই চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। এই চোখের দিকে তাকালেই তার দুনিয়া উলোট-পালট করে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে-ছুড়ে এই মানুষটার বুকে ঝাপ্টে পড়ে বলতে,’আমাকে ছেড়ে আর কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না, রিহান ভাই,’ কিন্তু রিধি তা বলবে না। সে জানে, যদি এই কথাটা সে এখন রিহানকে বলে তাহলে এখনই রিহান সব ছেড়ে-ছুড়ে রিধিকে নিয়ে পালিয়ে যেতে রাজি। রিধি এই কথাটা বললে রিহান তার হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করবে খুশিতে। কিন্তু বাস্তবতা যে বড়োই ভিন্ন। এই আশা যে কোনোদিনও পূরণ হওয়ার নয়। রিধিও নিজেকে রিহানের কাছে দুর্বল দেখাবে না। রিধি এখন রিহানের উপর দুর্বল দেখালে রিহান এই বিয়ের পরুয়া করবে না। রিধি নিজের দুর্বলতাকে আড়ালে রেখে উপরে যথাসম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করে করলো।

‘চলে যান রিহান ভাই।’

রিহান নিস্পলক দৃষ্টিতে রিধির দিকে তাকালো। এরপর রিধির পায়ের কাছে মেঝে থেকে উঠে এসে রিধির পাশে বসলো। রিধি পাশ ফিরতে চাইলে রিহান তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার দু’গাল নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।

‘আমাকে এখন আর ভালোবাসিস না রিধু?’

রিধি নাক-মুখ কুঁচকে রিহানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। রিহান রিধির ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে একটু পিছনে সরে গেল।

রিধি অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠল,
‘আপনি নেশা করেছেন, রিহান ভাই?’

‘আমি তোকে ভুলতে পারবো না রে রিধু । কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস আমাকে বল?’রিহান মেঝেতে বসেই অসহায় কণ্ঠে বলে উঠল।

‘আর আপনি নেশা করলে আমি যে কষ্ট পায় সেটা বুঝেন না?’

রিধির কথায় রিহানের সেই দুঃখী চেহারায় ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
‘তুই তো সেদিন থেকেই কষ্ট পাচ্ছিস রিধু। শুধু উপরে নিজেকে শক্ত দেখাতে চাচ্ছিস।’

রিধি চমকে তাকালো রিহানের দিকে। তা দেখে রিহান তাচ্ছিল্য হাসলো।

‘আপনি আর নেশা করবেন না রিহান ভাই। নাহলে আমি কিন্তু আপনার সাথে আর কথা…’ রিধি বাকিটুকু আর উচ্চারণ করতে পারলো না।

‘থেমে গেলি! আজ থেকে এই নেশায় আমার সঙ্গী। তোকেই নিজের করে রাখতে পারলাম না সেখানে এই নেশা ছেড়ে কী করবো!’ বলেই রিহান হাসলো। রিহানের কথায় রিধি কিছু বলতে পারলো না।

‘শেষবারের মতো আমার সাথে একটু চন্দ্রবিলাস করবি রিধু? প্রমিস করছি, তোকে আর কোনোরকম বিরক্ত করবো না। একটা কথাও বলবো না। শুধু চুপচাপ আমার পাশে পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করবি?’

রিহানের কণ্ঠে কী ছিল রিধির জানা নেই। সে রাজি না হয়ে পারলো না। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে অনেক মেহমান। ছাদে গেলে কেউ দেখে ফেলবে ভেবে রিধি চুপচাপ নিজের খোলা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ চাঁদের আলো নেই তেমন। যাও একটু-আধটু আলো দিচ্ছে তাও হালকা মেঘের আস্তরণ এসে মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে কিন্তু তবুও পুরো বিল্ডিংটা জ্বলজ্বল করছে। লাল-নীল বাতিতে সম্পূর্ণ বিল্ডিং জ্বলজ্বল করছে।
রিহান এসে চুপচাপ রিধির পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। দুইজনেই নীরবতা পালন করলো কিন্তু মনে মনে দুজনের সাথে পরস্পরের কত কথায় না হয়ে গেল! কিন্তু এই মনের কথাগুলো শোনার সাধ্য কী কারোর আছে?

বেশ কিছুক্ষন পরে রিধি নিস্পলক দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকাল।
‘আপনার কথা আমি রেখেছি। এবার আপনি আপনার কথা রাখুন রিহান ভাই। চলে যান।’

রিহান এক ফলক অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তার প্রাণেশ্বরীর দিকে। রিহান ভালোভাবে তাকালে হয়ত রিধির চোখ ফোলা দেখতো। সে ব্যালকনি দিয়ে চলে যেতে গিয়ে আবারো ফিরে তাকালো। রিধি রিহানের দিকেই তাকিয়ে ছিল। রিহানকে ফিরতে দেখে নিজে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে কঠোর মুখ করে তাকালো।
‘প্লিজ রিধু চল আমরা পালিয়ে যায়?’

‘বাস্তবতা ভাবুন। কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসুন। কাল আপনার বিয়ে। ভালো থাকুন।’

রিহান হাসলো। সে না চাইতেও নেমে গেল। সে যেতেই রিধি ওখানেই ধপ করে বসে পড়লো। সে আর পারছে না সহ্য করতে! কীভাবে থাকবে সে? রিধি দেখেছে রিহানের চোখে পানি। ছেলে মানুষের না-কি কাঁদতে নেই কিন্তু কষ্ট পেলে ঠিকই কাঁদে। রিধি নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। সে কীভাবে সহ্য করবে রিহান ভাইয়ের বিয়ে! এই মানুষটাকে সে কী আধো ভুলতে পারবে! নিয়তি এমন কঠিন কেন হলো ওদের! দুইজন ভালোবাসার মানুষ এঁকে অপরকে চেয়েও কেন পেলো না!

————–

বেশ রাত পেরিয়েই রিহান বাড়ি ফিরলো। সে চাবি খুলে বাসায় প্রবেশ করতেই দেখলো তার বাবা মকবুল শেখ সোফায় দুহাত মাথার পেছন দিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। রিহানের পায়ের আওয়াজ শুনেই চোখ খুলে তাকালো। রিহান বাবাকে দেখেও না দেখার ভান করে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে মকবুল শেখের গম্ভীর ডাকে থেমে গেল।

-‘এতো রাতে কোথ থেকে আসছো? কোথায় গিয়েছিলে?’

-‘সেটা তোমার জানার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি না বাবা।’ বলেই রিহান নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে গেলে মকবুল শেখের চিৎকারে থেমে গেল।
মকবুল শেখ বসা থেকে উঠে রিহানের সামনে দাঁড়িয়েই রীতিমতো চিৎকার করে বলে উঠল।

-‘দিন দিন বেয়াদব হচ্ছ তুমি। বাবার উপর এভাবে কথা বলার স্পর্ধা কে দিয়েছে তোমাকে?’

-‘আস্তে চিৎকার করো। বাসায় মেহমান। আর কী বললে? বাবার উপরে কথা? তুমি আমার জীবনের বড়ো সিদ্ধান্তটাও নিজের মনমতো চাপিয়ে দিয়েছো। কতই না অনুরোধ করেছি। একটু যদি মন দিয়ে ছেলের কথাটা ভাবতে? কী এমন ক্ষতি হতো বাবা?’রিহানের কণ্ঠটা অসহায় শোনালো।

রিহান মকবুল শেখের চোখের সামনে রুমের দরজা জোরে বন্ধ করে দিল।
মকবুল শেখ রিহানে ব্যবহারে থমকে গেল। তার ছেলে তো এমন ছিল না তাহলে এই একটা বিষয়েই কী তাদের বাবা-ছেলের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরতে চলেছে! কিন্তু এটা ছাড়াও যে আর উপায় নেই! সে কী বেশি করে ফেলেছে! কেন নিজে থেকে সম্পর্কে ফাটল ধরাতে দিল!

————-

কেটে যাচ্ছে রাত। সবাই আরামে ঘুমাচ্ছে। শুধু একই বিল্ডিংয়ের উপর-নিচে একই সাথে দুইটা রুমে কারো চোখেই ঘুম নেই। একজন কেঁদে-কেটে বালিশ ভিজিয়ে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে আরেকজন সেই তলার সোজাসুজি নিচের ব্যালকনিতে বসে নিজের দুঃখগুলোকে নেশার সাথে উড়াচ্ছে। পার্থক্য শুধু উপর-নিচ। একটু পাশাপাশি হলেই হয়ত দুইজন দুইজনের দুঃখগুলো দেখতে পারতো। তখন হয়ত নিয়তিটা ভিন্ন হয়ে যেত! একই বিল্ডিংয়ের দুইজন উপর-নিচ ব্যালকনিতে দুই কপোত-কপোতীর আজ দুঃখের সাক্ষী চাঁদ। হয়ত আজকের পর থেকে দুইজনের পথই আলাদা হয়ে যাবে। আজকের পর থেকে কেমন হবে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পথ চলা! তারা কী কাটাতে পারবে তাদের বাকি জীবনটুকু ভিন্নভাবে! বাস্তবতা এতো কঠিন!

#আষাঢ়ে_প্রণয়
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here