সিন্ধু ইগল – (২৪)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাসা অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে সারার বাসাতে আগুন কীভাবে লাগল? আয়মানের ধারণা তার কোনো শত্রুপক্ষই এমন একটি বিপদ ঘটানোর চেষ্টা করেছে। পুলিশ এসে অনুসন্ধান করে জানাল, বৈদ্যতিক ব্যবস্থা থেকে অগ্নিকাণ্ডটা হয়েছে। বিদ্যুতের তারের সাথে কোনোভাবে আর্দ্রতা বা স্যাঁতসেঁতে অবস্থার সংযোগে এটা ঘটেছে। অনেকদিন ধরে রোদে বৃষ্টিতে থাকা ক্ষয় হয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তারে প্রায়ই এমনটা ঘটে থাকে। এর ফলে যে বিস্ফোরণ হয় তা অত্যন্ত উচ্চ তাপ সম্পন্ন। এতে আশপাশের অনেক কিছুতে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনভাবে অগ্নিকাণ্ড হওয়ার বিষয়টাকে আর্কিং বলা হয়। সারা তখন ঘুমন্ত অবস্থাতে ছিল ঘরে৷ আগুনে তার মারাত্মক কোনো ক্ষয় ক্ষতি না হলেও অতিরিক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরে অনেক সময় আটকা থাকার ফলে প্রাণনাশের ঝুঁকি ছিল তার। তাকে উদ্ধার করে বের করা গেলেও শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ হসপিটালে অ্যাডমিট করা হয় দ্রুত৷ দু’দিন পর তার জ্ঞান ফিরলে শঙ্কামুক্ত হয় সে। এ খবর জাইমাই পৌঁছে দেয় আয়মানকে। খবর শোনা মাত্র সে আর দেরি করেনি ফ্লাইট ধরতে৷ ফিরে আসার পর জাইমার সঙ্গে হসপিটালে কিছুক্ষণ থাকলেও সারার পরিবার এলে চলে আসে সে।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসার পর তার হালচাল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না জাইমা৷ মাসকট পার্কে এসে উত্তপ্ত রোদের মধ্যে আধা ঘণ্টা ধরে মল সান লাউঞ্জের ওপর প্রায় আধশোয়া হয়ে ফোনে গেম খেলছে সে। তার পাশে কিছুক্ষণ বসে থেকে রোদের তাপ আর সহ্য না করতে পারে জাইমা গাছতলায় গিয়ে বসে। ফোনে সময় দেওয়া ছাড়া তারও কোনো কাজ নেই। জায়িন তাকে বারবার বলেছিল বাংলাদেশ চলে যেতে৷ কিন্তু সে যায়নি। উলটে আয়মানেরই সঙ্গে সঙ্গেই থাকছে সব সময়।
ঘণ্টা একটা পার হওয়ার পর জাইমা বিরক্ত হয়ে আয়মানের কাছে ফিরে এল আবার। রোদের মধ্যে একটা ঘণ্টা ধরে ওভাবেই বসে গেম খেলে চলেছে সে। ঘাম কানের চিপ বেঁয়ে গলায় এসে গড়িয়ে পড়ছে তার। তবুও কোনো হেলদোল নেই! কী আশ্চর্য ধরনের এই মেয়েটা!
-‘আজ সারাদিন কি এখানেই কাটিয়েই দেওয়ার চিন্তাভাবনা তোমার?’
পাশের লাউঞ্জে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল জাইমা। আয়মান পূর্ণ দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে রেখেই উত্তর দিলো, ‘একটু পর তোমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাব।’
ভ্রু কুঁচকে গেল জাইমার, ‘লং ড্রাইভ! কীভাবে কী?’
-‘কীভাবে আবার? গাড়ি করে।’
-‘এখানে তোমার গাড়ি? সেটা কীভাবে?’
ফিচেল হেসে বলল, ‘আমার হবে কেন? ভাড়া করব।’
-‘ওহ আচ্ছা, তো কখন যাবে?’
-‘হুঁ, এইতো এখনি বের হবো।’
বলেই তার কিছু সময় পরই পার্ক থেকে বেরিয়ে পড়ল দু’জন। ক্যাবে উঠে জাইমা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘সারাকে আর দেখতে যাবে না? ওকে এভাবে ফেলে রেখে ঘুরতে যাওয়া কি ভালো দেখাবে?’
গাড়ির জানালা থেকে অদূরবর্তী রাস্তার দিকে চেয়ে ছিল আয়মান। জাইমার কথায় হালকা হেসে বলল সে, ‘আরে ও তো মরে যাচ্ছে না। আমি তো ছুটে এলাম এই ভেবে যে বোধ হয় মরেই যাবে। যেভাবে বলেছিলে তুমি!’
আয়মানের এমন হৃদয়হীন কথা আর আচরণে জাইমা অভ্যস্ত হলেও তবু সে অবাক না হয়ে পারে না। বলল, ‘ওর কন্ডিশন সত্যিই খারাপ ছিল।’
-‘হ্যাঁ, এ জন্যই তো প্রথমে শুনে খুব খারাপ লাগছিল। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে জলদি টিকেট কেটে চলে এলাম। কিন্তু প্লেনে বসে আসতে আসতে ওই সময়ের খারাপ লাগাটা ধীরে ধীরে ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম এসে হয়তো ওকে মৃত পাবো। সেভাবে মনকে প্রস্তুত করেও নিয়েছিলাম।’
বিষণ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে জাইমা জিজ্ঞেস করল, ‘এসে ডেডবডি দেখলে কষ্ট লাগত না তোমার?’
সানগ্লাসটা খুলে আশেপাশে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে নির্বিকার সুরে উত্তর দিলো সে, ‘কষ্ট তো একটু লাগতই৷ কিন্তু তার জন্য শোকে কাটাব কয়েক দিন, কয়েক মাস, এটা হতো না৷ কারণ, আমি নিজেকে বুঝ দিতাম এই ভেবে যে, ওর বেঁচে থাকা এতটুকু সময় অবধিই ছিল। তাই সময় শেষে আমাদের থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যার মৃত্যু আগে সে তো আগেই যাবে। এটাই স্বাভাবিক।’
উদাস সুরে বলে উঠল জাইমা, ‘তোমার মতো সবাই যদি অদ্ভুত চিন্তার হতো!’
-‘অদ্ভুত কেন হবে আমার চিন্তা। এটা স্বাভাবিক কেন ভাবতে পারছ না তুমি? মানুষের মধ্যে ইমোশোন আছে বলে কি সেটার অতিরিক্ত ব্যবহার করতে হবে? এখনি তো আমিও মরে যেতে পারি৷ কিংবা তুমিই যদি আমার সামনে কার অ্যাক্সিডেন্ট ফিনিশড হয়ে যাও, তাতেও আমার একই ভাবনা থাকবে। কষ্ট, দুঃখ যেহেতু আমরা মানুষরা ফিল করতে পারি। তাই সেটা একটু আধটু হবেই। কিন্তু বেশি বেশি ফিল কেন করব? যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না।’
বলার মতো সহজে কিছু খুঁজে পেল না জাইমা৷ নিরবে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর বলল, ‘অথচ বেঁচে থাকাকালীন যথেষ্ট যত্নশীল তুমি আমাদের প্রতি। তাই মনে হয়েছিল আমাদের মৃত্যুতেও তুমি যথেষ্ট আহতও হবে।’
রোবটের মতো কেমন করে ঘাড় ফিরিয়ে জাইমার দিকে চেয়ে জবাব দিলো আয়মান, ‘আমি মোটেও খারাপের অ্যান্টনিম নই।’
তারপর কথাটুকু শেষ করে সেই রোবটের মতো করেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এর উত্তরে জাইমা আর কিছু বলল না। শুধু ওর অভিব্যক্তি চেয়ে দেখল। হঠাৎ একটু হাসল সে, জায়িনের কথার সঙ্গে হঠাৎ আয়মানের কথার মিল পেয়ে।
-‘তোমার কিছু শপিং করার নেই?’
-‘শপিং করব কেন?’
-‘আমরা মেলবোর্ন যাব। শপিং করার থাকলে এখান থেকে করে নিতে পারো। ফ্লাইট টাইম আরও ছয় ঘণ্টা পর।’
চরম বিস্ময় খেলে গেল জাইমার চোখে মুখে এবার। সঙ্গে আতঙ্কও। জায়িন তো মেলবোর্নই অবস্থান করছে এখন। হঠাৎ সেখানেই কেন যেতে চাইছে আয়মান?’
যতটা সম্ভব নিজেকে ধাতস্থ রেখে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি না লং ড্রাইভ যাবে বললে?’
-‘ঠিক লং ড্রাইভ না। একটু মেলবোর্ন ঘুরব ফিরব। ওখানেই কিছুদিন থাকব। ততদিনে সারা সুস্থ হোক।’
এমন একটা কিছু জাইমা একেবারেই আশা করেনি আয়মানের থেকে। হঠাৎ করেই মেলবোর্ন যাওয়ার সিদ্ধান্তের পিছে কোনো কারণ কি আছে? তবে তার কিছুটা থ্রিলিংও লাগছে এই ভেবে, শিকার যে নিজেই বাঘের খাঁচায় যাচ্ছে।
—————–
বেলস বিচের কাছাকাছি ফোর স্টার হোটেল টোর্কি হলিডে পার্ক। সেখানে ওয়ান বেডের দু’টো রুম বুকিং দিয়ে রেখেছিল আয়মান৷ জাইমা আপাতত কৌতূহল দমন করে বিশ্রাম নিতে চলে গেল নিজের রুমে। জায়িনকে কিছু জানাবে কি জানাবে না, এমন ভাবনায় আটকা পড়ে শেষমেশ না জানানোরই সিদ্ধান্ত নিলো সে। তার ধারণা, এমনিতেই আয়মানের ওপর নজরদারি চলছে জায়িনের। জানলে আপনা আপনিই জেনে যাবে সে।
খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম শেষে জাইমা আয়মানের ঘরে এল। এসে দেখল সে বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
-‘তুমি কি এই রাতেই ঘোরার সিদ্ধান্ত নিচ্ছ?’
মৃদু হেসে আয়মান বলল, ‘তুমিও যাচ্ছ। রেডি হয়ে এসো, যাও।’
-‘ঠিক আছে, কিন্তু কোথায়?’
-‘বিচে।’
এবার কেন যেন জাইমার নিশ্চিত মনে হচ্ছে, আয়মান কোনো সন্দেহের বশেই এখানে ছুটে এসেছে। জায়িন এই মুহূর্তে তার শিপেই অবস্থান করছে সমুদ্রে৷ যদিও জায়িন সমুদ্রেই পার করে বছরের অধিকাংশ সময়। একদম ধলাপেট সিন্ধু ইগলের মতোই এই ছেলের স্বভাব। কিন্তু আয়মান কি জায়িনের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিগ্ধ বলেই বেলস বিচ যাচ্ছে? কিন্তু সন্দেহ হলে সমুদ্রেই কেন আসবে সে? না কি সেও জানে জায়িনের জীবনের বৈশিষ্ট্য আর গতিবিধি সম্পর্কে? সামনে কী হতে চলেছে তা সে আন্দাজ করতে পারছে না। কিন্তু কিছু একটা হবে বলে তার মাঝে চাপা উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবল।
দুজন তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। সেখান থেকেই সোজা বিচে চলে এল ওরা। যেখানটাতে দেড় মাসের বেশি সময় আগে জায়িনকে নিয়ে আয়মান দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানটাতেই এসে দাঁড়াল সে। সমুদ্রের বুকে ভেসে চলা বোটগুলো দেখছে গভীর মনোযোগে। জাইমা তার দৃষ্টি লক্ষ করে সেদিকে চেয়েই ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু কি ভাবছ?’
-‘জায়িন মাহতাবকে স্মরণ করছি। এখানেই তার অস্তিত্বকে ডুবে দিয়েছিলাম। তারপরও মনে হচ্ছে কোথাও একটা কিন্তু রয়ে গেছে। সারার বাসার অগ্নিকাণ্ডটাই এমনটা ভাবতে বাধ্য করছে।’
-‘হয়তোবা তুমিই ঠিক।’
-‘আমি শিপ চলন্ত অবস্থাতে রেখেছিলাম। যাতে ওকে ফেলে দেওয়ার সময় কেউ সহজে অবজার্ভড করতে না পারে। আর করলেও বোঝার উপায় নেই ওটা কোনো মানুষ ছিল। অন্ধকার বলে কথা।’
-‘তোমার কী ধারণা চলছে এখন?’
-‘সম্ভাবনা নাইনটি পার্সেন্ট, মরে যাওয়ার।’
এরপর চুপচাপ কিছুক্ষণ দু’জন দু’জনের মতো নিরব সময় কাটিয়ে ডাইন্ট্রি রেইনফরেস্টের দিকে এগোলো। জাইমা ভেবে পাচ্ছে না, এই রাতের বেলা রেইনফরেস্ট যাবার এত শখ কেন জাগল হঠাৎ আয়মানের? কৌতূহল দমাতে সে জিজ্ঞেসই করে বসল, ‘তোমার মাথায় কী চলছে বলো তো?’
আয়মান হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘ওয়াটারফলে ডুবে থাকব।’
হাসছে আয়মান। জাইমা তা না দেখেও বেশ টের পেল। সে বলল, ‘আমার প্রেমিক থাকলে পুরোপুরি উপভোগ করতাম এমন সময়ে ওয়াটারফলে ডুবে থাকা। তোমার সঙ্গে কতটুকু উপভোগ করতে পারব জানি না।’
এতক্ষণ নিঃশব্দে হাসলেও এবার হো হো শব্দে হেসে উঠল আয়মান। তবে জঙ্গলে মধ্যে আসার পর ওরা আরও মানুষের অস্তিত্ব দেখতে পেল৷ এবার জাইমার স্বস্তি মিলল কিছুটা। এর আগে কখনো আসা হয়নি এখানে। বেশ উত্তেজনাও কাজ করছে তার মাঝে। তবে আয়মান যে আগেও এসেছে, তা বোঝাই যাচ্ছে গাইড ছাড়া চলার জন্য।
লাক্সারি লজের সামনে এসে দাঁড়াতেই জাইমা দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। মুগ্ধ চোখে চারপাশটা দেখতে দেখতে সন্দিহান কণ্ঠে জাইমা জিজ্ঞেস করল আয়মানকে, ‘মান, তুমি এমনটা বলবে না তো আমরা আজ নাইট এই লজে থাকছি?’
আয়মান হেসে সিল্কি ওক লজের দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘শুধু আজ রাত নয়। আগামী রাত অবধি থাকছি আমরা এখানে।’
-‘ওউ, তাহলে হোটেল কেন বুকড করলে? শুধু শুধু ডাবল কস্ট।’
আয়মান কিছু বলল না। কেমন রহস্য রহস্য হাসি ঠোঁটের কিনারায় ধরে রেখে ডাবল বেডের বুকিং দেওয়া রুমটার চাবি নিয়ে এগিয়ে গেল। জাইমা বিনা বাক্যে তাকে লক্ষ করে চলে এল ঘরটাতে। এখানে তারা একই ঘরে থাকবে।
-‘আমি গতকালই সব প্ল্যানিং করে রেখেছিলাম। তোমাকে কিছুটা সারপ্রাইজ দেবো বলে।’
-‘আমাকে হঠাৎ তোমার সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছা হলো কেন?’
হাস্যচেহারায় চেয়ে জাইমাকে সে উত্তর দিলো, ‘এই যে, সারার ইস্যু নিয়ে ফিরে আসতে পারলাম বলে। থ্যাঙ্ক ইয়্যু।’
বলেই ব্যাগপ্যাক থেকে জামা কাপড় বের করে বাথরুমে চলে গেল। জাইমা দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বিছানাতে বসে ভাবনাতে পড়ল আয়মানকে নিয়ে।
—————–
রাত ঢের হয়েছে। জঙ্গলের রাত মানে নিস্তব্ধতার বদলে চারপাশে অজানা অদেখা পাখি, পোকা বা নানান প্রাণীর আওয়াজ। ঘরের মাঝে সেসবের শব্দ না পৌঁছলেও বাইরে থাকলে ঠিক বোঝা যায়। আয়মান ড্রিংকস করে একটু আগেই বিছানাতে গা এলিয়েছে। কিন্তু মাতাল সুরে প্রলাপ বকে চলেছে অবিরত৷ কিছুটা স্পষ্ট আবার কিছুটা অস্পষ্ট কথা। স্পষ্ট যেটুকু বোঝা গেল তা ছিল, ‘জাইমা, হোয়্যার আর ইয়্যু লেডি। মাথাটা টিপে দাও একটু! জাইমা, ম্যাসাজ মাই ব্যাক প্লিজ। ইট’স সো পেইন।’
নরম আলোতে সাদা চাদরের মাঝে কালো টিশার্ট পরনে শায়িত আয়মানের কপাল, চোখ ঢেকে রাখা চুলগুলো আলগোছে গুছিয়ে দিয়ে ওর পাশে বসল জায়িন। কপালের দু’পাশে দু’আঙুলে হালকা চাপ দিয়ে ম্যাসাজ করে দিতে থাকল। অন্য বিছানার ওপর ঘুমে ঢুলুঢুলু জাইমা মহা বিরক্ত নিয়ে বসে আছে। এই মুহূর্তে ঘর থেকে তার বেরিয়ে যাওয়াই যথার্থ, তা বুঝেও উঠতে ইচ্ছা করছে না তার। জায়িন তাকে লক্ষ করে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাইছ জাইমা?’
-‘কী আর চাইব?’ ভর্ৎসনা শোনাল যেন ওর কথাটা।
-‘স্পেস কেন দিচ্ছ না তুমি?’
-‘হাহ্! আমি করি প্রশ্নটা?’
জায়িন হাসল। তা ঠিক দেখতে পেল জাইমা। বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নামার প্রস্তুতি নিলো সে। জায়িন তখন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি টেনশন করছ আয়মানকে নিয়ে?’
-‘অবশ্যই।’ কালক্ষেপ না করে চকিতেই জবাব দিলো সে।
কথাটা যেন কৌতুক মনে হলো জায়িনের, ‘রিয়্যালি! এ জন্যই তুমি এখনো বাংলাদেশ যাচ্ছ না? কী চিন্তা হচ্ছে তোমার ওকে নিয়ে? খুন করে দেবো? এমন কিছু?’
-‘বিয়েটা দেখেই যাই। আর তাছাড়া আমাকে আগে মুম্বাই যেতে হবে।’
-‘তারপর?’
-‘তুমি তোমার কাজ চালাও তো!’
অসম্ভব খারাপ মেজাজ নিয়ে তারপরই বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে। তখনো জায়িন মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল আয়মানের। পিঠের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থামল হঠাৎ। ঝুঁকে পড়ে আয়মানের মুখের কাছাকাছি এসে নাক চেপে রাখার মতো এলকোহলের ঘ্রাণ পেয়ে একটুখানি মুখটা কুঁচকে ফেলল সে। কিন্তু সে ঘ্রাণও একেবারে অগ্রাহ্য করে বরং আরও কাছে এসে আয়মানের কপোল জুড়ে নাকের ডগা ঘষতে থাকল সে কতক্ষণ৷ ওর ঠোঁটদু’টোর কিঞ্চিৎ ফাঁকের মাঝে আপন ওষ্ঠাধর গাঢ় করে ছুঁইয়ে উঠে পড়ল। খেয়াল করল ডান হাতটা আয়মানের বিছানার বাইরে ঝুলে আছে। তা উঠিয়ে সোজা করে রেখে হাতটার পাঁচ আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুলগুলো গুঁজে চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইল। ভেবেছিল এই হাতটা হয়তো ভীষণ কোমল হবে। যেমনটা আজ অবধি যত মেয়ের দেখেছে সে। কিন্তু সে ভাবনা বদলে জায়িন উপলব্ধি করল, অন্য সব মেয়েদের মতো এই হাতটা খুব কোমল নয়। বরং যতটা শক্ত বলা যায়। বুঝতে পারল সে, এই হাতটা তো সাধারণ মেয়েদের মতো কোমল হওয়ার কথাও না। এই হাত শক্তভাবে গড়েছে বলেই আজ আয়মান মেহরিন টেরোরিস্ট, সিরিয়াল কিলার৷ হাতটা ধরে কিছু সময় আয়মানের মুখপানে চেয়ে থেকে তারপর কিছুটা পিছিয়ে বসে খুব আরাম করে ওর পিঠে ম্যাসাজ করে দিলো। আর সেই আরাম পেয়েই আয়মান দু’ একবার মৃদুভাবে অস্পষ্ট শব্দ করল। জায়িন একটু হাসল তা শুনে।
____________