সিন্ধু ইগল – (২৩)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
একাধারে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে জায়িন। জ্ঞান ফেরার পর থেকে অদ্ভুত এক মৌনতা গ্রাস করে রেখেছে তাকে। যে মানুষটির ঠোঁটের কার্ণিশে সব থেকে মুগ্ধকর প্রাণবন্ত হাসিটা সর্বদা জড়িয়ে থাকত, সেই জায়গাটুকু এখন নীরস৷ চোখে মুখে গম্ভীরতা। হাসি খুশি, দুষ্টু আর মিশুক প্রকৃতির সুন্দর মানুষটির মাঝে যেন সুখীভাব হারিয়ে গেছে।
কেবিনের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রেজা তাকে অনেকক্ষণ যাবৎই লক্ষ করছে। জায়িন তার চোখের আড়দৃষ্টিতে তাকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। যেন মনে হচ্ছে সে দেখেইনি রেজাকে৷ যার জন্য রেজাও ভেতরে আসার সাহস পাচ্ছে না। আড়ষ্টতা কাজ করছে তার মধ্যে। জাকির এক সপ্তাহ ধরে ঠায় হসপিটালে পড়ে ছিল। তাকে জোর করে রেজা বাসায় পাঠিয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। সর্বক্ষণ জায়িনকে খেয়াল রাখার জন্য একজন নার্স চব্বিশ ঘণ্টায় নিয়োজিত। তবুও একা ফেলে রাখতে সাহস হচ্ছে না রেজার। এদিকে তার সাথেও এখন অবধি খোলাখুলি কোনো কথা বলেনি জায়িন৷ কিছু নিয়ে গভীর এক ভাবনাতে আছে সে, সেটুকু বুঝতে পেরেছে রেজা। কিন্তু কী ভাবছে? তা কেন তার সঙ্গেও আলাপ আলোচনা করছে না? দুর্ঘটনার পর থেকে এমন পরিবর্তন কেন হলো জায়িনের? তবে তাকে সময় দেওয়া উচিৎ। কিছু একটা বিষণ্নতাও হয়তো তার মাঝে দেখা যাচ্ছে।
রেজা চলে গেল হসপিটালের নিচে। সে যেতেই জায়িন উঠে বসল। মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ বুজে রইল। মাথার পেছনে চিনচিন ব্যথাটা এখনো গায়েব হয়নি৷ হুইলচেয়ার সমেত তাকে উঁচু করে ফেলে দেওয়ার সময় বোটের গায়ের সঙ্গে মাথাটা বেশ জোরেই বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল সে। একে তো সমুদ্রের বহু ফিট নিচে চলে গিয়েছিল, তার ওপর মাথার আঘাতটা খুব গুরুতর না হলেও কমও ছিল না। বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশ ভাগ ছিল। তবে আজ অবধি ভাগ্যকে সব সময় তার পক্ষেই পেয়েছে। তাই এমন মৃত্যুর দোরগোড়াতে পৌঁছেও ফিরে আসতে পেরেছে সে।
-‘নক না করেই ঢুকে পড়লাম, জায়িন।’
নারী কণ্ঠটা শুনতেই চোখ মেলল জায়িন। কিছুটা বিস্মিতও হলো সে মানুষটিকে দেখে।
-‘এখানে কেন তুমি?’
জাইমা ঈষৎ হেসে বেডের পাশটায় চেয়ার টেনে বসল। সাদা গোলাপের বুকেটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ এখন?’
-‘আল্লাহ পাকের ক্রিপায় আলহামদুলিল্লাহ।’
জায়িনের গম্ভীর মুখটা দেখে সে আবার প্রশ্ন করল, ‘আমাকে দেখে কি খুশি হওনি তুমি?’
-‘খুশি তো হইনি। অখুশিও হওনি৷ কিন্তু তোমার তো আসা উচিৎ হয়নি।’
-‘নো টেনশন। আয়মান নেই এখন।’
এ কথায় নিমিষেই উত্তেজিত হয়ে পড়ল জায়িন, ‘নেই মানে? কোথায় ও?’
আবেগঘন দৃষ্টিতে জাইমা দেখতে থাকল, আয়মানকে নিয়ে জায়িনের উদ্বিগ্নতা৷ এত সময় যাবৎ যে শুকনো চেহারাটায় গম্ভীরতা ছিল৷ তা এখন চিন্তার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে৷ মৃদু হাসল জাইমা, জায়িনের এমন অস্থিরতায়।
-‘লন্ডন পৌঁছেছে গতকাল। ওখান থেকে বারবার মেইল আসছিল ফিরে যাওয়ার জন্য।’
শক্ত মুখ করে জায়িন চেয়ে রইল জাইমার দিকে৷ জাইমা তার মনের পরিস্থিতি ধরতে পেরে নিশ্চিন্ত করল, ‘ফিরে আসবে কিছুদিনের মাঝেই৷ না গেলে ওর জন্য বিপদ ছিল। বুঝতেই তো পারছ৷ ওখান থেকে ওর আর কোনো মুক্তি নেই।’
-‘ওকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করো। আমি শুধু উঠে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় আছি। তারপরই ডিরেক্ট অ্যাক্টিভিটি দেখাব।’
-‘রেগে আছ ভীষণ ওর ওপর?’
জায়িন কোনো উত্তর দিলো না সে প্রশ্নের। উলটে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি যাওনি কেন এখনো?’
-‘তোমার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারতাম না। যার জন্য একটা সুন্দর, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন লাভ করতে চলেছি, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানিয়েই যাই কী করে?’
অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে জায়িনের মেজাজ বদলে গেছে। আরও খারাপ লাগছে তার হাসপাতালের বিছানাতে আজ পনেরোদিন যাবৎ এক নাগাড়ে পড়ে আছে বলে। কমপক্ষে আরও একটা মাস হয়তো তাকে জোর করেই এখানে ধরে রাখবে জাকির। জাইমার ভালো কথাগুলোও এখন তার বিরক্ত লাগছে। না পারছে দ্রুত সুস্থতা ফিরে পেতে, আর না পাচ্ছে হসপিটাল থেকে মুক্তি। এক ছুটে তার দেশে ফিরে যেতে মন চাইছে শুধু।
বালিশটা বিছানার সঙ্গে ঠেকিয়ে গা এলিয়ে, পাদু’টো টানটান করে বসল সে। জাইমাকে বলল, ‘দেরি কোরো না আর। আয়মান ফিরে এলে আর সহজে যেতে পারবে না। কালই ফ্লাইট ধরার চেষ্টা কোরো। ওখানে রেজা সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। কয়েকটা মাস স্রেফ কাগজে কলমে রেজার বউ পরিচয়ে থাকো দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া অবধি৷ ততদিন ঘুরেফিরে দেখো দেশটা। তারপর জবে জয়েন করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে ও৷’
কথাটা বলেই ঘাড়টা খানিক জাইমার দিকে ঘুরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘আর একাকিত্ব আর ভালো না লাগলে সত্যি সত্যিই তোমার জন্য তোমার যোগ্য বেস্ট একজন সোলমেটও খুঁজে দিতে পারি। আমি খারাপ হতে পারি৷ আমার আশেপাশের মানুষগুলো নয়।’
হাসল জাইমা। গভীর দৃষ্টিতে জায়িনকে দেখতে দেখতে বলল, ‘যদি আয়মানের ক্ষতি চাইতাম আলিয়ার মতো, এতটা ভালো নিশ্চয়ই পেতাম না তোমার থেকে? কিন্তু আমার কৌতূহল মেটাতে খুব জানতে ইচ্ছা করছে, জায়িন মাহতাব কি শুধুই একজন নিষ্ঠুর, ড্রাগন?’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জায়িনও নিরবে চেয়ে রইল জাইমার দিকে। তারপর শীতল গলায় বলল, ‘স্বার্থ, সুবিধা ছাড়া আমি কারও ভালো করি না, খারাপও করি না। আমাকে আর পাঁচটা ভালো মানুষের মতো উদার ভাবলে ধোঁকা খাবে। তবে যতদিন বেঁচে আছি, তোমার জীবন সুরক্ষার দায়িত্ব আমার থাকবে।’
-‘আমিই কি প্রথম নারী? যাকে জায়িন মাহতাব কামনার দৃষ্টিতে নিতে পারেনি?’
প্রশ্নটা শোনা মাত্রই জায়িনের মেজাজ বিচ্ছিরি রকম খারাপ হয়ে উঠল৷ গালি দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। কিছুটা কঠিন গলায় বলল, ‘আসলেই মেয়ে জাতটা চরম নোংরা জাত। ড্যামাবল!’
জায়িনের রাগান্বিত চোখদু’টো দেখে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত উঁচু করে জাইমা মুচকি মুচকি হেসে বলতে থাকল, ‘স্যরি স্যরি, আমি সিরিয়াসলিই তোমার গুরুগম্ভীরতা দেখে একটু খেপানোর জন্যই বলেছি। আমি জানি, যে যেমন জায়িন মাহতাব তার সাথে তেমন।’
মাথা ঝুঁকিয়ে রেখে জায়িন বলে উঠল, ‘আমার জীবনে ভালোবাসা আর সম্মানের জায়গায় প্রথম যে নারীর স্থান, তিনি আমার আম্মা। এরপর কখনো কোনো নারীকে নিয়ে পজিটিভ হওয়ার ইচ্ছা হয়নি৷ আয়মানের জায়গাটা ভিন্ন হয়েছে। এর যথেষ্ট কারণ আছে। আম্মার পর যদি কোনো নারীকে সব থেকে বেশি প্রায়োরিটি দিই, সেটা আয়মান। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও৷ তুমি আমাকে সহযোগিতা করেছিলে আয়মানের প্রতি তীব্র রাগ আর ক্ষোভ থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তুমি নিজেই ওর সুস্থতা চাইলে আর ওর জীবন ঝুঁকি থেকে ওকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানালে, তখন থেকেই তোমাকে নিয়ে আমার ধারণাটা বদলেছি। আম্মা আর আয়মানের পর তৃতীয় যে নারীকে আমি রেসপেক্ট করছি, সে তুমি। তাই নিজের জায়গাটা সেভাবেই ধরে রাখার চেষ্টা কোরো। আলিয়া ওর বোন হয়েও যতটা ওর ভালো চায়নি, বিপদ থেকে মুক্ত করার বদলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সেখানে তুমি পর হয়েও ওর জন্য ভেবেছ। ওর ভেতরের কোমলতা দেখতে পেয়েছ। যেটা আলিয়া দেখার চেষ্টাও করেনি।’
-‘মারাত্মকভাবে বারবার কারও থেকে আঘাত পেলে তার প্রতি কার না রাগ, ক্ষোভ জাগে? আমারও তাই হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য আমি এখনো নিজেকে নিজে মাফ করতে পারছি না। কারণ, তোমার জায়গায় আজ অন্য কেউ হলে তার ওপর ভরসা করে আমি ঠকে যেতাম৷ আলিয়ার মতো আমার দ্বারাও আয়মানের ক্ষতি হয়ে যেত। প্রার্থনা করব সব সময়, খুব শীঘ্রই তোমাকে চিনে নিক আয়মান, সুস্থ হয়ে উঠুক ও। দু’জন যেন সারাজীবন এক সঙ্গে থাকতে পারো আর ভালো থাকতে পারো। আসছি, ভালো থেকো।’
জাইমা উঠে পড়তেই জায়িন তাকে ধন্যবাদ জানাল।
মৃদু হেসে জাইমা জিজ্ঞেস করল, ‘লাইফ সেফ করার জন্য?’
-‘হুঁ। যেটার ঋণ শোধ করার মতো নয়।’
-‘কিন্তু অলমোস্ট তুমি করে দিয়েছ৷ এই খুনখারাবি, পাপের জীবন থেকে আমায় সহজে মুক্তি দিতো না আয়মান। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও পালিয়ে গেলেও ও ঠিক খুঁজে নিতো আমাকে।’
-‘এ জন্যই বাংলাদেশ সিলেক্ট করেছি৷ যেখানে ও মৃত। একবার ওখানে পা পড়লেই ওকে ধরা খেতে হবে। এই ভয়টা ওর আছে। যার জন্য নিজের বোনকেও খুঁজতে যায়নি। বেস্ট অফ লাক৷ আর বললে না তো, একজন আর্দশ জীবনসঙ্গী চাও কি না?’
-‘ওটা না হয় আমিই খুঁজে নেব? অনেকটা করেছ। প্রয়োজন হলে তখনো তো আছই। আমার না সত্যিই মনে হচ্ছে, জায়িন মাহতাবের এই চমৎকার দিকটি আমি ছাড়াও আরও অনেকেই দেখেছে।’
সে মুহূর্তে রেজা এসে দরজার মুখে দাঁড়াল। জাইমাকে দেখে চিনতে পারল, এই মেয়েটির জন্যই জায়িন নিজের রেফারেন্স দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। দু’দিন আগেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে হয়েছে তার, জায়িনের কথা মতো। অবশ্য সেই বিয়ের ভিত্তি নেই বলেই চলে।
ওর শেষ কথাটা শুনে জায়িনের মুখের দিকে তাকাল সে৷ কিছুটা বিরক্ত নিয়ে জায়িন চোখ বুজে বসে আছে। তাই ও-ই জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ, আপনার মন ঠিকই বলছে। স্যারের এই চমৎকার দিকটি আমি দেখেছি। এই যে আপনি যেমন স্যারের সহযোগিতায় একটা সুনিশ্চিত জীবন লাভ করতে চলেছেন। তেমন আমিও ওনার দ্বারাই এই জীবনটা পেয়েছি। সিফাত পেয়েছিল। যে এখন মৃত৷ আরও অনেকেই এমন আছে। যারা এখন সুখী, সুনিশ্চিত ভবিষ্যত গড়ে নিয়েছে স্যারের বদৌলতে।’
ফিরে তাকাল জাইমা রেজার কণ্ঠ পেয়ে। সৌজন্য হাসি ফুটিয়ে বলল সে, ‘আমি তাহলে একটু হলেও সঠিক চিনেছি আপনার স্যারকে।’
তারপর জায়িনকে বলল, ‘আর আমি একা থাকব না, জায়িন। পরিবার ছাড়া যখন চাচার বাসায় অবহেলায় বেড়ে উঠছিলাম, তখন একজন মানুষের ভালোবাসা পেতাম বলেই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতাম। তারপর যেদিন জীবনের চরম বিপদটা নেমে এল, সেদিন আমি নিজেই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। রেপড হওয়ার পর নিজেকে নিজেই আয়নাতে দেখতে লজ্জা পেতাম। সেখানে তার চোখের সামনে দাঁড়াতাম কীভাবে? পারছিলাম না। তাই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আয়মানের সাথে পরিচয় না হলে জীবনটা হয়তো আরও জটিল হতো। ও আমাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার পর এমনভাবে আমাকে প্রস্তুত করল, যার জন্য সবরকম হতাশা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, সব চলে গেল। কিন্তু রক্ত, মৃত দেহ, আয়মানের অসুস্থ রূপ দেখার পর জীবনটা আবার যেন কেমন থমকে গেল আমার। না ওর সাথে থাকতে ইচ্ছা করত, না ওর থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছা করত। কিন্তু বিধাতা নিশ্চয়ই আমাকে সুযোগ দিতে চান। তার জন্যই আয়মানের পর তোমার মতো একজন গ্রেশিয়াসকে আমার জীবনে পাঠালেন তিনি৷’
-‘তো এখন তুমি তার জীবনে ফিরতে চাইছ?’
-‘তার জীবনে আমি ফিরব না। কিন্তু আমার জীবনে আসার আহ্বান তাকে জানাব।’
-‘দু’টো বছর ধরে তুমি নিখোঁজ৷ সে অপেক্ষায় আছে এখনো তোমার জন্য?’
ম্লান হাসল জাইমা, ‘আছে বলেই তো আহ্বান জানাতে চাইছি। তার খোঁজ না নিয়ে আমি থাকতে পারিনি একদিনও। জীবনে কিছু না কিছু পুণ্য করেছিলাম বলেই ওর মতো একজনকে পেয়েছিলাম।’
-‘আমার বিশ্বাস তাহলে সে ফিরবে।’
-‘আমারও।’
শেষবারের মতো বিদায় নিয়ে জাইমা চলে গেল। হয়তো কাল পরশুর মাঝে সে বাংলাদেশ চলে যাবে।
জায়িনের ইশারায় ওর পাশে এসে বসল রেজা। জায়িন বলল, ‘সুযোগ কিন্তু ছিল রেজা। মেয়েটা চমৎকার। জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারতে ওর সঙ্গে।’
রেজা হেসে বলল, ‘আপনার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দেখার পর নিজের কথা ভাবব। কিন্তু ওকে নিয়ে না। সব ভালোকেই আমার আবার মনে ধরে না।’
-‘আমার বিড়াল আমাকেই ম্যাও শেখায়, না?’
কথাটা বলে দুজনই এক সঙ্গে হেসে উঠল।
-‘আপনি এখন ঠিক আছেন, স্যার?’
জায়িনের প্রাণখোলা হাসিটা দেখতে দেখতে শুধাল রেজা। এবার হাসিটা মিলিয়ে গেল জায়িনের। চোখে মুখে তার দৃঢ়তা ফুটে উঠল হঠাৎ। রেজা তা দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছুদিন দেশে গিয়ে ঘুরে আসবেন?’
-‘সেদিন মরে গেলে কাকে জিজ্ঞেস করতে এই প্রশ্নটা? মরতে মরতে বেঁচে গেছি। ওকে শিকার না করে তো এখান থেকে একচুলও নড়ব না।’
-‘কীভাবে যে কটটা খেলেন আমি এখনো বুঝতে পারছি না।’
-‘এহসানকে কেমন লাগে তোমার?’
-‘নাইস গায়। বয়স পঁয়তাল্লিশ হয়েও বোঝার উপায় নেই। যেন সদ্য ত্রিশ পার করেছে। সেন্সিবল অ্যান্ড বোল্ড ক্যারেক্টার। আটকা থাকা অবস্থাতেও একেবারে স্টেডি ছিল।’
-‘সঠিক চিনেছ। তবে পুরোপুরি না। প্রচণ্ড মাত্রায় ধূর্ত সে। এই প্রবীণ সুদর্শন তোমার ভাবির সিক্রেট এডমায়ারস।’
কথাটা শুনে বাক্যহারা হয়ে পড়ল রেজা। বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘নিশা, মানে ওই মধ্যবয়সী মহিলাকে তাহলে কী কাজে লাগছে ওর? ওকে কেন বিয়ে করেছে? মহিলার প্রতি যথেষ্ট যত্নশীলও সে। ভাবিকেই যদি পছন্দ করে সে, নিশাকে কেন বিয়ে করেছে?’
-‘তুমি তো খুব সহজেই এতগুলো প্রশ্নের উত্তর বিনা খেটে পেয়ে যাচ্ছ আমার থেকে। আর আমার ভেবে খুঁজে বের করতে কতটা মেহনতি হলো তার দাম কে দেবে?’
রেজা বোকা একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি জাকির স্যারকে আজই কনভিন্স করব। যে করেই হোক, আপনাকে যেন ডিসচার্জ করে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।’
-‘হুঁ, তো এহসানের সাথে আয়মানের প্রথম পরিচয় ভার্সিটিতে পড়াশোনাকালীন। যেখানে এহসান প্রফেসর ছিল। এটা তো জেনেছই নিশা আর এহসানের থেকে। নিশাকে লন্ডন নিয়ে আসাটা কম কষ্টের ছিল না। এহসানের প্রিয় ছাত্রী ছিল আয়মান। নিশা আর আলিয়ার পর আয়মানের সকল কিছু জানত এই এহসানই। তাই আয়মানের অনুরোধে নিশাকে দেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করে এহসান। ওর বাসায় মেড হিসেবে থাকতে শুরু করে নিশা। শুধু ভাইকে মানুষ করার জন্য। প্রতি মাসে টাকা পাঠাত সে দেশে, ভাইয়ের কাছে। কিন্তু ওভাবে তো নিশাকে লন্ডন রাখা সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে আয়মানের মন জয় করার জন্য নিশাকে করুণা করে সে। মানে বিয়ে করে নিশাকে। মূলত এহসানের জন্মস্থান মুম্বাই। তো এরপর আয়মান এহসানের এত বড়ো মহৎ কাজে মুগ্ধ হয়ে যায়। এমন সব কাজের মাধ্যমেই এহসান আয়মানের মনে একটা সফ্ট কর্ণার তৈরি করে। এছাড়া তো আয়মানকে অন্যদের মতো হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে না। এই লোকটা আয়মানকে পাওয়ার জন্য সর্বাধিক নিকৃষ্টও হতে পারে। লেসবিয়ান রিলেশনশিপের প্রপোজাল বার বা পাবে গেলে বহু পাওয়া যায়। তেমন আয়মানও এসবের মুখোমুখি বহুবার হয়েছে। কিন্তু মেগানের ট্র্যাপটা স্বাভাবিক না নিয়ে শুরুতেই কী করে ও ধরে ফেলল? এটা ভাবতে গেলে স্পষ্ট বোঝা যায় আমার অস্ট্রেলিয়াতে আসার সংবাদটা ওকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আগেভাগেই। তাই চট করেই মেগানকে ও সন্দেহ করে বসে৷ জাইমাকে দিয়ে সোজা মেগানকে বাসায় তুলে আনে। ফিজিক্যালি টর্চার করে খুব মেয়েটাকে। তারপরও মেগান মুখ খুলেনি আমি ওকে ডাবল পেমেন্ট করব বলে। তার মাঝে সারা মেয়েটার সাথে আমার মাত্র অভিনয়টা প্রথম ধাপে ছিল। কাজের শেষে ও আমার সাথে ডেটে আসত। এটাও সাধারণ ব্যাপার। এখানেও আয়মানের সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল না৷ কারণ, ও এখানে আসার পর সম্পূর্ণ চিল করছিল। কোনো বাড়তি টেনশন ও একেবারেই মাথাতে আনছিল না। আমোদ ফূর্তি, ড্রিঙ্কস, ড্রাগস, এসবেই ডুবে ছিল। তাই অন্যদের প্রতি ওর মনোযোগ থাকার কথা না একেবারেই। কিন্তু সারাকেও ও ফলো করতে শুরু করে। ওর মাঝে হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। আর ওকে ফলো করেই আমাকে খুব সহজে ধরে ফেলে।’
-‘মোটকথা, ভাবিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল আপনি এখানে আসার পরই। আর সেটা করেছিল এহসানই। কারণ, নিশা বা নিশার ভাইয়ের সাথে সব থেকে খারাপ হলেও ওর তো আসে যায় না৷ বরঞ্চ ও ঝামেলামুক্ত। তাই ও নিশা আর নিশার ভাইয়ের দিক না ভেবেই আয়মানকে কোনো মাধ্যমে জানিয়ে দেয় আপনার ব্যাপারটা। এখন যা দাঁড়াচ্ছে, ও তো ভাবিকে পেতে এই নিশা বেচারিকে খুন করেও ফেলতে পারে।’
-‘এক্সাক্টলি। আয়মানকে পুরোপুরি কাছে না পাওয়া পর্যন্ত নিশাকে টলারেট করছে ও। আয়মানের মন পুরোটা জয় করে নেওয়ার পর নিশাকে মারতে এক মিনিটও দেরি করবে না।’
-‘ওরা তাহলে লন্ডন ছেড়ে মুম্বাইতে কেন এখন?’
-‘ওটা আয়মানের জন্যই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আয়মান লন্ডন সহজে ব্যাক করবে না বলে এহসান মুম্বাই চলে আসে। যাতে এহসানের কাছেই আয়মান এসে থাকে।’
-‘এই শালা ভাবিকে সব সময় কাছে রাখার চেষ্টা করছে! আপনি এই ব্যাপারটা কী করে বুঝলেন স্যার? মানে এহসান যেভাবে নিশার কেয়ার করে, তাতে বোঝার উপায় নেই সে আয়মানের প্রতি উইক।’
জায়িন আর বসে থাকতে পারল না। শুতে শুতে বলল সে, ‘আমার খবরটা কে জানাল? সেই ব্যক্তিকে চিনতে আমার সন্দেহ তালিকাতে প্রথম ছিল এহসান আর নিশাই। মেগানকে প্রথমে সন্দেহ হলেও তখন ভাবনাটা হলো, মেগানকে শুরুতেই কী করে আয়মান সন্দেহ করল? কারণ, মেগান সত্যিই আয়মানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। যখন আয়মানকে আমি দেখাই ওকে। তাই অভিনয় তো করেনি ও। যে ওর অভিনয়টা ধরে ফেলবে আয়মান। মেগানের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বাস্তবিকই ছিল। এতেই বুঝতে পারলাম, মেগান ওর সামনে যাবার আগেই ও জেনে বসে আছে আমার খবর। আর মেগান যদি আমার কথা বলতই, তাহলে মেগানকে দিয়েই আমাকে ও ট্র্যাপে ফেলতে পারত। কিন্তু মেগান স্বীকার করেনি বলে অমানবিকভাবে বেচারির ওপর টর্চার করেছে।’
-‘উফঃ! ভাগ্যিস মেয়েটাকে জানে মারেনি। এখন তাহলে এই এহসানকে কী করবেন? আমি এখানে আসার সুযোগে ও তো নিশাকে নিয়ে ভেগে গেছে মুম্বাইতে। নিশার ভাইকেও নিয়ে গেছে।’
-‘এক সঙ্গে এতদিকে তুমি হ্যান্ডেল করতে পারবে না রেজা। তোমাকেও তো কাজে ফিরতে হবে। আয়মানকে কী করে অতি দ্রুত এখানে ফেরানো যায়, সেটা ভাবো। তারপর যা করার তা তো আমিই করব।’
এরপর দু’জনই নিরব মুহূর্তে চলে গেল। জায়িন চোখ বুজে কপালের ওপর ডান হাত ফেলে শুয়ে রইল। আর রেজা চিন্তিত ভঙ্গিতে নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবনাতে মশগুল হলো। কতক্ষণ এভাবে কাটার পর রেজা আচমকা বলে উঠল, ‘কোনো একটা উইকনেস জরুরি ভাবিজানের। আচ্ছা স্যার, ভাবির মায়ের মার্ডার হয়েছে এটা জানি আমরা। কিন্তু ওনার বাবার হদিস তো আমরা পেলাম না সঠিক। কেউ বলে তাকেও খুন করা হয়েছে। আবার কেউ বলে সে কোথাও লুকিয়ে আছে। এমন নয় তো, টেরোরিস্টের লিডার উনি নিজেই? মানে উনি বেঁচে আছেন?’
-‘প্রথম কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছিল। শেষ প্রশ্নটা কীভাবে মাথায় আসলো তোমার? সে টেরোরিস্ট ছিল বলে কি মেয়েদেরকেও টেরোরিস্ট বানাতে চাইবে? আর সে বেঁচে থাকলে আয়মানের অবস্থা এমন কেন হলো? ওকে নিজে নিজে রোজগার করে কেন চলতে হলো? একা কেন থাকতে হলো? কিন্তু এই কেসটাকে আমাদের আসলেই সিরিয়াস নেওয়া উচিৎ। আয়মানের বাবার অস্তিত্ব নিয়ে এই ধোঁয়াশাটা ভাববার মতোই।’
————–
বেলস বিচ জায়িনের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তটার জন্য খুবই বিশেষ জায়গা। দেড় মাস বিছানাশয্যাতে কাটিয়ে সুস্থতা ফিরে পেতেই সর্বপ্রথম ছুটে আসে সে সমুদ্রের বুকেই। মধ্য সমুদ্রে বোটের অগ্রমুখে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার মাঝে চমৎকার এক প্রশান্তিময় অনুভূতি অনুভব হয়। আর সাথে আছে তার এখানের জীবনের প্রথম পাওয়া বন্ধুগুলো – স্যামুয়েল, লুকা, লুইস আর কপার। আর তাদের আমোদপ্রমোদের জন্য শ্বেতকায় পাঁচজন সুন্দরী রমণী তো রয়েছেই। জায়িনসহ তারা পাঁচ বন্ধুই তুখোড় মস্তিষ্কের অধিকারী। লোকসমাজে এরা সাধারণ মানুষের মতোই চাকরি বা অন্যান্য পেশায় জীবনযাপন করছে। কিন্তু এই পাঁচজনের জীবনেই সব থেকে বড়ো রহস্য, তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যুক্ত। সেই একুশ বছর বয়সে প্রথম খুনটার পর থেকে। এই পাঁচজনের প্রতিভাও একেকরকম। এবং প্রশংসার দাবিদার। এদের মাঝে আপাতত জায়িন ছাড়া বাকি চারজন বিভিন্ন দেশের মাফিয়াদের ডান হাত হয়ে অবৈধ মাদক, অস্ত্র পাচার, চাঁদাবাজি, চুক্তিতে হত্যার ঘটনা, রাজনৈতিক ঘুষ, পতিতাবৃত্তি, শিল্প চুরি, বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত। এদের অপরাধের তালিকা দীর্ঘ। আয়মানকে এরা না দেখলেও নামে ঠিকই চেনে সিরিয়াল কিলার হিসেবে। ওরা চারজন জায়িনের থেকে আয়মানের ব্যাপারে সব জানার পর থেকে স্যামুয়েল রসিকতা করে হলেও চরম সত্য একটা কথা বলে খানিকটা খোঁচা মেরেছে জায়িনকে। কথাটা ছিল, ‘তুই চোর হয়ে নিশ্চয়ই সাধুচরিত্রের সোলমেট আশা করবি না, তোর এই অসাধারণ নীতি আমার মনে ধরেছে ভাই।’
কথাটা নিয়ে সবাই হাসি তামাশা করলেও জায়িন উপলব্ধি করল, সত্যিই তো তাই। সে তো ভালো নয়। সে যেমন, বিধাতা তার জীবনসঙ্গিনীকেও তেমনই একজন করবেন নিশ্চয়ই। তবে এ নিয়ে তার বিন্দু পরিমাণ আফসোস হচ্ছে না এ কারণেই, অবুঝ বয়সটাতে যে ছোট্ট পরীকে সে তার রানি বানানোর জন্য বড়ো ভাইয়ের কাছে আবদার ধরেছিল, তাকেই সে দীর্ঘ একটা সময় পর এসে পেতে চলেছে। কিন্তু তাদের দু’জনের এক সঙ্গে চলাটা খুব যে সহজ হবে না। আর সেই পথটাও শিথিল হবে না। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই তো আজ ছোটোবেলার বেস্টফ্রেন্ডদের ডেকেছে। তার ডাকেও পৃথিবীর চারকোণা থেকে চারজনই ছুটে এসেছে। বলা বাহুল্য, এরা কেউ-ই এখন অস্ট্রেলিয়া বসবাস করে না পরিবারের সাথে। পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে চায় বলেই হয়তো। অবশ্য স্যামুয়েল আর কপার এক সঙ্গেই ইতালিতে থাকে৷ লুইস নর্থ আমেরিকা আর লুকা আফ্রিকাতে। শুধু জায়িন এতকাল বাংলাদেশ ছিল। কিন্তু এখন সে এখানেই সেটেল্ড করে যাচ্ছে ন্যাশনালিটি বহু আগে থেকেই থাকার সুবিধার্থে। এর অবশ্য মূল কারণ আয়মান৷
—————
পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আয়মান অস্ট্রেলিয়াতে এসেছে গতকাল। তার জন্য সারার মৃত্যু হবে, এমনটা সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না। সহজ, সরল, মিষ্টি একটা মেয়ে তার এই বন্ধুটি৷ যে বন্ধুটি সব সময় সুখপাখি নামক কোনো এক জীবনসঙ্গীকে খুঁজেছে। যার বদৌলতে তার একাকিত্ব ঘুচবে, তার কাঁধে মাথা রেখে আগামী দিনের সুন্দর স্বপ্ন বুনবে। কত আশায় না ছিল মেয়েটির! তার সঙ্গে এতটা খারাপ সে কখনোই হতে দেবে না।
(চলবে)
_____________