#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৭
চমকপ্রদ আলো, ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে চৌধুরী বাড়ি৷ কারণ, আজ ইমন, মুসকানের বিয়ে। কনে গেছে বান্ধবী আর বড়ো বোন ইয়াশফাকে নিয়ে বউ সাজতে পার্লারে। এরই মধ্যে খবর এলো ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছে চৌধুরী বাড়ির ছোটো পুত্র ইমন চৌধুরী। খবরটি ঝড়ের গতিতে মুসকানের কাছেও পৌঁছে গেল। বিয়ে বাড়ির আনন্দ তীব্র হয়ে ওঠল যেন৷ দুপুর পরে কনে পার্লারে গেছে। বরের কথানুযায়ী বিয়ে পড়ানো হবে সন্ধ্যার পর। সাড়া বিকেল জুড়ে সাজানো হলো কনেকে। কনের বান্ধবী আর বোন সাজতেও বাকি থাকল না৷ সাজের প্রতি ইয়াশফা, মুসকান কারোরি ঝোঁক ছিল না। দুই মায়ের পেটের সন্তান হলেও এদের দু’বোনের বেশকিছু সাদৃশ্য আছে। চেহেরার গড়নও প্রায় মিলে যায়। শুধু মুসকানের গায়ের রঙ ইয়াশফার থেকে চাপা৷ ইয়াশফা ধবধবে ফর্সা আর মুসকানের গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। দু’জনের উচ্চতাও সমানে সমান। এই যে আজ মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে ডার্ক রেড লেহেঙ্গা পরেছে। যা দু’দিন আগে মুসকানের ওপর কিঞ্চিৎ ঈর্ষা থেকে কিনেছে সে। তার চোখের সামনে তার বাবা মুসকানকে এত এত শপিং করে দিচ্ছে। বয়সে বড়ো হয়ে ছোটো বোনের বিয়ের শপিং করছে। কিছুটা অপমান, কিছুটা লজ্জা বোধে আক্রান্ত হয়ে নিজের জন্য লাল টুকটুকে লেহেঙ্গাটা কিনেই ফেলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ফর্মালিটি করে মুসকানকে বলেছিল, বিয়ের দিন লেহেঙ্গা পরতে। কিন্তু মুসকান লেহেঙ্গা না নিয়ে সব অনুষ্ঠানের জন্য শুধু শাড়িই নিল। এজন্য অবশ্য মনে মনে মুসকানের রুচিকে ধিক্কার দিয়েছে ইয়াশফা। তার সে ধিক্কার বুঝতে পারলেও মন খারাপ করেনি মুসকান৷ কারণ ওই মুহুর্তে বড়ো বোনের পছন্দের থেকেও হবু স্বামীর পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেয়া বাঞ্ছনীয় মনে করেছে সে। জীবনে প্রথমবার ব্রাইডাল সাজল মুসকান, ইয়াশফা৷ ওদের দু বোনকে সাজিয়ে বিউটিশিয়ানরা খুবই অবাক। যেন জমজ দু’টো বোন দাঁড়িয়ে আছে। অচেনা কেউ হুট করে সামনে দাঁড়ালে এই মুহুর্তে এদের দু’জনকে জমজ বোনই বলবে৷ নিজেদের আয়নাতে দেখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল মাত্র। মুসকান মন থেকে আর ইয়াশফা জোরপূর্বক। কেন জানি কমপ্লিমেন্টটি ভালো লাগল না তার। কিন্তু মুসকান শান্তি পেল। মনে মনে বলল, তারা তো একই বাবার সন্তান। মিল থাকতেই পারে৷ এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা দুই বোন।
মুসকান আর ইয়াশফার ব্রাইডাল সাজের ছবি দেখে ইমন যারপরনাই অবাক! মাত্রই হোয়াটসঅ্যাপে ছবি গুলো পাঠিয়েছে মুসকান। হৃদয়ের নারীকে চিনতে ভুল করেনি সে। তবু সাজসজ্জায় মুসকানকে যেন ঠিক এন্ড্রয়েড ফোনের অ্যাপ গুলোর মতোই আপডেট করা হয়েছে। ইয়াশফাকেও ভারি সুন্দর লাগছে। নিঃসন্দেহে তার মেজো কাকার দুই মেয়ে সুন্দরী। বর বেশে তৈরি হচ্ছিল ইমন৷ পাশাপাশি এসব ভেবেই মিটিমিটি হাসছিল। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল দিহান। ইমন তাকাতেই দরজার কপাটে ঠেস দিয়ে দু-হাত বুকে বেঁধে ভ্রু নাচাল সে। ইমন হাতঘড়ি পরতে পরতে বলল,
‘সায়রীকে বল পার্লারে যায়নি মেনে নিয়েছি। কিন্তু ও আসার পর সব সময় ওর পাশে যেন থাকে।’
দিহান দুষ্টুমি ভরে হাসল। বলল,
‘তোমার ও তো বেরিয়েছে।’
ইমন মুখ ফিরিয়ে নিজের কাজে মন দিল। দিহান গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে ইমনের কাছাকাছি দাঁড়ালো। কনুই দ্বারা পেটে গুঁতো দিয়ে বলল,
‘একটা জিনিস এনেছি।’
বাঁকা চোখে তাকাল ইমন। দিহান চট করে পকেটে হাত রাখল। দাঁত ক্যালিয়ে হাসতে হাসতে পলিথিনে মোড়ানো দু’টো ডিম সিদ্ধ বের করে সামনে ধরে বলল,
‘এই নে হাঁসের ডিম আনছি তোর জন্য। আমি বিয়ের পরেরদিন সকালে খাইছিলাম। কিন্তু আমার মনে হয় এইটা বিয়ের দিন রাতেই খাওয়া দরকার। তুই তো খুব কেয়ারলেস বন্ধু। আমি ভীষণ কেয়ারিং। তাই আম্মার পালের হাঁসের খাঁটি ডিম জোগাড় করে দিলাম।’
বিস্ময়ে দিশেহারা ইমন। দিহান প্রচণ্ড দুষ্টু। তাই বলে তাকেও ছাড় দিল না? এমন একটা সময়ে এমন কাণ্ড! রাগে হাসফাস করতে করতে চাপা ধমক দিল সে,
‘শা লা এমন চটকানা দিব না, বউয়ের নাম ভুলে যাবি।’
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল দিহানকে। গটগট পায়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। দিহান ত্বরিত সামনে দাঁড়াল তার। জোর করল ডিম দু’টো খেতে। ইমন চোখ গরম করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘দিহান, ফাইজলামি করিস না।’
‘ফাইজলামি না দোস্ত, তুই খা। সকালবেলা এরজন্য তুই আমারে খুশি হয়ে চার, পাঁচটা চুম্মাও দিতে পারোস।’
বাঁকা হাসল ইমন। মাথা চুলকে বলল,
‘লাইক সিরিয়ালি? এতবছরে যখন বন্ধুকে চুম্মাচাম্মি করার রুচি হয়নি। কাল থেকে হবে?’
দিহানের চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। ঢোক গিলে মুখ হা করে কতক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
‘তাইলে এই ব্যাপার মাম্মা?’
আয়নায় নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঈষৎ হেসে রুম ছাড়তে উদ্যত হলো ইমন। দিহান অনুরোধ করল,
‘খুব আশা নিয়ে আনছি দোস্ত খা।’
ইমন ওর বুকে মৃদু কি ল বসিয়ে বলল,
‘এটা বরং তুই খা। আমার চেয়ে তোর বেশি প্রয়োজন।’
বাঁকা চোখে তাকাল দিহান। বলল,
‘কেন কেন?’
ইমন দুষ্টুমি ভরে হেসে জবাব দিল,
‘ঝালাই পুরোনো গাড়িতেই দেয়, নতুন না।’
ইমনের মুখে এমন একটি কথা শুনে হেচকি ওঠে গেল দিহানের৷ ইমন তো কথাটা বলে চলেই গেল। এদিকে দিহান তার কথা মাথায় চেপে বসে পড়ল৷ বন্ধুর জন্য নিয়ে আসা পালের হাঁসের সিদ্ধ করা ডিম দু’টো নিজেই খেল। এরপর তার মনে পড়ল ইমন যা বলেছে তা সত্যি নয়৷ নিছক তাকে ক্ষেপানো। সে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়৷ ইমনকে বোঝাতেই হবে সে পুরনো গাড়ি না৷ তার কোনো ঝালাইয়ের প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস না হলে সায়রীর কাছেই শুনুক! মুহুর্তেই একহাত দিয়ে মুখ আঁটকে ফেলল। মনে মনে বলল,
‘কন্ট্রোল দিহান, কন্ট্রোল। নয়তো সায়রী তোকে এক লা ত্থি দিয়ে বাসার বাইরে ফেলবে। আরেক চটকানা দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকাবে।
___
পার্লার থেকে কনে আসতে আসতে মাগরিবের আজান পড়ে গেল। সেই সাথে প্রচণ্ড বেগে ঝড়বৃষ্টি।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো ভয়াবহ ঝড়বৃষ্টি মাথায় করেই। বিয়ে শেষ হতেই বরের বন্ধুরা গিয়ে বাসর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিচে ড্রয়িং রুমে মুরুব্বিদের সাথে বসে মুসকান। ইমন ছোটো বোনদের সাথে ছবি তুলছে। সে সময়ই হঠাৎ তার মনে পড়ল ইয়াশফার কথা। জিজ্ঞেস করল ইয়ানাকে। ইয়ানা বলতে পারল না৷ ইমনের সৎ মা শুনে বলল,
‘ওকে তো আমিও দেখছি না৷’
ইভানে মা বলল,
‘মেয়েটা বোধহয় আবারো মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে।’
মেজো কাকি কথাটা শুনেই নাকি কান্না শুরু করে দিল। ইমন বিরক্ত হলো খুব। ইয়ানাকে বলল,
‘ইয়াশফাকে ডেকে আন গিয়ে।’
ইয়ানা উপরে যেতে দাঁড়াতেই মেজো কাকি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘থাক এত দরদ দেখাতে হবে না। তোমরা আনন্দ উল্লাস করো। আমিই যাচ্ছি আমার মেয়েকে দেখতে।’
পারভিন চলে গেল উপরে। ছোটো কাকির মাথায় তখন আকস্মিক ইভানের কথা মনে পড়ল, ছেলেটাকেও অনেকক্ষণ ধরে দেখছে না। যাক একদিকে ভালোই হয়েছে। বিয়ের ঝামেলা মিটে গেছে। ইভান যেখানে থাকার থাকুক। এসবের মাঝে থেকে গণ্ডগোল পাকানোর থেকে দূরে থাকাই ভালো। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
মেজো কাকি ইয়াশফার ঘরে যেতে যেতে ইভানের ফোনে কল করল৷ মুসকান পার্লার থেকে আসার পর থেকেই ইভানের নাম্বারে কল করছেন তিনি৷ কিন্তু বরাবরই ফোন বন্ধ বলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কথা ছিল পার্লার থেকে ফিরতি পথেই মুসকানকে কিডন্যাপ করা হবে। এরপর তাকে নিয়ে যা খুশি করে ভোর রাতে ইভান চলে যাবে আমেরিকায়। বাংলাদেশে আসবে দশ, বারো বছর পর। এরই মধ্যে আজকের কলঙ্কময় রাতকে মুছে ফেলতে মুসকান গলায় দড়ি দেবে। পারিবারিক অশান্তিও দশ, বারো বছর পর মিটে যাবে। যদি মেটার সম্ভাবনা নাই থাকে। ইমনের ত্যাজ এতেও না কমে, হার না মানে। তবে দেশের বাইরের স্যাটেলড করবে সে। তবু দিনশেষে শান্তি তার জীবনের বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে পেরেছে। ইভানের এই পরিকল্পনার মূলে ছিল মেজো কাকি। তাই সশরীরে বধূ সাজে মুসকানকে চৌধুরী বাড়িতে আসতে দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় তার। চোখের সামনে সতীনের মেয়ে তার শশুর বাড়িতে বউ হিসেবে মর্যাদা পায়৷ যে মর্যাদা তার সতীন পায়নি। ইভানের ফোন এখনো বন্ধ বিরক্ত হয়ে রেগেমেগে নিজের ফোনই বন্ধ করে ফেলল মেজো কাকি। এরপর মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখল মেয়ে ঘরে নেই। ভ্রু কুঁচকে গেল মুহুর্তেই। এই মেয়েটা গেল কোথায়? ছাদে না তো? মন খারাপ হলেই তো ছাদে যাওয়ার স্বভাব আছে তার। রাগে গজগজ করতে করতে ছাদের দিকে হাঁটা ধরল পারভিন৷
____
তাজা ফুলের সুঘ্রাণে মন মাতোয়ারা। মাত্রই মুসকানকে বাসর ঘরে রেখে যাওয়া হয়েছে। ইমন বারান্দায় বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মুসকান চুপচাপ বসে আছে ধবধবে সাদা বিছানায় ছড়ানো, ছিটানো গোলাপের পাপড়ির ওপর৷ বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে তার৷ পরিচিত বাড়ি, পরিচিত ঘর, পরিচিত মানুষ অথচ অপরিচিত অনুভূতি। গা জুড়ে বইছে শিরশিরে বাতাস। ক্ষণে ক্ষণে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এসি চলছে তবু নাকের ডগায় জমছে ঘাম। হঠাৎ হঠাৎ আবার হাঁটুও কেঁপে ওঠছে। বসে আছে সে৷ তবু হাঁটু কাঁপছে কী অদ্ভুত! হাঁটুতে হাত দিয়ে বুলিয়ে দিল। বুকের ভেতরে থাকা যন্ত্রটা কেঁপে ওঠল তক্ষুনি। ত্বরিত হাত রাখল বুকে। ঢোক চিপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সায়রী এসে তাকে অমন অবস্থায় দেখে মুচকি হেসে দরজা লাগিয়ে বলল,
‘কী গো সুন্দরী বুকে হাত কেন?’
চমকে ওঠল মুসকান। যেন মারাত্মক ভয় পেল। সায়রী ত্বরিত এসে কাঁধ চেপে ধরল তার। বলল,
‘আরেহ মেয়ে ভয় পেলে নাকি!’
স্বাভাবিক হতে একটু সময় নিল মুসকান। বলল,
‘আমি একটু পানি খাব আপু।’
‘ওয়েট আনাচ্ছি।’
দরজা খুলে মুখ বের করল সায়রী দেখতে পেল ইমন, দিহান সহ আরো বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। সে গলা উঁচু করে বলল,
‘এই ইমন তোর বউয়ের গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খাবে বলছে।’
বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠল। দিহান উঁচু গলায় বলল,
‘কাম সারছে বন্ধু আমার বাসর ঘরে না ঢুকতেই বউয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ!’
হাসির মাত্রা বাড়ল ওদের। ইমন বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। নিচে তাকিয়ে ইশারা করল ইনায়াকে। সে এলে পানির ব্যবস্থা করতে বলল। এরপর বন্ধুদের চাকা ধমক দিল। কিন্তু ওরা থামল না। নিজেদের মতো ক্ষেপিয়েই গেল৷ ভেতরে বসে থাকা মুসকান সেসব শুনে লজ্জায় যেন আধমরা হয়ে রইল। বুকের ভেতর চলা ঢিপঢিপ বাড়তে লাগল ক্রমশ। মন বলল,
‘আজ খুব সর্বনাশ হবে তার খুব।’
চলবে…