#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৬ ( খণ্ডিত অংশ)
প্রণয়ের উষ্ণ ছোঁয়ায়, আর্দ্র বাক্যে প্রচণ্ড আবেগে বিগলিত হয় মুসকান। হৃদয় জুড়ে শিহরণ জাগে। একচ্ছত্র লজ্জায় নুইয়ে পড়ে দেহ শ্রী। প্রেয়সসীকে প্রগাঢ় অনুভূতিময় বাক্য বলে আবেগঘন হয়ে রয় ইমন নিজেও। লজ্জাবনত মুখশ্রী দেখে হৃৎপিণ্ড কাঁপতে থাকে। একে অপরের অতি নিকটে দাঁড়িয়ে সংগোপনে অনুভব করে গভীর প্রণয়ানুভূতিকে। কিছু স্পর্শ হয় উন্মাদনার, কিছু বাক্য হয় আলোড়নের। আর কেউ একজন হয় সর্ব সুখের। দু’টি হৃদয় যখন একে অপরের মাঝে সুখ খুঁজে পায়। দুঃখের কি সাধ্য থাকে তাদের আলাদা করার?
দরজা খোলাই ছিল। ওরা একে অপরের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। মুসকানের কোমল ঠোঁটজোড়া থেকে তর্জনী সরিয়েছে ইমন। তৃষ্ণার্ত কাকের মতো এগিয়েছে নিজের পুরুষালি ঠোঁটজোড়া। ঠিক সেই মুহুর্তেই আচমকা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সায়রী। মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। দু’হাতে চোখজোড়া ঢেকে মুখ ঘুরিয়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠেছে,
‘সরি, সরি দোস্ত!’
আকস্মিক সায়রীর আগমনে মুসকানকে বাহু বন্ধনী থেকে মুক্ত করে তড়াক করে সরে দাঁড়ায় ইমন। চোখ দুটো কিঞ্চিৎ বড়ো বড়ো করে তাকায় দরজার বাইরে সায়রীর দিকে। এরপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে তীব্র লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা মুখশ্রী, আর আকস্মিক ভয় পেয়ে কম্পমান নারীদেহের পানে। ধাতস্থ হতে কিয়ৎক্ষণ সময় লাগে ওদের তিনজনেরই। এরপর সায়রী বিস্মিত চোখে ইমনের দিকে তাকায়। রয়েসয়ে ঢোক গিলে হাতে থাকা ফোনটা এগিয়ে ধরে বলে,
‘মুসকানের ফোন বাজছিল, অনেক্ক্ষণ ধরেই। তাই নিয়ে এলাম। তোরা দরজা বন্ধ… ‘
সহসা কেশে ওঠল ইমন। থেমে গেল সায়রী। ইমনের দিকে আড়চোখে তাকাল মুসকান। মুহুর্তেই ইমনও তাকাল। ইশারা করল সায়রীর থেকে ফোনটা নিতে। জরুরি কল এসেছে বোধহয়। সন্তর্পণে এক ঢোক গিলে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল মুসকান। লজ্জায় তাকাতে পারল না সায়রীর দিকে। সায়রীও আর ওর সামনে থেকে লজ্জা দিতে চাইল না। ত্বরিত ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। বলে গেল,
‘আমরা রেডি৷ বেরুচ্ছি.. তোরা রেডি থাকলে চলে আসিস।’
_________
ঘন্টা হতে চলল ইভান কল করে যাচ্ছে মুসকানকে। অথচ ধরার নাম নেই। রাগে, ক্ষোভে নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ছে ইভান। এমন সময় তার দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিল মেজো কাকি। বলল,
‘ইভান আসব?’
উত্তপ্ত মেজাজে উত্তর দিল ইভান,
‘আসো।’
সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো মেজো কাকি। বসল ইভানের পাশে। ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে ইভান৷ তার এই উত্তপ্ত আচরণের কারণ জানে সে। ইভানের বুকের ভেতর ঠিক কোন আগুন জ্বলছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। তাই তো সেই আগুনে ঘি ঢালতে চলে এলো সে। আর পু ড়িয়ে ছাঁই করার পায়তারা করল সতীনের মেয়েকে। মুসকানকে সে কোনো কালেই সহ্য করতে পারেনি। যেদিন থেকে জেনেছে মুসকান তার স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। সেদিন থেকে অসহ্যের মাত্রাটা আকাশ ছুঁয়েছে। বুকের ভেতর যে জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে তা কেবল থামাতে পারে ছোটো জায়ের ছেলে ইভান৷ তাই ইভানের মাথায় হাত, পিঠে হাত বুলিয়ে কিছু সময়ের জন্য রাগ নামানোর চেষ্টা করে বলল,
‘আজকে ওরা আসছে৷ কাল গায়ে হলুদ পরদিন বিয়ে।’
সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল ইভান। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘তুমি কি এসব বলতেই এসেছ?’
ওঠে দাঁড়াল মেজো কাকি। ইভানকে আরো বেশি উত্তেজিত করতে বলল,
‘আমি এসেছি তোমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে।’
চ্যাঁচিয়ে ওঠল ইভান৷ বলল,
‘কী পরামর্শ দেবে? শা”লির মেয়ে ফোনই ধরছে না। ফোন না ধরলে প্রভাবিত করব কীভাবে?’
ইভানের ক্রোধের তোপে পড়ে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল সে। দরজার দিকে তাকাল ভীত চোখে। এই ছেলের উদ্ধত আচরণের জন্য সে আবার ধরা না পড়ে যায়। যেদিন থেকে শুনেছে মুসকান ইমনকে বিয়ে করতে রাজি। তাদের মনোমালিন্য সব দূর হয়ে গেছে। সেদিন থেকেই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে সে। তাছাড়া ইমনের বাসায় মুসকান দু সপ্তাহ ধরে থাকছে। এ নিয়ে ইভানের মাঝে কম ক্রোধ দেখতে পায়নি। ইমনকে ইভান হিংসে করে ছোট্টবেলা থেকে। জানত সে৷ মুসকানকেও খুব একটা পছন্দ করে না। এ কথাও জানত৷ কিন্তু এর বাইরেও যে কিছু আছে তা টের পেয়েছে এই চৌদ্দ দিনে। তাই ইভানের মাথায় কুমন্ত্রণা ঢুকায়৷ মুসকানকে ভয় দেখিয়ে বা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে যেভাবেই হোক এই বিয়ে থেকে সরে যেতে বলতে বলে। ইভানও সেই মোতাবেক মুসকানকে লাগাতার ফোন করে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটা ফোন ধরছেই না৷ মেজো কাকিও ভীষণ চিন্তায় পড়ল। ইভান যদি মুসকানকে আটকাতে না পারে তাহলে ইমন, মুসকানের বিয়েটা হয়ে যাবে৷ এ বাড়ির মেয়ের পরিচয় পেল এখন বউ পরিচয়ও পাবে৷ তাছাড়া ইয়াশফার এখনো বিয়ে দেয়নি। মুসকানের বিয়ের খরচ সব তার স্বামীই দিচ্ছে। দেবে না কেন? মুসকান তারও মেয়ে। ইয়াশফার কথা ভেবেই কেঁদে ফেলল মেজো কাকি। বাবার আদুরে মেয়েটার বাবাতে ভাগ বসাল ঐ মেয়ে৷ এখন সবকিছুতেই ভাগ বসাচ্ছে। ইমন ছেলে হিসেবে যেমন পাত্র হিসেবেও তেমন। এমন মেয়ে জামাই লাখে একটা মেলে। ঐ ফকিন্নির ঝি, সতীনের মেয়ের কপাল সোনায় সোহাগা হবে। আর তার মেয়েটা বাবার থেকে পাওয়া আঘাতে ঘর আঁটকে ধুকে ধুকে মরবে? মা হয়ে এসব সে সহ্য করবে? কক্ষণো না৷ মেজো কাকি গভীর চিন্তায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ইভান কিয়ৎক্ষণ বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষবারের মতো চেষ্টা করল। ফোন দিল মুসকানকে।
সায়রী চলে গেল৷ মুসকান মিসড কল চেক করে নাম্বারটা চিনতে পারল না। ইমন তার ব্যাগপত্র চেক দিচ্ছে। এমন সময়ই ফোন বেজে ওঠল আবার৷ মুসকান কিছু না ভেবেই রিসিভ করে সালাম দিল। ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে ইভানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘মুসকান, তুমি ফোন ধরেছ! কতক্ষণ ধরে ট্রাই করছি।’
‘আপনিহ!’
কিঞ্চিৎ ভয়, সীমাহীন বিস্ময়ে শিউরে ওঠল মুসকান। ব্যাগপত্র চেক দিতে দিতে তাকাল ইমন। মুসকানের মুখো ভঙ্গি দেখে ভ্রু গেল। মুসকান ঢোক গিলে তাকাল ইমনের দিকে। ফোনের ওপাশে থাকা ইভান বলল,
‘মুসকান লিসেন, তুমি এই বিয়েটা করো না। তোমার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেসব জানার পর এই বিয়ে তুমি করতে পারবে না৷ তোমার মতো প্রবল আত্মসম্মান সম্পন্ন মেয়ে কিছুতেই ইমনকে জীবনসঙ্গী করবে না।’
মুসকান ঘামতে শুরু করল। সন্দেহের বশে ওঠে আসল ইমন। দাঁড়াল মুসকানের পাশে৷ খেয়াল করল মুসকানের শরীরে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। হাত দু’টো মৃদু মৃদু কাঁপছে। কেন জানি খটকা লাগল তার৷ কোনোকিছু না ভেবেই মুসকানের হাত থেকে কেড়ে নিল ফোনটা৷ ধরল নিজের কানে। শুনতে পেল,
‘এই বিয়েটা করলে খুব বড়ো ভুল হয়ে যাবে মুসকান৷ আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।’
আকস্মিক চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল ইমনের। কঠিন দৃষ্টিতে একবার তাকাল মুসকানের ভয়, দুঃশ্চিন্তা মিশ্রিত মুখশ্রীতে। এরপরই দৃষ্টি ফিরিয়ে মেঝেতে স্থির করল৷ একহাতে ফোন চেপে ধরল শক্ত করে৷ অন্য হাত মুঠো মন্দি করে গমগমে কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘করলাম বিশ্বাস। এবার বল, বিয়েটা করলে ঠিক কী ভুল হবে মুসকানের?’
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মুসকান। এ জীবনে এমন ভয় সে কখনো পায়নি৷ পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে বোঝা দায়। হৃৎস্পন্দন রোধ করে শুধু ভীত চোখে ইমনের কঠিন মুখটায় তাকিয়ে রইল সে। এদিকে ইমনের কণ্ঠ পেয়ে ভয়ে সংকুচিত হলো ইভান। ইমন কি তার সব কথা শুনতে পেয়েছে? ঘাবড়ে গেল খুব৷ আমতা আমতা করে বলল,
‘ইমন, তুই আমাকে ভুল বুঝিস না৷ আসলে মেজো কাকি বলছি ভাই, বোনদের মধ্যে বিয়ে করা নাকি ঠিক না। মুসকান তো আমাদের বংশেরই মেয়ে। আমিও শুনেছি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে রক্তের কানেকশন থাকলে বাচ্চা, গাচ্চা হতে ঝামেলা হয়।’
নিমিষেই চোখ দু’টো বুজে ফেলল ইমন। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘তোকে এত পন্ডিতি করতে হবে না৷ আমারটা আমি বুঝে নিতে জানি।’
ফোন কেটে দিল ইমন। এপাশে ইভান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ ফোনটা ছুঁড়ে ভেঙে চুরমার করে দিল। ইভানের ক্ষিপ্ততা দেখে ত্বরিত পালালো
মেজো কাকি। মনে মনে ভাবল,
‘এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।’
মুসকানের ফোন আর মুসকানের হাতে দিল না ইমন৷ বন্ধ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল৷ এরপর কঠিন চোখে তাকাল মুসকানের দিকে। বলল,
‘এ কয়েকটা দিন আমার হুকুম ছাড়া এক পা নড়া তো দূরে থাক এক গ্লাস পানিও খাবে না৷ ওকে?’
ইমন ভেবেছিল মুসকান ত্যাড়ামি করবে। তাই নিজেকে তৈরি করেই রেখেছিল। কিন্তু না সে ত্যাড়ামি করল না। ইমনকে অবাক করে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল ‘ওকে’ যা ইমনের সমস্ত ক্রোধ নিমিষেই দূর করে দিল৷ ভালোবাসার আবেশে ডুবে রইল কিছু সময়।
চলবে…
#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৬ ( বর্ধিত অংশ )
বিয়ের আমেজে ভরপুর চৌধুরী বাড়ি। তিনদিন আগে থেকেই আত্মীয়, স্বজনদের আগমন শুরু। বেড়েছে পড়শীদের আনাগোনাও। যারা সামনে আনন্দপূর্ণ ভাব প্রকাশ করছে আর পিঠ পিছে করছে নিন্দা। বড়ো দু’জন ভাই রেখে বিয়ে করে নিচ্ছে ইমন৷ এতদিন যে কাজের মেয়ে পরিচয়ে ছিল সে নাকি এ বাড়িরই সন্তান। এ নিয়েও সমালোচনার কমতি নেই৷ এদিকে মেজো কাকির কাঁ টা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতেও বাদ রাখছে না৷ বাড়ির বড়ো মেয়ে ইয়াশফা৷ গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে আরো এক বছর। তার বিয়ের নাম গন্ধ নেই। অথচ ইয়াশফার চেয়ে বয়সে ছোটো আরেক মেয়ের বিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পড়শীদের এসব কানাঘুঁষা শুনে মেজো কাকির বুকের ভেতর জ্বলুনির তীব্রতা বাড়ল৷ মুসকানের সুখী মুখ, বাড়ির সকলের থেকে পাওয়া অধিক গুরুত্ব জাগিয়ে তুলল তার ভেতরের পিশাচিনী সত্তাকে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ঘৃণ্য এক অপরাধের। যে অপরাধটির প্রধান অস্ত্র ইভান চৌধুরী। গতকাল ইমন মুসকান বাড়ি এসেছে। এসেছে তাদের বন্ধু দিহান, সায়রীও। আজ ইমনের বাবা, সৎ মা আর বোন আসবে৷ সাতসকালে দাদুভাই নির্দেশ দিল, মুসকানকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে। বাড়িতে আসার পর পরই চমক পায় মুসকান। আত্মীয়, স্বজনদের মধ্যে অনেক নতুন মুখ দেখে। জানতে পারে তার আর ইমনের বিয়ে চারদিন পর। হঠাৎ সারপ্রাইজ পেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে কেঁদে ফেলে সে৷ তাকে সামলায় সায়রী৷ ইমনের চোখ জুড়ে প্রকাশ পায় একরাশ তুষ্টি। দাদুভাই এর নির্দেশ পেয়ে তৈরি হয়ে নেয় সায়রী। কিন্তু মুসকান তৈরি হয় না৷ সায়রী তাগাদা দিলে সে চলে যায় ইমনের রুমে। বেশ রাত করেই ঘুমিয়েছে ইমন৷ বিয়ের তোড়জোড় চলছে। দাদুভাই আর মেজো কাকার সঙ্গে দেড়টা অবধি আলাপআলোচনা করেছে। মুসকানের মামা বাড়ির সকল সদস্যকে দাওয়াত করা হয়েছে রাতেই। একদিন আগে আসবে তারা কথা দিয়েছে। তাদের সাথে কথাবার্তা শেষ করেই ঘুমুতে এসেছে সে। ঘুমে এতটাই বিভোর যে ওঠে সকালের খাবারটা অবধি খায়নি। কেউ তাকে ডাকতেও আসেনি৷ যতক্ষণ খুশি ঘুমাক। কিন্তু এই যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ ঘুমাতে দিল না মুসকান৷ দ্বিতীয় বারের মতো তার আরামপ্রিয় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাল। প্রথমবার ঘটিয়েছে রাত সাড়ে তিনটার দিকে৷ প্রচণ্ড গরমে হাসফাস অবস্থা। লোডশেডিং হচ্ছে ঘনঘন। উপরতলার প্রতি ঘরে আইপিএসে লাইট, ফ্যান চললেও নিচতলায় এই সুবিধা নেই। ইমন চার্জার ফ্যান পাঠিয়েছে অবশ্য। তবু যেন শরীর ঠান্ডা হচ্ছে না। ঘনঘন গলা শুকিয়ে ওঠছে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়া অতি জরুরি। তাই রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে বোতলে ভরে রাখা ঠান্ডা পানি বের করে মুসকান। কিন্তু পানি খেতে গিয়েই বাঁধে বিপত্তি। মনে পড়ে ইমনের বলা সেই কথাটা,
‘এ কয়েকটা দিন আমার হুকুম ছাড়া এক পা নড়া তো দূরে থাক এক গ্লাস পানিও খাবে না৷ ওকে?’
পানি আর মুখে তুলে না সে। মনের ভিতর দুষ্টুমি চাপে। এক ঢোক গিলে বোতল নিয়ে নিজ ঘরে চলে যায়। অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটার প্রয়োজন বোধ করে খুব৷ বালিশের তলা থেকে ফোনটা তুলে ডায়াল করে ইমনের নাম্বারে৷ ঘুমানোর সময় মাত্র একঘন্টা। গভীরে তলায়নি তখনো। এমন সময় বিকট শব্দে ফোন বেজে ওঠায় কিঞ্চিৎ মেজাজ খিঁচে ওঠে। ছোটো ছোটো দৃষ্টি মেলে তাকায় স্ক্রিনে। মুসকানের নাম্বার দেখে বুক ধক করে ওঠে। বসে ধড়ফড়িয়ে। এরপর ধাতস্থ হয়ে ফোন রিসিভ করে। ইভান, মেজো কাকিকে নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় সে৷ এই দু’জন ব্যক্তি একদমই সুবিধার নয়৷ আগে প্রকাশ্যেই মুসকানের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে৷ এখন করবে অপ্রকাশ্যে। যথাসম্ভব সচেতন থাকতে হবে৷ আগলে রাখতে হবে মুসকানকে। সার্বক্ষণিক এসব চিন্তাই ঘুরপাক খায় ইমনের মাথায়৷ মাঝরাতে তাই এভাবে মুসকানের ফোন পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে৷ মুসকান কিছু বলার পূর্বেই উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,
‘কী হয়েছে, ঠিক আছ তুমি? আমি আসব?’
ত্বরিত বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় ইমন৷ তক্ষুনি ওপাশ থেকে ভেসে ওঠে মুসকানের নম্র কণ্ঠের বিস্ফোরণ ঘটানো বাক্য,
‘আমার খুব পিপাসা লেগেছে, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে পারি?’
ঠুস করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মতো করেই ইমনের সমস্ত উত্তেজনা বিলীন হয়ে যায়। জগতের সকল ঘুমেরা এসে দানা বাঁধে চোখের কোণে। পাশাপাশি আশ্চর্য ঠেকে মুসকানের নির্বোধতা দেখে। মেয়েটা তো এমন স্বভাবের নয়৷ তবে কেন আজ এই আচরণ? ইমনের থেকে জবাব না পেয়ে গোপনে হাসে মুসকান। ফের প্রশ্ন করে,
‘কী হলো বলছেন না কেন? খাব না?’
ইমনের ঘুমকাতুরে চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ শক্ত চোয়ালদ্বয় ঝলে পড়ে কিঞ্চিৎ। হাঁটু ভর করে বিছানায় ওঠে। শুয়ে পড়ে নিঃশব্দে। এরপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত কাটে। বলে,
‘রাত দুপুরে ইয়ার্কি করতে আসছ তুমি! আমি কি তোমার বেয়াই লাগি?’
রেগে গেছে ইমন। বুঝতে পেরেই কল কেটে দেয় মুসকান৷ ঢকঢক করে পানি পান করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায় বিছানায়।
দ্বিতীয়বারের মতো আবারো ইমনকে বিরক্ত করতে ছুটে সে। রাতে অহেতুক হলেও এবার আর অহেতুক নয়৷ যতই দাদুভাইয়ের আদেশ থাকুক। বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। হবু বরকে একবারটি জানানো উচিত। প্রথমে টেক্সট করে রাখতে চাইলেই পরে মত বদলায়। চলে যায় রুমে৷ ইমন তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। উদাম শরীরটা বুকে ভর করে বালিশে মুখ গুঁজে আছে৷ মুসকান নিঃশব্দে রুমে ঢুকে লাইট অন করে। ধীরপায়ে চলে যায় বেডের বা’পাশে। কিয়ৎক্ষণ ঘুমন্ত ইমনের মুখটায় চেয়ে থাকে অপলক। মায়াবি, স্নিগ্ধ পুরুষালি মুখাবয়ব। ফর্সা ত্বকে কুচকুচে কালো, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। দেখতে দেখতে কখন যেন চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে৷ এমন সুন্দর মানব তার স্বামী হবে? মন সুন্দর, দেহ সুন্দর। আগাগোড়া যার অমায়িক সৌন্দর্যে ভরা সেই হবে তার বর? আকস্মিক সুখে, লজ্জায় নিঃশ্বাস চঞ্চল হয়। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে দু-হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় খোঁচা দাঁড়ির খসখসে গালে। তার নরম হাতের স্পর্শে নড়েচড়ে ওঠে ইমন। তবু চোখ খুলে না। মুসকান হাত সরিয়ে নেয়৷ পিটপিট করে তাকিয়ে ভাবে ডাকবে কিনা৷ পরোক্ষণেই মত বদলায়। ডাকাডাকি ছেড়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে ইমনের কপাল, গাল, নাক সবশেষে পুরু ঠোঁটজোড়ায় আঙুল ছোঁয়ায়৷ সর্বাঙ্গে মৃদু কাঁপন ধরে। অদ্ভুত শিহরণে বুকের ভেতর করে ছলাৎ ছলাৎ। মুখ নিচু করে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়েই রয়৷ তার বিবশ হৃদয় চমকে ওঠে আচমকা ইমনের কণ্ঠে। চোখ দু’টো বন্ধ, শুয়ে আছে একই ভঙ্গিতে। সবকিছু ঠিকই আছে শুধু ঠোঁট দুটো নড়ছে। তার ভারিক্কি কণ্ঠস্বরে কেঁপে কেঁপে ওঠছে মুসকানের বিবশ হৃদয়।
‘এইতো ক’টাদিন মুসকান, ইমন চৌধুরীর বৌমিকা হয়ে গেলেই যতক্ষণ খুশি, যেভাবে খুশি আদর দিতে পারবে৷ ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়েও থাকবে। কেউ বাঁধা দিবে না, কোনো বাঁধা থাকবে না।’
ঢোক গেলে মুসকান। ধরা পড়ে গিয়ে চোরের মতো ওঠে দাঁড়ায়। ঘুমায়নি অথচ ভাণ করেছে ঘুমানোর। অভিমান হয় খুব। মুখ ফিরিয়ে তাই অভিমানী কণ্ঠে বলে,
‘আমরা শপিংয়ে যাচ্ছি। সেটাই বলতে এসেছিলাম। ঘুমাচ্ছেন বলে আস্তে আস্তে বলতে চেয়েছি। আপনি যে ঘুমিয়েও অভিনয় করেন সেটা বুঝতে পারিনি।’
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি সে। প্রস্থান করেছে রুম থেকে। সঙ্গে সঙ্গেই ওঠে বসেছে ইমন। শপিংয়ে যাচ্ছে মুসকান? আশপাশে তাকিয়ে ত্বরিত ফোন হাতে নিল সে৷ কল করল দিহানকে। মুসকান কার সাথে যাচ্ছে, কোথায় যাবে সব শুনে স্বস্তি ভরে ফোন কাটে। এরপর মিটমিটে হাসি ঠোঁটে লেপ্টে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে।
_______________
বিয়ের জন্য শপিংয়ে বেরুচ্ছে মুসকান৷ এই শুনে মেজো কাকির মাথা গরম। তার সে গরম মাথাকে ঠান্ডা করে দিল ইভান৷ ইভানের বুদ্ধিতে মেয়ে ইয়াশফাকে মুসকান, সায়রীর সঙ্গে শপিংয়ে পাঠাতে ওঠে পড়ে লাগল সে। ইয়াশফা মোটেই রাজি ছিল না৷ কিন্তু মায়ের কান্নাকাটিতে রাজি না হয়ে উপায়ও পেল না৷ ইয়াশফার ধারণা তার মা মুসকানকে হিংসে করছে। তার বাবা এত টাকা খরচ করছে মুসকানের জন্য। সতীন এবং সতীনের ঘরের সন্তানকে বাঙালি কোনো নারীই সহ্য করতে পারে না৷ বাঙালি কেন পৃথিবীর সব নারীই বোধহয় এই একটা জায়গাতে মারাত্মক ভাবে হিংসাপরায়ণ হয়৷ মা পারভিন বেগমও এর বাইরে নয়৷ মুসকান ইয়াশফার সৎ বোন৷ এই কঠিন সত্যি মেনে নিতে তার কম কষ্ট হচ্ছে না৷ শুধু কষ্ট নয় ভেতরে ভেতরে অপমান বোধও হচ্ছে। মেয়ে হয়েই যদি তার এই অবস্থা হয় তাহলে মায়ের কী অবস্থা হতে পারে? কয়েকটা সন্তানের বাবা হওয়া খুব স্বাভাবিক। স্বাভাবিক একাধিক ভাই, বোন থাকাও। কিন্তু কয়েকজন নারী বর হওয়াকে ইয়াশফার স্বাভাবিক মনে হয় না৷ তার মায়ের সতীন ছিল মুসকানের মা৷ স্বামীর ভাগ দেয়া কোনো নারীর পক্ষেই সম্ভব না৷ যদিও ভদ্রমহিলা বেঁচে নেই। তবু তার মা পারভিন যে চরমভাবে ঠকেছে এটি চাঁদ, সূর্যের মতোই সত্যি৷ তার মাকে ঠকিয়েছে বাবা। বাবার প্রতি অভিমান আছে রাগ আছে৷ সেই অভিমান রাগের এক টুকরো কেন জানি মুসকানের প্রতিও এসে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মায়ের প্রতি তীব্র মায়া জাগে ইয়াশফার। মাকে এখন সাধারণ বাঙালি অসহায় বধূদের মতোই মনে হয়। তাই যদি না হতো বাবা কি পারত এতবড়ো কাণ্ড ঘটাতে? আজকাল মায়ের করা ভুল গুলোকেও ঠিক মনে হয়। মন বলে মা আসলে খারাপ না, দুঃশ্চিতা আর হতাশাগ্রস্ত হয়েই তার মা খারাপ আচরণ করে ফেলে সবার সাথে। তাছাড়া যে মহিলা এত বছর সংসার করে স্বামীর ভালোবাসা পায়নি৷ পেয়েছে শুধু বিশ্বাসঘাতকতা। যার মানসিক শান্তি বলে কিছু নেই৷ সে কী করে অন্যের সঙ্গে হাসিখুশি ব্যবহার করবে? কীভাবেই বা সহ্য করবে চোখের সামনে সতীনের মেয়ের সুখ? এটা বাস্তব জীবন৷ কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়। আর না তার মা বাংলা সিনেমার তথাকথিত নায়িকা চরিত্র। যে অসুখী হয়েও সুখী হওয়ার অভিনয় করবে। নিজে কষ্ট সয়ে অন্যের সুখ কামনা করবে৷ মায়ের ইচ্ছেতেই অপছন্দনীয় মুসকানের বিয়ের শপিংয়ে যেতে রাজি হয় সে। তৈরি হয়ে নেমে আসে নিচে। তাকে দেখে অবাক হয় সকলেই। সন্দেহ জাগে অনেকের মনে তবু বাড়ির বড়ো মেয়ে সে। তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয় সবাই। প্রথমে মুসকান ভীত হলেও পরবর্তীতে খুশিই হয়। এ বাড়িতে ইয়াশফার সাথে তার দারুণ শৈশব রয়েছে। একদম নিজের বোনের মতোই ভালোবাসত ইয়াশফা তাকে। আগলেও রাখত খুব। সেইসব দিনের কথা স্মরণ করেই খুশি মনে বেরোয় সে। ওরা বের হওয়ার পর পরই ইভান বেরোয়। পিছু নেয়। বাংলাদেশে তার কিছু বিদেশি ফ্রেন্ড সার্কেল এসেছে। তাদেরকে ফোন করে কয়েক মিনিট কথা বলে। তিনদিন পরই বন্ধুদের ফ্লাইট। যা ঘটানোর ঠিক তিনদিনের মধ্যেই ঘটাতে হবে। মনে মনে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে বসে ইভান। বিড়বিড় করে বলে,
‘ইভান নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে না ডার্লিং।’
চলবে..।