টিপ টিপ বৃষ্টিতে পর্ব ২৩

0
1235

#টিপ_টিপ_বৃষ্টিতে
#পর্ব_২৩
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

বিথী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বস এর দিকে।

~ এই যে হ্যালো.. আপনি ঠিক আছেন..?

বিথী চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিলো। তারপর চোখ খোলে ম্যানেজার এর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো দু’দিকে। সে ঠিক আছে।

ম্যানেজার সামনে বসা বস এর দিকে তাকিয়ে বললো,’ স্যার আমি উনাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আপনার নতুন পিএ।’

বস হাত নেড়ে বুঝালো ম্যানেজার কে চলে যেতে।

ম্যানেজার চলে যেতেই বিথী বলে উঠলো, ‘ মুরতাসীম আপনি এখানে..? ‘
মুরতাসীম অবাক হয়ে বললো,’ অন্য কেউ থাকার কথা ছিলো বুঝি..? আর আপনি আমাকে চিনেন..?

বিথী নিজেকে শান্ত রেখে বললো,’ আরে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না..? ওই যে গাড়ি,তারপর বৃষ্টির সন্ধ্যায় আপনার সাথে আমার দেখা হলো। অনেক কথা হলো!মনে পড়েছে আপনার..? এটা আপনার কোম্পানি..? ‘
মুরতাসীম চুপ করে বিথীর দিকে তাকিয়ে আছে।
বিথী এদিক ওদিকে ভালো করে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।
মুরতাসীম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বিথীর দিকে।
বিথী ওর তাকানো দেখে বললো,’ আগে যদি জানতাম এটা আপনার অফিস, আপনি আমার বস। তাহলে কি এতো ভয় পেতে হতো। এতো কষ্ট করে ইন্টারভিউ দিতে হতো।

মুরতাসীম বিথীর কথা শুনে বলে উঠলো, ‘ কেনো আমাকে কি ভয় করছে না আপনার..?’
বিথী অবাক হওয়ার মতো মুখ করে বললো,’ আপনাকে ভয় পাওয়ার কি আছে..?’
মুরতাসীম বিথীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ আপনি জানেন আমার ভয়ে অফিসের সবাই কাঁপে!!..
বিথী এবার চুপ হয়ে গেলো। সে হয়তো প্রয়োজন থেকে বেশি বলে ফেলছে।

মুরতাসীমঃ কাজ বুঝতে পেরেছেন..?
বিথীঃ হুম…
মুরতাসীমঃ তাহলে যান।
বিথী উঠতে নিলেই ফোনটা বেজে উঠে। বার কয়েক বেজে কেটে গেছে।
মুরতাসীম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বিথীর হাতে মোবাইলের দিকে।
বিথী মুরতাসীম এর দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমি কাল থেকে জয়েন করতে চাই।’
মুরতাসীম কিছু সময় চুপ থেকে বললো,’ যদি বলি আজ জয়েন করতে হবে। ‘
বিথীও পাল্টা প্রশ্ন করলো,’ যদি না করি..?’
মুরতাসীমঃ চাকরি থাকবে না আপনার।
বিথীঃ চাকরি থেকেও ইম্পর্ট্যান্ট কাজ হলো আমার এখন আমার বোনের কাছে যাওয়া।চাকরি একটা গেলে আরেকটা পাবো। বলেই মুরতাসীম এর ক্যাবিন থেকে বের হয়ে ব্যাগ নিয়ে তারাতারি বেরিয়ে পরলো ভার্সিটির উদ্দেশ্য।

**

হাত চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে আছে আকাশ।

অন্ধকার ঘরের দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করলো ঐশী।সাথে দীপ্ত, অথৈ,শান্ত, মৌ, দীপ্তি।

ঐশী একটা পানির বোতল হাতে নিয়ে আকাশের চেয়ারের ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

বাঁকা হাসি দিয়ে বোতলের ডিপ খোলে পুরো পানি ঢেলে দিলো আকাশের মুখে।

কিছু সময়ের মধ্যে পিটপিট করে চোখ খোললো আকাশ।

সামনে ঝাপসা ঝাপসা কিছু মানুষের অভয়ন দেখে ভালো করে দেখার জন্য মাথা ঝাকড়ে আবার তাকালো। হাত উপরে তুলতে নিয়ে বুঝলো হাত বাঁধা। পাগলের মতো হাত ছুটানোর জন্য টানাটানি শুরু করলো।

ঐশী বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে দেখছে আকাশের কাহিনি।

আকাশ ঐশীর দিকে তাকিয়ে আরও অবাক হয়ে রেগে বললো,’ ঐশী আমার হাত বাঁধা কেনো..? আ…আর এটা কোন জায়গা..? আমি এখানে কিভাবে আসলাম..?

ঐশী কিছু না বলে তাকিয়ে আছে আকাশের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে। কন্ঠের তেজ দেখে সবাই অবাক না হয়ে পারলো না।

ঐশী রেগে গিয়ে আকাশের গাল হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো,’ চু….প! একদম চুপ…হাত পা বেঁধে রেখেছি তাও তেজ কমে না। আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে কথা একদম বলবি না। ‘
আকাশ শয়তানী হাসি দিয়ে বলে উঠলো,’ কেনো ভয় পাও বুঝি..?
ঐশী তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, ‘ কাপুরুষধের কেউ ভয় পায় না ঘৃণা করে।’
আকাশঃ ভয় না পেলে কাপুরুষ কে বেঁধে রেখেছো কেনো..?? হাত খোলে দিয়ে সাহস থাকলে কথা বলো।
ঐশীঃ আমি এখানে আমার সাহস এর পরিচয় দিতে আসিনি।
আকাশ একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,’ তাহলে কেনো এসেছো..? রোমান্স করতে, আদর পেতে বলে হুঁ হুঁ করে হেঁসে বললো, আমি জানি তোমার স্বামী তোমাকে সুখ দিতে পারে না তাই আমাকে নিয়ে এসেছো…!

ঐশী রাগে আকাশের গালে থাপ্পড় বসিয়ে হাতে গরম রড চেপে ধরলো।

ব্যাথায় আকাশ চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছে।

ঐশী বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,’ ঠিক বলেছো, ঠিক এমন ভাবে তোমাকে এখানে আদর আপ্যায়ন করতে এনেছি।

চোখ খোলে আকাশ ঐশীর দিকে তাকালো। চোখ লাল আগুনের মতো হয়ে গেছে।

ঐশী পেছন ফিরে সব গুলোকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললো।
অথৈ কিছু বলতে চাইলে ঐশী থামিয়ে দেয়। আর বলে বেরিয়ে যা এখন।

সবাই বেরিয়ে যেতেই ঐশী আকাশের গাল শক্ত করে ধরে রেগে বলে উঠলো,’ বার বার বলে ছিলাম আমার বোনের গায়ে যদি একটু আঘাত খায় আমি ছাড়বো না। তারপর ও, তারপর ও একি ভুল করলে। আমার বোনের গায়ে হাত তুলার দিগুণ শাস্তি আজ তুমি পাবে।বলেই আকাশের ছেড়ে দিয়ে দূর গিয়ে দাঁড়ালো।
হাতে একটা প্লেট নিয়ে ছুড়ে মারলো আকাশের মুখে।
সাথে সাথে ব্যাথায় আকাশ আর্তনাদ করে উঠলো।
আকাশঃ ঐশী তুমি পাগল হয়ে গেছো।
ঐশী একটা ভেঙে যাওয়া চা’য়ের কাপ এনে উপর থেকে আকাশের পায়ে ফেললো সাথে সাথে পা কেটে রক্ত গড়িয়ে পরছে।

আকাশ ছুটার জন্য ছটফট করছে।

ঐশী আকাশের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠলো, ‘ কি কষ্ট হচ্ছে..? ঠিক এমন ভাবে আমার কলিজাটার ও কষ্ট হয়ে ছিলো তোরা কেউ কি একবারও আমার বোনের কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করেছিস..? বলেই আকাশের কাটা জায়গায় মরিচ গুঁড়ো দিয়ে চেপে ধরলো ব্যাথায়,জ্বালায় আকাশের চোখ দিয়ে টপটপ পানি পরছে।
আকাশঃ ঐশী তুমি পাগল হয়ে গেলো। ছাড়ও আমাকে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না।
ঐশী হেঁসে বলে উঠলো,’ হুম আমি পাগল হয়ে গেছি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছি। বল আমার এই পবিত্র বোনের গায়ে কলঙ্কের দাগ কেনো লাগিয়ে ছিস..? কেনো আজ সত্যি ভালোবেসে, বিশ্বাস করে আমার বোনের জীবন এমন..? কেনো করলি এমন নিখুঁত অভিনয়..? কেনো এভাবে ভেঙে, চুরে, চুরমার করে দিলি আমার বোনের মন টা..? কেনো ঠকালি আমার বোন কে..?কেনো! কেনো..??বলেই লাথি দিয়ে চেয়ার শুদ্ধ আকাশকে ফেলে দিলো।

আকাশের চেয়ার ঠিক করে ঐশী ওর সামনে বসলো।
ঐশীঃ আমি সত্যি টা জানতে চাই আজ। কেনো আমার বোনের সাথে এমন করে আমাকে বিয়ে করতে এসেছিস..? কার প্লেন এইগুলো..? কে দূর থেকে এমনটা করছে..?

আকাশের ঠোঁট কেটে রক্ত পরছে। প্লেট বারি খেয়ে কপাল কালচে হয়ে গেছে। পা থেকে রক্ত পরছে সাথে মরিচ গুঁড়োর পুড়ানিতে ওর শরীর দূর্বল হয়ে গেছে। সকাল থেকে না খেয়ে আছে।

ঐশী উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।

এতো কিছুর পরেও আকাশ নির্লজ্জের মতো ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ তোমার কি মনে হয় আমাকে অন্য কেউ বলবে, টাকা দিবে আর আমি কাজ করবো..? আমি কারো হুকুমে চলি না, আমার হুকুমে মানুষ চলে। তোমার যেহেতু এতই কারন জানার ইচ্ছে তাহলে চলো চলে যাই আজ থেকে ৩০বছর আগের এক ছলনাময়ী পুরুষের কাছে ।

ঐশীঃ মানে..?
আকাশ ফিসফিস করে বললো, ‘ রহস্যের সমাধান… ‘

অতীত********

বর্নফুল গ্রামে থাকতো একজন কৃষক উনার ছিলো দুই মেয়ে।

বড় মেয়ে সর্না আর ছোটো মেয়ে সুনালী।

খুব ভালোই কাটছিলো ওদের জীবন হঠাৎ একটা ঝড়ে থমকে গেলো ওদের জীবন।

পাশের গ্রামে জমিদার বাড়িতে বেড়াতে এসে ছিলো এক যুবক।সম্পর্কে যুবকের নানার বাড়ি হলো জমিদার বাড়ি। যুবকটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিলো।যে কোনো মেয়েই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়তে বাধ্য।

বড় বোন সর্না একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় ওই যুবকের সাথে দেখা হয়ে যায়। প্রথম দেখায় সেই সুদর্শন যুবক এর প্রেমে পড়ে যায় সর্না৷ এভাবে প্রতি দিন স্কুল যাওয়ার সময় দেখা হতো ওদের সাথে থাকতো ছোটো বোন সুনালী।

এভাবে কেটে যায় কয়েক মাস। এই কয়েক মাসে ওদের মধ্যে অন্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। আসতে আসতে সম্পর্ক অনেক গভীরে চলে যায়।

সর্না কয়েক দিন ধরে নিজের মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করে।

অসুস্থ হয়ে পড়ে সর্না, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন শুনতে পারে কুমারী সর্না অন্তঃসত্তা। সাথে সাথে ওর জীবনে নেমে আসে কঠিন মুহূর্ত।

সর্নার মা বাবা গরিব ছিলো। যখন অবিবাহিত মেয়ের মা হওয়ার কথা শুনলো সর্নার বাবা অসুস্থ হয়ে গেলো। সর্নার মা সর্না কে ঘর বন্ধ করে অনেক মারলো সুনালী বোনকে আগলে রাখতে পারলো না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলো বড় বোনের দিকে।

রাতে সর্নার মুখ থেকে সব শুনে পরের দিন সর্নার বাবা গেলো ওই যুবকের কাছে। গিয়ে ওর নানাজি কে পেলো। সব খুলে বললো ওর নানা কে। তারপর বাড়িতে ফিরে এসে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলো সর্নার বাবা।

কিছু সময়ের মধ্যে পুরো দুই গ্রাম জানাজানি হয়ে গেলো সর্নার প্রেগন্যান্ট হওয়ার কথা। কে জানালো….? এই কথা তো যুবকটির নানাজি ছাড়া আর কেউ জানতো না!!
লোকজন ছিঃ ছিঃ করা শুরু করলো। সারা গ্রামে লুটিয়ে পড়লো সর্নার বদনাম। বাবার শুখে পাথর হয়ে সর্না ছুটে চললো সেই বাড়ির দিকে।

ওখানে গিয়ে শুনলো সেই ছেলে শহরে নিজের বাড়ি চলে গেছে। দুই দিন পর উনার বিয়ে।

সর্না পাগলের মতো বলতে শুরু করে ছিলো ওর আর সেই যুবকের সম্পর্কের কথা।

ওর এইসব কথা শুনে রেগে জমিদার বাড়ির লোকজন ওকে মেরে রাস্তায় ফেলে গিয়ে ছিলো।

ওর কথা গ্রামের কেউ বিশ্বাস করেনি। ঘর থেকে বের হতে পারেনি ওরা কেউ। আর যাই হোক জমিদারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে যাবে না।

দুই দিন পর সর্না গলায় রশি দিয়ে গাছের ডালে ঝুলে গেলো।

সুনালী সে দিন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো নিজের প্রান প্রিয় বোনের লাশের দিকে। কিছু করতে পারেনি সে। তার বোনকে বাঁচাতে পারেনি। সঠিক সম্মান দিতে পারেনি। কিন্তু বেঁচে থাকলে এর প্রতিশোধ নিবে কথা দিয়ে ছিলো। গ্রামের লোকজন সুনালী আর ওর মাকে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে বলে।

সুনালী কে ওর মা দূরসম্পর্কের উনার এক বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

সুনালী ওখানে যাওয়ার কয়েকদিন পর শুনতে পায় ওর মা মারা গেছে। মা’কে শেষ বারের মতো দেখতেও পায়নি সুনালী।

ওর নতুন জীবন শুরু হয় এখান থেকে।
সুনালী যার বাসায় এসে ছিলো উনার কোনো মেয়ে ছিলো না৷ ওকে মেয়ের মতো ভালোবাসতে শুরু করলো। সুনালী পেলো এক সুন্দর জীবন।
কিন্তু সে তার বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই কাপুরুষকে দিনের পর দিন খুঁজে বেরিয়েছে।

একদিন শপিং মলে পেয়েও গেলো সেই পুরুষ কে। নিজের মেয়েকে নিয়ে এসে ছিলো শপিং করতে।

সে দিন সুনালী তাদের পিছু নেয়। তারপর তাদের সম্পর্কে সব কিছু জেনে নিজের ছেলেকে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। কিন্তু সবটা এখনো শেষ হয়নি…

বর্তমান ****

আকাশ গল্পটা বলে ঐশীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ কেমন লাগলো গল্পটা..?’
ঐশী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। সে ভালো করেই বুঝে গেছে এই মানুষগুলো কে..?

ঐশী কিছু বলার আগেই দরজা থেকে বিথী বলে উঠলো, ‘ বাহ্ খুব সুন্দর গল্প ….

চলবে…

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here