আড়ালে অন্তরালে শেষ পর্ব

0
1061

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

সমাপনী অংশ

বৃষ্টি আজ উন্মত্তের মত ঝরছে। টুপটাপ শব্দ তুলে যেন নুপুরের ঝংকার দিচ্ছে। বৃষ্টি হলে চারদিক শুনশান নীরব হয়ে কেমন একটা ভুতুড়ে আবহ তৈরী করে দেয়। আচমকা বৃষ্টিতে তানভীর মন ভার করে গাড়িতেই বসে আছে। তানভীরের ভাবভঙ্গি দেখে মায়া বলল – আমরা গাড়িতে বসে থাকার জন্য এসেছি, তাইনা?
সূক্ষ্ম খোঁচাটা আঁচ করে তানভীর বলল – বৃষ্টিরমধ্যে কোথাও বসাও যাবেনা, ধ্যাৎ। তারচেয়ে বরং বাসায় জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যেত। চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক আর সবাই মিলে গল্প করার মজাই আলাদা, তাইনা বলো।

মায়ার মনে পড়ে গেল এমনটা সে ভাবতে পারেনা। তার বেড়ে ওঠার পরিবেশটা বিষাক্ত ছিল। মায়ের শূন্যস্হানটার পরিপূরক কিছুই হয়না। প্রতিনিয়ত সে বুঝতে পেরেছিল মায়ের না থাকাটা তাকে তার জন্মদাতার কাছ থেকেও দূরে করে দিয়েছিল। অত্যাচারে ঝর্ঝরিত হয়ে যখন নিজেকে হারাতে বসেছিল তখন দেবদূত হয়ে এসেছিল রায়হান। রাস্তার মোড়ে থাকা বখাটেদের বিরুদ্ধে যখন তেজস্বী রূপ ধারণ করে তখনই রায়হানের চোখে পড়ে মায়াবতী মেয়েটার যশস্বী রূপ। তর্জনী তুলে যখন বখাটেদের বলেছিল – হেই, মেয়ে বলে দূর্বল ভাবিস না। আমাকে অশ্লীল কথা বললে জিভ টেনে ছিড়ে নিব।
সেই মুহূর্তে মুগ্ধ হয়ে নিজের দলে কাজ করার প্রস্তাবটা দেয় রায়হান। নিজের হাতে গড়ে তুলেছিল মেয়েটাকে। বিষাক্ত ঐ পরিবেশটায় থেকেও দিনশেষে শান্তি মিলত নিজের কর্মক্ষেত্রে। শান্তি মিলত বড় ভাইরূপী ঐ রায়হানের কাছে। কখনো মায়া তো কখনো নিরুপমা, এই রূপের পেছনে একমাত্র অবদান রায়হানের।
চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসা অশ্রুফোঁটা বেহায়া হয়ে কখন যে কোলে এসে টুপ করে পড়েছে তা টেরই পায়নি মায়া। স্ত্রীর হঠাৎ উদাস হয়ে যাওয়ায় ভড়কে গিয়ে তানভীর বলে – এই কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? গাড়িতে বসে থাকায় রাগ হচ্ছে বুঝি?
মায়ার সম্বিত ফিরল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল – আপনি আমাকে কোন পরিস্থিতি থেকে এনেছেন তা জেনেও কেন আমার দগ্ধ ক্ষতস্থানে আঘাত করেন? দিনশেষে আমিও মানুষ। আমারো অনুভূতি আছে।
আপনি আমার জীবনে ফাহিম হয়ে এসেছিলেন। আপনি আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। নিজ হাতে আবার সে স্বপ্ন ধূলিচাপা দিবেন না।
তানভীর ঈষৎ হেসে জবাব দিল – নতুন করে উড়তে শিখিয়েছি যখন ডানা ঝাপটে উঁচুতে উঠবে। কেন ওসব মনে রেখে তুমি কষ্ট পাবে? তোমাকে শক্ত হতে হবে মায়া। চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করার ভাষা শিখতে হবে। তুমি আমার বউ, আমার সম্মান। তোমাকে দূর্বল চিত্তে মানায় না। আমার কাছে লক্ষ্মী বউ হয়ে থেক কিন্তু তোমার চোখে থাকবে আগুনের ঝলকানি। অন্যায়কে ভস্ম করে দিবে সেই ঝলকানি।
পরিস্হিতির মন্দা ভাব উপলব্ধি করে আবার গাড়ি ঘুরালো তানভীর। বৃষ্টির জন্য আজ একান্তে সময় কাটানো বানচাল হলো।

_____

চরম পর্যায়ের বিস্ময় নিয়ে আয়েশা নির্বাক হয়ে বসে আছে।
রায়হান তখন নিজের দু হাতের তালুতে আদুরে ঐ মুখখানা আগলে নিয়ে বলে – তুমি কখনোই আমাকে ওসব খেতে দেখোনি। আমি রাত জেগে কাজ করতাম, ফারহান বুঁদ হয়ে থাকত নেশায়। অ্যালকোহলের তিকুটে গন্ধটা ফারহানের রুম থেকে আসত৷ আয়েশা আমি ওসব ছুঁইনি আজ অবধি। বুকের বাঁ পাশে হাতটা রেখে দেখোনা আমার প্রতিটি স্পন্দন তোমার কাছে নিজেকে মেলে দিচ্ছে। আয়েশা, তুমি উত্তর দিবে না? তুমিই দেখো না ঘরে তুমি আর আমি আছি শুধু। তবুও তুমি ভয় পাচ্ছোনা। কারণ তুমি জানো আমি কোন অঘটন ঘটাবো না। আয়েশা, কাপুরুষরা নারীদেহকে ভালবাসে, মনে ভালবাসেনা। তারা জানেই না নারীদের ভালবাসলে নারীরা মন, দেহ কেন নিজের জীবনটাও দিয়ে দেয়।
এই রায়হানকে চিনে না আয়েশা। দৃষ্টি অবনমিত রেখে আগের রায়হানের সাথে এই রায়হানকে মিলাতে ব্যস্ত সে।
আয়েশার নিরুত্তাপ ভঙ্গিমা রায়হানকে ভেঙে দিয়েছে। আয়েশার গাল থেকে হাত নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। আয়েশা চোখ না তুললেও রায়হানের গতিবিধি দেখছে সে। হাল ছেড়ে ছেলেটা যখন সদর দরজার দিকে ছুটে যায় তখনই তার সামনে গিয়ে পথ আটকায় আয়েশা। ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে – বাহিরে বাঁজ পড়ছে। জুম বৃষ্টিতে কোথায় যাচ্ছেন?
রায়হান মৃদু হেসে বলল – আমাকে আজ আটকানোর কোন অধিকার তোমার নেই যে। না আমি তোমার একান্ত আপনজন, না আমি তোমার বর। আমাকে আটকানোর সেই অধিকার তোমার নেই, আমারও নেই।
আয়েশা সরলো না। বাচ্চাদের মত জেদ ধরে বল – ভেতরে গিয়ে বসুন। এত কথা কেন বলছেন?
রায়হান আয়েশার রুমের দিকে ইশারা করে বলল – যেদিন বিনা বাঁধায় ঐ কক্ষে যাওয়ার অধিকার থাকবে আমার, সেদিন এভাবে আটকিও।
আয়েশা না সরে বলল – আমি সরছি না, যেতে পারলে যান।
রায়হানের খুব ইচ্ছে করল মেয়েটাকে বুকে টেনে কপালে চুমু এঁকে দিতে কিন্তু নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে বলল – একটা ছাতা দাও।
আয়েশা ছাতাটা এনে দিতেই রায়হান বেরিয়ে গেল বৃষ্টি মাথায় করে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে সেদিন তানভীর বলেছিল – মনের কথা মনে লুকিয়ে রাখলে হারানোর ভয় থাকে। সময় থাকতে মনের কথা বলে দেয়াই ভালো।
আজ নিজেকে হালকা লাগছে। সে তো চেষ্টা করেছে, আক্ষেপ থাকবে না।
রায়হান যদি ঘুরে একবার তাকাতো তাহলে দেখত তাকে আটকানোর জন্য মেয়েটা এই অসময়ে বৃষ্টিতে নেমে এসেছে। বৃষ্টির বর্ণহীন তরলের সাথে মেয়েটার নোনা অশ্রুজল মিশে গেছে।

____

মাহতাব খান নিজের কাজ সেরে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন দেখলেন মেয়েটা মনমরা হয়ে বসে আছে। বৃষ্টি থামার পরই তিনি ফিরেছেন। তানভীর অবশ্য বৃষ্টির মধ্যেই ফিরে এসেছে। বাবাকে দেখে মুখ গোমড়া করে বলল – অসময়ের বৃষ্টিটা আমার ডেটিংয়ে বাঁধা দিয়েছে। বউর মান ভাঙাতে তো পারলাম না উল্টো আরো রেগে বোম হয়ে গেছে।
সন্তানের মুখে অমন কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লেন মাহতাব। আজ তাঁর মনটা বেজায় খুশি। তার উপর ছেলের অমন আচানক কথায় মন খুলে তিনি হাসছেন। বাবার মুখে অমন হাসি দেখে তানভীরও হেসে বলল – এই যে জনাব মাহতাব খান, একটু টিপস দেন বউর মান ভাঙানো জরুরী।
মাহতাব খান তখন গলা ছেড়ে ডাক দিলেন – বৌ মা, এদিকে এসো। কথা আছে।
গলার আওয়াজটা অনেকটা জোরে ছিল। মায়া স্পষ্ট শুনতে পেয়ে গুটিগুটি পায়ে নেমে এসে শ্বশুরের সামনে দাঁড়াল।
মাহতাব খান তাকে বসতে বললেন। রায়হানকে অবশ্য ফোনকল দিয়ে ডেকে নিলেন। হাসতে হাসতে তিনি বললেন – জরুরী আলাপ আছে। রায়হান আসুক, তখন বলব।
আয়েশার পাশে বসল মায়া। তানভীর মুখ গোমড়া করে বলল – বাবা, তোমার মেয়েকে বলে দাও আমার বউয়ের থেকে যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে, আমার বউয়ের পাশে আমি বসব।

তানভীরের কথায় মায়া চোখ বড়বড় করে তাকাল। আয়েশা ঠোঁট টিপে হেসে দিল। মাহতাব খান ছেলের দিকে এক নজর তাকিয়ে মায়াকে বললেন – বউমা তুমি ওখানেই বসো, আয়েশাও নিজের জায়গায় থাকবে।
তানভীর মুখ বাঁকা করার চেষ্টা করে পারল না। তখন বাবার দিকে তাকিয়ে বলল – মুখটাকে ৯০ডিগ্রি বাঁকা করে বলছি, তুমি আমার বড় শত্রু।
তাদের মিষ্টি খুনসুটি চলাকালীন রায়হান আসলো। তানভীরের পাশে বসে মৃদু হেসে বলল – চাচু, কেন ডেকেছো, এত জরুরী তলব?
আয়েশা খেয়াল করল রায়হানের মুখে বিষাদের ছায়া। মাহতাব খান হেসে বললেন – জরুরী কাজই। অনেকতো চেষ্টা করলাম আয়েশার বিয়ে দিতে। কিন্তু কার কুনজর পড়েছে যে ঠিক হওয়া বিয়েগুলোও ভেঙে যায়। কত কত কটু কথা শোনে মেয়েটা। বিয়ের বয়সটাও পার হয়ে যাচ্ছে। বহু চেষ্টার পর আজ একটা মনমতো ছেলে পেয়েছি। কাল দেখতে আসবে আমার মেয়েটাকে। কালই আকদ করে নিব। অনেকদিন ছেলেটার খোঁজ খবর নিয়ে আমি এগিয়েছি। মেয়েটার একটা গতি না করে আমি মরেও শান্তি পাবনা।

কথাগুলো শুনে রায়হানের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো যেন। মাথা নিচু করে সবটা শুনে বিমর্ষ হয়ে গেছে। তানভীর একনজর রায়হানের দিকে তাকাল।
বাবার মুখে কথাগুলো শুনে আয়েশা নিজের ওড়নার কোণটা খামচে ধরল।
রায়হান নিজেকে সামলে নিল মুহূর্তে। কন্ঠের আড়ষ্টতা দূর করে বলল – আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই হবে। জমিয়ে মজা করা যাবে। তানভীরও ফিরেছে। অবশেষে আয়েশা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।
জোর করে মুখে হাসি টেনে কথাগুলো বললেও চোখের কোণে চিকচিক করে খেলা করছে অশ্রু ফোঁটা।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আয়েশা বলল – আমি এ বিয়ে করছি না বাবা। অযথা আমাকে আর সঙ সাজিও না। আর কোন মানুষের সামনে সঙ সেজে আমি বসব না। এটাই আমার শেষ কথা।
মেয়ের মুখে অমন কথা শুনে মাহতাব খান চমকে উঠলেন। নিজের শান্তরূপটা ত্যাগ করে তিনি বললেন – আমি কথা দিয়ে এসেছি। কালই আকদ হবে।
আয়েশা চেঁচিয়ে উঠে বলল – আর একটা মানুষ যদি আমায় দেখতে আসে না বাবা, আমি নিজেকে শেষ করে দিব। তবুও নিজেকে আর পণ্য বানাতে পারব না। রংচং মেখে কোন পুরুষের সামনে আমি যাব না। তুমি আমার বাবা, তোমার রাগটা আমার রক্তেও বইছে।
কথাগুলো বলেই দৌড়ে চলে গেল আয়েশা। মাহতাব খান অবাক হয়ে দেখলেন মেয়ের অদ্ভুত আচরণ। তানভীর নিজের বোনের এ রূপ দেখে যারপরনাই অবাক। রায়হান নিজের উত্তর পেয়ে মাহতাব খানকে বলল – আমি আসি চাচু।
উৎসবমুখর পরিবেশটা হঠাৎই যেন বিষাদে পরিণত হয়েছে।
আয়েশা নিজরুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বেশ কিছুক্ষণ কান্না করলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিল যা করার এখনই করতে হবে।

_______

রাতে আবারও বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো উন্মত্ত হয়ে আছড়ে পড়ছে যেন। গাছের পাতায়, মাটিতে বৃষ্টি ফোঁটাগুলো যেন সংগীতের রাগ। বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখছে মায়া। সব মেয়েদেরই বৃষ্টির প্রতি সহজাত আবেগ কাজ করে। মায়াও ব্যতিক্রম নয়। বৃষ্টির ছাঁট এসে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা সেও করছে।
বৃষ্টি বিলাশে মায়া এতটাই মগ্ন ছিল যে সে বুঝতেই পারেনি কখন তানভীর তার পিছনে এসে দাঁড়ালো। তার সম্বিত ফিরে তানভীরের কোমল স্পর্শে। মায়ার পিছন থেকে দুহাত সামনে এনে জড়িয়ে ধরে। ওটুকু স্পর্শে কেঁপে ওঠে মায়া। নিজের পেটের উপর তানভীরের জড়িয়ে থাকা হাতে হাত রাখতে গিয়ে লজ্জায় সরিয়ে নিল। ঘাড়ের উপর রাখা তানভীরের থুতনিটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করল তার। জড়তা কাটিয়ে ওটুকু কাজ সে করতে পারেনি। চোখজোড়া বন্ধ করে মুহূর্তটা উপভোগ করছে বেশ। খুব করে চাইছে সময়টা এখানেই থমকে থাকুক। হঠাৎ শুনতে পেল মায়াবী কন্ঠের মধুর সুরটা।

“তোর চোখের ঝিল-
জানি
পেরোনো মুশকিল
এগিয়ে গিয়েছে-
আমার দু’টো পা_
তোকে একার দেখার লুকিয়ে
কি মজা!
সে-তো আমি ছাড়া
কেউ জানে না।
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা
নয়রে সোজা-
সে তো আমি ছাড়া
কেউ জানে না।
অতটুকু গেয়েই থেমে গেল তানভীর। মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল – ভালবাসি মায়া, খুব ভালবাসি। কতটা ভালবাসি জানিনা তবে যতটা ভালবাসলে তোমাকে ছাড়া নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয়, ঠিক ততটুকু ভালবাসি।
মায়ার চোখে তখন যেন নেশা ভর করেছে। তানভীরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যে ঘোরে সে হারিয়েছিল তা বুঝতে পেরে তানভীর বলল – ওভাবে তাকিয়ে থেকো না। পরে নিজেকে সামলাতে পারব না। তোমাকে একান্তে পাওয়ার সে সময়টুকু এখনো আসেনি। কয়েকদিন বাদে মাস দুয়েকের জন্য ব্যবসার কাজে দেশের বাহিরে যাব। তখন না পাওয়া কিছু নিয়ে ছটপট করতে চাইনা।
মায়া তখনো অপলক তাকিয়ে আছে। তাকে কাছে টেনে কপালে চুমু দিয়ে তানভীর বলল – ঠোঁটের চুমুতে জীবাণু আছে বউ, কপালে চুমু দেয়াটা বেশি পবিত্র লাগে।
নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে মায়াই হামলে পড়ল তানভীরের বুকে। জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বলল – আমি আপনাকে অনেকটা সম্মান করি। ঠিক ততটা সম্মান করি যতটা সম্মান করলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়।

রসিকতা তানভীরের সবসময়ের অভ্যাস। সিরিয়াস সময়েও রসিকতা ছাড়ে না সে। সেই ভূত তখনো মাথায় চাপল। চট করে সে বলল – আমাকে জড়িয়ে ধরার সময়টুকু ওভার হলে এবার ঘুমোতে চলুন। দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে ঝিমঝিম করছে। ভাই মানুষ কিভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে প্রেম করে? আমারতো এখনই শখ মিটে গেছে।
অমন মুহূর্তে এমন বেফাঁস কথায় মায়া তাকে ছেড়ে দিয়ে চোয়াল ঝুলিয়ে বলল – আপনি ছেলে না মেয়ে? আমারতো সন্দেহ হচ্ছে।
তানভীর হাসতে হাসতে বলল – সময় হলে বুঝবা বউ। এবার ঘুমাবো। ওয়েদারটা ঘুমের। এক মিনিটও নষ্ট করতে চাইনা।
মায়া তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল – ঘুমোতে যান আপনি, আমি এখানে থাকব। গিয়ে ঘুম বিলাস করুন।
তানভীর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল – কোলবালিশ লাগবে।
কথাটা বলেই মায়াকে টেনে নিয়ে বারান্দার দরজা আটকে দিল। ইশারা করে বলল ঘুমাতে। নিজেও শুয়ে পড়ল।
মায়া মনে মনে ভাবছে – কি নিরামিষ লোকের পাল্লায় পড়েছি। বৃষ্টি বিলাস বাদ দিয়ে ঘুম বিলাস করছে।

_____

সকাল সকাল ফোন হাতে নিয়ে থ হয়ে বসে আছেন মাহতাব খান। যেই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন বলে সকল আয়োজন করতে চেয়েছিলেন, সেই ছেলে নাকি হাসপাতালে। রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে পা ভেঙে গেছে।
খবরটা শুনে মাহতাব খান আয়েশার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেন না। শেষে কিনা মদ্যপ ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। আয়েশাও বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল – বোঝা কমাতে চেয়েছিলে আব্বু।
তানভীর বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিশ্চুপ আছে।
আয়েশা তার চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোনদের কটাক্ষ শুনে নীরবে কাঁদছে।
ছোট চাচী তো বলেই দিয়েছেন – ঘরেই বুড়ি হতে হবে। কোন বউ মরা লোকের গলায় ঝুলিয়ে না দিলে এমন বুড়ো মেয়ে কে ঘরে নিবে?
চাচাতো বোনরাও হেসে হেসে বলল – আমরা তোমার ছোট হয়েও বাচ্চার মা হয়ে গেলাম আর তোমার বরই জুটলো না, বাচ্চাতো দূরের কথা।
বড়চাচা বললেন – অমন মায়ের অমন মেয়ে কে নিবে? রূপ দিয়ে কি হবে? চরিত্র মায়ের মতই হবে। এ ভয়ে মানুষ তাকে ঘরে তুলবে?
মায়ার মেজাজ তরতর করে বেড়ে গেছে। তখনই রায়হান এগিয়ে এসে বলল – আপনাদের এত চিন্তা ওকে নিয়ে। ও মাই গড! এজন্য সবাইকে একটু মিষ্টি মুখ করাও চাচু।
সবাই চুপ হয়ে গেল। মুহূর্তেই পরিবেশটা থমকে গেছে। রায়হান তখন মাহতাব খানকে বললেন – আপনার মত থাকলে এবং আয়েশার মত থাকলে এখন এই মুহূর্তে ওকে বিয়ে করে এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের সকল পরিশ্রম পন্ড করতে চাই।
মনে মনে রায়হান বলল – বিয়েগুলো ঠেকাতে আমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে, আজ আর ওকে রেখে যাব না। তাহলে পরে আবারও পরিশ্রম করতে হবে।

মাহতাব খান চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বললেন – তবে তাই হোক।

____

বহু অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রায়হানের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আয়েশাকে বুকে জড়িয়ে চোখের অবাধ্য জলগুলো হাত দিয়ে মুছে বলল – অনেক কষ্টে তোমাকে জয় করেছি। রাজকন্যার জন্য যেমন রাজপুত্ররা লড়াই করত ঠিক তেমন করে যুদ্ধ করেছি।
আমি পেরেছি, আমি জিতেছি। এত বছরের ভালবাসাকে নিজের করতে পেরেছি। আজ থেকে অসভ্য, বর্বর, অশ্লীল লোকটার কাছেই তোমার থাকতে হবে।
ফোনের মেসেজ টিউন শুনে ফোনটা হাতে নিতেই ছোট্ট একটা বার্তা। তাতে লেখা – অনেক শুভকামনা স্যার। আপনার সকল অপপরিশ্রম সফলতার মুখ দেখেছে। শত সন্তানের জনক হোন আপনি।
ঈষৎ হেসে ফোনটা রাখতেই দ্বিতীয় বার্তাটা এলো।
তানভীর পাঠিয়েছে – শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেই ছাড়লি ভাই। কত বিয়ে ভাঙলি আমার বোনের। আগে বললেি পারতিস। বেহুদা নিজে কষ্ট পেলি। শুভকামনা ভাই। দোয়া করিস আমি আর তুই যেন ক্রিকেট টিম বানাতে পারি।

মেসেজগুলো পেয়ে রায়হান হেসে দিল। আয়েশাকে টেনে এনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল – ভালবাসি আয়েশা, অনেক ভালবাসি। বার বছরের জমানো ভালবাসা, একটুও ফিকে হয়নি।
আয়েশা এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল – কখনো এই দিনটা আসবে ভাবিনি। আপনার ভালবাসার মান আমি রাখব।

____

ও.টি থেকে ছোট্ট আদরটাকে এনে রায়হানের কোলে দিল নার্স। তানভীর পাশে দাঁড়িয়ে ছুঁয়ে দিল ছোট্ট হাত পা গুলো। মাহতাব খান খুশিতে ছুটোছুটি লাগিয়েছেন। মায়া দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সবার খুশি। রায়হান এগিয়ে গিয়ে পিটপিট করে তাকানো নিজের ছেলেটাকে মায়ার কোলে দিয়ে বলল – তুমি তো আমার ছোটবোন। তুমি আমার বাবাটাকে দেখবে না ছুঁয়ে।
মায়ার চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ছোট্ট হাত পাগুলো ছুঁয়ে দিল সে। তানভীর এসে তাকে আগলে নিয়ে বলল – আল্লাহ চাইলে আমাদেরও এমন একটা প্রিন্স আসবে।
মাহতাব খান নিজের নাতীকে কোলে নিতে আকুলি বিকুলি করছেন। তানভীরও ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে নিজের বাবার কোলে তুলে দিলেন। খুশির জোয়ারে ভাসছে সবাই।
একটু দূরে দাঁড়ানো মায়ার কাছে এসে তানভীর বলল – মন খারাপ করছ কেন? ডাক্তারতো বলেই দিয়েছে তুমি সুস্থ হলেই আমরাও আমাদের ছোট্ট প্রাণকে ছুঁয়ে দিতে পারব। ধৈর্য্য ধরো।
মায়া চোখ মুছে মাথা উপরে নিচে ঝাঁকিয়ে বলল – হুম, পারব তো। ঠিক পারব।

হঠাৎই নিরুপমার কাছে খবর এলো জামশেদ রহমানকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার সংবাদ শুনে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে তার ছেলে জিসান রহমান।
রায়হানে খবরটা দিতেই নিরুপমাকে সে বলল প্রস্তুতি নিতে।
তানভীরকে দেখে এগিয়ে গেল মায়া। ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে তানভীর বলল – আমার মেয়ে হলে তোকে জামাই বানাব ব্যাটা।
হেসে দিল সবাই।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here