আড়ালে অন্তরালে পর্ব ৯

0
438

#আড়ালে_অন্তরালে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ৯

মধ্যরাতে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেল মায়ার। গলাটা শুকিয়ে যেন চৈত্রের চির ধরে যাওয়া ফসলের মাঠের মত হয়ে গেছে। হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নামতে লাগলো সে। অন্ধকারে কারো মৃদু চিৎকার শুনে চমকে উঠলো মায়া। ঘুম ঘুম চোখে হঠাৎ আলোর তীব্র ঝলকানি। চোখজোড়া জ্ব লে উঠলো। চোখ কচলে তাকাতেই দেখলো ফাহিমও ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
মায়া চোখ কচলাতে কচলাতে বলল – আপনি কে? আমার রুমে কি করছেন?
তৎক্ষনাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিমায় মায়া জিভে কামড় বসিয়ে বলল – সরি, আমি ভুলে গেছি। আমার ভুল হয়ে গেছে। মনেই ছিলোনা যে আমি এখন আপনার বাসায়।
একেতো হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া, তারপর মায়ার আজগুবি কথাবার্তা শুনে ফাহিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল – অন্ধকারে কি খনি থেকে হীরে আহরণে গিয়েছিলে? পেটের উপর এমন চাপ দিয়েছিলে যে আমি কেউকেউ করে উঠলাম। আর একটু চাপ পড়লে কাজ হয়ে যেত।
ফাহিমের কথা শুনে মায়া বুঝতে পারলো অন্ধকারে ফাহিমের পেটের উপর চাপ পড়তেই সে চিৎকার করে উঠেছে। ফাহিমের শেষোক্ত কথাটা শুনে মায়া ফিক করে হেসে মনে মনে বলল – পেটের উপর চাপ আরেকটু পড়লে কি উনি টয়লেটের কাজ বিছানায় সারতেন?
কথাটা নিজমনে বললেও তার রেশ ধরে সে হিহি শব্দ করে হেসে উঠলো। ফাহিম অবাক হয়ে দেখছে মায়ার কাজকর্ম।
হাসি থামিয়ে মায়া বলল – একটু পানি খাব। পানি খাওয়ার জন্য এমন তড়িঘড়ি করে উঠছিলাম।
ফাহিম রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। খানিকক্ষণ বাদে এক বোতল পানি এনে মায়ার পানে এগিয়ে দিয়ে বলল – শরীর কেমন এখন?
দু ঢোক পানি খেয়ে বোতলের ছিপিটা আটকাতে আটকাতে মায়া বলল – ব্যাথা কম আছে এখন।
ফাহিম মলিন হেসে বলল – সত্যি তো!
মায়া উপরে নিচে মাথা ঝাকিয়ে বলল হুম।
আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়তেই ফাহিম বলল – আমার এদিকে সরে এসো, মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
মায়া নিজের জায়গা থেকে নড়লো না মোটেই। গুটিয়ে আছে খুব। এতক্ষণ হাসলেও হঠাৎ মনে হলো সে এখন অন্যের ঘরে। চেনা ঘর, চেনা বিছানা ছেড়ে অপরিচিত কেউ একজনের পাশে সে শুয়ে আছে। ছোট মায়ের বেদম প্রহারে সে যখন অচেতন হয়ে পড়ে থাকতো, কেউ তাকে একটু সেবা করত না কিন্তু মিরাজ থাকলে খুব করে প্রতিবাদ করত। ছোট্ট ভাইটাকে খুব মিস করছে সে।
মায়ার আবার মনে পড়ল পাশে থাকা লোকটা যদি এখন আর দশটা পুরুষের মতন নিজের অধিকার চেয়ে বসে! সে যদি বুঝতে না পারে ভঙ্গুর মায়ার অবস্থা!
ফাহিমের মায়া জড়ানো কন্ঠ শুনে চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে মায়া। ফাহিম তখন মৃদুস্বরে বলল – কি অত ভাবছো গো! বাসার কথা মনে হচ্ছে? নাকি অন্য কিছু ভাবছ?
মায়ার নিরুত্তরতা ফাহিমকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল। সে শান্ত স্বরে বলল – মায়া! তুমি আমার সহধর্মিণী। তোমাকে একদিনের জন্য বিয়ে করিনি। একজীবনের জন্য বিয়ে করেছি। বিয়েটার জন্য শারীরিক বা মানসিক প্রস্তুতি না তোমার ছিল, না আমার ছিল! তুমি যেসব ভাবছ তেমনটা আমি নই মায়া।
ফাহিম খানিক বিরতি নিয়ে আবার শুরু করল – বিয়েটা পবিত্র বন্ধন মায়া। তুমি কি এটা অস্বীকার করতে পারবে যে আমাদের কবুল বলার পর থেকে আমার জন্য তোমার একটা টান আসেনি? আমি কেমন যেন একটা টান অনুভব করছি। তোমাকে ভালো রাখতে চাই মায়া। ভালবাসতে চাই।
ফাহিমের কথাগুলো এতক্ষণ মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনছিল মায়া। বুকের ভিতর চাপা পড়া দীর্ঘশ্বাসটা ফেলে সে বলল – অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ুন। ফাহিম মৃদু হাসলো কিন্তু তা আলোর অভাবে মিলিয়ে গেছে।

____

রাত প্রায় শেষ হতে চলল। ইমতিয়াজের মুঠোফোনের কম্পনটা মৃদু থেকে মৃদুতর হতেই সে স্ক্রিনটা আনলক করে দেখলো মুরাদের ক্ষুদেবার্তা।
– কেমন আছেন ইমতু? আপনার ঐ ছোট্ট বাবাটা কেমন আছে? সে কি এখনো তার বাবা মাকে জাগিয়ে রেখেছে?
মেসেজটা পড়ে হাসলো ইমতিয়াজ। সোফা থেকে মাথাটা হালকা উঁচু করে দেখলো তার অর্ধাঙ্গিনী আর তার ছোট্ট প্রা ণ টা কি সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে। হাসপাতালের তিনশ পাঁচ নম্বর কেবিনের এই রুমটায় নাকি মুরাদ এসেছিল কাল ইমতিয়াজের ছোট্ট বাবাটাকে দেখতে। মুরাদের মেসেজ পেয়ে আবার হাসলো ইমতিয়াজ। মনে মনে ভাবছে কখন এলো!
আরেকটা মেসেজ আসতেই চোখ ছানাবড়া ইমতিয়াজের। সে পাল্টা প্রশ্ন করল – কিহ্, আপনার সঙ্গে আমি কথাও বলেছি!
আর কোন উত্তর এলোনা। খানিক বাদে আরেকটা মেসেজ এলো করিডোরের বাইরে আসেন। আমি অপেক্ষা করছি।
ইমতিয়াজ মেসেজটা পেয়ে আর দেরী করল না। টি শার্ট আর ঢোলা ট্রাইজারটা পরেই দৌড় লাগাল। তার মন বলছে আজ সে মুরাদকে দেখতে পাবে। ও.টি.র সামনে এসে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ। মুরাদ তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছে। একটা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে ইমতিয়াজ। ঘাড়ে কারো স্পর্শ পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে। মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, চোখে রিম লেস গ্লাস। চুলগুলো চোখের ভ্রু ছুঁই ছুঁই। হাতে ঔষধের কিছু বক্স। স্কাই ব্লু টি শার্টটা যেন এই লোকটার জন্যই তৈরী করা হয়েছে।
ইমতিয়াজের অমন বিস্মিত চাহনি দেখে তার পাশের চেয়ারটায় বসে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে মুরাদ নিচু আওয়াজে বলল – বিকেলে আমায় একটা ধমক দিয়েছিলেন, আপনার ওয়াইফের প্রেসক্রিপশনের ফটো তোলার সময়।
ইমতিয়াজ অস্ফুটস্বরে বলল – মুরাদ!
গলাটা নিচে নামিয়ে মুরাদ বলল – সাদমান আমাদের আ’স্তা”না’র সামনে পর্যন্ত এসেছে। রিহান তাকে ধ রে আমাকে ফোন দেয়ার অপেক্ষা করছি।
ইমতিয়াজ অবাক হয়ে বলল – জ/মে টেনে নিলো নাকি!
মুরাদ কিছু না বলে ফোনটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল – লোকটাকে সবাই ভালো জানত। নিরুপমা নিজ থেকেই উধাও। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে।
ইমতিয়াজ খপ করে মুরাদের হাত চেপে ধরে বলল – আমার গল্পতো জানেন। আপনার গল্প বলবেন না!

মুরাদ দৃষ্টি নিচু রেখেই বলল – আমি যে এক মেজরের সন্তান, তা কখনো বুঝতে পেরেছেন! কিন্তু মানুষ হয়েছি চাচার কাছে। সময় হলে আরো বলব। এখানে এসেছি ঔষধ নিতে। সব নিলাম। এখন চলেও যাব।
ইমতিয়াজকে কোন প্রশ্ন করতে না দিয়ে হাঁটা ধরলো মুরাদ। আবার পিছু ফিরে দ্রুত পায়ে হেঁটে ইমতিয়াজের একদম কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলল – হাসপাতালটা বাবার। আমি সাইন করে দিয়েছি, আপনার এক টাকাও বিল দিতে হবে না। রাস্তার ও পাশের মানুষগুলো অপেক্ষা করছে। আজ তাদের জন্য খাবার দিতে দেরী করে ফেললাম।
যেতে যেতে মুরাদ গান ধরলো – ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে…..
ইমতিয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে, গানটা সে কাছের কোন মানুষের কন্ঠে শুনেছে।

_____

সকালে ফাহিমের ঘুম ভাঙলো প্রতিদিনের মত এলার্মের শব্দ পেয়ে। দেখলো বিছানায় মায়া নেই। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়াশরুমটা ফাঁকাই ছিল। টাওয়াল আর ট্রাউজারটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই দরজায় কারো শব্দ পেলো ফাহিম। দরজা খোলার আগেই শুনতে পেলো – ঘরে কি চা পাতা, চিনি নেই?
ফাহিম মজার ছলে বলল – আমি এখানে নিয়ে এসেছি।
জবাবটা মায়ার মনমত হলো না। তিরিক্ষি কন্ঠে সেও জবাব দিল – ওসব না নিয়ে বিচুটি পাতা নিতেন, বেশ কাজে দিত।
দশ মিনিট পর বেরিয়ে আসলো ফাহিম। গলায় টাওয়েলটা ঝুলানো। কানের দুপাশ বেয়ে পানি পড়ছে। দেখলো দরজার সামনে পা মেলে বসে আছে মায়া। তাকে এক নজর দেখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল ফাহিম। চা পাতা, দুধ আর চিনির বয়ামগুলো চুলার পাশে রেখে মায়ার পাশে এসে বসলো। মৃদুস্বরে বলল – বিচুটি পাতা দিয়ে কি চা বানানো যায়!
মায়া উত্তপ্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাতেই দেখলো কি মায়াভরা চাহনি, কি মুগ্ধ তার মুখের আদল। চুল থেকে টুপটুপ করে পানি এসে শরীরটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিছু বলতে যেয়েও পারলো না সে। ক্ষীণ কন্ঠে বলল – মাথাটা ভালো করে মুছে নিন, ঠান্ডা লেগে যাবে।
ফাহিম অলসতার ভঙ্গিতে বলল – অমনই থাকে, শুকায় না। পরে এমনিই শুকিয়ে যাবে।
এবার মায়া তেতে উঠে বলল – বলেছে আপনাকে? দেন টাওয়েলটা। দেখি কেমনে না শুকায়। যতসব আইলসা!
ফাহিমের গলা থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ফাহিমের মাথাটা মুছে দিচ্ছে মায়া। কে বলবে মেয়েটা গতকালও কতটা অসুস্থ ছিল!
মাথা মুছে কোমল হাতের চিকন চিকন আঙ্গুল দিয়ে ফাহিমের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে মায়া বলল – আমার মা বলত, গোসল করলে চুল ভালো করে মুছে নিতে হয়। নয়তো ঠান্ডা লেগে যায়।
ফাহিম ছোট্ট বাচ্চাদের মত চুপটি করে বসে আছে। সবকিছু তার স্বপ্ন মনে হচ্ছে। যেন চোখটা খুললেই সব মিলিয়ে যাবে। এভাবে কারো যত্ন পাবে সে ভাবতেও পারছে না।
মায়া আবার বলল – চা বানিয়ে আনি। আমাকে চা পাতা আর চিনি এনে দেন।
ফাহিম অস্হির কন্ঠে বলল – সব চুলার পাশে রেখে এসেছি।
মায়া চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। এক কাপ চা সকাল বেলায় তার চা-ই চাই।

চলবে…….

টাইপোগ্রাফি :মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here