আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ১৩
ইব্রাহিম বাড়ির পরিবেশ আজ সকাল থেকেই থমথমে। সব সময় শান্ত থাকা মাহতাব আজ সিংহকে মতো হিংস্র চোখে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাব স্তব্ধ হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। লামিয়া! লামিয়া তাকে ছেড়ে গেছে! এই মেয়েটা তো তাকে ছাড়া একরাত থাকতে পারে না। তাহলে আজ কিভাবে তাকে ছেড়ে গেলো! এখন রাতে সে কিভাবে ঘুমাবে? মেহরাবের বাহুতে মাথা না রাখলে ত তার ঘুম হয় না। ইসস,কাল সারা রাত মেয়েটা হয়তো ছটফট করেছে। এখন নিশ্চয়ই মাথা ব্যাথায় অস্থির হয়ে এদিক সেদিক পায়চারি করছে। লামিয়া ঠিক আছে তো! কার বাসায় গেলো? মামার বাড়িঘর তো যায়নি। তাহলে?
— কি করেছিস তুই মেহরাব? মেয়েটা বাড়ি ছাড়ল কেন? সত্যি করে বল।
ময়না বেগম সহ বাসার সবাই কেপে উঠলো। মধু এক কোণে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাদছে। মাহতাব আর তার বিয়ের এক মাস পার হয়েছে সবে। কিন্তু এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সাথে যেন তার হাজার বছরের সম্পর্ক।
মাহতাবের হুংকারে মেহরাব মাথাটা হালকা উঁচু করলো। টলমলে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইলো সে। কিন্তু ঠোঁট দুটো আলাদা করতে পারলো না। কয়েকবার কেপে উঠলেও মুখ থেকে কোন শব্দ বের হলো না মেহরাবের। নিদারুণ অসহায় চোখে তাকিয়ে শুধু নিজের মাথা নাড়িয়ে বলল সে কিছুই জানে না।
কুলসুম বেগম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই বলল,
— আমার মনে হয় লামিয়া অন্য কারো সাথে,,,
–মাআআআ!!
বাকি কথা আর মুখ থেকে বের কররে পারল না সে। তিন ছেলেমেয়ে এক সাথে গর্জে উঠলো। সারাজীবনে যা কখনো হয়নি আজ তা হলো। মায়ের উপর গলা উচু করলো তারা। মাহতাব বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। তার মা এমন কথাও বলতে পারে! কুলসুম বেগম ছেলেমেয়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস করলেন না। কিন্তু গত কয়েকটা দিন লামিয়া সব কিছুতেই কেমন উদাসীন ছিল। ঘনঘন ফোন আসত। ফোনে কথা বললেই লামিয়ার মুখটা বিষন্নতায় ঢেকে যেতো। কুলসুম বেগম অনেকবার বিষয়টি খেয়াল করেছেন। কয়েকবার লামিয়ার সাথে কথা বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে দিয়েছে। তিনি ভেবেছেন স্বামী স্ত্রীর মান অভিমান চলছে হয়তো। তাই আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে অন্তত নিজের মনকে শান্তনা দেয়া যেতো।
— তুমি এমন কথা কিভাবে বললে মা! লামিয়া কে তো আর আজ নতুন দেখছো না। তাহলে? মাঝে মাঝে তো আঙ্গুল নিজের ছেলের দিকে ও একটু তুলতে পারো। সে তো আর জমজমের পবিত্র পানি নয়। ছেলের কাছেও জিজ্ঞেস করো তার কারো সাথে পরকীয়া চলছে কি না?
ময়না বেগমের এমন কথায় সবাই অবাক চোখে মেহরাবের দিকে তাকালো। মেহরাব নিজেও অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে তার আপার দিকে। পরকীয়া! সে কি এতটাই জঘন্য? বউ রেখে বাইরে পরকীয়া করবে?
— এসব কি বলছো আপা? আমাকে নিয়ে এমন কথা কিভাবে বলতে পারলে!তুমি তোমার ভাইকে চেনো না? আমি কেন এমন করবো? ভাইয়া!! তুমি কেন চুপ করে আছো? আরে আমি ভালোবাসি আমার বউ কে। অন্য মেয়ের কথা কোনদিন চিন্তাও করিনি। আল্লাহর দোহায় লাগে, আমাকে এতটা নিচ ভেবো না।
মেহরাব নিজের শান্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। চিন্তায়, অস্থিরতায় ক্রমশ হাইপার হয়ে উঠছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আটকে আটকে আসছে তার।তার পরিবার,যেখানে সে জন্ম থেকে বড় হয়েছে। যাদের সাথে তার জীবনের ৩৪ বছর কেটেছে।তারাই তাকে অবিশ্বাস করছে! এতো বড় একটা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নিরদ্বিধায় করে ফেললো!
মেহরাব হাত পা ছড়িয়ে আবার ফ্লোরে বসে পরলো। মাহতাব উঠে গিয়ে মেহরাব কে শান্ত করার চেষ্টা করছে। মেহরাব এতোটাই উত্তেজিত হয়ে গেছে যে,যে কোন সময় প্যানিক এট্যাক হয়ে যেতে পারে।
— নিজেকে সামলা মেহরাব। তোরা কেউ-ই আমাদের কাছে ফেলনা নয়৷ ভুল তুই করেছিস। লামিয়া কে অনবরত ইগনোর করেছিস। সব কিছুই আমার চোখে ধরা পরে মেহরাব। বাড়ির অভিভাবক আমি। চোখ কান বন্ধ করে তো আর রাখতে পারি না।
— আ আমি ক কি করেছি ভাই? আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে বলো আমি কি করেছি? সবাই কেন আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে? লামিয়া কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ভাই আমাকে বলো প্লিজ। আমি আর এসব নিতে পারছি না।
মেহরাবের বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া মুখের পানে তাকিয়ে মাহতাব আর কিছু বলতে পারলো না। সে তার ভাইকে চিনে। তার ভাই এমন কিছু করতে পারে না।
এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতেই বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। রহিমা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সবাই ভেবেছে হয়তো লামিয়া এসেছে। সবাই কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো এক অচেনা মেয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। মেহরাব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দরজার দিকে। কাঙ্ক্ষিত মুখ না দেখে চোখ নামিয়েঅপি ফেললো সে। লামিয়া ছাড়া এখন আর কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। রাত দুটো থেকে সকাল আট টা পর্যন্ত পরিচিত সব জায়গায় পাগলের মতো খুজেছে লামিয়া কে। মাহতাব ও তার সাথেই ছিল। সব তো ঠিক ছিল। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে লামিয়ার চলে যেতে হলো।
অপরিচিত মুখটা দেখেই সবার মুখ আগের চেয়ে বেশি থমথমে হয়ে গেলো। মাহতাব ছাড়া বাকি সবাই মুখ কুচকে তাকিয়ে আছে। মাহতাব মেহরাবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। মধু একপাশে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে তার একদম ভালো লাগেনি। কাল বিকেলে ও এই মেয়ে বাসায় এসেছিল। বাকিরা যে যার রুমে ঘুমাচ্ছিল। একমাত্র সে আর জরি কিচেনে বিকেলের নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। এই মেয়েই তো কাল লামিয়ার সাথে দেখা করেছে৷ তার পর থেকেই লামিয়া সারা টা সময় কেমন মনমরা হয়ে ছিল।
— ভিতরে এসো এলিজা। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
এলিজা ধীর পায়ে এসে ড্রয়িং রুমে এসে দাড়ালো। মাহট্যাব ইশারায় বসতে বলল তাকে। ময়না বেগমের পাশের সোফায় গিয়ে চুপচাপ বসে পরলো সে।
— মধু,,এলিজার জন্য পানি নিয়ে এসো।
— জি।
মধু কিচেনে চলে যেতেই মাহতাব সিঙ্গেল সোফায় বসে শান্ত চোখে তাকালো এলিজার দিকে। চোখ ঘুড়িয়ে একবার মেহরাবের নির্জীব মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— কাল এ বাসায় কেন এসেছিলে?
এলিজার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাপছে। এসির নিচেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মাহতাব শান্ত হয়ে থাকলেও তার ভয়ে এলিজার কলিজা শুকিয়ে গেছে। মাহতাব কে সে মৃত্যুর মতো ভয় পায়। মেহরাবের মুখের অবস্থা দেখে সে বুঝে গেছে বাসায় কি হয়েছে। কাপা কাপা হাতে কপালের ঘাম মুছে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। মধু ততক্ষণে তার সামনে পানি এনে রেখেছে।
— পানি খেয়ে দ্রুত জবাব দাও এলিজা। বিষয় যখন আমার পরিবার নিয়ে তখন একচুল ছাড় পাবে না।
মাহতাবের শক্ত গলা শুনে তারাতাড়ি পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো এলিজা। মেহরাব উঠে এসে অবাক গলায় বলল,
— তুই কাল আমাদের বাসায় এসেছিলি! কই,আমাকে তো কিছু বলিস নি!
— বলবে কেন। নিজের কুকীর্তির কথা কে ঢোল পিটিয়ে বলে।
— কি বলছো ভাইয়া? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ একটু খুলে বলবে?
— এসব ভালো লাগছে না মাহতাব। ঠিক করে বল কি করেছে এই মেয়ে?
সবার আগুন দৃষ্টি মুহুর্তেই এলিজা কে জ্বা*লিয়ে দিবে যেন।ময়না বেগম তো পারলে এখনই দু ঘা লাগিয়ে দেয়। মাহতাব মধু কে ইশারা করলো ময়না বেগমের কাছে যেতে। কখন মে*রে দেয় বলা যায় না।
মধু ময়না বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। তার একহাত নিজের হাতে নিয়ে তাকে আস্বস্ত করলো। কুলসুম বেগম মুখ কুচকে রেখেছে। সব কিছু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তার।
এলিজার নিরবতা দেখে মাহতাব ঠান্ডা গলায় হু*মকি দিয়ে বলল,
— দেখো মেয়ে,বেশি কথা আর ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ নয়। মুখ খুলে সত্যি টা বলো। নাহলে আমি এক্ষুনি থানায় কল করবো। লামিয়া কে কি*ডন্যাপ করার অপরাধে জেলে পচে ম*রতে হবে। আর আমি এটা নিশ্চিত করবো, তুমি যাতে কোন ভাবেই ছাড়া না পাও।
মেহরাব শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
— আ আমি লা লামিয়া কে ব বলেছি আমার পেটে মেহরাবের বাচ্চা। সে লামিয়া কে আর চায় না। তাই আমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
মেহরাব ধপ করে বসে পরলো। ময়না বেগম ফুসে উঠেছে। মধুর হাত একঝটকায় ছাড়িয়ে কষিয়ে চর লাগিয়েছে এলিজার গালে। মাহতাব ময়না বেগম কে ছাড়িয়ে নিয়েছে সাথে সাথে। এই মেয়েকে সে ছাড়বে না। তার পরিবার ভাঙ্গার চেষ্টা করে কতবড় ভুল করেছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াবে তাকে।
— আহ আপা! তোমার লেগে যাবে তো। এভাবে কেউ হাইপার হয়? এসে চুপ করে বসো।
মধু হা করে তাকিয়ে আছে ভাই বোনের দিকে। দুই টনের থাপ্পড় লাগিয়েছে এলিজা কে অথচ ভাই বলছে তার বোনের নাকি লেগে যাবে! কি আশ্চর্য!!
— কাল থেকে এক কেজি চালের ভাত খাবে প্রতিদিন। এমন দুর্বল বউ আমার পছন্দ নয়।
মাহতাবের কথা শুনে মধু মুখ কালো করে ফেললো। আপার এতো শক্তি যে কই থেকে আসে কে জানে। এখন এখানে তার কি দোষ?
চলবে,,
আমার_অবেলায়_তুমি
সানজিদা_বিনতে_সফি(সাথী)
পর্ব_ ১৪
“তোমরা কি বিয়ে করেছো?”
কুলসুম বেগমের সন্দিহান প্রশ্নে সবাই বিরক্ত হলো। মাহতাব ময়না বেগম কে শান্ত করে বসিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলল,
— আম্মা,,বুঝদার মানুষ হয়েও অবুঝের মতো কথা আপনার কাছে আমাদের কারোরই কাম্য নয়। দয়া করে পরিস্থিতি বুঝে কথা বলুন।
কুলসুম বেগম কপালে ভাজ ফেলে ছেলের দিকে তাকালো। ছেলেমেয়েদের এমন ব্যবহারে সে বিরক্ত। বিয়ের ছয় বছরেও যখন তাদের কোন সন্তান নেই তাহলে মেহরাব আরেকটা বিয়ে করতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। সে তো আর লামিয়া কে ফেলে দিচ্ছে না। লামিয়া ও আগের মতোই এ বাড়িতে থাকবে। যে সংসারে বাচ্চাকাচ্চা নেই সে সংসার কে কি সংসার বলে!
— তোমরা বাড়াবাড়ি করছো মাহতাব। মেহরাব যদি এই মেয়েকে বিয়ে করে থাকে আমি তো এখানে দোষের কিছু দেখছি না। আমি চাই মেহরাব সন্তানের মুখ দেখুক। এখানে ভুল টা কোথায় বলবে?
মেহরাব ছাড়া বাকি সবাই আহত চোখে কুলসুম বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। ময়না বেগম কিছু বলতে গিয়েও মাহতাবের ইশারায় থেমে গেলো। মেহরাব আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে। খালা সহ রহিমা আর জরি কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখেই অশ্রু জমেছে।
কুলসুম বেগমের প্রশ্রয়ের কথায় এলিজা যেন একটু সাহস পেল। আগের মতো ভয়ের আভা তার মুখে আর দেখা যাচ্ছে না৷ মাহতাব সবার দিকে চোখ বুলিয়ে মেহরাব কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— তুই কি নিজের ব্যপারে কিছু বলতে চাস?
মেহরাব কারো দিকে তাকালো না। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো সে। পুরো জীবন টাকেই অর্থহীন লাগছে তাঁর কাছে। পরিবারের মানুষ গুলো ও তাকে বিশ্বাস করছে না! লামিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে কি হবে।
সবার এমন খাপছাড়া ব্যবহার দেখে ময়না বেগম তেতে উঠল। এলিজার দিকে তেড়ে গিয়ে রাগে গড়গড় করতে করতে বলল,
— এই মেয়ে, মুখ খোল। এরকম নোংরা কাজ কেন করেছিস? আমার ভাই কোনদিন ও এমন কাজ করবে না আমরা সবাই তা ভালো করে জানি। এখন যদি সত্যি কথা না বলিস তাহলে এই মুখ নিয়ে আর বের হতে পারবি না। তোর ওই মুখ ভেঙ্গে আমি স্টোর রুমে রেখে দেবো।
— আহ ময়না! অভদ্রের মতো ব্যবহার করছো কেন? বাচ্চা যদি মেহরাবের হয় এটা তো খুশির কথা। তোমরা অযথাই ঝামেলা করছো।
— তুমি চুপ করো আম্মা। তোমার বিবেচনা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি এই বাড়ির মুরব্বি। তোমার এমন অবিবেচকের মতো কথা মানায় না আম্মা। এই মেয়ে, তুই মুখ খুলবি নাকি আমি তোর মুখ ভাঙ্গবো?
এলিজা থরথর করে কাপছে। এক থাপ্পড় খেয়ে তার গাল টনটন করে ব্যথা করছে। আরেকটা খেলে দাত আর মুখে থাকবে না। সব পেটে চলে যাবে।
মাহতাব এখন আর ময়না বেগম কে আটকাচ্ছে না। সে চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। স্থির দৃষ্টিতে মা আর ভাইকে দেখে যাচ্ছে। এই মেয়ের কথায় তার কোন আগ্রহ নেই।
মধু গোল গোল করে ময়না বেগম আর এলিজা কে দেখছে। কখন ময়না বেগম আরেকটা দিয়ে গাল লাল করবে সেই অপেক্ষা। অসভ্য মেয়ে একটা।
— রহিমা আমার জন্য হাতুড়ি নিয়ে আয়। এই মেয়ে এভাবে মুখ খুলবে না।
এলিজা কেপে উঠলো। সোফার একপাশে সেটে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,
— বলছি, বলছি। মাসখানেক আগে আমার মেহরাবের সাথে দেখা হয় নিউমার্কেট এরিয়ায়। তখন কথায় কথায় জানতে পারি মেহরাবের কোন সন্তান নেই। মেহরাবের এ নিয়ে কোন মন খারাপ ও ছিল না। তবে সে লামিয়া কে নিয়ে চিন্তিত ছিল। লামিয়া নাকি ইদানীং মেহরাবকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। অদ্ভুত সব ব্যবহার করে। তাই ও একটা বাচ্চা দত্তক নিতে চাইছিল। আমার তখন সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। এই বাচ্চাটা আমি নিজেও রাখতে চাইছিলাম না। এবোর্শন করতে গিয়েও কিছু কমপ্লিকেশনস এর কারনে করতে পারিনি। তাই আমি মেহরাব কে অফার করি আমার বাচ্চাটা দত্তক নেয়ার জন্য। মেহরাব খুশিমনে রাজি হয়ে যায়। তারপর থেকে মেহরাব আমার খুব যত্ন নিতো। আমার কখন কি লাগবে তা কখনো বলতে হয়নি। বলার আগেই মেহরাব সব হাজির করেছে। ওর কেয়ার দেখে আমার মনে লোভের জন্ম হয়। কারণ আমার স্বামী কখনো আমার এভাবে খেয়াল রাখেনি। ভিনদেশী হওয়ার দরুন ওদের মধ্যে এমন কেয়ারিং ভাব টা কাজ করেনা। তাই আমি ভাবলাম মেহরাব যেহেতু আমার সন্তান কে নিজের পরিচয় দিচ্ছে সেখানে আমাকে দিলে দোষ কোথায়? লামিয়ার জায়গায় আমি ও তো থাকতে পারি৷ তাই আমি কাল এ বাসায় আসি। লামিয়ার এমনিতেই মেহরাবের উপর সন্দেহ ছিল। আমার সব কিছু গুছিয়ে বলায় ও কিছুটা কনভিন্স হয়। পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে আমি লামিয়ার সামনে মেহরাব কে কল করি। মেহরাব রিসিভ করতেই আমি বলি,”তোর মেয়ে আমাকে বিরক্ত করছে। একেবারে তোর মতো হবে দেখবি।যেমন বাবা তার তেমন মেয়ে।”
“দেখতে হবে না মেয়েটা কার।”
আমাদের কথাবার্তা শুনে লামিয়া বিশ্বাস করে নেয় এটা মেহরাবের সন্তান। আমি লামিয়াকে অনুরোধ করি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তার জন্যই মেহরাব আমাকে এ বাড়িতে আনতে পারছে না। লামিয়া শুধু চুপ করে আমার কথা শুনেছে। আমি ও খুশিমনে ফিরে গিয়েছি কাল। লামিয়া যেহেতু চলে গেছে তখন তার জায়গায় আমি থকলে সমস্যা কোথায়? আমার সন্তান তার সত্যিকারের মায়ের ভালোবাসা পাবে। পরবর্তীতে আমরা আবার বাচ্চা নিবো। আপনি বলুন আন্টি,আমাকে মেনে নিতে তো আর কোন আপত্তি থাকার কথা নয়।
এলিজার গালে আরেকটা চ*ড় পরেছে।আর এবার মেরেছে স্বয়ং কুলসুম বেগম। অতটা জোড়ালো না হলেও ভালোই লেগেছে এলিজার। সে এখনো গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কুলসুম বেগম নিজের জায়গায় বসে শ্বাস টানতে টানতে বলল,
— পুলিশ কে কল করো মাহতাব। এই মেয়েকে এক্ষুনি পুলিশে দিবে। ক্রিমিনাল একটা।
মাহতাব আগেই পুলিশ খবর দিয়েছে। তাই মা কে আস্বস্ত করে শান্ত হতে বলল।পুলিশ সব জায়গায় লামিয়ার খোজ করছে। মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে!
— রহিমা,,আম্মাকে পানি দে।
— আইচ্ছা ভাইজান।
রাহিমার যেতে যেতে আফসোসের গলায় বলল,
— আম্মার মা*রার কি দরকার আছিল। আফায় মা*রলে তো ভালো কইরা দিতে পারতো। নাগিন বেডি।
— মেহরাব,,,
মেহরাব আগের মতোই চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ভাইয়ের ডাকে চোখ তুলে তাকালো। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মলিন হাসল।
— এতগুলো বছরেও আমি তোমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি ভাই! (আফসোসের স্বরে)
— আমরা তোকে বিশ্বাস করি। তাই এই মেয়েকে তোর মুখোমুখি করেছি। যাতে সব কিছু তোর সামনে আসে। কাল রাতে যখন লামিয়াকে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন মধু আমাকে বিকেলের ঘটনা বলে। আমি ছাদের সিসিটিভি চেক করে দেখে এই মেয়েকে সন্দেহ হয়। তাই আজ সকাল হতেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুই ব্যপারটা লামিয়ার সাথে শেয়ার করতে পারতি। তাহলে আজ এই পরিস্থিতিতে পরতে হতো না। স্বামী স্ত্রীর মাঝে কখনো তৃতীয় কাউকে আনতে নেই মেহরাব। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হওয়া চাই কাচের মতো সচ্ছ। গোপনীয়তা আসলেই সেখানে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। অন্তত পক্ষে আমার সাথে আলোচনা করতে পারতি।
— আমি চেয়েছিলাম ভাই। সব কিছু সামলে আমি তোমাদের সবার সাথে আলোচনা ও করতাম। লামিয়া কে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম আমি। এমন কিছু হবে আমি স্বপ্নে ও ভাবিনি। এই মেয়েকে আমার সামনে থেকে সরাও ভাই৷ আমি কি করে ফেলবো আমি নিজেও জানি না।
রহিমা কুলসুম বেগম কে পানি দিয়ে মাহতাব কে বলল,
— পুলিশ আইছে ভাইজান।
— ভিতরে নিয়ে আয়।
রহিমা দরজার দিকে ছুটলো। এলিজা বার বার সবার কাছে ক্ষমা চাইছে। কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ময়না বেগম কিছুক্ষণ পর পর কটমট করে তাকাচ্ছে৷ মাহতাব তার একহাত ধরে রেখেছে। তাই সে কিছু করতে পারছে না।
পুলিশ ভিতরে আসতেই মাহতাব তাদের সাথে হাত মিলিয়ে বসতে বলল।
— লামিয়ার কোন খবর পেয়েছেন অফিসার?
— জি স্যার। সে বনানীতে তার এক ফ্রেন্ডের বাসায় আছে। ফোন কিছুক্ষণের জন্য অন করেছিল। আমরা লোকেশন ট্রেক করে সেখানে গিয়েছলাম। ম্যাম বলেছে সে নিজের ইচ্ছায় সেখানে গিয়েছে। আর সে এ বাড়িতে আসবে না।
— ঠিক আছে। বাকিটা আমি সামলে নিবো। আপনি আপাতত এই মেয়েকে নিয়ে যান। আমি পরে থানার গিয়ে সব ফর্মালিটিস পূরণ করে আসবো।
— ঠিক আছে স্যার।
পুলিশ এলিজা কে নিয়ে যেতেই মেহরাব উঠে কুলসুম বেগমের মুখোমুখি দাড়ালো। মায়ের গালে হাত রেখে করুন গলায় বলল,
— আমার সন্তান চাই না আম্মা। সন্তান ছাড়া ও আমি বেচে থাকবো। কিন্তু লামিয়া কে ছাড়া আমি ম*রে যাবো আম্মা। লামিয়ার জায়গা অন্য কাউকে দেয়া আমার এই জীবন থাকতে সম্ভব না। ওকে আর এসব নিয়ে কিছু বলো না আম্মা। ও মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছে।আমি অনুরোধ করছি আম্মা।
ভাই,আমি লামিয়াকে আনতে যাচ্ছি। আমি ওকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে যাবো। তুমি কি যাবে আমার সাথে?
— হুম।
দুই ভাই বেড়িয়ে গেল। ময়না বেগম আঁচলে মুখ গুজে কাদছেন। লামিয়া কে মেহরাব আর এখানে আনবে না। মধুর মনও খুব খারাপ হয়ে গেছে। লামিয়া কে ছাড়া বাসা ফাকা ফাকা লাগে। বাসার সবার মন খারাপ হয়ে গেলো।
চলবে,,