#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
বহমান স্রোতস্বিনীর মতো সময়ের স্রোত বয়ে চলেছে। পেরিয়ে গেছে রুহানীর নিখোঁজের পাঁচ পাঁচটা দিন! এখন পর্যন্ত রুহানীর কোন খোঁজ কেউ পায়নি। পুরো সিলেট শহর বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়ে গিয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছে কিন্তু এখনো কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেনি। জাহানারা শেখ ও রহমত শেখকে মনে সাহস ও যাতে ভেঙে না পরে তাই রিহা তার স্বামীর সাথে এসে থাকছে। রিহা যেন এখন নিজের বাবা-মায়ের মনের মতো মেয়ে হয়ে উঠেছে।
আঁধার অম্বরপানে অনিমেষনেত্র মেলে দিকবেদিক হয়ে চেয়ে আছে আরহান। রকিং চেয়ারে অনবরত দুলছে সে। অক্ষিপটে কল্পনার ঘুরি যেন ডানা মেলে অতীতে ঘোরাফেরা করছে।
______
“তোমার কী হয়েছে রুহি? আজ আমার থেকে এতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?”
রুহানী ছুটে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকায়। অতঃপর হাতে থাকা ছোটো ডায়েরিতে কিছু লিখে,
“আজ তো আমি আপনার নাগালে আসবই না। কালকে আপনি আমার কথা শোনেননি। ”
লিখে কাগজটা ছিঁড়ে গোল করে আরহানের দিকে ছুঁড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ আরহান ক্যাচ ধরে বলে,
“আরে ইয়ার প্লিজ।”
কাগজটা খুলে পড়তে পড়তে বলে,
“দেখো, সব মানলাম কিন্তু ওই কথাটা মানতে পারব না। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
দূর হতেই রুহানী মাথা নাড়ালো। মানে সে অসন্তোষ এখনও। আরহান হতাশ হয়ে বলে,
“তুমি জানো, আমার এসব রাজনীতি খুব একটা মন টানে না। বাবার কথায় তার বিজনেসের কাজ ধরেছি, মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। সবই তো করলাম। এখন আবার রাজনীতিও! আমি কয় দিক সামলাবো?”
রুহানী ইশারায় বুঝাল,
“আঙ্কেল খুব করে চাইছেন। প্লিজ আমি আংকেলকে কথা দিয়েছি আমি আপনাকে বোঝাবো।”
“তুমি তোমার আংকেলকে বলে দাও তুমি বুঝিয়েছো কিন্তু আরহান বোঝেনি। নরমাল বিষয় এটা নিয়ে এত ঝামেলা করার কি আছে। তাছাড়া বাবার রাজনীতিতে আমি কখনোই মাথা ঘামাইনি। আমার প্যাশনই ছিল অন্য কিছু।”
আরহানের কথা শুনে রুহানী দীর্ঘশ্বাস ফেলল অতঃপর লিখলো,
“মানলাম আপনার প্যাশন ছিল না কিন্তু আঙ্কেল তো চাইছেন। তাছাড়া এতে করে আপনি জনগণের জন্য কিছু করতে পারবেন। সাধারণ মানুষজনের পর্যন্ত আপনি পৌঁছাতে পারবেন। আমি আপনার মধ্যে সেই সামার্থ্য দেখেছি। আপনি খুব ভালো ও জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হবেন।”
রুহানী আবারও একই উপায়ে কাগজের টুকরোটা আরহানের কাছে পৌঁছালো। আরহান লেখাগুলো পড়ে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি এত কম বয়সে এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই না। যদি জড়াতেই হয় তাহলে আরো পরে। এখনই কেন? একবার জড়িয়ে পড়লে আমার জীবনের সব সময় ওখানেই চলে যাবে। বাবাকে দেখি তো। বাবা মাকে খুব ভালোবাসতেন। খুব খুব ভালবাসতেন। কিন্তু মায়ের সাথে অতটা সময় কাটাতে পারেননি। বাবা ব্যস্ত থাকতো রাজনীতি নিয়ে, ব্যবসা নিয়ে। আর মা তার পাইলটের জব নিয়ে। কিন্তু যখন মা ছুটির দিনে বাড়ি থাকত তখন প্রায় সময়ই বাবা ব্যস্ত থাকতেন। আমি চাইনা আমার জীবনটাও এরকম হোক। আমি তো চাই তোমার সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে। তুমি আমার পাশে থাকলে মনে হয় কোনো কষ্টই কষ্ট না। এইযে একসাথে তিন দিক সামলাচ্ছি।”
রুহানী এবার এগিয়ে এলো। এগিয়ে এসে আরহানের কাঁধে হাত রাখল। মিষ্টি করে হেসে ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলল,
“আপনি পাশে থাকলে আমার মনোবল বাড়ে। নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। নয়তো আমার প্রতিব*ন্ধকতা জেনেও এতোটা ভালোবাসা পাব বলে ধারণাই ছিল না।”
“তুমি আবার নিজেকে ইনফিরিয়র ভাবা শুরু করেছ! এতো বলি, তুমি খারাপ পরিস্থিতির শি*কার। যা একদিন ঠিক হবে। হতেই হবে। ”
আরহানের দৃঢ় বিশ্বাসে রুহানী প্রসন্ন হাসলো। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“আমিও চাই কথা বলতে। আমি চাই যাতে কেউ বলতে না পারে আরহান ইসরাক খানের স্ত্রী বোবা! আমার জন্য আপনি মানুষের কথা শুনুন আমি চাই না। কিন্তু মনে একটা ভয় রয়েই যায়। ১৮ বছরেও যে মেয়ে কথা বলতে পারল না! পারল না নিজের প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে! সে কি আদৌ কখনো কথা বলতে পারবে?”
“হুঁশ। এতো বাজে চিন্তা করো না। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। যে বলবে তার…..! কারও এমন সাহসই হবে না।”
“আপনি প্লিজ আংকেলের কথায় রাজি হয়ে যান। আমি আপনার মধ্যে একজন আদর্শ রা*জনীতিবিদের ছায়া দেখতে পাই। প্লিজ প্লিজ। নয়তো কাল থেকে আমি বাড়ি থেকেই বের হব না। তখন দেখব কীভাবে দেখেন আমায়!”
রুহানী বাচ্চাদের মতো নাক ফুলিয়ে বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে ফিরে রইলো। আরহান রুহানীর থুতনিতে হাত দিয়ে ওর মুখশ্রী একবার নিজের দিকে ঘোরায় তো রুহানী আবারও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরহান বলে,
“তবে তোমার বাড়িতে চলে যাব!”
তাও রুহানীর রাগ কমলো না। আরহান এবার হেসে ফেলল। সে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি মেনে নিলাম তোমার কথা। আমি রাজি আছি। বাবা যাই করুক আমি রাজি। খুশি?”
রুহানী খুশিতে উছলে ওঠল। তারপর আরহানের হাত জড়িয়ে দূরে ফুচকাওয়ালাকে দেখিয়ে ইশারায় বলল,’ফুচকা খাবে।’ যেই বলা সেই কাজ। আরহান রাজি হয়ে গেল। অতঃপর ওরা দুজন একসাথে ফুচকা খেলো।
________
কল্পনার সুতো কে*টে বেরিয়ে আসলো আরহান। তার ঘরের দরজায় কেউ এসেছে। আরহান ভাবল, এটা তার দাদী। সে হাঁক ছাড়ল,
“তুমি এখন যাও দাদী। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”
“আমি তোমার দাদি না আরহান। আমি তোমার বাবা। ”
আরহান তার বাবার কণ্ঠ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর বলল,
“পূর্বের কথাটা তোমার উপরও লাঘু হয় বাবা। আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই।”
আজমল খান এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তারপর বললেন,
“সন্ধ্যা থেকে তো একাই ছিলে। এখন রাতের এগারোটার বেশি বাজে। আর কতো একা থাকবে? ডিনার তো করে নাও। তুমি এভাবে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে নির্ঘুম থাকলে বুঝি রুহানী ফিরে আসবে? বরং তুমি আরো দুর্বল হবে। রুহানীকে খোঁজার মতো শক্তি পাবে না।”
“আমি ওকে খুঁজি আমার মনের শক্তি দ্বারা বাবা। আমার শারীরিক শক্তি এসব ম্যাটার করে না। শারীরিক অসুস্থতা তো নিয়ম মেনে চলল, ঔষুধ খেলে ঠিক হবে। কিন্তু মানসিক অসুস্থতা যে দীর্ঘস্থায়ী! এই দীর্ঘস্থায়ী অসুখের একমাত্র ঔষুধ হচ্ছে রুহানী।”
ছেলের কথা শুনে আজমল খান হতাশ হলেন তিনি হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন
“আমরা তো খোঁজ জারি রেখেছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজছি। কোথাও পাচ্ছি না। বিজ্ঞাপন ছাপা, সবকিছু হয়ে গেছে। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যারা রুহানীকে কি*ডন্যাপ করেছে তারা এখন পর্যন্ত কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। কোনো মু*ক্তিপণও চায়নি। আমরা কী সূত্র ধরে ওদের দিকে আগাবো?”
“আমার মনে হচ্ছে রুহানী সিলেটে নেই! তাই সিলেটে খুঁজে কোনো লাভ নেই।”
_______আরহান নিজের সন্দেহের কথাটা বলা মাত্রই ঘুমন্ত রুহানীর সামনে বসা লোকটি অট্টস্বরে হেসে উঠে বলল,
“ইউ আর রাইট আরহান! তুই একদম সঠিক বুঝতে পেরেছিস। তোর রুহানী সিলেটে তো নেই। কিন্তু কোথায় আছে? দেখি, সেটা খুঁজে বের করতে পারিস কিনা।”
লোকটি এবার হুট করে হাসি থামিয়ে রুহানীর দিকে এগিয়ে গেল তারপর রুহানীর কপালের সামনে জড়ো হওয়া চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
“ইউ আর সাচ অ্যা স্লিপিং বিউটি রুহানী। তোমার মুখের আদলে যেন একরাশ মায়া ভর করে আছে। মন তো করছে সারাজীবনের জন্য তোমাকে নিজের করে নেই! আরহানের কথা ভুলে যাও না তুমি! একদম ভুলে যাও। এনেছিলাম তোমাকে কষ্ট দিয়ে ধীরে ধীরে মা*রতে কিন্তু তোমার মায়ায় পড়ে গিয়ে এখন নিজেরই বেহাল দশা করে ফেলেছি। তাইতো যখনই সুযোগ পাই তোমাকে দেখার জন্য তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় সোনা। তুমি না ঘুমালে যে আমি তোমাকে শান্তিতে দেখতে পারব না! একদিন আস্তে আস্তে তোমার মন থেকে আরহান নামটা মুছে যাবে! তখন আমি নিজের নাম তোমার মনে গেঁথে দিব। তুমি হবে আমার রাজ্যের রানী! দুনিয়া থেকে দূর, আমার হৃদকুটিরে থাকবে।”
লোকটি আবারও পাগলের ন্যায় হাসতে শুরু করল।
_____
আজমল খান অবাক হয়ে দরজার জিজ্ঞাসা করলেন,
“তাহলে কোথায় থাকতে পারে রুহানী? তোমার কোন ধারনা আছে? বা কোন ক্লু পেয়েছো? পেলে বলো। এটা আমরা পুলিশকে দেব। ওদের হেল্প হবে।”
“না বাবা। পাইনি। তবে এটা শিউর যেই কিডন্যাপ করে থাকুক না কেন সে খুব চতুর। এই কয়েকটা দিন আমাদের ভ্রমের মধ্যে রেখেছে। আমরা তো আগেই বুঝতে পেরেছি কি*ডন্যাপের উদ্দেশ্য কোন টাকা পয়সা না। অন্য কোন উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যটা কোন আপন মানুষদেরই থাকতে পারে।”
“তোমার কাকে সন্দেহ হয় আরহান?”
“সন্দেহের তালিকাটাতো ধরতে পারছি না বাবা! একবার ভেবেছিলাম হয়তো রিহা কিন্তু… কিন্তু না। রিহার এসব করে কী লাভ? যদি রিহা এসব করতেই চাই তো রুহানীকে সরিয়ে ফেলতে চাই তো তবে এত বছর অপেক্ষা করত না। রিহা ছোট থেকেই রুহানির উপর রাগ কারণ তোমায় মনে কর তোর রুহানি তার পাওনা ভালোবাসা ভোগ করছে। অবশ্য তা কিঞ্চিৎ সত্যও। রহমত শেখ ও জাহানারা শেখ রুহানীর ওই নিঃসঙ্গ সময়ে রিহাকে কোন না কোন ভাবে অবহেলাই করেছে রুহানীকে সময় দিতে গিয়ে। তাই ছোট্ট রিহার মস্তিষ্কে ছোট থেকে জন্ম নেওয়া রুহানীর প্রতি আ*ক্রোশ ক্রমশ বাড়ছিলই। তাই আমার মনে হয় না রিহা এরকম কিছু করতে পারে। যদি করত তবে আগেই করত। তাছাড়া আমি যখন রিহার সাথে কথা বলেছি তখন রিহার চোখ মুখের রুহানীর খোঁজ পাওয়ার জন্য সত্যিই উৎকণ্ঠা ছিল। এখন আর কাকে সন্দেহের তীরে আনবো, সেটাই বুঝতে পারছি না।”
আজমল খান আরহানের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“এসব চিন্তা করে বের করতে হলেও তোমাকে নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে হবে। তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তোমার মস্তিষ্ক কাজ করবে না। তখন তুমি কিভাবে খুঁজে বের করবে? একটু তো এসে খেয়ে নাও। ভাবো তো, রুহানী ফিরে এসে যখন জানতে তুমি এরকম অনিয়ম করেছ তখন রুহানী কি তোমাকে বাহবা দিবে?”
আরহান এবার হেসে ফেলল। সে বলল,
“উঁহু। মুখ ফুলাবে। আমার সামনেই আসবে না।”
“তাহলে চলো। একটু খেয়ে নাও। দুপুরেও খাওনি। খালি পেটে নাকি সন্ধ্যায় ব্ল্যাক কফি খেয়েছ। এতো উদাসীন তুমি!”
আজমল খান ছেলেকে টেনে উঠিয়ে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
আমার প্রথম বই “মেঘের আড়ালে উড়োচিঠি” ৩৩% ছাড়ে প্রিঅর্ডার করুণ আপনাদের পছন্দের যেকোনো বুকশপে। রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।