সিন্ধু ইগল – (২)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
৪
নতুন কেসটা নিয়ে কাজ করতে করতে রাত কখন ঠেকেছে তিনটার কাটাতে, জায়িন তা টেরও পায়নি। ল্যাপটপ, বিভিন্ন কাগজপত্র, সব সরিয়ে রেখে ওয়াশরুম গেল। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে জানালাটা বন্ধ করার জন্য যেতেই এক আশ্চর্যজনক দৃশ্যের মুখোমুখি হলো সে। তার দোতলার জানালা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাউন্ডারির ওপাশের বাংলোতে লনের মতো ফাঁকা জায়গাটিতে একটা বিশাল সাইজের পিটবুল শুয়ে আছে। গভীর দৃষ্টিতে দেখছে সে, তার মালিককে। জায়িনদের বাগানের যে আম গাছটির ডাল বাউন্ডারির ওপাশে চলে গিয়েছে, সেই আমগাছে ঝুলানো দু’টো রিং ধরে ঝুলছে একটি মেয়ে। সোজা কথায় শারীরিক ব্যায়াম করছে সে। এই গভীর রাতে কোনো সুস্থ মানুষ ব্যায়াম করতে পারে বলে জায়িনের ধারণা ছিল না। সেন্টারটেবিলের ওপর থেকে ক্যামেরা দূরবিনটা নিয়ে এসে তাতে দেখতে থাকল মেয়েটাকে। মেয়েটি জাদু না মাধু তা জানা নেই তার। তবে সন্ধ্যার পর যে মেয়েটিকে দেখেছিল সে এটা সেই মেয়েটিই, তা শতভাগ নিশ্চিত হলো জায়িন। ঘর্মাক্ত শরীরে আষ্টেপৃষ্টে থাকা টপসটা ভেদ করে শরীরের প্রতিটা আকর্ষণীয়, সুন্দর খাঁজ ফুটে উঠেছে। কিন্তু জায়িনের নজর বারবার গিয়ে আটকে যাচ্ছে মেয়েটির ঘর্মাক্ত চেহারাতে। প্রায় অনেকগুলো ছবি তুলে নিলো সে এবারও। যতক্ষণ অবধি মেয়েটা ব্যায়ামে ব্যস্ত, ততক্ষণ অবধি জায়িন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকেই পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। মেয়েটার চেহারার মধ্যে কিছু একটা আবিষ্কার করতে চাইছে সে, যা তার ভীষণ পরিচিত। কিন্তু কী সেটা?
ফজরের আযান ভেসে এলো কানে। এতখানি সময়ের মাঝে মেয়েটিকে আরও বিভিন্ন উপায়ে ব্যায়াম করতে দেখল জায়িন। আজকের পর থেকে জায়িন মাহতাব দিবাচর উপাধি পাওয়ার সঙ্গে যে নিশাচর উপাধিও পেতে চলেছে, তা আর বাউন্ডারির ওপাশের মেয়েটি জানতেও পারল না। মেয়েটি চলে যেতেই জায়িন বিছানাতে এসে শুলো। মৃদু হেসে ভাবতে থাকল, ‘এত কাল ধারণা ছিল, আমার মতো দারুণ এক্সারসাইজ আমি ছাড়া আর কে-ই বা জানে। কিন্তু তুমি আমার ধারণাও উর্ধ্বে।’
কথাটা ভেবেই পাশ ফিরে শুতে গিয়ে চোখে পড়ল চাদরের মাঝে খোলা শরীরে ডুবে থাকা মৌপ্রিয়াকে। তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে স্বগোতক্তি করে উঠল জায়িন, ‘আর তোমার নিয়তিতে সকালে কী আছে, মৌপ্রিয়া?’
৫
জায়িন ঘুমিয়েছে দুই ঘণ্টা হলো। মৌপ্রিয়া অ্যালার্মের শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি করে অ্যালার্মটা বন্ধ করল, যাতে জায়িনের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। জলদি উঠে সে গোসল করে এসে দেখল, ফজরের নামাযের ওয়াক্ত পার হয়ে গেছে। যদিও তাতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস হলো না। নামায পড়ার অভ্যাসটা তার আগে ছিল না। এ বাড়িতে এসেই যতটুকু যা হয়েছে। চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ারে শুকিয়ে জায়িনের মাথার কাছে এসে বসল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল জায়িনের ঘুমন্ত মুখটার দিকে। অদ্ভুত বিষয় হলো, জায়িনের ঘুমন্ত চেহারাটা দেখলেও মনে হয় সে মৃদু মৃদু হাসছে। কোনো শ্যাম বর্ণের মানুষ দেখতে এতটা সুন্দর হয়, তা জায়িনের দেখা না পেলে মৌপ্রিয়ার জানাই হতো না। অথচ এই বর্ণটা নাকি তার নকল। না জানে আসল রূপে মানুষটা তাকে আরও কী পরিমাণ ঘায়েল করবে!
জায়িনের চুলের মাঝে আঙুল চালাতে চালাতে মৌপ্রিয়া স্বগোতক্তি করে উঠল, ‘কবে আসল আপনিটাকে দেখতে পাবো, বলুন তো? আমি তো আপনার বউ, এক মুহূর্তের জন্য আমার সামনেও কি এই মিথ্যা বর্ণ থেকে বেরিয়ে আসা যায় না?’
দরজাতে হঠাৎ ফুলি এসে কড়া নাড়তে শুরু করল। এখন বাজে সকাল সাতটা। বেশ বিরক্ত নিয়ে মৌপ্রিয়া দরজা খুলে ফুলিকে রাগ দেখিয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে ফুলি? উনি ঘুমাচ্ছেন তো! দরজার ওপর তোমার দাপাদাপিতে ওনার ঘুম ভেঙে যাবে।’
ফুলি আজ প্রথম মৌপ্রিয়ার কথার ওপর কথা বলে উঠল রাগান্বিত স্বরে, ‘ভাঙলে ভাঙুক। এমনিতেও ইটু সময় বাদে ছোডো ভাইজানরে ডাইকা পাডাইবো কর্তাসাহেব। আফনেরে নিচে ডাকতাছে। জলদি আয়েন।’
ফুলি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। তার হঠাৎ এমন আচরণে মৌপ্রিয়া বিস্মিত। ওড়না দিয়ে ভালোভাবে মাথা, মুখ ঢেকে সে নিচে নেমে এলো। সকাল সকাল বাড়ির প্রতিটা সদস্য উপস্থিত। এমনকি রেজাও। কিন্তু রেজার পাশে একজন পুরুষলোক বসে আছে, দু’হাতের মাঝে মুখ ডুবিয়ে। তার চেহারাটা দেখা না গেলেও তাকে ভীষণ পরিচিত লাগছে মৌপ্রিয়ার। সেই পরিচিত ব্যক্তিটির কথা মনে পড়তেই ভয়ে বুকের ভেতর ধক্ করে উঠল ওর। সবার চেহারাতে কেমন গম্ভীরতা বিরাজ করছে। কী হয়েছে সবার? আর ওই লোকটিই বা কে? বাইরের কোনো পুরুষের সামনে তো মাহতাব সাহেব বাড়ির মহিলাদের আসতে দেন না।
মৌপ্রিয়াকে দেখে ফুলি বলে উঠল, ‘ওই যে আইছে ভাবিসাহেবা।’
কথাটি রেজার পাশে বসা পুরুষটির কানে পৌঁছাতেই চকিতে মাথা তুলে তাকাল সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকল মৌপ্রিয়াকে। আর মৌপ্রিয়া তাকে দেখে রীতিমতো শঙ্কিত। ভয়ার্ত চোখে শ্বশুর আর শাশুড়ির দিকে একবার তাকাল। জায়িনের বড়ো দু’ভাই জাকির আর জাহিদ ভুল করেও তাকাল না মৌপ্রিয়ার দিকে। গম্ভীর চেহারায় দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে বসে আছে তারা। রেজার পাশে বসে থাকা ছেলেটি হঠাৎ ঝড়ের গতিতে উঠে এসে মৌপ্রিয়াকে থাপ্পড় দিয়ে বসল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘বেঈমান! খুনী! আমার বাচ্চাটাকে মেরে, আমাকে ধোঁকা দিয়ে তুই নতুন সংসার পেতেছিস? আমাকে ঠকিয়ে তুই ভেবেছিস পার পেয়ে যাবি! সুখে সংসার করবি?’
মাহতাব সাহেব কাঠিন্য গলায় বলে উঠলেন, ‘কোনো চিৎকার চেঁচামেচি করবে না৷ আর এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে ওর গায়েও হাত তুলবে না। এসব কখনো আমার বাড়িতে হয় না।’
কথাগুলো শেষ করে মাহতাব সাহেব রেজাকে বললেন, ‘জায়িনকে ডেকে নিয়ে এসো রেজা। ও নিজেই এসে বিচার বিবেচনা করুক ওর বউকে নিয়ে।’
জায়িনের মা জান্নাতি বেগম বলে উঠলেন, ‘বিয়ে তো দিয়েছিলেন আপনি, পাত্রী পছন্দও করে এনেছিলেন আপনি। তাহলে জায়িন কেন বিচার করবে? এমন নোংরা চরিত্রের মেয়েকে আমি আর এক মুহূর্ত মানতে পারব না। জায়িনকে কিছু বলতে হবে না। আপনি ওর বাড়ির সদস্যকে খবর পাঠান। ওরা এসে নিয়ে যাক মেয়েকে। আমাদেরকে ঠকানো হয়েছে। কেন ঠকাল আমাদের? এর কৈফিয়তও দিতে হবে তাদের।’
মৌপ্রিয়ার মুখে কোনো জবাব নেই। বুকটা ফেটে কান্না পাচ্ছে তার। বিয়ের আগে রাকিবের সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল দু’বছরের। আর তা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও রূপ নেয়। হঠাৎ রাকিব স্কলারশিপ পেয়ে বাইরে পড়াশোনা করতে চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর একদিন মৌপ্রিয়া জানায় তাকে, সে অন্তঃসত্ত্বা। আর তা জানার পর রাকিব চলে আসতে চায় দেশে। এসে মৌপ্রিয়াকে বিয়ে করতে চায় সে। কিন্তু তার মাঝেই জায়িনের পরিবার থেকে প্রস্তাব যায় মৌপ্রিয়ার জন্য। মৌপ্রিয়া জায়িনকে দেখে আর জায়িনের পরিবারের বিশাল অবস্থার কথা জেনে সব কিছু ভুলে বিয়েতে মত দিয়ে দেয়। আর দেড় মাসের বাচ্চাটাকেও নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু রাকিবকে সে বাচ্চার ব্যাপারে মিথ্যা জানায়, বাচ্চাটি গর্ভস্রাব হয়ে গেছে। বিয়ের পর প্রথম দু’তিন মাস রাকিবের সাথে যোগাযোগ রাখলেও ধীরে ধীরে রাকিবের সাথে সেই যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। রাকিবের দেশে ফেরার কথা ছিল আরও এক বছর পর। হঠাৎ করে রাকিব কেন দেশে ফিরে এলো? আর তার শ্বশুরবাড়ি চিনল কী করে? এই মুহূর্তে এই প্রশ্নগুলোই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে মৌপ্রিয়ার। কারণ, মৌপ্রিয়া আর জায়িনের বিয়ের কথা তাদের দুই পরিবার ছাড়া তো আর কেউ-ই জানে না।
মাহতাব সাহেব স্ত্রীকে বললেন, ‘আমি আর তুমি ছেলেকে কেবল পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু হুকুম করতে পারি না বউকে ত্যাগ করতে বলার জন্য। জায়িন কী চায় তা ওর মুখ থেকেই শুনি আমরা। ও যদি তালাক দিতে চায় তবেই মৌপ্রিয়া এই বাড়ি ছাড়বে।’
তারপর রেজাকে বললেন, ‘জায়িনকে ডেকে নিয়ে আসো রেজা।’
রেজা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করে তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টিতে একবার মৌপ্রিয়ার দিকে তাকাল। মনে মনে মাহতাব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে উপরে গেল, ‘বিয়ে করলে তো তালাক দেবে আপনার ছেলে!’
মাহতাব সাহেব রাকিবকে বললেন, ‘তুমি এখন আসতে পারো। আমি চাই না আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তুমি থাকো।’
রাকিব গরম চোখে মৌপ্রিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘কিন্তু আমার ওর সাথে বোঝাপড়া আছে। আমাকে কথা দিয়েও ও কেন কথা রাখেনি?’
-‘সেটা এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তোমরা বোঝাপড়া কোরো।’
রাকিব আর কথা বাড়াল না। বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।
ওপরে গিয়ে রেজা দেখল, জায়িন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অথচ নিচে যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে এই মানুষটির এক ফোঁটাও ভাবনা নেই। অবশ্য থাকার কথাও না। যেখানে ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিচ্ছেই সে। খুব আলতো স্বরে রেজা জায়িনকে ডাকতে থাকল। ডাকতে ডাকতে বলল, ‘স্যার, আপনার আব্বার ডাক পড়েছে নিচে। তালাক দেবেন না?’
জায়িনের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ শোনা যায় ভীষণ আহ্লাদী ভরা কণ্ঠের মতো। যা শুনতেও খুব মিষ্টি লাগে। রেজার কথার জবাবে তেমন আহ্লাদী সুরে জায়িন বলে উঠল, ‘উফঃ! তুমি দাও রেজা। বিরক্ত কোরো না।’
কথাটা আর জায়িনের কণ্ঠস্বর শুনে রেজার দারুণ হাসি পেল আবার ভালোও লাগল। মনে মনে বলে উঠল, ‘শালা একে দেখে আর এর কণ্ঠ শুনে কে বলবে, কত বড়ো মাপের জানোয়ার এটা!’
হাসতে হাসতে রেজা মজা করে বলল, ‘আমি মেয়ে হলে এতক্ষণ আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম স্যার। আপনার স্বাভাবিক ভয়েজের থেকেও বেশি মিষ্টি আপনার ঘুমের আহ্লাদ ভরা ভয়েজ।’
এ কথার মাঝেই মৌপ্রিয়া হুড়মুড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকল। বিধ্বস্ত অবস্থা হয়ে গেছে তার এইটুকু সময়ের মধ্যে। একটু আগেও যে পর্দার মাঝে ছিল, এখন পর্দার একটুখানি বালাইও নেই। কাঁদতে কাঁদতে চেহারার দশা বেহাল। আজ আর রেজার মায়া হলো না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মৌপ্রিয়া লুটিয়ে পড়ল জায়িনের পায়ের ওপর। ঘুমের মাঝে কেউ এসে এভাবে পা জড়িয়ে ধরলে যে কারোরই চমকে ওঠার কথা। কিন্তু জায়িন আগের মতোই ঘুমে অচেতন। মৌপ্রিয়া মরাকান্না জুড়ে নিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা, বুক শুকিয়ে চৌচির।
-‘আমাকে মাফ করে দিন, জায়িন। আমার খুব বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আপনাকে ছাড়া আমার মাঝে কারও চিন্তাই আসে না। খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। আমাকে একটা সুযোগ দেবেন প্লিজ। আপনি আমাকে অন্যায়ের যে কোনো শাস্তি দিন। শুধু আমাকে তালাক দেবেন না। আমি মরে যাব নয়তো। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।’
জায়িন চোখ বোজা অবস্থাতেই মুচকি মুচকি হাসতে থাকল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘তোমার দেনমোহর বাবদ গহনা আর টাকাটা আমার কাছেই হেফাজতে আছে মৌপ্রিয়া। গাজীপুর থেকে যশোর যেতে বেশ সময় লাগবে। এখনই গোছগাছ শুরু করে দাও। এবার তোমাকে একাই যেতে হবে। এখন আর আমার ঘুমের বিরক্ত কোরো না। রাগ চড়ে যাবে নয়তো।’
মৌপ্রিয়া জায়িনের ঘুমন্ত, শান্ত কণ্ঠের এই কথাগুলোই আরও বেশি ভেঙে পড়ল। উতলা হয়ে উঠল সে জায়িনকে মানাতে। পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘জায়িন, আমাকে মাফ করে দিন। তালাক দেবেন না আমাকে। দয়া করুন।’
ঘুমের মাঝে এত বারবার বিরক্ত জায়িন আর সহ্য করতে পারল না। সারা রাত জেগে কাজ করে সকাল সকাল মৌপ্রিয়ার কান্নাকাটি মাথায় রক্ত চড়িয়ে দিলো যেন। মুহূর্তের মাঝে এক বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। এত জোরে মৌপ্রিয়াকে লাথি মেরে বসল, ছিটকে প্রায় চার হাত দূরে গিয়ে পড়ল মৌপ্রিয়া। বুকে প্রচণ্ড আঘাত পেল সে। কিন্তু তার থেকেও বড়ো আঘাত তার জন্য অপেক্ষা করছিল। খুব বেশি খেপে গিয়ে জায়িন শোয়া থেকে উঠে বসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল ওকে, ‘বান্দির বাচ্চা! তালাক দেবেন না তালাক দেবেন না করছিস তুই? তোর সঙ্গে বিয়ে হলে তো তালাক দেবো আমি! আমার ঘুম নষ্ট করলি কেন? তোর মতো আরামে শুয়ে বসে খাই ঘুমাই আমি?’
৬
মৌপ্রিয়ার বাড়িতে শুধু ফোন করে জানানো হয়েছে, মৌপ্রিয়া বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এরপর আর একটি অতিরিক্ত বাক্যও ব্যয় করেননি মাহতাব শেখ। নিজে পছন্দ করে এনেছিলেন তিনি মেয়েটিকে। তার বংশে আজ পর্যন্ত এমন নোংরা চরিত্রের কোনো মেয়ে বউ হয়ে আসেনি। আর না কোনো মেয়ে এমন চরিত্রের আছে। চরিত্রের খারাপ গুণটি শুধু জায়িনের মাঝেই দেখতে পান তিনি৷ ছেলেটিকে ভালো পথে আনতেই তো সুন্দর একটি মেয়েকে ছেলের বউ করে আনলেন। অথচ, সেই মেয়েটিও শেষ পর্যন্ত এত বাজে হবে তা মাহতাব চিন্তাও করতে পারেননি। জায়িনের সামনে দাঁড়াতেও তার ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। হয়তো এরপর থেকে জায়িনের ওপর কোনো বিষয়ে জোরদাবি খাটাতেও দ্বিধাতে পড়বেন তিনি।
সন্ধ্যার সময় মৌপ্রিয়া চলে গেছে। আর জায়িন দুপুরের খাবার খেয়ে ঢাকা মহানগর গেছে। যাওয়ার আগে তার সঙ্গে মৌপ্রিয়ার দেখাও হয়নি। সবাই এমনটাই জানে। কিন্তু মৌপ্রিয়া চৌরাস্তা আসতেই রাস্তার মাঝে জায়িনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। শেষবার ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওর কাছে ছুটে যেতেই কোথা থেকে একটা বাস এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে পিষে রেখে যায়। মৌপ্রিয়া রাস্তার মাঝে পড়ার সময়ও দেখতে পায় জায়িন পকেটে দু’হাত পুরে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকেই। মৌপ্রিয়ার চোখে বাঁচার আকুতি স্পষ্টভাবে দেখতে পায় জায়িন। অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে মানুষ জড়ো হতে হতে মৌপ্রিয়ার চোখের আড়াল হয়ে যায় জায়িন।
ড্রাইভিং সিটে বসে অপেক্ষা করছিল রেজা। আর চোখের সামনে মৌপ্রিয়ার শেষ পরিণতি দেখছিল ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে। আজকাল প্রচণ্ড রাগ হয় তার বর্তমান মেয়ে জাতির ওপর। এরা এত বোকা কেন সেটাও প্রচণ্ড ভাবায় তাকে। সুন্দর মুখ আর টাকার মোহে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনে এই বোকা মেয়েগুলো। বড্ড আফসোস হয় তার এদের জন্য।
জায়িন গাড়িতে উঠে বসেছে, তা রেজা একটুও টের পেল না। চেহারা কুঁচকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মৌপ্রিয়ার অ্যাক্সিডেন্ট স্পটের দিকে। তার সেই দৃষ্টি জায়িন লক্ষ করে হেসে ফেলল, ‘কষ্ট হচ্ছে রেজা? ভীষণ পছন্দ করতে?’
হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠল রেজা, ‘আপনি কখন এসে বসলেন স্যার? আমি তো টেরও পাইনি।’
জায়িন উত্তরে নীরবে শুধু হাসলই। রেজা তার সেই হাসির অর্থ বুঝে একটু লজ্জা পেল। বলল, ‘আপনি কী করে বুঝতে পারেন স্যার, মানুষের স্বরূপ?’
-‘আমার বিশেষ কিছু গুণ আছে রেজা। আর সেই গুণগুলোর জন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে কী বলা হয় বলো তো?’
-‘সিন্ধুইগল।’
বলেই হেসে উঠল রেজাও, জায়িনের সঙ্গে। রেজা বলে উঠল, ‘আমি যখন প্রথম ডিপার্টমেন্টে জয়েন করি, তখন থেকেই আপনাকে নিয়ে আমি দারুণ এক্সাইটেড ছিলাম স্যার। তারপর যখন শুনলাম আমাকেই আপনার অ্যাসিসট্যান্ট রাখা হলো, আমি প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলাম। আপনাকে কেন সিন্ধুইগল বলা হয়, তা আবিষ্কার করতে পারব জেনেই খুশিতে আমার ঘুম উড়ে গিয়েছিল। মাসের পর মাস আপনি সমুদ্রে কাটান, ইগলের মতো ভীষণ ধূর্ত, সাহসী আর ভয়াবহ তীক্ষ্ণ নজর আপনার, এসবের গল্প শুনতে শুনতে যখন তা আপনার সঙ্গে থেকে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম তখন সত্যিই আমি বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সিন্ধুইগলের স্বভাবের সাথে এসবের থেকেও আপনার বড়ো মিল পেলাম, যখন দেখলাম আপনার শিকার ক্ষমতা। যার দিকে আপনার নজর একবার গাঁথলে তার আর আপনার থেকে রেহাই নেই। সে যদি অন্য কারও হয়ে থাকে, তবুও আপনি সেই অন্যের জিনিসকে ছিনিয়ে নিজের খাদ্য বানিয়ে নেন। একদম সিন্ধুইগলের মতোই। কিন্তু স্যার, মৌপ্রিয়ার ব্যাপারে আপনি সব জেনেও কেন বিয়েটা করেছিলেন? তাহলে বেচারিকে আজ মরতে হতো না।’
এ পর্যায়ে জায়িন গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘ওকে আমি বিয়ে করেছিলাম? বিয়ে করলে ওকে মারতাম?’
-‘এটা কীভাবে সম্ভব স্যার? আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম আপনার বিয়ের মুহূর্তে।’
-‘আমাকে কবুল বলতে শুনেছিলে?’
-‘না, তা শুনিনি। আমি আর আপনার আব্বা, ভাইয়েরা আসার পূর্বেই আপনি নাকি কবুল বলেছিলেন। আচ্ছা বুঝলাম, আপনি তাহলে মিথ্যা বলিয়েছিলেন কাজিকে দিয়ে। কিন্তু কাবিননামাতে আপনার স্বাক্ষর নিতে দেখেছি আমরা সবাই।’
-‘কাজিকে নিয়ে এসেছিল কে বলো তো?’
-‘আপনার বন্ধুরা হয়তো।’
-‘সব কিছুই ফেক ছিল। জায়িন মাহতাব জেনে শুনে এমন একটা নষ্ট মেয়েকে বউ করবে? আমার বিবি হবে এমন অন্যের খাওয়া জিনিস?’
-‘এসব তো আপনি চাইলে বিয়ের আগেই আপনার আব্বাকে জানাতে পারতেন।’
-‘জানাইনি দু’টো কারণে। এই যে আজকের পর থেকে আমার আব্বা আমার সামনে দাঁড়াতে অপরাধবোধ করবেন, তার সিদ্ধান্ত, আদেশ, হুকুম আমার ওপর চালাতে দু’বার ভাববেন। আর আরেকটা কারণ হলো, ওই মুহূর্তে আমি বললেও আব্বা বিশ্বাস করতেন না। সময়টা এমন ছিল তখন, পৃথিবীর সব থেকে অপরিচিত মানুষকে তিনি বিশ্বাস করলেও আমাকে করতেন না। আব্বাকে এই চরম শিক্ষাটা দিতেই তখন জানাইনি।’
-‘বুঝতে পারলাম। কিন্তু ওকে খুন না করলে হতো না স্যার? মেয়েটা আপনাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল।’
প্রশ্নটা শুনে জায়িন হাসতে হাসতে বলল, ‘ভালো তো আমাকে ফারজানাও বাসে, আমার শ্রদ্ধেয় সিনিয়র অফিসারের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী রাজিয়াও বাসেন, আমার সহকর্মী মিস সিফাতও বাসে। সবাইকেই কি মনে ঠায় দেবো রেজা?’
-‘এদের মাঝে সিফাত কিন্তু পিয়োর ছিল স্যার।’
-‘পিয়োর হলে বিয়ের আগেই আমার সঙ্গে ঘুমাতে আসত? আর মৌপ্রিয়ার অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতক। আমার আব্বা আম্মা সরল মনের মানুষ। আর সেই সরলতার সুযোগ নিয়ে ও ওনাদেরকে ঠকিয়েছে। আমি পৃথিবীতে কিছু শ্রেনীর মানুষকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি। তাদের মধ্যে এই বেঈমান শ্রেণীর মানুষকে সব থেকে বেশি। ওর কলিজায় সাহস কতখানি! সেটাই এই নয় মাস যাবৎ দেখে এলাম। তবে ওর কপাল ছিল। বাস্তবে না হলেও মিথ্যামিথ্যি তো মাহতাব শেখের বাড়ির বউয়ের পরিচয় পেয়েছে। আমার বাচ্চার মা হওয়ার সাধ ছিল ভীষণ! হাহঃ! আমার বিবি হওয়ার যোগ্যতা রাখে সেই নারীই, যার শরীরে প্রথম গভীর স্পর্শ থাকবে আমার। যে আমার হ্যান্ডসাম লুক, আমার পরিবারের অর্থশালী অবস্থা দেখে ঘায়েল হবে না। ঘায়েল হবে আমার ভালোবাসা দেখে।’
-‘আপনার সঙ্গে না থাকলে এই বিচিত্র নারী জাতিকে আমার চেনাই হতো না স্যার। চারপাশে তাকালেই খালি মনে হয় সব দুই নাম্বার। সলিড আর পিয়োর বলে কিছু আছে কি?’
-‘জায়িনের জন্য অবশ্যই আছে রেজা। জায়িন ঠিক খুঁজে নেবে। এখন গাড়ি ঘোরাও বাসার দিকে।’
-‘বাসায়? আজ রাতে না ফারজানা ম্যামের কাছে যাবেন?’
জায়িন মিটিমিটি হাসতে হাসতে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। চোখদু’টো বুজে বলল, ‘তোমার ফারজানা ম্যামের দেওয়া মধু দুপুরের পরেই খেয়ে এসেছি। এখন আমার চোখের আরাম চায়।’
কথাটা বলতে বলতে জায়িন চোখের পর্দায় উপস্থিত করল গতরাতের মেয়েটিকে। যার ব্যায়াম করা মুহূর্তটুকু দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে বিনা অসুবিধায় দেখে গেছে। যাকে আজ সারাটাদিনেও এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি সে। বারবার খুঁজে চলেছে সেই অপরিচিত মুখটির মাঝে তার ভীষণ চেনা বস্তুটিকে। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছে না সে, সেই চেনা বস্তুটি কী?
_______