#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১১
বিবশ শরীরে রাদ এখনো বাইকে থম মেরে বসে, ওর মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন ধপ ধপ করছে। রাদ শান্ত গম্ভীর মানুষ। অথচ আজ আদি ওর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আগের বুলিগুলো আওয়ালে হয়তো সম্মুখেই পুঁতে ফেলতো! বেঁচে গেলো। রাগান্বিত রাদের বলিষ্ঠ হাতের চাপে মুঠোফোন এবং হাত দু’টোই কাঁপছে। রাগ, হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে রাদের অচিরেই! মাগরিবের আজানের মধুর ধ্বনিতেই রাদ আকস্মিক সম্বিৎ ফিরে! অর্থাৎ দীর্ঘ লম্বা শ্বাস টেনে মনে মনে আল্লাহর কাছে একটাই পার্থনা করে রাদ,” ওর ইরানী যেভাবেই থাকুক অন্তত যেন সুস্থ এবং ভালো থাকে। দ্রুত যেন সব ঠিক হয়ে যায়।”
রাদ বুঝতে পারছে ইরা ওদের সম্পর্কের বিষয়ে বাসায় জানিয়েছে। নাহলে আদির হাতে ইরার ফোন থাকা অসম্ভব ব্যাপার। থাকলেও ওকে জানিয়ে দিতো ইরা। যেহেতু জানায়নি মানে বাসায় অবশ্যই কিছু হয়েছে। কিয়ৎক্ষন আগেই রাদের মন নেগেটিভ ভাবছিলো সেটাই সত্যি হলো। রাদের রাগ পরে গিয়ে মনে দানা বাঁধে একরাশ ভয়, আশঙ্কা! ওরা কী জোড় করে ইরার বিয়ে দিয়ে দিবে আদির সঙ্গে? আদি এতটা কনফিডেন্টলি কথাগুলো বলছিলো। রাদের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে বাইকটাও নিজে চালিয়ে বাসায় যেতে পারবে না। রাদ গাঢ় ঢোক গিলে। হৃদয়যন্ত্র’টা অসম্ভব ভাবে ধড়ফড় করছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট জোড়া বিজিয়ে নিলো। গলাটা শুষ্ক লাগছে। ওর হাত জোড়া শঙ্কায় মৃদু কাঁপছে। কে বলে ছেলেরা ভয় পায় না। রাদের আজ ভীষণ ভয় করছে। উন্মনা হয়েই কাঁপা হাতে বাইক স্টার্ট দেয় বাসায় চলে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই মুহূর্তে বাহিরে থাকলে রাদ অঘটন একটা ঘটিয়েই ফেলবে! যেটা সুখ বয়ে আনবে না।
_______________
রাত প্রায় ১২-টা বাজে, আজকাল এতো সুন্দর চাঁদ উঠে আকাশে৷ কখনো মাখনের মতো মেঘের ভাঁজে ভাঁজে লুকোচুরি খেলে, কখনো সগৌরবে গোল বৃত্তটি স্বচ্ছ নীল আকাশে চুপটি করে বসে থাকে। তখন শুধু অবাক নেত্রে দেখতে ইচ্ছে করে চন্দ্রসুন্দরীর মোহমুগ্ধ, বিমুগ্ধ রূপ!
বাগানে বিশাল বিশাল আম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রুপালী চাঁদের দ্যুতি যেন ভিন্ন এক খেলায় মেতে থাকে। এ-ই যে একটু হাত বাড়ালে চক্ষে বিঁধে কোথাও চাঁদের রশ্মিতে সব পরিষ্কার, স্বচ্ছ। যেন হাত থেকেই দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আবার কোথাও আঁধারে ঘেরা! সব অন্ধকার! কী অদ্ভুত। দিন-রাত্রি দু’টোই যেন রোজ রোজ দেখা একটি বিস্ময়কর ম্যাজিক। যেই ম্যাজিকে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ একটু গভীরে ভাবলেই এটি চমৎকার এবং বিস্ময়কর!
আদি উন্মনা হয়ে দাঁড়িয়ে সেই আম বাগানে, যেখানে কিছুদিন পূর্বে প্রেমে মত্ত্ব ছিলো দু’টো মানব-মানবী। আদি ভেবে যাচ্ছে সব এলোমেলো ভাবনা। ওর ভীষণ রকম কষ্ট হচ্ছে দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। চক্ষুদ্বয় বারবার রক্তিমবর্ণ ধারণ করছে। পৃথিবীর সব বড্ড নগন্য মনে হচ্ছে, আবার কখনো সেটাই বিস্ময়কর ঠেকছে। এসব ভাবনার একটা-ই কারণ আজ আদি বড্ড এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। উন্মনা হয়েই ইরার ফোনটা হাতে নিয়ে লক খুলে গ্যালারিতে যায় আদি৷ ওখানে সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা করার সময় ইরা, রাদের সঙ্গে কিছু সেলফি নিয়েছিলো। আদি জুম করে রাদ’কে দেখলো খুটিখুটিয়ে। এক দেখায় ছেলেটাকে ভদ্র ফ্যামিলির, এবং ভালো ছেলে মনে হচ্ছে। নিঃসন্দেহে চমৎকার দেখতেও ছেলেটা। ফর্মাল পোশাকে নিমজ্জিত বলে কী? দেখেই মনে হচ্ছে বড় অফিসের বড় কর্মকর্তা সে! তবে ইরার সঙ্গে বেমানান লাগছে ছেলে’টাকে। ইরার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণের, অথচ ছেলেটা একদম ফর্সা! চক্ষে বিঁধে গেলো সেটা। আদি ভারাক্রান্ত হয়ে ভাবনায় পরে গেলো। এই সুদর্শন ছেলেটা ইরা’কে কেন ভালোবাসে?
ইরার সঙ্গে বিয়েতে প্রথমে রাজি ছিলোনা আদি এর কারণ সম্পর্কে বোন, এবং ইরা’র গায়ের চাপা রঙ দু’টোই বড়সড় কারণ ছিলো। কিন্তু সেটা কাউকে বলেনি আদি। ইরা’কে ও অনেকটা অন্য চোখেই দেখতো ছোট বেলা থেকে। হয়তো বোনের চোখেই দেখতো না ও৷ মনে হতো এ-ই মেয়ের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। কোনও কিছুতেই ইরা পার্ফেক্ট নয়। পড়াশোনাটাও ওর ভয়েই করতো এ-ই মেয়ে। আলাদা করে ওর কোনও গুণ নেই। তবে ইরা মিশুক, প্রাণবন্ত মেয়ে। সেটাও আদির কাছে ইরেটেটিং লাগতো এতো কথা বলে মেয়েটা। সব মিলিয়ে ওর অবজ্ঞার পাত্রী ছিলো ইরা। কিন্তু ঐযে অন্য চোখে দেখতো আদি ইরা’কে, ইরার মায়ায় আঁটকে গিয়েছিল ও আসলে বহু আগেই। কিন্তু ওর মস্তিষ্কে ইরা’কে নিয়ে ছিলো অনেক অপছন্দের মেলা। তা-ই এসবে কখনো পাত্তাই দেয়নি আদি। কিন্তু বাবা বিয়ের কথা বলতেই মস্তিষ্ক হেরে গেলো। এতো এতো অপছন্দের কারণ থাকতেও মন জিতে গেলো। মেয়ে’টাকে ভালোবাসে আদি! সেটাও অনেক আগে থেকে! শুধু বুঝতে পারেনি বা বুঝার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু ইরার কাছে আজ আদি শুধু মাত্র ঘৃণার পাত্র। এবং এই ছবিগুলো প্রমাণ করছে ইরা ওর থেকে ব্যাটার ডিজার্ভ করে এবং ও সেরকম কিছু জীবনে খুঁজেও পেয়েছে! ইরার জীবনে আদির কোনও জায়গা অবশিষ্ট নেই!
আদি একরাশ দমবন্ধ অনুভূতি নিয়েও ইরা, রাদের একের পর এক ছবি দেখতে লাগলো। প্রত্যেকটি ছবিতে ইরা, রাদের প্রাণখোলা হাসি আদির বক্ষঃপঞ্জর ছিন্ন’ভিন্ন খ’ণ্ড’বিখ’ণ্ড করতে যথেষ্ট! হৃদয়ে সূক্ষ্ম ব্যাথা তিরতির করে বাড়ছে। ইরা কখনোই এভাবে ওর সামনে হাসেনা৷ এতটা সান্নিধ্যেও আসেনি! ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যতই ছবি গুলো দেখছে খারাপ লাগা কয়েকশো গুণ বাড়ছে। ধীরে ধীরে কষ্ট গুলো রাগে, জেদে পরিনত হচ্ছে। মনে মনে জেদ চাপছে ও কখনো ইরার বিয়ে এই ছেলের সঙ্গে হতে দিবেনা। কিছুতেই না। আদি রাগী, বদ-মেজাজি মানুষ। ওর স্বভাব সুলভ ভেবে আদি হনহনিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো!
____________
আফরোজ ছেলের অপেক্ষায় ডাইনিং এ বসে। আদির রাগ সম্পর্কে সবাই অবগত। সেই জন্যেই ইরার রুমের দরজা খোলার সাহস হয়নি কারোর-ই। কিন্তু মেয়েটা সে-ই সকালে খেয়েছিলো এখনো অভুক্ত! সবাই-ই রেগে শুয়ে পড়লেও আফরোজ ইরা আদিকে না খাইয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারছেন না। উনি ইরা’কে কয়েকবার ডেকেছেন মেয়েটা কোনও রা, সারা দেয়নি। একে ছোট মানুষ, তম্মধ্যে এই সময় আবেগ অনুভূতি ভীষণ প্রখর থাকে। সামান্য ধমক গায়ে বাঁধে। সেখানে আজ প্রথমবারের মতো বাড়ির ছেলে হাত উঠিয়েছে মেয়েটার উপর। নিজের ক্ষতি করে ফেলল নাকি সেটা নিয়েও বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন আফরোজ।
উনার রাশি রাশি ভাবনাচিন্তা অবসান ঘটিয়ে আচমকা সশব্দে আদি মেইনডোর খুলে বাড়ি’তে প্রবেশ করে। আফরোজ শব্দ শুনেই বুঝলেন ছেলে এসেছে। ঠাওর হলো ছেলে এখনো যথেষ্ট রেগে! মায়ের মন সন্তানের ভাবভঙ্গি বুঝতে সময় ব্যায় করতে হয়না। আদি নিঃশব্দে ডাইনিং পেরিয়ে সোজা রুমে ঢুকে গেলো। চিন্তিত মায়ের উপরেও ওর গম্ভীর দৃষ্টি একবারের জন্যেও পড়েনি।
চিন্তিত আফরোজ আরও আধঘন্টা বসে রইলেন। আদি যখন ফ্রেশ হয়ে মাত্র বিছানায় গিয়ে বসেছে হয়তো। তখন ছেলের মতিগতি বুঝেই পরে ধীরপায়ে আদির রুমে ঢুকে দেখলেন। ছেলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আফরোজ ছেলের সম্মুখে বিছানায় বসলেন নরম, কোমল হাতটা ছেলের পায়ে রাখলেন। আদি চমকে উঠে চক্ষুমেলে চায়। ঘটনা বুঝে তৎক্ষনাৎ দ্রুত মায়ের হাত ধরে রাগান্বিত গলায় শুধায়,
—” কী করছো মা, তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন!”
আফরোজ ছেলের মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পারলেন উনার ছেলেও ভালো নেই। আজকে ইরার ব্যাবহারে কষ্ট পেয়েছে ভীষণ! তবুও উনি নরম গলায় বললেন,
—” যা হওয়ার হয়ে গেছে বাবা। তুই খেয়েনে। মেয়েটা এখনো রুমবন্দী কিছু খায়নি। এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে না মেয়েটা!”
ইরার কথা শুনে আদির ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো আদি। কণ্ঠে রাগ ঢেলে বিষণ্ণ, গম্ভীর গলায় বলল,
—” একরাত না খেয়ে থাকলে মরে যাবে না ও। ছোট বাবা ছোট মাও নিশ্চয়ই খায়নি। ওরা কী মরে যাচ্ছে? ওদের কষ্ট হচ্ছে না? ”
আফরোজ বেগম ছেলের অভিমান, রাগ ধরতে পারলেন। কিন্তু ইরা কী কখনো আদির মন বুঝবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি ক্ষীণ আওয়াজে শুধালেন,
—” ইরা সে-ই সকালে খেয়েছিলো। মেয়েটা ইদানীং এমনিতেই ঠিক মতো খায়না। সেদিনও মাথা ঘুরিয়ে পরে যাচ্ছিলো। আমি বরং একটু ওকে দেখেই আসি?”
আদি রুদ্ধশ্বাস ফেলে। জোড়ালো গলায় বলে,
—” মা আমি এমন করতে চাইনি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ওকে আগলে রাখতে পারিনি? আমার ছায়াতলে থেকেও ইরা এসব কী করে করলো!”
আদির কণ্ঠে হতে স্পষ্ট আফসোস, হতাশা ঝরে ঝরে পড়ছে। আফরোজ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কিঞ্চিৎ হতাশ গলায় বললেন,
—” পাহারা দিয়ে কী ভাগ্য বদলানো যায় বল? যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই এভাবে মেয়েটার সাথে রাগ দেখালে হবে? ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছে। খাবারটা অন্তত দিয়ে আসি বাবা!”
আদির রাগ উঠে গেলো! আচমকা চিল্লিয়ে উঠলো,
—” মা একদম ওর হয়ে দরদ দেখাতে আসবে না। কান খুলে শুনে রাখো, আসবে না। যাও ঘুমিয়ে পরো!”
বলেই আদি উঠে বসে লম্বা লম্বা দম ফেলে। ছেলে’কে বুঝাতে এসে নিজেও হাল ছেড়ে দিলেন আফরোজ। রাগ হলো উনার আদির এহেন জেদ দেখে। এই ছেলেটাকেও সবাই আদরে আদরে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন৷ যার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। উনি রাগ সামলাতে পারলেন না কড়া গলায় বলে উঠলেন,
—” বিয়ে করতে আমাদের কথাতেই রাজি হয়েছিলি। তুই তো ইরা’কে পছন্দ করতিনা। তাহলে এতো কিসের রাগ তোর। এই রাগ জেদ না তোকে ধ্বংস করে দেয় বাবা। ”
আফরোজ সশব্দে হেঁটে রুম ত্যাগ করলেন। আদি মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ছাইচাপা রাগ দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। কেউ কেন বুঝতে পারছে না ওর কষ্টগুলো। আদির বুক জ্বলে যাচ্ছে, আঙ্গার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। মা ঠিক বলেছে ও ধ্বংস হ’য়ে গেছে। এই রাগ, জেদের জন্যেই ইরা’কে নিজের ভালোবাসার সাথে পরিচয় করাতে পারেনি। ও ব্যার্থ! ভাই হিসেবে ব্যার্থ, প্রেমিক পুরুষ তো ও নিজেকে বলতেও পারবেনা। শাসিয়ে, রাগ, জেদ অধিপত্য দেখিয়ে আর যাইহোক ভালোবাসা হয় না। আদি আজ আবিষ্কার করলো, ও ভালোবাসতেই জানেনা। আগলে রাখতে জানে না। ভালোবাসা কী সেটাই হয়তো আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি! অন্তর বিষিয়ে উঠলো আদির। নিজেকে তিরস্কার করতে সময় ব্যায় করে না ও।
_______________
রাত প্রায় ১-টায় আদি ইরা’কে দেখতে ওর রুমে এলো। আফরোজ তখনও ডাইনিং এ বসে কাঁদছিলো। মেয়ের জন্য কাঁদছিলো, না নিজের ছেলের জন্য, আদি জানেনা। মায়ের কান্নার ফলস্বরূপ মা’কে দেখিয়ে প্রথমে নিজে খেয়েছে। এবং বাধ্যতামূলক মা’কে শান্ত করতে ইরার জন্য খাবার নিয়ে ওর রুমে এসেছে।
ইরা বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে তখনও কাঁদছিলো বসে বসে। নিঃশব্দে ক্রন্দনতর ইরা যখন আদিকে রুমে ঢুকতে দেখলো। সশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো। আদি দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিলো যেন ওর কান্না আজমল খানের কর্ণধার না হয়। তাহলে আদির রাগ আদির উপরেই ভীষণ ভারী পড়বে। ইরা’তে উনি চরম ভাবে দূর্বল। এটা ওদের চোদ্দগুষ্টি শুদ্ধ মানুষ জানেন। শুধু ছোট্ট ফুপি এই মানুষটা এসবের পরওয়া করেন না। তবে শুধু মাত্র আজমল খানের জন্যেই আদি ইরা’কে পেয়েও হয়তো পাবে না। তিক্ততা ভর্তি ভাবনা গুলো আর ভাবতে পারলো না আদি!
খাবার প্লেট ইরার পড়ার টেবিলে রেখে আদি ইরার সম্মুখে গিয়ে বসলো। আদির বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে মাত্রাঅতিরিক্ত ভাবে। যাইহোক কেউ কখনো ইরার উপর হাত উঠায়নি অথচ আজ মেরেছে। তখন ছোট মায়ের আঘাত দেখেই আদির রাগ হচ্ছিলো। এখন নিজেকে আঘাত করতে ইচ্ছে করছে নিজেও একি কাজ করেছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলস্বরূপ ইরার শ্যাম মুখশ্রীর বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ, পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে। না খাওয়া মুখটা ভয়ে চুপসে আছে। ওকে এভাবে দেখে আদির বক্ষপিঞ্জরের জ্বালাপোড়া অনুভূতি তীব্র যন্ত্রণার রূপ ধারণ করলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো আদি কাঁপা কাঁপা হাতে। ইরা আকস্মিক ঝাপিয়ে পরলো আদির বুকে। হু হু করে কাঁদছে মেয়েটা। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। কান্নার তোড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অস্পষ্ট, গলায় বার বার বলছে,
—” স্যরি ভাইয়া, আমি তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনি..আমি।”
ইরা কান্নার ফলস্বরূপ কথা বলতে পারছে না। আদি ইরার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। তৎপরে মাথায় চুমু খেলো। ক্ষীণ আওয়াজে ভরাট গলায় বলে,
—” এসো আমার সঙ্গে, খেতে হবে।”
আদি ওকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ইরা ঝাপসা দেখছিলো চক্ষে। আদি ওকে ধরে নিজেই চোখে, মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। কিছুটা ধাতস্থ হয় ইরা আদির অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাবহারে! সব থেকে বড় কথা এতকিছুর পরেও আদি ওকে তুমি সম্মোধন করেছে মানে আদি সম্পূর্ণ আদি রূপে আছে। পূর্ণ রূপটা যে ওর রাগী, গম্ভীর, এবং বদমেজাজি। ইরা শান্ত হয় অনেকটা। চক্ষুদ্বয় সহ সম্পূর্ণ মুখ ফুলে গিয়েছে ইরার কাঁদতে কাঁদতে। সারাদিন অভুক্ত মেয়েটা টলছিলো রীতিমতো। আদি কাঁপতে থাকা ইরা’কে ধরে রুমে নিয়ে যায়। বেডে বসিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে, নিজ হাতে ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। ইরার যদিও খাবার গুলো গলা দিয়ে নামতে চাচ্ছিলো না ভয়ে, আতঙ্কে। তবুও চুপচাপ খাচ্ছিলো৷ আদি এটা বুঝতে পেরেও অবিচল খাইয়ে যাচ্ছিলো। ইরার খাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি ছিলো। সেটা ইরা’কে দেখে উপলব্ধি করতে পেরেছে আদি। অথচ ওর মা, না দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছে সেটা। এর নাম মা! ইরা’কে সবটুকু খাইয়ে পানি খেতে দিয়ে আদি ক্ষান্ত হলো! গম্ভীর গলায় বলল,
—” শুয়ে পরো, আর হ্যাঁ। গায়ে হাত উঠানোর জন্য এক্সট্রিমলি স্যরি। ”
ইরার চক্ষুদ্বয়ে পুনরায় অথৈজল টলমল করছে! রুদ্ধশ্বাসে জমাটবদ্ধ গলায় কিছু বলতে চাইলো। আদি ওকে কিছু বলতে না দিয়ে পুনরায় গম্ভীর রাশভারী গলায় বলল,
—” আমাকে রিকুয়েষ্ট করতে হবে না। আমি জানি আমি বদমেজাজি মানুষ, ভালো না। আমাকে বিয়ে করা যায় না। তাই বলে আমার কথা শুনতে আমি কাউকে জোড় করিনি। বাবা যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি মাথা পেতে নিবো।”
ব’লে আদি প্লেট হাতে রুম থেকে বেরুতে উদ্বেগ হয়েও আচানক থেমে গেলো, পেছন ফিরে পূর্ণদৃষ্টিতে ইরার উৎসুক জনতা মুখে নির্মিমেষ নেত্র বিদ্ধ করলো। অন্যরকম গলায় বলল,
—” আমি রাগে অনেক কিছু বলি ইরা। কিন্তু কখনো তোমার খারাপ চাইনা! ওতোটা খারাপ না। যতটা তুমি ভাবো আমাকে। ”
বাক্য সম্পূর্ণ করে আদি এক মিনিট দাঁড়ায় না শশব্যস্ত পায়ে রুম ত্যাগ করে। আদির শ্লেষাত্মক বাক্যটি ইরার কানে ঝুমঝুম করে বাজতে লাগলো। ভীষণ করুণ, অপরাধীর ন্যায় শোনাচ্ছিলো আদির কন্ঠ’টা। কিন্তু ইরা আদি’কে নিয়ে দীর্ঘ প্রহর ভাবতে পারলো না। ওর মাথায় শুধু মাত্র ওর প্রাণপুরুষ ঘুরছে। আদি বলে তো গেলো বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। কিন্তু বিকেলে যে ওর ফোনের লক খুলে নিয়ে যায় আদি। নিশ্চয়ই কিছু করেছে ফোন দিয়ে। রাদ’কে উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি তো? যতই এই ছেলে করুণ গলায় কথা বলুক। ইরা জানে রাগলে আদির মাথা ঠিক থাকে না।
চলবে!
[ ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক করিনি!]