#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ৮
—” অনেক বৃষ্টি ঝড়ে তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দুচোখ ভড়িয়ে। ”
রাদ পুনরায় গাঢ় গলায় এক লাইন গায়। ইরা ‘হু’ ‘হু’ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু কাঁদছে। রাদের এক একেকটা মুখনিঃসৃত বাক্য ওর হৃদয়স্থলে তুলছে কাল বৈশাখী ঝড়! সেই ঝড়ের তোরে, প্রখরতায় ইরা ঝুমঝুমিয়ে কাঁদছে। রাদ ওকে কোনও প্রকার বাঁধা দিলো না কাঁদতে বরং মোহনীয় গলায় ঝংকার তুলে বলল,
—” তোমার দুঃখ গুলো দিবে আমায়, কিনবো আমি সুখের দামে!”
ইরা’র কাঁন্না ভারি বর্ষণের ন্যায় বেড়ে গেলো। ক্রন্দনরত, মলিন গলায় একরাশ মায়া ঢেলে বলল,
—” ভালোবাসি রাদ! আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি..!”
রাদ নিজেকে হয়তো আর সংযত করতে সক্ষম হলো না। আবেগী গলায় বলল,
—” হুঁশ, কেঁদ না ইরা, আমার কষ্ট হচ্ছে! তোমার কান্না আমার নিতে পারিনা তুমি ভুলে গেলে? ”
ইরা রাদের করুণ স্বর উপেক্ষা করতে পারলো না। নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে ও। রাদ আচমকা কেমন অদ্ভুত, আবেগ মিশ্রিত গলায় বলল,
—” ইরা? ”
—” হু!”
—” তোমাকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে, এক্ষুণি!”
ইরা হতবিহ্বল হলো এহেন আবদারে। এই রাতে কিভাবে? তবে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো না সেটা। আজ কেন যেন রাদের অনাকাঙ্ক্ষিত আবদার ফেলতে মনপিঞ্জর সায় দিলো না। ইরাও নাক টেনে ফট করেই ক্রন্দনরত মোটা গলায় বলল,
—” ঠিক আছে এসো। আমি অপেক্ষা করছি!”
রাদের নিজেকে বিশ্বাস করাতে সময় লাগলো না। ইরার সম্মতিসূচক জবাব’টা! ও সাবলীল এবং স্বাভাবিক। ওর বিশ্বাস ছিলো ইরা আজ ওকে ফিরিয়ে দিবে না। এটুকু বিশ্বাস তো ভালোবাসার মানুষের উপর থেকেই যায়। রাদ কয়েক সেকেন্ড ভেবে গাঢ় গলায় বলল,
—” একটা শর্ত আছে!”
ইরা দু’হাতে মুখ মুছে! নিজেকে সামলাতে নেয়। ম্লানমুখে বলল,
—” কী? ”
রাদ কিছুটা সময় নিলো! অতঃপর শান্ত গাঢ় গলায় বলল,
—” আমি তোমার সাথে কথা বলতে বলতেই আসবো। কতদিন পর কথা বলছি একদম লাইন কাট করতে ইচ্ছে করছে না!”
ইরার বুকটা কেঁপে উঠলো। হু হু করে উঠলো ওর ভেতরটা, রাদ শান্ত কিন্তু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। রাগ, জেদ, অভিমান কোনটাই কাউকে বুঝতে দেয় না। যদিও ইরার ক্ষেত্রে সেটা কিছুটা কম তবুও নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করতে খুব ভালো করেই জানে রাদ অথচ আজ ওর কথা গুলো কেমন অসহায়, করুণ। কতটুকু কষ্ট রাদ ওর ধারা পেয়েছে সেটা ও হারে হারে টের পাচ্ছে। তাতে অপরাধবোধ দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে। ইরা চোখে পানি! ঠোঁটে ম্লান হাসি ফুটিয়ে চাপা গলায় বলল,
—” আজ সারারাত কথা বলবো। তুমি এসো আমি লাইনেই আছি। ”
বহুদিন খড়ার পর, রাদের মনে আজ এক পলশা বৃষ্টি বয়ে গেলো। কতগুলো দিন পর ইরার মিষ্টি কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। মন চাইছে ওকে বক্ষঃস্থলে এনে বন্দী করে রাখতে। একটু একটু কথা বলতে যেন ফুড়িয়ে না যায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না। রাদ ঠোঁট কামড়ে ধরে। প্রসন্ন গলায় বলে,
—” তুমি না বললেও আমি আজ সারারাত কল কাটবো না। আজ আবার টাইম কাউন্ট হবে সেই আগের মতো কতঘণ্টা কথা হলো দেখবো।”
ইরা কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রশ্বস্ত করে হাসে। ঝুমঝুম গলায় বলল,
—” আচ্ছা, এবার এসো আমিও তোমাকে দেখতে চাই। জলদি এসো।”
—” আরে বাবা। এতো উতলা হচ্ছো কেন। এলেই তো চলে যেতে হবে। তাই ধীরে ধীরে আসি। এখন এক মিনিট দাঁড়াও আমি শার্ট পরে নেই। ”
রাদ যদিও এই কথাটা মুখে বলেছে আসলে ও নিজেই পাগল হয়ে আছে কখন প্রেয়সীর মিষ্টি মুখের দর্শন পাবে। ইরাকে কলে রেখেই শার্ট পরলো। আয়নায় নিজের চেহারা নিজেরই বিধ্বস্ত লাগছে। চোখ, মুখের ভীষণ করুণ অবস্থায় রাদ বিচলিত হয়ে পরলো। শার্ট খুলে ফেলল। এভাবে ইরার সম্মুখে উপস্থিত হলো মেয়েটা কেঁদে ভাসাবে। নিজেকে দায়ী করবে ওর করুণ অবস্থার জন্য! রাদ সেটা ভালো করেই জানে। একবার ড্রেসিং উপর রাখা ফোনের দিকে তাকিয়ে। রাদ তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।
ইরা বুঝতে পারলো সেটা ওয়াশরুমের দরজায় হওয়া মৃদুমন্দ শব্দে। ওর এসব সব মুখস্থ। ইরা নিজের বাসায় বসে থেকেও বলে দিতে পারবে ফোনের ওপাশে থাকা সুদর্শন ছেলেটা কী করছে। মুচকি হাসলো ইরা। ফোন কানে রেখেই ধীরে ধীরে বিড়াল পায়ে গিয়ে দরজা খুলে বাহিরে উঁকিঝুঁকি দিলো। এর পর বেরিয়ে সবার রুমের দরজার পরখ করলো। পরপর দ্রুত পদে নৈঃশব্দ্যে রুমে ঢুকে গেলো। মনে মনে প্ল্যান করে নিলো কিভাবে কী করবে। আজকে প্রথম ইরা রাদ বাসায় দেখা করবে! কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে অথচ সেটা দিয়ে কারোই বিন্দুমাত্র টেনশন নেই। বরং আপ্লুত কতদিন পর দেখা হবে!
রাদ ফ্রেশ হয়ে শুভ্র গায়ে একটা শুভ্র শার্ট জড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলো যথাসম্ভব। উপকারের ভাই কাশিশের সরকারি গাড়ি’টা নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্বেগ হওয়ার প্রহরেই। জুহা ঘুমঘুম চোখে হন্তদন্ত হয়ে উঠে ড্রইংরুমে উপস্থিত হলো! রাদকে অনেক দিন পর এমন পরিপাটি, গোছালো অবস্থায় রাত করে বাহিরে যেতে উদ্বেগ দেখে। চমকপ্রদ হলো ভীষণ। আহাম্মক হয়েই প্রশ্ন করে উঠলো,
—” কীরে, এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
রাদ অবিচল, সরল গলায় প্রতুক্তি করে,
—” ইরার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি!”
জুহা ভীষণ চককালো প্রথমে, পরমুহূর্তে মুখে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি। ছেলের এই পরিবর্তন দেখে মন থেকে এক বড় বোঝা নামলো। কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানেই যেন রাদ আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে দেখে চক্ষু জুড়িয়ে গেলো।
ফোনের ওপাশে জুহার উপস্থিতিতে ভয়ে ইরার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন যখন কয়েকগুণ বেড়ে! তখন রাদের সহজ স্বীকারোক্তি ওর পাংশুবর্ণ মুখটা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলো। পরপর শ্রবণে পৌঁছুলো জুহার, কিছুটা কড়া কিন্তু রসাত্মক আওয়াজ,
—” ও এতোদিনে মহারানী’র রাগ পরলো তবে! ওকে বলে দিস রাদ, একবার আসুক আমার পুত্রবধূ হয়ে। আমার ছেলে’কে কষ্ট দেওয়া! সব সুধ তুলবো আমি। ”
বলেই মুচকি হেসে ছেলেকে ইশারায় ‘গুড লাক’ বলে যেমনে এসেছিলেন, একি ভঙ্গিতে চলেও গেলেন। মায়ের বাচ্চামিতে রাদ ঝড়া হাসলো। ইরা হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
—” তুমি হাসছো? আন্টি আমার কথা কিভাবে জানলো? কী কিউট করে কথাও বলল। ঝাড়লেন আবার আদুরেও। ”
রাদ কিছু ব্যাঙ্গ করে আর্ত গলায় বলল,
—” কিভাবে জানলো জিজ্ঞেস করছো? তুমিই তো সেই কারণ! তোমার বিরহে সব উগলে দিয়েছি!”
রাদের কথার ভঙ্গিতে ইরা ঝুমঝুমিয়ে হেসে ফেলল। ইরা মৃদুস্বরে হাসির আওয়াজে প্রশান্তিতে রাদ চোখ বুজে ফেলল। ইরা যখন হাসে রাদের ইচ্ছে করে ওকে খে’য়ে ফেলতে। ইরার হাসির শব্দ রাদকে সেই শুরু থেকে মুগ্ধ, মোহাবিষ্ট করে দেয়। নিজেকে সামলে রাদ মেইন ডোর লক করে হেলে’দুলে হাঁটতে লাগলো। যেন ওর থেকে সুখী মানুষ আর কেউ নেই এই নিস্তব্ধ রজনীতে। হঠাৎ জুহার কথা রেশ ধরে গাঢ়, গম্ভীর গলায় বলল,
—” এত হেসবেন না। আপনার শাশুড়ি আম্মা আপনার খবর করুক আর না করুক। আমি কিন্তু ছেড়ে দিবো না!”
ইরা মোটেও ভয় পেলো না বরং বিষণ্ণ মুখশ্রী হলো উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। সেভাবেই হাস্যোজ্জ্বল, ঝলমলে গলায় মিষ্টি করে বলল,
—” হ্যাঁ আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক আদর করবে। ”
রাদ কিঞ্চিৎ ভয় দেখাতে চেয়েছিলো প্রেয়সী’কে। হলো উল্টো ওর নিজেরি গলা শুকিয়ে গেলো ইরার মিষ্টি মোহনীয় কণ্ঠে! এই মেয়ের কণ্ঠে’ই আল্লাহ সকল জাদু দিয়েছে। ইরার গায়ের রঙ শ্যামবর্ণের হলেও। ওর রেশম কালো চুল, গলার স্বরে মনে হয় সকল মায়া, সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। যে কেউ একবার শুনলে আরেকবার শুনতে চাইবে। ইরা রাদ’কে চুপ করে যেতে দেখে দুষ্টু হাসলো। রাদ পরাস্ত গলায় বলল,
—” পাজি মেয়ে। তবে যাই বলো মা কিন্তু তোমাকে মহারানী ডেকেছ, আমার ইরানী’কে। ”
ইরা অনেকদিন পর ইরানী ডাকটা শুনে পুনরায় ঝুমঝুমিয়ে হাসে শুধু অথচ চক্ষেজল থৈথৈ করছে। খুশির অশ্রু। দু’জনের মনে হচ্ছিলো তখন ওদের জীবনে কোনও দুঃখের ছোঁয়া নেই। ওদের থেকে সুখীও আর কেউ নেই। সকল মন খারাপ, বিষণ্ণতা, অসহায়ত্ব যেন এক পলকেই ভালোবাসার তীব্র ভারি বর্ষণে ধুয়েমুছে চলে গিয়েছে। দু’জনের কথার মধ্যেই রাদ এসে পৌছে গেলো ইরার এলাকায়। রাত তখন প্রায় মধ্যপ্রহরে। চাঁদ মামা তখন স্বগর্বে মাথার উপর ধাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ছড়াচ্ছে এক মহনীয় আলো। রাদ ইরার বাসায় তিন রাস্তার মোড়েই গাড়ি পার্ক করে ইরাকে বলল,
—” আমি তো চলে এসেছি আমার ইরানী। এখন আপনি জলদি দেখুন। আপনার বাড়ীর জল্লাদ মানুষ গুলো কী করছে!”
ইরা কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
—” পঁচা ছেলে। আমি তোমাকে বললেই সোজা বাড়িতে ঢুকে যেও। ”
রাদ আশেপাশে তাকাতে তাকাতে ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
—” বাড়িতে যাবো। প্রবলেম হবে না তোমার?”
ইরা তৎপর হয়ে আশ্বস্ত গলায় বলল,
—” চিন্তা করো না। আমি যা বলছি সেটা করো৷”
রাদ ইরার উপর ভরসা রেখে শান্ত গলায় বলল,
—” ওকে!”
ইরা তখন রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সব নিস্তব্ধ। এমনটাই ও আশা করছিলো। গুটগুটি পায়ে সবার রুমের দরজা ও বাহির থেকে লাগিয়ে দিলো।
ইরাদের বাসা একতলা বিল্ডিং। দুপাশে দু’টো ফ্ল্যাট সিস্টেমে বাড়িটি তৈরি হলেও ওরা যেহেতু স্বপরিবার থাকে তাই নিজেদের মতো করে দুইটা ফ্ল্যাট এক করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। তবে বাড়িটি বিশাল। শুভ্র টাইলস ধারা ঝকঝকে তকতকে! বাড়ির দুই বৌ বাড়িটি সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে সর্বদা।
বাড়িতে ঢুকেই সর্বঘরের সম্মুখে ওদের ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমের পিছনেই কিচেন। কিচেনে বাম, ডান দুইদিক দিয়েই যাওয়া যায়। ড্রইংরুম, ইরা মিতী, এবং আদির রুম এক পাশে। এবং ওপর পাশে বড়দের রুমের পাশে একটি গেস্টরুম। সিঁড়ি কোঠার দুইপাশেই মূলত ড্রইংরুম, এবং গেস্টরুম। এই দুই রুম সর্বদা খালিই থাকে মেহমান না আসলে। এবং ওদের প্রতিঘরেই ওয়াশরুম আছে। তাই রাতে অতিপ্রয়োজন ছাড়া কারো রুম থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন পরে না। তবুও ইরা বাহির দিয়ে দরজা লাগিয়ে নিয়েছে। কেচি গেইটের চাবি সব সময় মেইন ডোরের পাশেই ঝুলানো থাকে। সেটা হাতে তুলে নিলো। এবং বাড়ি থেকে বের হওয়ার আরও একটি দরজা যেটা ড্রইংরুমে। ইরা মেইন ডোর না খুলে ড্রইংরুমে দরজা খুলে বের হলো। সামনের কেচি গেইট খুলতেই যা সমস্যায় পরলো। তবুও একবুক সাহস নিয়ে ধীরে ধীরে তালা এবং সময় ব্যায় করে নৈঃশব্দ্যে কেচি গেইট খুলে বের হলো ও। এবং ফোন কানে রেখে ফিসফিস করে রাদ’কে বলল,” ভিতরে চলে এসো সোজা।” ইরা রাদ একটিবার ভাবলোও না এই মুহূর্তে যদি কেউ একজন উঠে যায় তবে কী হবে? বা হতে পারে?
বাসার সম্মুখে ছোট্ট খোলা আঙ্গিনা যার একটু সামনে পুরনো একটা গেইট। বাড়ির সম্মুখে চার দিকে রেলিং দেওয়া হলেও। ওদের বাড়ির পিছনে আম গাছের বড়সড় বাগান আছে। সেদিকটা পুরোপুরি খোলামেলা। রাজশাহীর বিখ্যাত কিছু আমের গাছে ভর্তি করা এই বাগান। ইরা রাদকে বাড়িতে ঢুকিয়ে সেখানেই নিয়ে গেলো।
দু’জনের মনেই আছে একটু ভয় তো একরাশ উত্তেজনা। এবং প্রিয় মানব মানবীর দেখা পাওয়ার প্রাপ্তি! ইরা রাদের হাত টেনে বাগানের কিছুটা ভিতরে নিয়ে যেতে লাগলো।
চাঁদের আলোয় সর্বত্র ঝলমল করছে। ওরা বাগানে যেতেই গাছের ফাক ফকর দিয়ে চাঁদের তীর্যক আলো ওদের সাথে লুকোচুরি খেলতে লাগলো!
যেতে যেতেই হুট করে দাঁড়িয়ে আচমকা রাদের বুকে হামলে পরে ঝুমঝুমিয়ে কেঁদে উঠলো ইরা। সেই পরিচিত ঘ্রাণ কতদিন পর পেলো ইরা। বারবার অস্থিরচিত্তে শ্বাস টেনে নেয় ও। রাদ অন্য সময় হলে ইরাকে নিজে বাহু থেকে সরিয়ে দিতো। কিন্তু আজ সবকিছুই কিঞ্চিৎ ভিন্ন। রাদ ছাড়াছাড়ির বদলে ইরা’কে বাহুবন্ধনে আরও আড়ষ্ট করে নেয় নিজের সাথে। এবং ঠোঁট প্রশ্বস্ত করে স্মিথ হেসে। বিগলিত গলায় বলে,
—” আমার ইরানী আরও সুন্দর হয়ে গিয়েছে। ”
ইরার চোখ মুখের অবস্থা করুণ, বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ। শ্যাম মুখটা যেন অসহ্য যন্ত্রণায় পুড়ে গিয়েছে আরও। রাদ ইরাকে সর্বদাই কনফিডেন্ট রাখতে চায় তাই এমন করুন অবস্থা দেখেও পজিটিভ কথাই বলল। যদিও ইরার শুকনো মুখটা দেখে ওর ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে। এবং ইরা নিজেও জানে সত্যিটা কী? ও ক্রন্দনরত অবস্থায় চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল,
—” তোমার চোখে ধূলো পরেছে! রাদ আমি আরও কালো হয়ে গিয়েছি। আমাকে তোমার পাশে একটুও মানাবে না। তুমি কত সুন্দর! ”
রাদ শুধু স্মিত হাসে কিছু বলেনা। ইরা বরাবরই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে নিজের গায়ের রঙ নিয়ে। রাদ অতিরিক্ত ফর্সা। ঠিক ওর মায়ের মতো জুহা’কে এখনো দেখলে বুঝা যায় ও কিশোরী কালে আগুন সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু রাদের বাবা ছিলো কুচকুচে কালো। রাদ ওর বাবার কোন বৈশিষ্ট্য পায়নি দুর্দান্ত, দুর্বোধ্য ব্রেইন ছাড়া। পড়াশোনায় রাদ মারাত্মক। রাদ লম্বাচওড়া কিছুটা শুকনো ধাঁচের ছেলে। তবে ওর বলিষ্ঠ পেশিবহুল দেহটা যেন এমনই সুন্দর। ফর্সা লম্বাটে মুখ, কালো কুচকুচে সরু ভ্রুঁদ্বয়ের নিচে তীক্ষ্ণ কালো চোখ, তীক্ষ্ণ সরু নাক, পিচ রঙা ঠোঁট, ঝরঝরে সিল্কি চুল। উঁচু গ্রীবাদেশে তীক্ষ্ণ কণ্ঠনালীটা যেন ওর সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এক কথায় সুদর্শন পুরুষ। অন্যদিকে ইরা রাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। শ্যামাঙ্গিনী সুন্দরী মায়াবতী ইরা। যার রেশম কালো লম্বা ঘন ক্যাশ ছাড়া ওর কিছু নেই। সেটা নীলা বেগম নিজেই বলেন মাঝেমধ্যে। তবে বরাবরই রাদ ওর মিষ্টি কণ্ঠর হাসি, গোলগাল মায়াবী মুখশ্রী এবং ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট ছোট ছোট চোখ, বোচা নাকের প্রশংসা করে এসেছে। রাদ সর্বদা বলে ইরাকে নাকি এভাবেই মানায় বরং সুন্দর হলে রাদের মতো সাদা বিড়াল লাগতো! ওর কাছে শুভ্র মানেই সুন্দর নয়। যেন ইরার কালো গায়ের রঙে ওর কিছুই আসে যায় না।
রাদ’কে নিশ্চুপ দেখে। ইরা রাদের বুক থেকে মুখ তুলে। চোখে মুখে অশ্রুবর্ষণ নিয়ে রাদকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো। এর ফাঁকে ইরার কোনও কথায় পাত্তা না দিয়ে রাদের কয়েকদফায় ইরার কপাল জুড়ে চুমু খাওয়া শেষ। এখন ইরার খোলা চুলে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ডুবিয়ে ইরার শরীর থেকে ভেসে আসা এক অদ্ভুত মাতাল করা সুভাষ নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে নিতে ব্যাস্ত সে। ইরা নিজের মতো করুণ গলায় বলল,
—” তুমি শুকিয়ে গেছো রাদ! কী অবস্থা করেছো নিজের?”
রাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে ইরার মিষ্টি কণ্ঠে পৌঁছাতে ব্যার্থ। তিন বছরের সম্পর্কে আজ রাদ নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ। কেমন মাতাল, মাতাল অদ্ভুত মোহাবিষ্ট সব অনুভূতি। ওর পুরুষালী, গম্ভীর, শান্ত মন যেন কেমন গলে যাচ্ছে। ওর কী কান্না পাচ্ছে না অন্যকিছু বুঝতে সক্ষম নয় রাদ। শুধু এটুকু স্পষ্ট রাদ ওর ইরনী’কে অসম্ভব ভালোবাসে। রাদ আচমকা অন্যরকম গাঢ় গলায় বলল,
—” ইরা, আই মিস ইউ সো ম্যাচ! ”
ইরা স্মিত হেসে রাদের গ্রীবাদেশ উঁচু কণ্ঠনালীতে চুমু খায়। রাদ চোখ বুজে নেয়। এই মেয়েটা বরাবর ওকে ঘায়েল করতে প্রস্তুত। ছেলে হয়েও ও ইরার মতো হুটহাট কিছু করতে পারে না। ইরা মুখ উঠিয়ে রাদের বন্ধ চক্ষে অনিমেষ চেয়ে বিষণ্ণ হাসে। ম্লান গলায় বলে,
—” অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”
—” উহুম্ম!”
রাদ কথা বাড়াতে পারলো না। অক্ষিপল্লব খুঁলে নিঃশব্দে পুনরায় গাঢ় এক চুমু খেলো ইরার কপালে। ইরার করুণ কণ্ঠে নিজের ইমোশন সংযত করতে অক্ষম রাদ। ও এমন কোনও রিয়েকশনে যেতে চাচ্ছে না, যেন ইরার কষ্ট বেড়ে যায়। কেউ না জানুক রাদ জানে ওর ইরানীও ওকে ছাড়া ভালো ছিলো না। কিন্তু রাদের বক্ষপিঞ্জর ওর সাথে বিদ্রোহ শুরু করলো৷ পরাস্ত রাদ শেষে নিজেকে সামলাতে, তিন বছরের সম্পর্কে এই প্রথম ইরার ঠোঁট দু’টো নিজের দখলে নিয়ে নেয়। রাদের বন্ধ চক্ষুদ্বয় বেয়ে পরে একফোঁটা গরম, তরল জল। রাদের আকস্মিক এহেন কাণ্ডে ইরা তৎক্ষনাৎ লজ্জায় চক্ষুদ্বয় খিঁচে বন্ধ করে ন্যায়। খামচে ধরে রাদের শুভ্র শার্টের কোণা। এক নতুন অদ্ভুত অনুভূতিতে শরীরে যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। মন, মস্তিষ্ক, কোমল দেহখানি যেন ন্যাতিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা ডিলে হয়ে পরে কব্জির বাঁধন। রাদ দু’হাতে আগলে নেয় ওর ইরানীর নরম, কোমল দেহ’টা নিজের বক্ষঃস্থলে। মেতে থাকে প্রেয়সীর মিষ্টি অধরপল্লবে।
গাছের ফাঁকে ফাঁকে রুপালী চাঁদ তার চন্দ্রসুধা মাখিয়ে দেয় প্রেমে মত্ব দুই মানব মানবীর উষ্ণ আর্দ্র দেহেখানায়! যেন আজ চাঁদ মামার এতো আয়জন শুধু মাত্র ওদের জন্য!
চলবে!
[কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন সবাই। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। রিচেক করিনি!]