#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-২১)
#আরশিয়া জান্নাত
চায়ের পানি বসিয়ে অন্তরা পত্রিকা খুলে বসেছে। তখনই দরজায় বেল বাজে, অন্তরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৬:৩৫বাজে। এতো সকালে কে আসতে পারে?
দরজা খুলে অন্তরা রীতিমতো চমকে যায়।
নাহিদ তুড়ি বাজিয়ে বলে, এক্সকিউজ মি ম্যাম আর ইউ দেয়ার?
আপনি এখানে? আপনি দেশে ফিরলেন কবে? আর এখানের ঠিকানাই বা পেলেন কিভাবে?
এতো কথা দরজায় দাঁড়িয়েই বলবা? ভেতরে ঢুকতে দিবা না?
আসুন
সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ না, মা ফজরের নামায পড়ে শুয়ে আছেন।
নাহিদ জুতো জোড়া খুলতে খুলতে বললো, ল্যান্ড করেছি রাত ৩টায়, চিটাগং এয়ারপোর্টে। বিয়ে এটেন্ড করার উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু ফ্লাইট ডিলে হওয়ায় লেট হয়ে গেল। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে চটজলদি ভাত বাড়ো তো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ওয়াশরুম কোনদিকে?
অন্তরা ইশারায় দেখালো, নাহিদ গিয়ে আবার ফিরে বললো, ভাত আছে তো? না থাকলে অন্য কিছু রেডি করো ফাস্ট। আ’ম টু মাচ হাংরি।
অন্তরা বেকুব বনে গেল। নাহিদ তাকে এমনভাবে বলছে লাইক ওদের মাঝে সব স্বাভাবিক। এই যে এতো মাস পর দেখা হলো, কোনো জড়তা নেই! অন্তরা চটজলদি গতরাতের পোলাও রোস্ট আর গরুর মাংস গরম দিলো। যত্ন করে সালাদও কেটে নিলো, তারপর পরিবেশন করতেই নাহিদ গোসল সেরে বের হয়েছে।
টাওয়েলে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে নাহিদ যখন অন্তরাকে ক্রস করলো, অন্তরার হার্টবিট বেড়ে গেল কয়েকগুণ। এই তো সেই মানুষ যাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন দেখেছিল। যার ছবি দেখে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে কত রাত। অথচ একটা দূর্ঘটনা সব তছনছ করে দিয়েছে। সেই থেকে আর চোখের দেখাও দেখেনি মানুষটাকে। না নিজে দেখা দিয়েছে। তবে এখনো কেন হৃদকম্পন হচ্ছে? নাহিদ তো আর তার নেই, সে অন্য কারোর বর। না না এসব ভাবাও পাপ।
অন্তরা তাকে গেস্টের মতোই ট্রিট করবে এখানে অন্য কোনো অনুভূতির জায়গা নেই।
নাহিদ চেয়ারে বসে বললো, কি ব্যাপার ওমন রোবট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? বেড়ে দিবে না?
অন্তরা, প্লেটে সব তুলে দিলো, তারপর পানির গ্লাস এগিয়ে রেখে বললো, আপনি শুরু করুন আমি মাকে ডাকছি।
এখনি ডাকতে হবেনা। উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধহয়।
অন্তরা চুপচাপ বসে রইলো, নাহিদ মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে কিন্তু অন্তরার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেনা। হঠাৎ অন্তরাকে বললো, অন্তরা ঐ যে কালো ব্যাগটা ওটা একটু খুলো তো।
আমি খুলবো?
হু
কেন?
কেন মানে কি? গেস্টদের কেউ এতো প্রশ্ন করে?
নাকি অসময়ে এসেছি বলে দাম নেই?
আচ্ছা মানুষ তো! আমি কি তা বলেছি?
সব মুখে বলতে হবে কেন? ভাবভঙ্গিতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
অন্তরা আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ নিতে গেল। এই লোক আজ পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধানোর মতলবে আছে। ভালোমন্দ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেনাই, আসার পর থেকে একটার পর একটা ফরমায়েশ দিচ্ছে। স্ট্রেইঞ্জ!
অন্তরা ব্যাগ এনে বললো, ধরুন আপনার ব্যাগ।
সেকেন্ড চেইন খুলো
অন্তরা খুলে দেখলো একটা প্যাকেট।
ঐ প্যাকেটটা বের করো। ওটা তোমার গিফট।
অন্তরা প্যাকেটটা না খুলেই বললো, ধন্যবাদ। কিন্তু আমার তো গিফট পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। কি উপলক্ষ্যে দিচ্ছেন?
প্রিয়দর্শিনী উপলক্ষ্যে দিলাম।
প্রিয়দর্শিনী!
হুম। প্রিয় জনকে দর্শন করার সৌভাগ্য মিলেছে বহুমাস পর। সেই আনন্দের উপটৌকন এটা।
অন্তরা প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ক’দিনের ছুটিতে এলেন?
ছুটি নেই, আর্জেন্ট লিভ নিয়ে এসেছি। ২/৩ দিন আছি হয়তো।
এমন জরুরীভাবে এলেন কেন? বাসায় সবাই ঠিক আছে তো?
উমম সবাই ঠিকঠাক। আমিই ঠিক নেই তাই এসেছি।
কি হয়েছে আপনার?
নাহিদ কিছু বললো না, সরাসরি অন্তরার চোখের দিকে তাকালো। সেই তাকানোটা সাধারণ ছিলনা। কত না বলা কথা, অপ্রাপ্তির নির্লিপ্ত আর্তনাদও যেন চোখের কোণ ভরে আসছে। বুক খাঁ খাঁ করা চাহনী।
অন্তরা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে সবকিছু গুছিয়ে রাখলো। গেস্টরুমের দরজা খুলে বললো আপনি ঐ ঘরটায় রেস্ট করুন, সবাই উঠলে খবর দিবো।
নাহিদ ম্লান হেসে বললো, আচ্ছা!
অন্তরা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। বহুকষ্টে সে এতক্ষণ চোখের পানি আটকে রেখেছিল। বাঁধভাঙা অশ্রুতে সিক্ত হয়ে বালিশে মুখ গুজে রইলো। কেন মুখোমুখি হলো? কেন ঘটলো তার অনাকাঙ্খিত আগমন? অন্তরার মন কেন শক্ত হয় না?
শামীমা উঠে গিয়ে নাহিদের রুমে ঢুকলো, নাহিদ সালাম দিয়ে বললো, কেমন আছেন আন্টি? শরীর ভালোতো?
শামীমা মাথা নাড়িয়ে বললো, আছি বাবা ভালো। তোমার কোনো অসুবিধা হয়নিতো?
নাহ কোনো অসুবিধা হয় নি।
অন্তরাকে দেখে কি বুঝলে? ওর মত বদলাবে মনে হয়?
নাহিদ কিছু বললো না। শামীমা তার মাথায় হাত রেখে বললেন, চিন্তা করো না। আল্লাহ যা করবেন অবশ্যই ভালো হবে। ভরসা রাখো।
।
।
তাইয়্যেবার গায়ের রং কালো নয়। শ্যামলা বলা চলে, ওর মতে সেটা ১৯ ২০ তফাৎ। হুমায়ুন আহমেদের মতে এটা মায়াবতী রং। তাইয়্যেবার রুপ আকর্ষণীয় না হলেও সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে অনেক বিশেষত্বই লক্ষ্য করা যায়। তাই হয়তো ওমরের তাকে এতো পছন্দ। আসলে সৃষ্টিকর্তা যার সাথে জোড়া বেঁধে রেখেছেন তার বিশেষত্ব আর কারো চোখে না পড়লেও সঙ্গীর চোখে পড়বেই। এখন সেটা যত ক্ষুদ্র সৌন্দর্য বা বৈশিষ্ট্য হোক না কেন! বাম পাঁজরের মানুষটা যে তারই অংশবিশেষ।
ওমরের ঘুম ভেঙেছে তাইয়্যেবার মুখ দেখে। ওমর চোখ খুলেই দেখেছে তাইয়্যেবা তারদিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির সংঘর্ষ হতেই তাইয়্যেবা অন্যদিকে ফিরলো। ওমর তখন হাত বাড়িয়ে তাইয়্যেবাকে স্পর্শ করলো, তাইয়্যেবা ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু ভঙিতে ভ্রু নাচালো।
ওমর অপর হাত মেলে বললো, বাহুতে মাথা রাখো।
বেলা কত হয়েছে খবর আছে? মা কে চা দিতে হবে। আমি যাই,,
ওমর সংকোচে দু’হাত গুটিয়ে ফেলল। তাইয়্যেবা কি তবে এখনো রেগে আছে?
তাইয়্যেবা গোসল করে এসে, শাড়ির ভাজ ঠিক করলো,সুন্দর করে চুল মুছে হালকা সাজগোজ করে বের হলো। সে যেন খেয়ালই করলো না একজন খুব মন দিয়ে তাকে দেখছে।
ওমর ফ্রেশ হয়ে বের হলো।শামীমাকে বললো, নাহিদের তো আসার কথা ও কি এসে গেছে?
হুম ভোরে এসেছে। এখন ঘুমাচ্ছে।
ওহ
অন্তরা কোথায়?
ওর রুমেই আছে।
ওহ।
তাইয়্যেবা সবার জন্য চা নিয়ে এলো, পরোটা আর মুরগীর মাংস রেখে বললো, মা আমি অন্তরাকে ডেকে আনছি আপনারা শুরু করুন।
শামীমা জানে অন্তরা আসতে চাইবেনা তাও বাঁধা দিলো না।
তাইয়্যেবা অন্তরার দরজা নক করতেই অন্তরা দরজা খুলে দিলো। কেঁদেকেটে মেয়েটা চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তাইয়্যেবা দরজা চাপিয়ে বললো, অন্তরা কি হয়েছে বোন এই অবস্থা কেন?
বৌরাণী,সে এসেছে দেখেছ?
নাহিদ ভাইয়ের কথা বলছো?
হুম। সে কেন এসেছে? আসার দায়বদ্ধতা তো নেই!
এমন করে বলছো কেন ভাই? সে তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে, ভালোবাসার মানুষের কাছে দায়বদ্ধতার অভাব আছে?
আমিতো বলেছি তাকে অন্যত্র বিয়ে করে নিতে, করে নি?
তাইয়্যেবা হেসে বললো, তাই বুঝি এমন কাঁদছিলে? অন্যের হয়ে গেল ভেবে?
আমি কলঙ্কিত বৌরাণী। আমার মতো মেয়ে তার সাথে মানায় না। সে আমার চেয়ে বেটার ডিজার্ব করে।
অন্তরা, মানুষের মন কি আর এসব মানে? পারিবারিকভাবে তোমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সেখানে দুজনের সম্মতি ছিল। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন তো আর আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নাও নি। এতোশত মানুষের ভীড়ে তার তোমাকে আর তোমার তাকেই পছন্দ হয়েছিল। সে তোমার ইনসিডেন্টকে পরোয়া করেনা। তার প্রমাণ তো বহুবার দিয়েছে। এমন সাপোর্টিভ লাইফ পার্টনার পাওয়া সৌভাগ্য বোন। তবে অন্যের অন্যায়ের শাস্তি তাকে কেন দিচ্ছ? সে তো অন্যায় করেনি। বরং তোমার অপেক্ষায় আছে।
উনি আমাকে ভালোবাসেন বলেই ভয় লাগে। আমার মনে হয় ভালোবেসে অন্ধ হয়ে করুণা করছেন। ভুল মানুষকে সঙ্গী করতেও দ্বিধা করছেন না!
ধুরর বোকা মেয়ে কি বলে শুনো! তুমি মোটেও ভুল মানুষ না। আর না সে করুণা করছে। ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখতে চাওয়া বা পাশে থাকা করুণা বোঝায় না। এটা হচ্ছে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সে চাইলেই অন্যত্র বিয়ে করতে পারতো, তোমার সঙ্গ ছেড়ে দিতে পারতো। কিন্তু সে সেসব করেনি। ক্ষণিকের মোহ হলে এমন করা সম্ভব হতো বলো?
অন্তরা চুপ করে রইলো।
তাইয়্যেবা ফের বললো, তুমি যা বলবে তাই হবে। তোমার সিদ্ধান্তে কেউই হস্তক্ষেপ করবেনা। তবুও বলবো সঠিক মানুষকে ফিরিয়ে দিও না। এটা সবসময় পাওয়া যায় না। চলো এখন সবাই একসঙ্গে নাস্তা করবো।
খেতে ইচ্ছে করছে না,,
এসব বললে তো আমি শুনবোনা। আমি এতো কষ্ট করে পরোটা ভেজেছি, না খেয়ে পার পাবেনা। চলো বলছি।
টেবিলের উপর শাড়ীর প্যাকেট দেখে বললো, সে দিলো বুঝি?
অন্তরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। তাইয়্যেবা শাড়িটা হাতে নিয়ে বললো, বাহ! বেশ সুন্দর তো। তোমাকে দারুণ মানাবে।
অন্তরা হাসলো। তাইয়্যেবা মনে মনে বললো, আল্লাহ! মেয়েটার জীবনটা গুছিয়ে দাও। অতীতের কালো অংশটা মুছে দিয়ে শুভ্রতায় ভরিয়ে দাও।
চলবে,,,,,