#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-২০)
#আরশিয়া জান্নাত
আইনের আওতায় এনে অনীল কে শাস্তি দিতে পারবে এই আকাশ কুসুম কল্পনা পারভীনের ভেঙেছে অনেক আগেই। তবুও ভেবেছিল এত বছর পর নিশ্চয়ই দমানো যাবে অনীলকে। কিন্তু নিজের ভাইয়ের লাশ দেখে সেই আশায়ও জল পড়েছে। পারভীনের বহু বছরের জমানো ক্ষোভ সে না তুলে মরবে না। এই জীবনে তার হারানোর আর কিছুই নেই। তাই নিজের হাতেই খু*ন করেছে অনীলকে। অনীল ও সুযোগ বুঝে তাকে গুলি করে,,,,অনীল চাইলেই এই মৃত্যু এড়াতে পারতো সে তো জানতোই পারভীন তার ক্ষতি না করে থামবেনা। সত্যি বলতে সে নিজেই চাইছিল এই পাপীষ্ঠ জীবন থেকে মুক্তি পেতে। আত্মহত্যা করে ক্ষমা পাওয়ার সব দরজা সে বন্ধ হতে দিতে চায় নি। পরম করুণাময় চাইলেই তো তার সব গুনাহ মাফ হবে। কিংবা জাহান্নামের আজাব ভোগ শেষে জান্নাত লাভের আশাও তো আছে ।
অনীলের এই অপমৃত্যুর ঘটনা কয়েকদিন বেশ আলোচনা হয়। নিউজে তার মৃত্যুশোক প্রকাশ হয়। কত এমপি মন্ত্রী ওমরদের স্বান্ত্বনা দিতে আসে। এভাবেই কেটে গেল ৬মাস,,,,
মালপত্র সব একে একে ট্রাকে তোলা হচ্ছে, শামীমা অনীলের শেষ ইচ্ছে অনুসারে ঢাকা শহর থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামে শিফট হচ্ছে। অনীল সেখানে একটা বাড়ি কিনেছিল শামীমার নামে। এই বাড়িটা মূলত অন্তরার ঘটনার পরই সে কেনে। ঢাকায় তাদের যে কয়টা ফ্ল্যাট আছে সব ভাড়ায় দিয়ে তারা চলে যাচ্ছে অচেনা একটা শহরে। ওমর তার মায়ের উপর আর কথা বলেনি। ঢাকা শহরে বেড়ে উঠা ওমরের জন্য এটা কঠিন সিদ্ধান্ত বটে! তবুও মা বোনের সুবিধার্থে সব করতে সে রাজী।
সব মালামাল পাঠানোর পর গাড়িতে উঠতেই শামীমা বললো, একটু দাঁড়া একজন এখনো আসেনি।
সবাই তো বিদায় জানিয়ে গেল আর কে বাকি আছে?
আসল মানুষই তো বাদ পড়ে গেল। তাকে ফেলে যাই কি করে?
ওমর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে, তখনই লাগেজ হাতে তাইয়্যেবা আসে।
শামীমা হেসে বললো, আমার বৌমার কথা ভুলেই গেছিস দেখছি! কি রে মা এতো দেরি হলো যে? তোর না আরো সকালে আসার কথা?
তাইয়্যেবা লাগেজ রেখে বললো, আর বলবেন না আন্টি রাস্তায় যা জ্যাম। দেখি সরোতো আমি আন্টির পাশে বসবো।(ওমরকে বললো)
ওমর আগামাথা কিছুই যেন বুঝলো না। মা তাইয়্যেবাকে পেলো কোথায় আর তাইয়্যেবাই বা যাচ্ছে কেন? বৌমাই বা বললো কেন? তাদের তো বিয়ে হয় নি,,,,
শামীমা ছেলের মুখ দেখে বললো, ওরে এমন হ্যাবলাকান্ত বনেছিস কেন। বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে হতে কতক্ষণ?
তাইয়্যেবা অন্যদিকে ফিরে হাসতে লাগলো। ওমর লজ্জায় আর পেছনে ফিরলো না।
।
।
চট্টগ্রামে আসার পর সবকিছু গোছগাছ করতে করতে প্রায় চারদিন লেগে যায়। তারপর ঘরোয়াভাবেই ওমর আর তাইয়্যেবার বিয়ে পড়ানো হয়।
অন্তরা তাইয়্যেবাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো,ওমরের প্রিয় আকাশী রঙের শাড়িতে তাইয়্যেবাকে মায়াবতীর চেয়ে কম লাগছে না। খোপায় রজনীগন্ধার গাজরা এঁটে অন্তরা বললো–বৌরাণী তোমাকে যা সুন্দর লাগছে না! আমার ভাইয়াতো আজ চোখ ফেরাতে পারবেনা।
তাইয়্যেবা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলল,ধুর কি যে বলো! তোমার ভাইয়ার সৌন্দর্যের সামনে আমি কিছুই না। আমার তো ভয় হয় লোকে যদি বলে বসে এমন রাজপুত্তুরের পাশে অমাবস্যা,,,
ছি বৌরাণী কি বলো এসব? গায়ের রংটাই কি সব? তোমার চেহারা দেখেছ আয়নায়? কত্ত সুন্দর মুখের গড়ন, মায়াভরা চোখ। আর মা তো বলে তুমি হচ্ছো ভাইয়ার মনের একমাত্র রাণী। যে আমার ভাইয়ের চোখে বেস্ট সে আসলেই বেস্ট।
তাইয়্যেবা ভেবে পায় না এতো সৌভাগ্য তার হলো কিভাবে? এমন ভালো পরিবার তার হবে সে কি স্বপ্নেও ভেবেছিল? তার ননদ শাশুড়ি তাকে কত ভালোবাসে, আর ওমর তো তার মনের মানুষই। যেদিন সে শুনেছিল ওমরও তাকে পছন্দ করে সে তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে নি। শামীমা তাকে আংটি পড়িয়ে বলেছিল, আমার ছেলেটা নিজের মনের কথা বলতে পারেনা, ওর সবকিছু বুঝে নিতে হয়। তুমি এসে ওকে বোঝার দায়িত্বটা নাও। আমার আর কিছু চাই না।
অবশেষে তাইয়্যেবার জীবনে সুখপাখি ধরা দিলো?
🌿🌿🌿🌿🌿
শামীমা অনীলের ছবির সামনে অশ্রুসিক্ত হয়ে বসে রইলো, অনীল গত হয়েছে ছয় মাস হয়ে গেছে। এই সত্যিটাও যেন সত্যি মনে হয় না। মানুষ মরণশীল এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু এই মৃত্যু তো স্বাভাবিক ছিল না। গত ১বছরে তার পরিবারে একের পর এক তান্ডবে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে এখন পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। অনীলের হাসিমুখখানা আর সরাসরি দেখা হবেনা, এই মানুষটা এখন এই পৃথিবীর কোথাও নেই। মেয়েদের আশ্রয় কেমন অবিরাম বদলাতে থাকে তাই না? বাবার পর অনীলকেই একমাত্র আশ্রয় মনে হতো, সেই অনীল যাওয়ার পর এখন ওমর। এভাবেই কবরে যাবে হয়তো। ছেলেমেয়েদের বিয়েটাও বেচারা দেখে যেতে পারে নি, আল্লাহ! এই মানুষটাকে তুমি মাফ করে দিও,,,
মা, তোমার ছেলে তো বোধহয় আজ আর রুমে যাবেনা। সেই যে ভাবীকে রুমে দিয়ে এসেছি ঐ রুমে আর ভুলেও যায় নি। কি করবো বলোতো?
কি বলিস? ওমর এখনো ঘুমাতে যায়নি? কয়টা বাজে এখন?
১টা বাজতে চলল,,
আমার ছেলেটা আসলেই লাজুক। তুই গিয়ে বল রুমে যেতে, আমি বললে আরো লজ্জা পাবে।
আমি বুঝি না বাপু তোমার ছেলের এতো লজ্জা আসে কোত্থেকে,ঢং!
অন্তরাকে দেখে ওমর বারান্দার রেলিং ধরে বললো, বুঝলি অনু উনার ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে সুপাত্রে দেবেন, আর আমি কি করলাম ছোট বোনকে বাদ রেখে নিজে বিয়ে করে ফেললাম। উনি থাকলে নিশ্চয়ই বিরক্ত হতেন,,,
ভাইয়া তুই বাবাকে মিস করছিস তাই না?
মিস করছি কি না জানিনা। একটা কথা কি জানিস মৃত্যুর পর মানুষের প্রতি ঘৃণা থাকেনা। তাকে আমি আজীবন ঘৃণা করেছি। কিন্তু এ কথা সত্যি তিনি আমাদের ছায়া ছিলেন। হয়তো আমার অবচেতন মন এই বিশেষ দিনে তাকে পাশে পাওয়াটাই আশা করতো। তাই আজ যখন সে নেই শূন্য লাগছে।
আমার তো মনে হয় বাবা বুঝি এখনো ঢাকায় আছেন, গেলেই দেখবো টিভির রিমোট হাতে বাংলা সিনেমা দেখছেন!
হ্যাঁ জসীমের লটারীর পাওয়া মুভিটা! কতবার যে দেখেছে জীবনে,,,
ভাইয়া, ছাড় না এসব। ভাবি সেই কখন থেকে বসে আছে, যা না ভেতরে।
ওমর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ও আমার বহুকাঙ্ক্ষিত মানুষ, কিন্তু পেয়েছি এমন সময় যখন মনটা আসলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
খারাপ সময় অনেক গেছে ভাইয়া। এবার দেখিস সব ভালোই হবে।
ওমর বোনের মাথায় হাত দিয়ে বললো, তোর কথা যেন সত্যি হয়।
ওমর রুমে ঢুকে দেখল তাইয়্যেবা বৌ সাজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওমর নিঃশব্দে দরজা চাপালো। আলমিরা থেকে টিশার্ট নিয়ে রুমেই চেইঞ্জ করলো। খাটের পাশে বসে ঘুমন্ত তাইয়্যেবার দিকে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে। তাইয়্যেবার হাতটা সযত্নে হাতের মাঝে নিয়ে গাল ছুঁইয়ে বললো, ভাগ্যিস তুমি ঘুমাচ্ছ। নয়তো এমন সুন্দর দৃশ্য দেখা হতো না। তোমার জীবনের সব দুঃখ মুছে যাক, আল্লাহ তোমায় অনেক সুখী করুন।
তারপর ওয়াশরুম থেকে উযূ করে এসে শোকরানার নামায পড়লো। তাইয়্যেবা ততক্ষণে উঠে ওর পাশে বসলো।
কি ব্যপার ওঠে গেলে যে?
তাইয়্যেবা আড়মোড়া ভেঙে বললো, ছুপে রুস্তমের মতো রুমে ঢুকলে। ডাকলে না কেন?
তুমি গভীর ঘুমে ছিলে তাই আর ডাকিনি। তাছাড়া রাত তো কম হয়নি।
বসো আমিও উযু করে আসি, একসঙ্গে দু রাকাত নামায পড়বো।
ওমর হাসলো। তাইয়্যেবা আর ওমর একসঙ্গে নামায পড়ে নিলো। ওমর তাইয়্যেবার মুখোমুখখি ফিরে বললো, তাইয়্যেবা তুমি কি জানো তোমাকে আকাশী রঙে কতটা সুন্দর লাগছে? আমি ঠিক জানতাম আমার প্রিয় রঙে তোমাকে অপরূপা লাগবে,,,
তাই বুঝি?
ওমর অপ্রস্তুত গলায় বললো,আমি কি বেশি বলে ফেলেছি?
কম বলার ইচ্ছে?
নাহ,,,
তবে?
ওমর প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ঘুমাবেনা?
কেন ঘুমাবোনা? অবশ্যই ঘুমাবো। না ঘুমানোর মতো কি আছে? এমন তো না আজ আমার স্পেশাল দিন,না আজ ভরা পূর্ণিমা। আমি কেন জেগে থাকব!
তাইয়্যেবা খিটখিট করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো; মনে মনে বলল, আনরোমান্টিক বর ঝুটেছে কপালে। এমন বিশেষ রাতে ঘুম ঘুম করে ফেনা তুলছে! অথচ যখন ঘুমে ছিলাম কত্ত রোমান্টিক ফীল করালো। হাহ!
ওমর নীচে বসেই ভাবতে লাগল, কি এমন বলেছে সে যে তাইয়্যেবা এমন রেগে গেল? সে কি ভুল কিছু বলেছে? হঠাৎ টেবিলে নজর পড়তেই মনে পড়লো গিফট-টাইতো দেয়া হলো না,,,,
চলবে,,,