#কাজল_চোখের_মেয়ে
#নুসাইবা_ইভানা
পর্ব-৫
সানার চোখ থেকে টুপ টুপ করে অশ্রু ঝড়তে লাগলো। দু’হাতে বেড শিট আকরে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। মাথা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে কিছুই যেন নেই মাথায়।গাড়ী নিয়ে পুলিশ স্টেশনে আসে সানা। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,আমি মিসিং ডায়েরি করতে চাই।
– আরেহহহ সুনেহরা ম্যাম যে!বসুন।
– অফিসার প্লিজ কিছু করুন আমার হ্যাসবেন্ডকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
– রিলাক্স ম্যাম উনি কোন বাচ্চা নন। কখনো থেকে খুঁজে পাচ্ছেননা?
– সাত ঘন্টার বেশি হবে। আমরা দূ’জন একসাথে এসেছিলাম।
– আপনি বাসায় চলে যান স্যার ঠিক চলে আসবে।
– চলে আসবে মানে কি? আপনাদের কোন রেসপন্সিবিলিটি নেই! কোন সমস্যা না হলে কি আমি আপনাদের কাছে এসেছিে!ফোনটাও সুইচ অফ। ড্রাইভার নেয়নি, বডিগার্ড নেইনি। এভাবে কখনো ও বের হয় না। নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে।
– ম্যাম চব্বিশ ঘণ্টার আগে মিসিং ডায়েরি নেয়া হয় না।তবুও আপনার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
– চেষ্টা করছি কি! দ্রুত ব্যাবস্থা নিন। আপনার কথা মতো চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে করতে বড় কোন বিপদ হয়ে যাক?
– ম্যাম বললাম তো দেখছি!
______________________________________________
বৈশাখের শেষ দিকে ভেজা বেঞ্চ আর ভেজা কৃষ্ণচুড়া। হাতে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপের ভেতরে একটা কালো গোলাপ। রাত তখন সবেএগারো’টা পার্কে কোন মানুষ নেই বললেই চলে, মাথা নিচু করে বসে আছে রাজ। কিছু সময় পর মনে হলো তার পাশে কেউ বসেছে।রাজ জানে কে হতে পারে, নিশব্দে ফুলগুলে মাঝখানে রেখে দিয়ে বলে,শেষবারের মত বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
পাশের মেয়েটা বলল,কি বলবে, তাড়াতাড়ি বলো, আমার বেবি রেখে এসেছি।
– কিছু বলার নেই।
– তাহলে তামাশা করতে আমাকে ডেকে এনেছো? এই মধ্য রাতে?
– কুল জান, এতো হাইপার কেন হচ্ছ জান্স। কথাগুলো বলে নিজেই হেসে বলে,তুমি আমার স্বভাব বারবার নষ্ট করে দাও! এই এতো বছর পরেও এক বাচ্চার মা’কে জান বলছি।
– হেয়ালি না করে কি বলবে বলো!
– তুমি বাসায় যাও রোজি, আমি একজনকে তোমার সাথে দেখা করাতে নিয়ে আসছি।
– ভুলেও এই কাজ করবে না। আমি কারো সাথে দেখা করতে পারবো না। আমার হ্যাসবেন্ড ফেরার সময় হয়েছে। আমি চললাম। ভালো থেকো নিজের মত নিজেকে ঘুছিয়ে নাও।
রোজি সামনের দিকে পা বাড়াতেই রাজ, রোজ বলে ডেকে উঠে।
এতো বছর পর সেই পরিচিত ডাক শুনে রোজির পা থমকে যায়। নিজকে সামলানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের কোনের জাল টুকু মুছে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে, কি বলতে চাও?
রাজ ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তোমার জন্য এনেছিলাম, তোমার তো হলুদ গোলাপ পছন্দ?
– রোজি ফুলগুলো নিলোনা উল্টো রাজের উদ্দেশ্যে বলল, পছন্দ সব সময় এক থাকে না। এখন আমার লাল গোলাপ পছন্দ।
রাজ রোজির দিকে না তাকিয়ে বলে,তোমাকে পেয়ে গেলে জীবনে আর কোন কিছুর আফসোস থাকতো না।এই দীর্ঘ মেয়াদি অভিনয় করতে হতো না। তাই হয়তো তোমাকে পেলাম না।
রোজির আর কোন উত্তর দিলো না। পার্কে থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠে বসলো,এখন রোজি কাঁদবে খুব করে কাঁদবে। নিজের চোখ থেকে টুপ, টুপ করে বৃষ্টির মত ঝড়ে যাওয়া অশ্রুগুলোকে আটকাচ্ছে না, বরং ঝড়তে দিচ্ছে। উপসংহারে যদি বিচ্ছেদ-ই থাকবে, তাহলে সূচনা এতো রঙিন হয়েছিল কেন?রোজি হাত দিয়ে নিজের বুকের বা”পাশ জড়িয়ে ধরে বলে,আমি ভালো নেই রাজ একটুও ভালো নেই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তোমাকে হারানো বিরহ। এই নিখুঁত অভিনয়ে সেই ক্ষত কারো দৃষ্টিতে পরছে না।ঠিক হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের মত আমাদের সমাপ্তি হলো।
রাজ কতখান সেখানেই বসে রইলে। হাতের ফুলগুলো নিচে পরে আছে। কি আশ্চর্য যে, মেয়ে সব সময় বলতো লাল গোলাপ সবার পছন্দ-তো তাই আমার হলুদ গোলাপ পছন্দ। আর তুমি আমার লাইফে হলুদ গোলাপ। ঠিক হলুদ গোলাপের মত স্পেশাল এক্সপেন্সিভ।
রাজ বের হলো নিজেকে একদম পাল্টে নিয়ে পকেটে থেকে মোবাইল বের করে, অন করতেই সানার কল আসলো।
রাজ নিজেকে সামলে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরতেই, সানার করুন কন্ঠ ভেসে এলো, আমার কারো সাথে দেখা করার ইচ্ছে নেই শুধু তুমি তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে আসো। কোথায় ছিলে? মোবাইল বন্ধ ছিলো কেন? আমার টেনশন হচ্ছিল বুঝতে পারছো?
রাজ শান্ত কন্ঠে বলল, আমি আসছি, এই পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই আছো যে আমার জন্য অপেক্ষায় আছে, তাই তোমাকে উপেক্ষা করবো না। আসছি আমি।
রাজ গাড়ী নিয়ে বের হয়নি একদম নিজেকে আড়াল করে বের হয়েছিল, কালো হুডি আর মাস্ক দিয়ে নিজেকে আড়াল করে। বের হয়ে একটা রিক্সা নেয়।
মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত,ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়লেও ভালোবাসা ছাড়া যায় না। সবই যে বলে,জীবনে,মানুষ আসবে যাবে কেউ থাকবে না এসব ব্যাপার না। শতজন আসলেও সেই একজনের শূন্যতা পূরণ করতে ব্যার্থ! সে না থেকেও আমাদের সাথে থেকে যায়।
আমাদের, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব একটা মানুষ থাকে।যাকে ভেবে হাসা যায়,আবার চট করেই মন খারাপ করা যায়। সে জীবনে না থাকলেও বিষন্ন বিকেলে তার কথা ভেবে মনটাকে সান্ত্বনা দেয়া যায়। সে ভাগ্যে না থাকলেও আমাদের জীবনে থাকে। কঠিন ভাবে আমার সাথে জড়িয়ে থাকে। তার অস্তিত্ব শুধু অনুভব করা যায়। প্রকাশ করা যায় না। তবে সে থাকে আমাদের প্রতিটি মন খারাপ অথবা হুট করেই ঠোঁটের কোনে হাসিতে লেপ্টে থাকে। তার শুন্যতা কখনো পূরণ হয় না।
সানা কেঁদে, কেটে এক করে ফেলেছে, রাজের বাবা সোহেল সিকদার,দিশা বেগম রুশা সবাই সানাকে এতোক্ষণ সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। এরমধ্যেই রাজ বাসায় ঢুকেই দেখে সব এক জটলা।
রাজকে দেখেই সোহেল সিকদার বলে,কোন কমন সেন্স নেই কোথায় ছিলে?
রাজ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, মাহার কেসটা ক্লোজ করতে।এরজন্য এমন অবস্থা করতে হবে!
সানা উঠে কোন কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো।
রাজ পিছু পিছু রুমে আসলো, ততক্ষণে ধরনি জুড়ে মুষল ধারার বৃষ্টি পরছে। সানা খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির ফোটার সাথে তার অশ্রুগুলোও ঝড়ে পরছে।
রাজ সানার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরালো, সানার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,আমি ফিরেছি তো! কাঁতছো কেন?
সানা রাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,বারবার মনে হচ্ছিল তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।
– উঁহু আর আমার জীবন থেকে কিছু হারাবার নয়৷ একদম কাঁদবে না।
– আমি জানি তুমি কেস ক্লোজ করতে যাওনি। তাহলে সত্যি করে বলো কেথায় ছিলে?
-আলতো করে সানার কপালে চুমু দিয়ে বলে, কিছু সত্য না জানাই ভালো। যে সত্য তোমার হৃদয়ে ক্ষত তৈরি করবে, থাকনা তা অজানা। বিশ্বাস রাখো আমি অনৈতিক কিছু করিনি।
– সানা আর ঘাটলো না। জড়িয়ে ধরলো রাজকে। সানা জানে রাজ কখনো রোজিকে ভুলতে পারবেনা। কথাটা জানার পরে রাজের প্রতি তার ভালোবাসা দ্বিগুণ বেরে গেছে।
রাজ সানার থুতনি ধরে মুখটা একটু উঁচু করে বলে,
শোনো, কাজল চোখের মেয়ে
আমার দিবস কাটে, বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে।
এই যে মেয়ে, কাজল চোখ
তোমার বুকে আমায় চেয়ে
তীব্র দাবির মিছিল হোক।
তাকাস কেন?
আঁকাস কেন, বুকের ভেতর আকাশ?
কাজল চোখের মেয়ে
তুই তাকালে থমকে থাকে
আমার বুকের বাঁ পাশ।
(সাদাত হোসাইনের কবিতা)
সানা রাজের পায়ের উপর ভর দিয়ে রাজের অধরে আলতো করে নিজের অধর মিলিয়ে দিলো।
সানা সরে আসতে চাইলে রাজ সানার অধর গভীর ভাবে আঁকড়ে ধরলো।
ভালোবাসাময় হোক সানা আর রাজের জীবন।
সারাক্ষণ লাইট, ক্যামেরা আর মিথ্যে অভিনয়ের আড়ালে সব অভিনেতা, অভিনেত্রীর জীবনেই থাকে কিছু সাদা, কালো অধ্যায়। তবে তাদের চাকচিক্য দেখে আমরা ভাবি তারাই হয়তো সবচেয়ে সুখি মানুষ!
সমাপ্তি