#বেনেবউ
#পর্ব_১৯
#তানজিলা_খাতুন_তানু
– ‘আমি অনেক সাধারণ পরিবারের সন্তান। আমাদের এমনও দিন গেছে, দুইবেলা ঠিকমতো খেতে পাইনি, না খেয়ে থেকেছি। পড়াশোনা করেছি নিজের জেদ ও চেষ্টাতে। পড়াশোনা শেষ করার পর মোটামুটি একটা জব পাই, আর তখনি আমার পরিচয় হয় সুমার সাথে। সুমা বেশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না ওদের। তবুও আমাকে ভালোবেসে নিজের সুখ সবকিছু ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছিল, সেইদিনই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি সফল হবো আর আজকে দেখো আমি সফলতা অর্জন করেছি, কতকগুলো কোম্পানির মালিক আমি। সবটাই হয়েছে শুধুমাত্র সুমার জন্য। সেদিন সুমা আমার হাত ছেড়ে দিলে, আমি ছন্নছাড়া হয়ে যেতাম আমার গোটা জীবন টাই এলোমেলো হয়ে যেত কিন্তু সেটা ওর কারনেই হয়নি আমি কৃতজ্ঞ ওর কাছে।’
নিভ্র আর ইপ্সিতার স্যারের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। একজন পুরুষের সফলতার পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে সেটা হোক মা কিংবা স্ত্রী। তেমনি ওনার সফলতার পেছনে ওনার স্ত্রীর অবদান সবথেকে বেশি।
সুমা হেসে বলল,
– ‘বাচ্চাদের সামনে কি শুরু করেছ বলো তো।’
– ‘কেন বলা যায় না নাকি?’
সুমা মনখারাপ করে বলল,
– ‘জানো তোমাদের স্যার জিবনে সবকিছুই পেয়েছে, আমাকে সবকিছু দিয়েছে। অথচ আমাদের সবকিছু থেকেও নেই, ছেলে বিদেশ পড়ে থাকে তার সময় নেই বুড়ো বাবা মায়ের খবর নেওয়ার।’
কন্ঠে গভীর দীর্ঘশ্বাস। সমস্ত বিলাসিতা থাকা সত্ত্বেও ওনাদের সন্তান ওনাদের কাছে থাকে না এই আক্ষেপটা ওনাদের কে ভালো থাকতে দেয়নি। নিভ্র আর ইপ্সিতা অবাক হলো, এতটা হাসির পেছনে যে এতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা বোঝা যায়নি।
– ‘জানো নিভ্র তোমার স্যার তোমার কথা প্রায়ই বলতেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে দেখার, তুমি আমার ছেলের বয়সী হবে তাকে তো আর নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারছি না তাই তোমাকেই নিজের ছেলে হিসাবে আদর যত্ন করলাম।’
সুমার চোখে পানি। জীবনে চলার পথে টাকাই সবকিছু নয়। নয়তো এতটা ধনী হবার পরেও সন্তানকে কাছে না পাওয়ার কষ্টে ওনারা প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে ম*রছেন।
– ‘আজকে দেখে ইপ্সিতা মা আমার মেয়ে আর নিভ্র তোমার ছেলে কেমন! কি তোমাদের কি কোনো আপত্তি আছে?’
ওরা দূজন হতবাক। ওনাদের ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাধ্য ছিল না ওদের তাই রাজি হয়ে যায়। সুমা ইপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরল। এতদিন ছেলেকে কাছে না পাওয়ার কষ্টটা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।
নিভ্র আর ইপ্সিতার ওনাদের সাথে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। মনটা দুজনেরই ফুরফুরে।
– ‘আঙ্কেল আন্টি খুবই ভালো মানুষ বলুন।’
– ‘হুমম। ম্যামের সাথে আমার আগে পরিচয় ছিল না এই ফার্স্ট।’
– ‘সত্যি পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এতটা সুন্দর।’
– ‘হুমম।’
ইপ্সিতার মা ফোন করে ওকে নীচে যেতে বলে কিছু কারনে। ইপ্সিতা নিভ্রকে বলে নীচে তলায় এসে দেখল ফুপি আসমিনা এসেছে। ওনাকে দেখামাত্রই ইপ্সিতার বিরক্তি এসে ভর করল,
– ‘মা উনি এইখানে কি করছেন?’
– ‘তোকে কিছু বলতে চাই।’
– ‘আমি ওনার কাছে কিছু শুনতে আগ্রহী নয়।’
– ‘ইপ্সিতা মা একবার আমার কথাটা শোন।’
– ‘আচ্ছা বলুন কি বলবেন।’ (বিরক্ত হয়ে)
– ‘জানি আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আমার মনে হয়েছিল তুই আসার পর দাদা ভাবি আমার আর আমার মেয়ের প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে সেই রাগেই তোর সাথে আমি ব্যবহার করিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর তোর ক্ষতি আমি চাইনি।’
– ‘আর কি বলবেন আপনি, ক্ষতি না চাইলেও তো করেছেন। আমার জীবনটাই বরবাদ করে দিয়েছিলেন এরপরেও বলছেন ক্ষতি চাননি।’
– ‘জানি তোর অনেক রাগ জমা হয়ে আছে আমার উপরে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর রিয়া তোর সাথে যেটা করেছে সেটা নিয়ে কিছু বলার সাহস আমার নেই, রিয়া তার অন্যায়ের শা’স্তি পাচ্ছে ওর জেল হয়েছে। তবে পারলে আমাদের মা মেয়েকে মাফ করে দিস, আর কখনো তোদের সামনে দাঁড়াব না। ভালো থাকিস।’
আসমিনা কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ইপ্সিতা বিরক্ত হয়ে বলল,
– ‘মা প্লিজ এইসব কারনে আমাকে ডাকবে না, আমি সত্যি ভালো আছি। নিজের পুরানো অতীত মনে করে কষ্ট পেতে চাই না।’
– ‘মারে তোর আন্টির গলাতে সত্যি অনুশোচনা ছিল, অনেকবার রিকুয়েস্ট করছিল তোকে দেখার জন্য তাই তোকে ডাকলাম।’
ইপ্সিতা ফিরে যায় তবে মনটা বড্ড কু ডাকছে। আসমিনার ওইভাবে কথা বলাটা বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে।
ইপ্সিতা বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করছে, কিছুটা একটা বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। ওকে চিন্তিত দেখে নিভ্র জিজ্ঞেস করল,
– ‘কি হয়েছে?’
– ‘আজকে রিয়ার মা এসেছিল।’
– ‘তারপর?’
– ‘আন্টি অদ্ভুত সব কথা বললেন, আমার মনটা কিরকম একটা খচখচ করছে।’
– ‘চিন্তা করো না সব ঠিক হবে।’
নিভ্র ইপ্সিতাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।
– ‘কি হলো?’
– ‘ঘুমাও।’
ইপ্সিতা নিভ্রের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল আর নিভ্র আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
পরেরদিন সকালে একটা খারাপ সংবাদ আসলো। আসমিনা অর্থাৎ ইপ্সিতার ফুপি আত্ম’হ’ত্যা করেছেন। নিউজটা সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। ইপ্সিতার বাবা বোনের উপরে রেগে থাকলেও তার মৃ’ত্যুটা সহজে মেনে নিতে পারেননি, স্ত’ব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। ইপ্সিতা বাবার কাঁধে হাত রাখার পরেই উনি পাগলের মতো উল্টোপাল্টা কথা বলতে লাগলেন।
– ‘ আসু আমার উপরে অভিমান করে চলে গেছে তাই নারে?’
– ‘বাবা এইরকম বলো না।’
– ‘নারে মা মেয়েটা কালকে এসেছিল আমার কাছে মাফ চাইল কিন্তু আমি মাফ করিনি। নিশ্চয় অনেক অভিমান হয়েছিল তাই তো আমাকে ছেড়ে এইভাবে চলে গেল। আসুরে এইটা তুই কি করলি।’
ইপ্সিতার বাবা ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। ছোট থেকে বোনটাকে আদর যত্নে বড়ো করে তুলেছিলেন আজকে সেই বোনকেই অভিমান করে চলে যেতে দেখে বুকটা কষ্টে ফেঁটে যাচ্ছে। ইপ্সিতা বাবাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনার দিতে লাগল আর দূরে রাখা আসমিনার লা’শের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
– ‘আত্মহ’ত্যা কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হতে পারেনা সেটা তুমি বূঝলে না আন্টি। এই পৃথিবীতেও সুখ পেলে না আর না ওপারে পাবে, নিজের কাজের শা’স্তি ওই পাড়েও তোমাকে পেতে হবে। তবূও চাইব ভালো থেকো।’
সু’ইসা’ইড কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। সু’ইসা’ইড করলেন তো নিজের জীবনকে নিজের হাতেই শে’ষ করলেন, জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও লড়াই করে যেতে হবে ঠিক যেমনটা ইপ্সিতা করেছে। লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাই তো সুখ জীবনে ধরা দিয়েছে।
রিয়াকে মায়ের মৃ’ত্যুর খবর জানানোর জন্য পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, রিয়াকে ১দিনের জামিন দেওয়া হয়েছে। আসমিনার শরীরটাকে ছি’ন্নভিন্ন করা হয়েছে। কিছু করার নেই এটাই তো নিয়ম। পোস্ট’ম’র্টেম হয়ে যাবার পর আসমিনাকে দা’ফন করা হয়। রিয়া পাগলের মতো প্রলাপ করছিল, বারবার ইপ্সিতাকে দায়ী করছে সবকিছুর জন্য,
– ‘এই তোর কারনেই আমি আমার সবকিছু হারিয়েছি। তোকে আমি ছা’ড়বো না।’
সবাই রিয়াকে সামলে নেই। পুলিশের কাছেও রিয়া বলে,
– ‘স্যার ওই ইপ্সিতা আমার মাকে মে’রে ফেলেছে। ওর জন্যই আমার মা ম’রে গেছে।’ (হাউমাউ করে কেঁদে উঠে)
পুলিশরা এইসমস্ত কথাতে পাত্তা দেয়নি। কারন আসমিনা সুই’সা’ইড নোট লিখে গেছে। আর তাতে লেখা ছিল,, “আমি আসমিনা একজন অপরাধী, যার কোনো ক্ষমা হয় না। নিজের করা অন্যায় গুলো আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল। কোথাও একটুও শান্তি পাচ্ছিলাম না, কিন্তু আমার যে শান্তির ভীষন প্রয়োজন ছিল তাই নিজেকে মু’ক্তি দিয়েই শান্তি দিলাম। সবাই ভালো থেকো।”
যখন রিয়ার কথা কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। তখন রিয়া নিভ্রের কাছে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– ‘নিভ্র দ্যাখো ওই ইপ্সিতার জন্য আমার মা ম’রে গেছে, তুমি ওকে ছেড়ে দাও। ওকে তোমার জীবন থেকে চলে যেতে বলো।’
এমনিতেই সবকিছু নিয়ে নিভ্র ডিপ্রেশড ছিল তার উপরে রিয়ার এইসব আজগুবি কথা শুনে রাগটা কন্ট্রোল করতে পারল না, ঠাস করে রিয়ার গালে থাপ্পর বসিয়ে দেয়। সবাই থমকে যায়, নিভ্রের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকলে।
রিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলল,
– ‘তুমি আমাকে মা’রলে!’
– ‘হ্যাঁ মা’রলাম। আর এটা অনেক আগেই দেওয়া উচিত ছিল তাহলে হয়তো তোমার মাকে এইভাবে প্রা’ন দিতে হতো না।’
– ‘মানে?’
– ‘মানেটা এখনো বুঝবে না। তোমার কারনেই তোমার মা আত্মহ’ত্যা করেছে সেটা কি বুজতে পারছ না।’
– ‘আমার কারনে!’ (এক পা পিছিয়ে গিয়ে)
– ‘হ্যা্ঁ তোমার কারনেই। বাকিটা নিচে ভেবে দ্যাখো বুঝে যাবে।’
নিভ্র চলে যায়। রিয়া ওইখানেই বসে পড়ে নিজের অন্যায়গুলো মনে করতে থাকে। জীবনে প্রথমবারের জন্য অনুভব করে কি ভুলটাই না করেছে জীবনে। প্রতিহি*সা ওর জীবনটাকে ছাড়খাড় করে দিলো।
রিয়া মা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে কিন্তু আফসোস ওর ভুলের কারনেই একজন মানুষ নিজের প্রা*ণ দিয়ে দিলো।
#চলবে