#বেনেবউ
#পর্ব_৯
#তানজিলা_খাতুন_তানু
ইপ্সিতা কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। বারবার সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে কখনো কখনো নিজের পাশে কাউকে একজনকে প্রচন্ড প্রয়োজন হয়, এই মূহুর্তে ইপ্সিতারও কাউকে একজনকে প্রয়োজন কিন্তু কার কাছে গিয়ে নিজের মনের কথাগুলো, কষ্টগুলো খুলে বলবে সেটাই বুঝতে পারল না। নিভ্রের কাছে যাওয়া মানেই নিজের সাথে নিভ্রকে জড়িয়ে নেওয়া আর যেটা ইপ্সিতা পারবে না।
কি মনে করে ফেসবুকটা লগইন করতেই নয়নের মেসেজ আসলো। ইপ্সিতার মনে হলো, এই মানুষটারই তো প্রয়োজন ছিল। তাই অপেক্ষা না করে মেসেজ করল,
– ‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, আপনি কি ফ্রি আছেন?’
কিছুক্ষণ পর মেসেজটা সিন হলো, সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাই আসলো।
– ‘হ্যাঁ বলুন।’
ইপ্সিতা কান্নার ইমোজি সেন্ড করলো, নয়ন ওইটা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কি হয়েছে?’
– ‘রিতেশের সাথে আজকে দেখা হয়েছিল।’
– ‘রিতেশ কে?’
– ‘সেই ছেলেটা যার জন্য আমার এই অবস্থা।’
– ‘কোথায়?’
– ‘বীরভূমে।’
– ‘কিন্তু তো বলেছিলেন আপনি কলকাতায় আছেন?’
– ‘ছিলাম কিন্তু কয়েকদিন আগে ফিরে এসেছি।’
– ‘তাহলে এখন কোথায় আছেন?’
– ‘নিজেদের বাড়িতেই।’
– ‘এখন কি করতে চাইছো?’
– ‘জানি না কিছু জানি না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে।’
– ‘আপনি কেন নিজের জীবনটা এইভাবে থামিয়ে রেখেছেন? চাইলেই তো মুভ অন করতে পারেন!’
– ‘চেয়েছিলাম তো। বাবা মায়ের কথাতে বিয়ে করতেও বসেছিলাম কিন্তু ওনারা সব সত্যি জেনে বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যায়। তারপর বীরভূমে আসার পর এক ছেলের সাথে পরিচয় হয় নিভ্র ছেলেটা খুব ভালো, আমাকে পছন্দও করে কিন্তু আমি তো চাই না নিজের এই জীবনের সাথে তাকে জড়িয়ে নিতে।’
নিভ্র নামটা শুনে নয়ন চমকে উঠল। কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল,
– ‘আপনার আসল নাম কি ইশিতাই?’
– ‘না। ইপ্সিতা চৌধুরী।’
– ‘চিন্তা করবেন না, সবকিছু ভালোই হবে।’
পরেরদিন, রিতেশ পাগলের মতো সবকিছুর প্রমান খুঁজে বের করতে লাগল। ইপ্সিতার এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখে কথাগুলো সব সত্যি। রিতেশের মাঝের কথাগুলো কিছুই মনে পড়ছে না, কি হয়েছিল নিজে কি করেছে কিছুই জানে না।
রিতেশ নিজের সমস্ত বন্ধুদের সাথে দেখা করে, প্রমান জোগাড় করার চেষ্টা করে। একটা বিষয় ওর কাছে একটু অদ্ভুত লাগে, যেসব বন্ধুরা ওর সাথে নেশা করত তারা কিন্তু পুরোপুরিই সুস্থ আছে শুধুমাত্র ও একাই রিহ্যা’বে গিয়েছিল।
১সপ্তাহ পর,
নয়নের চেষ্টায় ইপ্সিতা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনে তো এইরকমই একটি মানুষের ভীষন প্রয়োজন যে ওকে মানসিক সার্পোট দেবে। কিন্তু আদৌও কি ওর কপালে এইরকম কোনো মানুষ আছে?
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে ইপ্সিতার মা দরজা খুলে অপরিচিত মানুষকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘আপনারা কারা?’
– ‘আমি অহনা আহমেদ। ইপ্সিতা কে একটু ডেকে দেবেন।’
– ‘আচ্ছা আপনারা ভেতরে এসে বসুন আমি ওকে ডাকছি।’
ইপ্সিতার মা ইপ্সিতাকে বলল একজন মহিলা ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। ইপ্সিতা বসার ঘরে অহনা আহমেকে দেখে চমকে উঠল।
– ‘আপনি এইখানে?’
– ‘সব বলছি আগে তোমার বাবা আর ফুপিকে একটু ডেকে পাঠাও তো।’
– ‘কিন্তু কেন?’
– ‘সব জানতে পারবে। আমার উপর এইটুকু ভরসা রাখতে পারো।’
ইপ্সিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা আর আন্টিকে ফোন লাগিয়ে আস্তে বলল। ইপ্সিতার আন্টির বাড়ি ওদের বাড়ি থেকে ১ঘন্টার পথ। বাইকে বেশিক্ষণ লাগে না, তাই বাবাকে বলল আসার পথে আন্টিকে নিয়ে চলে আসতে।
১ঘন্টা পর,
অহনা আহমেদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘আপনারা শুধুমাত্র জানেন আমি ইপ্সিতার ম্যাম, যদিও এর বাইরে আমার একটা পরিচয় আছে আর সেটা হলো আমি রিতেশের মা।’
রিতেশ নামটা শুনে সকলে চমকে উঠল। ইপ্সিতার বাবা বলল,
– ‘সেই শয়তানটার মা আপনি। আমাদের বাড়িতে কি করছেন? এখুনি বের হয়ে যান।’
– ‘আপনি একটু শান্ত হন, আমাদের কিছু জানানোর আছে।’
– ‘আমাদের মানে?’ (ইপ্সিত)
– ‘রিতেশ রিতেশ….
রিতেশকে দেখে ইপ্সিতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
– ‘ওই জানোয়ারটা আমার বাড়িতে কি করছে? এখুনি বের হয়ে যান আপনারা।'(ইপ্সিতার মা)
– ‘আঙ্কেল আমার কথাটা শুনুন একটু।’
– ‘কোনো কথা নয়,এখুনি বের হ।’
– ‘যদি বলি ইপ্সিতাকে আমি ধ’র্ষ’ন করিনি।’
গোটা বাড়িতে এই কথাটা গমগম করতে লাগল। সকলেই চমকে উঠে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
– ‘মানে?’ (ইপ্সিতার বাবা)
– ‘মানে যেটা হয়েছে তার কোনোটাই আমার সজ্ঞানে নয়।’
– ‘এই তোমার কথার কিছুই বলতে পারছি না। যা বলার সোজাসুজি বলো।’
– ‘ইপ্সিতার ক্ষতিটা আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি। আমাকে দিয়ে সবটা করানো হয়েছে।’
– ‘মানে? কে করিয়েছে?’
– ‘আসমিনা আহমেদ।’
সকলে আরেকদফা চমকে উঠল। আসমিনা আহমেদ আমতা আমতা করে বললেন,
– ‘এই তুমি কি সব বলছো?’
– ‘লুকিয়ে লাভ নেই, সমস্ত কিছু প্রমান পেয়ে গিয়েছি।’
– ‘কি প্রমান?’ (কাঁপা কাঁপা গলায়)
রিতেশ হেসে বলল,
– ‘ইপ্সিতাকে আমি ভালোবাসি, প্রচন্ড রকমের ভালোবাসি আমি কখনোই নিজের সজ্ঞানে ওর ক্ষ’তি করবো না। তাই উনি আমাকে ড্রা’গসের নে’শা ধরিয়ে এইসব কাজ করাতেন আমাকে তাতিয়ে তুলতেন।’
রিতেশ সমস্ত প্রমান দিতে লাগল। ইপ্সিতার বাবা আসমিনা আহমেদকে একটা থাপ্পর বসিয়ে দেন।
– ‘ছিঃ তুই এতটা নীচ কাছ কিভাবে করতে পারলি?’
আসমিনা আহমেদ মাথা নিচু করে আছেন। এইভাবে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে সেটা উনি আগে বুঝতে পারেননি।
– ‘কি হলো বলবি নাকি? আরো একটা থাপ্পর খাবি?’
– ‘আসলে ইপ্সিতা হবার পর থেকে তুই আমার আর আমার মেয়ের দিকে খেয়াল করিস না। বাবা হারা মেয়েটাকে নিয়ে আমি কিভাবে দিনযাপন করছি সেটা তুই একবারও দেখেছিস।’
– ‘এইসব তুই কি বলছিস? আমি তো প্রতিমাসে তোর বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দিই।’
– ‘কেন মিথ্যা বলছিস?’
– ‘আমি মিথ্যা বলছি না। এই দ্যাখ ব্যাঙ্কের ডিটেলস। আমি প্রতিমাসেই তোর মেয়ের একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিই।’
– ‘কি বলছো তুমি এইসব?’
– ‘হ্যাঁ। রিয়াই তো আমাকে বলল, ওর একাউন্টে পাঠিয়ে দেবার জন্য।’
আসমিনা আহমেদ একপা পিছিয়ে গেলেন। নিজের মেয়েই যে এইভাবে ঠকিয়ে গেছেন সেটাই বুঝতে পারেননি। মেয়ে বলতো টাকা গুলো নিজের উর্পাজন করা,কখনোই সত্যিটা বলেনি।
– ‘দাদা আমাকে মাফ করে দিস, মেয়ের কথা শুনে আমি প্রতিশো’ধের নে’শাতে ডুবে গিয়ে এত বড়ো অন্যায় করতে ফেলেছি। আমি ভাবতাম ইপ্সিতার কারনেই আমাদের এই দশা তাই এই অন্যায় করে ফেলেছি।’
আসমিনা আহমেদ হু হু করে কেঁদে উঠলেন। ইপ্সিতা নিজের চোখের পানি মুছে বলল,
– ‘আন্টি তুমি হয়তো নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছ কিন্তু আমার জীবনের সাথে যেটা হয়ে গেছে, সেটা কি আর ঠিক করতে পারব কোনদিন! আমি তোমাকে কখনোই মাফ করবো না, কখনোই না।’
ইপ্সিতা নিজের ঘরে চলে যায়। অহনা আহমেদ ইপ্সিতার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘দাদা নিজের ইচ্ছাতেই হোক আর অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক অন্যায়টা আমার ছেলের হাতেই হয়েছে তাই আমি চাই রিতেশের সাথে ইপ্সিতার বিয়ে দিতে। আমার ছেলেটা আপনার মেয়েকে বড্ড ভালোবাসে আর আমারও ইপ্সিতাকে বেশ পছন্দ।’
– ‘আমি বিষয়টা ভেবে জানাচ্ছি।’
– ‘ঠিক আছে তাহলে আজকে উঠছি।’
রিতেশ আর ওর মা চলে যেতেই ইপ্সিতার বাবা বললেন,
– ‘আজকের পর থেকে তোর সাথে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই। আর হ্যাঁ প্রতিমাসে টাকাটা ঠিক পেয়ে যাবি আর আগে তুলনাই একটু বেশিই দেবো।’
#চলবে….